ছায়া মানব ২
২.
‘একটু আগেই আমাকে রাক্ষস বলেছিলে তাই না? এটা কি ঠিক?’
অহনা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। পরক্ষণেই দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে লাগল। ছোট্ট মাথায় বুদ্ধি আসছে না। কি বলবে এখন? স্যার কি নালিশ করবে এটা নিয়ে? কিছু একটা ভেবে পেয়েছে এমন ভঙ্গি করেই বলল,’আইডিয়া পেয়ে গেছি!’
‘ কিসের আইডিয়া?’ বর্ষণের কঠোর উক্তি।
‘ আমি মূলত আপনাকে কিছু বলিনি। আমার কি এতো সাহস আছে যে আপনাকে নিয়ে কিছু বলব? আমিতো আশ্রাফ স্যারকে বলেছি। ওনি পুরো রাক্ষসের মতো। খুব বকে আমাকে।’
ব্রুজোড়া কুঁচকে আসে বর্ষণের। মেয়েটার সাহস দেখে তার কপাল আকাশে ওঠে যাওয়ার উপক্রম। কিছুটা শান্ত হয়ে বলল,’তোমার সাহসের তারিফ করতে হয়। একজন শিক্ষকের কাছে অন্য শিক্ষকের নিন্দা করছ। তাও আবার একদম প্রকাশ্যে। এটা যদি আমি আশ্রাফ স্যারকে বলি তাহলে কি হবে জানো?’
‘ না, একদম বলবেন না। আমি কাউকে কিছু বলিনি। বাড়ি যাব। মা অপেক্ষা করছে। আজকে বিরিয়ানি রান্না করেছে, না গেলে সব খেয়ে নেবে কুকুরে।’
বলেই অহনা দৌড়ে চলে গেল। গেইট পার হতেই থেমে যায়। ক্লাসেই সব জিনিসপত্র রেখে চলে এসেছে। সেগুলো আনতে যেতে হবে। সবটা ভেবে পেছনে তাকাতেই দেখল শিক্ষক এখনো তার আগের অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কিছু ভাবছে সে। অহনা অন্যপাশ দিয়ে চলে গেল।
কলেজ থেকে বের হতেই তমার সাথে দেখা। ক্লাস করবেনা বলে চলে এসেছে। দু’জন মিলে ধর্মসাগর পাড় ঘুরতে যাবে বলে ঠিক।
সেখানে যেতেই অহনা কিছুটা কপাল কুঁচকে বলল,’এটাকে সাগর নাম দিয়েছে কে? ধর্মপুকুর পাড় নাম হলে ভালো মানাতো।’
তমা মৃদু বাতাসে হাত দুটো ছড়িয়ে দিয়ে বলল,’সে যাই হোক। আমার কিন্তু ভালোই লাগে। এখানকার বাতাস খুবই মিষ্টি। পরিবেশটাও ঝকঝকে। যেকারো মন ভালো করতে এটাই উত্তম জায়গা।’
বলার সাথে সাথেই তমার কোমরে কেউ স্পর্শ করল। সে ঠিক বুঝতে পেরেছে কেউ ইচ্ছে করেই এমনটা করেছে। সাথে সাথেই চোখ-মুখ খিঁচে পেছনে তাকায়। ছেলেটা চলে যেতে চাইলেই তমা তার গালে থা’প্পর বসিয়ে দেয়,
‘তোর সাহস কি করে হলো আমার গায়ে হাত দেওয়ার?’
কলার চেপে ধরে মুহুর্তেই,’বাড়িতে কি মা-বোন নেই।’
অহনা আকস্মিক ঘটনায় আঁতকে ওঠে। কিছু লোকও এগিয়ে এসেছে। অহনা তমার হাত ধরে তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কয়েকজন লোক ছেলেটাকে সরিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। কিন্তু ছেলেটা অস্বীকার করছে। সে একদম তমার গায়ে হাত দেয়নি। তমা আরো রেগে যায়,
‘তোকে পুলিশে দেব জা* ছেলে। জুতার বারি দেওয়া দরকার তোকে।’
কয়েকজন লোক ছেলেটার মুখে ঘু’ষি দিয়েও বসল। তমার রাগ যেন ফেটে পড়ছে। কিছুতেই শান্ত হবার নয়। এমন সময় বর্ষণের গাড়ি এসে থামে। দেয়ালের অপরপাশের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল। অহনাকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থামায়। নেমে আসে দ্রুত। অহনা তমাকে কিছুতেই সরাতে পারছে না। সুযোগ পেলে যেন ছেলেটাকে চিবিয়ে খাবে, এমন অবস্থা। রাগে চোখ দুটো থেকে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। বর্ষণ ঘটনার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে অহনাকে বলল,’এদিকে আসো তোমরা।’
তমাকে সামলাতে অহনা মেনে নিল বর্ষণের কথা। দ্রুত তাকে কোলাহল থেকে নিয়ে গাড়িতে তুলল।
তমা কিছুটা শান্ত হতেই বর্ষণ জিজ্ঞেস করল,’তোমার বাড়ি কোথায়?’
তমার বদলে অহনার বলে দিল,’দক্ষিণ সাত্তা!’
তমাকে বাড়িতে নামিয়ে দিতেই অহনাও নেমে পড়ে। কিন্তু বর্ষণ বলল,’তুমি নেমে পড়লে কেন? এটাতো তোমার বাড়ি নয়।’
‘ আমি ম্যাচে থাকি।’
কথাটা শুনে বর্ষণের কিছুটা করুণা হয়। কেননা আজকালকার ম্যাচের করুণ অবস্থা সম্পর্কে সে অবগত। বলল,’গাড়িতে ওঠো।’
‘ না, আমি আপনার সাথে যাব না।’
‘ আমি একা একটা মেয়েকে মাঝরাস্তায় ফেলে যেতে পারি না। আমি তোমাকে তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দেব। ওঠে এসো।’
অহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে অন্যদিকে হাঁটা ধরল। বর্ষণ তাকে কঠোর গলায় আদেশ করল,’এসো বলছি। একজন শিক্ষক হিসেবে অন্তত সম্মান করো।’
ধমক খেয়ে অহনা সুড়সুড় করে গাড়িতে গিয়ে বসল। অনেকক্ষণ পিনপতন নীরবতা। বর্ষণ নিজে থেকে বলল,’বাড়িতে কে কে আছে?’
‘ বাবা-মা আর আমি।’
‘ বাড়ি কোথায়?’
‘ইলাশপুর!’
‘তারা তোমাকে একা একা এত দূর পাঠিয়ে দিল?’
‘ তারা আমাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায়। তাই পাঠালো। আমি কিন্তু ছোট থেকেই শহরের আবহাওয়ায় বড়ো হয়েছি। এতোদিন মামার বাসায় ছিলাম। এখন কিছু সমস্যার কারণে ম্যাচে থাকি। মাঝে মাঝে মা-বাবা দেখতে আসে।’
‘ তোমার বাবা কি করেন?’
অহনা রেগে যায়,
‘ গাড়ি থামান।’
‘ কেন?’
‘ এতো প্রশ্ন করেন কেন? শিক্ষক কি আমার ব্যক্তিগত বিষয়গুলোও জানতে পারে? আমি বলব না আর কিছু। হুহ!’
গাড়ি থামাতেই অহনা নেমে পড়ে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাঁটা ধরে। মনে মনে কয়বার বকাও দিল বর্ষণকে। মেয়েটার অদ্ভুত আচরণ দেখে বর্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
গলির মোড়ে পৌঁছতেই অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। মাথাটাও ঝিম মেরে ওঠল। ধ্যান-জ্ঞান হারিয়ে হাঁটছিল। এমন সময় তার মনে হলো পেছনে কেউ আছে। কিন্তু ফিরতেই কিছুই দেখল না। পরপর তিনবার একই ঘটনা ঘটল। অথচ কেউ নেই। রেগে যায় খুব,
‘কে পেছনে? সাহস থাকলে সামনে আয়। সাহসী হলে সামনাসামনি হ।’
সাথে সাথেই বেরিয়ে এলো রাবি। অহনা তাকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলল,’কিরে, আমার পিছু নিয়েছিলি কেন?’
‘ আগে বল, তুই বর্ষণ স্যারের গাড়িতে ওঠেছিলি কেন?আমি তোকে তার গাড়ি থেকে নামতে দেখেছি।’
‘ তাতে তোর সমস্যা কি?’
‘ আমি দেখেছি স্যার তোর দিকে কেমন করে তাকাচ্ছিল। মনে হয় প্রেমে পড়েছে।’
‘ গাধার মতো কথা বলছিস কেন? আমি কি জানি না কেন এটা বলছিস? কার লেটার নিয়ে আসলি আজকে আবার?’
রাবি গদোগদো হয়ে বলল,’বেশি না, মাত্র তিনটা।’
‘ যা ভেবেছিলাম। তাদের বলে দিস। আমার সামনে আসতে। সাহস ছাড়া প্রেম করার অধিকার নেই কারো। সাহস করে আমায় কথাটা বলতে বলিস।’
‘ তুই একটু বলে দে, কেমন ছেলে তোর পছন্দ। আমি তেমন ছেলেকেই তোর সমানে আনব। এভাবে সবাইকে ছ্যাকা দিলে এই শহর ছ্যাকাখোরে ভরে যাবে।’
অহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’বাবা বলেছে ভালো রেজাল্ট করতে। এসবের পেছনে কখনোই সময় দিতে পারব না।’
রাবি চারিদিকটায় নজর বুলিয়ে বলল,’তোর কপালে কী আছে কে জানে! একসময় দেখবি প্রেম করার মতো ছেলে দেশে নেই।’
‘দরকার হলে চিরকুমারী হয়ে থাকব। এখন বিদায় হ। আমি গেলাম।’
অহনা পা বাড়াতেই রাবি তাকে থামিয়ে দেয়,
কাল সবাই ঘুরতে যাবে, তুই যাবি?’
‘ কোথায়?’
‘ আর্মি ক্যাম্পের কাছে। সেখানেতো শীতকালীন ট্রেইনিং চলছে। শুনলাম সেনাপ্রধান জেনারেল কে এম ফাত্তাহ আসবেন। ওনাকে দেখার খুব সখ আমার। তাই সবাইকে ম্যানেজ করলাম যেতে। যদি তুইও যেতি তাহলে ভালো হতো।’
‘ সেখানে কি আরো চার-পাঁচজনকে আমার সামনে এনে দাঁড় করাবি?’
‘ আমি সিরিয়াস। দোষটা তোর। তুই এতো সুন্দর যে সবার নজরে পড়িস। এতে আমাদের কারো কোনো দোষ নেই’
‘যারা আমাকে সুন্দর বলে আলাদা করে। মূলত তাদের চোখ বলতে কিছু নেই। না হয় সৃষ্টির প্রতিটা জিনিসকেই সুন্দর মনে করত। যাক গে, ট্যুর বলতেই আমার ভালো লাগে। সো, কোনো কথা নেই, আমি যাচ্ছি।’
রাবির থেকে বিদায় নিয়ে ম্যাচে গিয়ে ওঠে। সেখানে তিনজন থাকে একটা রুমে। অর্পি, ছোঁয়া এবং অহনা। অর্পি এবং ছোঁয়া অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। এ হিসেবে অহনার থেকে অনেকটাই বড়ো। ছোট হওয়ায় মেয়েগুলোর ক্রোধে পড়ে বারবার। আজকের আদেশ, ওদেরকে রেস্টুরেন্ট থেকে বিরিয়ানি এনে খাওয়াতে হবে। এদিকে মাসের শেষ প্রায়, অহনার কাছে টাকা অবশিষ্ট নেই। জুতা কিনে বারতি অনেকটা টাকা নষ্ট করেছে। সবশেষে রইল মাত্র পঞ্চাশ টাকা। অর্পিকে বলল,’এখন টাকা নেই। পরে কোনোদিন খাওয়াবো আপু।’
‘ সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। এখানে থাকতে হলে আমাদের কথা মনে চলতে হবে। আমরা চাইলেই এখন তোমাকে বের করে দিতে পারি। কোথায় যাবে এই অবেলায়?’
‘ না, আমি যাচ্ছি।’
বলেতো দিল। কিন্তু কী করে জোগাড় করবে টাকা? তার ওপর কাল সবাই ঘুরতে যাবে।তার জন্যও কিছু টাকা দরকার। হঠাৎ করেই কলটা বেজে ওঠল। অহনা দ্রুত কল ধরতেই ওপাশ থেকে শব্দ এলো,
‘ কেমন আছিস মা? কোনো সমস্যা হচ্ছে নাতো থাকতে?’
‘ একদম না। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?’
‘এইতো আলহামদুলিল্লাহ। শোন, তোর বিকাশে কিছু টাকা পাঠালাম। এই কয়দিন হয়ত কষ্ট হয়েছে তোর। এবার টাকাটা পাঠাতে একটু দেরী করলাম। সবজি বিক্রি করতে দেরী হয়েছিল তাই।’
অহনার চোখ ছলছল করে ওঠে,’বাবা, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। টাকাটা আমার অনেক দরকার ছিল। আমি যখন চাকরি করব তখন তোমাকে এত কষ্ট করতে দেব না।’
রোস্তম মেয়ের কথায় হাসে। কিছুটা মানসিক প্রশান্তি পায়। অহনা খুশি হয়ে টাকাটা তুলতে দোকানে যায়। সেখানেই হয় বিপত্তি। দোকানে বসে আছে বর্ষণ। লোকটার সাথে বারবার দেখা হওয়াটা মেনে নিতে পারল না অহনা। পুরো দিনটাই যেন তার চেহারা দেখে কাটছে। চলে যেতে চাইলেই বর্ষণ বলল,’আমি দোকানদারের কাস্টমার তাড়িয়ে দিতে পারি না। কি দরকার তোমার?’
‘ ইঁদুরের বি’ষ দরকার, আছে এখানে?’
‘ অবশ্যই, থাকবে না কেন? এখানে সবকিছুই পাওয়া যায়। কিন্তু সব ছেড়ে তুমি ইঁদুরের বি’ষই নিতে চাও কেন?’
‘আপনাকে খাইয়ে মে’রে ফেলব।’
বর্ষণ ব্রু বক্র করে বলল,’আমার সাথে তোমার কোনো বিরোধ নেই। এমন আচরণ করো কেন? মনে হয় জন্মের শ’ত্রুতা আমাদের। আবার এটাও ভুলে যাও, আমি তোমার শিক্ষক।’
‘ কলেজে আপনি আমার শিক্ষক, বাইরে নন। অন্য শিক্ষকরা আপনার মতো কথাও বলেনা। আপনার কথা বলার ভাব, ভঙ্গি সব অন্যরকম। কেমন জানি! একদম রাক্ষসে..!’
থেমে যায় অহনা। বর্ষণ পুরো বাক্য শোনার জন্য যেন অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে, বলল,’কথাটা শেষ করো। তোমার মুখেতো কিছুই আটকায় না।’
এমন সময় দোকানি চলে আসায় তাদের কথা বন্ধ হয়ে যায়। অহনা টাকা তুলে চলে যেতেই বর্ষণ ওকে উদ্দেশ্য করে বলল,’আমি আর কলেজে যাচ্ছি না। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি।’
‘ তো আমি কি করব?’
বলেই অহনা নিজ গন্তব্যে চলল। হঠাৎ তার ভাবনা এলো, এভাবে ওনি চাকরি ছাড়লেন কেন? কী কারণ থাকতে পারে? সেটা আবার ওকে জানিয়ে দিল কেন? অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতেই কারো সাথে ধা’ক্কা খায়। সোজা বলে ওঠল,’কানা নাকি? দেখতে পান না?’
কথাটা বলেই লোকটার মুখের দিকে তাকাল। কেমন ঘোরলাগা চোখ। অহনা অপ্রস্তুত হয়ে যায় তার হৃদয়ের ব্যাকুলতা দেখে।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম