ছায়া মানব ২ ৪২.

0
245

ছায়া মানব ২

৪২.
রোস্তম আর মাহতিমের কথার এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করল,‘তোমরা কি বাড়িতে জানিয়ে এসেছ?’

মাহতিম অহনার দিকে তাকাল। পরপরই বলল,‘না, সবাইতো ঘুমাচ্ছে। আমরা বিরক্ত করতে চাইনি‌ কাউকে।’

সুমার ব্রু কুঁচকে এলো,‘সে কী কথা! এভাবে কাউকে না জানিয়ে আসা উচিত হয়নি তোমাদের।’

অহনা বলল,‘কিছু হবে না। কল করে বলে দেব।’

‘এতে বুঝি রাগ করবে না তারা? কাউকে কিছু না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত। বাড়ির লোককে গণ্য করা উচিত ছিল। এখন যদি কেউ টের পেয়ে যায়! খুঁজে না পেলে কী তুলকালাম কাণ্ড হবে ভেবে দেখেছ?’

মাহতিম সাথে সাথেই বলল,‘আমিও সেটাই ভাবছি। তাই কাউকে বুঝতে না দিয়ে আমরা চুপিচুপি চলে গেলেই ভালো হয়।’

রোস্তম‌‌ও একমত হলো,‘ঠিক বলেছ তুমি।’

অহনার মন খারাপ হয়ে যায়। বলেই বসল,‘তুমি ইচ্ছে করে জানিয়ে আসোনি।’

সুমা তাকে বুঝালো,‘আমরাতো আর কয়েক ঘণ্টা পরেই যাচ্ছি। এই পর্যন্ত কিছুই হবে না। চলে যাওয়াই ভালো হবে।’

‘তাড়িয়ে দিচ্ছ?’

‘কেমন কথা মেয়ের। তাড়িয়ে দেব কেন? আমরা তোর ভালোই চাই। কয়দিন পর যে বাড়ির ব‌উ হবি সে বাড়ির মানুষকে নারাজ করতে চাস?’

অহনা আর মাহতিম একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। একসাথে বলে ওঠল,‘সত্যিই?’

রোস্তম সুমাকে চোখ রাঙালো। ভুল করেই যেন কিছু বলে ফেলল। না বলার কথা ছিল তাদের। পরপরই বলল,‘কিছু না।’

অহনাও আর জানতে চাইল না। হয়ত বুঝে গেছে। খানিক পরেই মাহতিম বলল,‘এবার যাওয়া উচিত, একটা বেজে গেল।’

অহনা বসে আছে, উঠছেই না। সুমা জোর করে উঠিয়ে দিল। কোনোরকমে টেনে নিয়ে গেল দরজার সামনে,‘কিছু সময়ের জন্য শুধু। দিনেই তো দেখা হবে।’

‘অনেকদিন পর দেখলাম। তোমরা আমাকে আনতে চাও না কেন নিজের বাড়িতে?’
প্রশ্নটা করেই অহনা চুপ করে গেল। মাহতিম সন্দিহান চোখে দেখল রোস্তম আর সুমাকে। পরপরই অহনাকে বলল,‘চলো।’

অহনাও আর কথা বাড়ালো না। গাড়িতে উঠে বসল। মন খারাপ করে আছে। গাড়ি চলার গতিতে যতক্ষণ মা-বাবাকে দেখা গেল ততক্ষণ নির্লিপ্ত নয়নে দেখতে থাকল। কিছু সময় যেতেই মাহতিম বলল,‘যা জানলাম, তুমি শহরেই বড়ো হয়েছ। তার কারণ কী? আপাতত তোমার গ্রামের কেউও তোমাকে চেনে না।’

অহনা বলল,‘সে অনেক আগের কথা। বাবা-মা আমাকে নিয়ে ভয় পায় তাই শহরে পাঠিয়েছে। মামা-মামি খুব আদর করত। তাদের কাছেই থেকেছি। অবশ্য বাবা টাকা পাঠিয়ে দিত। নামমাত্র তাদের কাছে থেকেছি, সব খরচ বাবাই দিত। প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই দিত। কিন্তু মামি মারা যাওয়ার পর মামা দ্বিতীয় বিয়ে করে কিছুদিন আগে। তারপর থেকেই আমাকে আর সহ্য হয়নি নতুন মামির। একটা মজার বিষয় হলো, মামি আমাকে হিংসে করত। কারণ সবাই আমাকে খুব সুন্দরী বলতো। অবশ্য যার মন কলুষিত সে আসল সৌন্দর্য কখনোই গায়ের চামড়া দিয়ে বিচার করেনা। মামি কথায় কথায় রাগ দেখাতো আমায়। আমারও সহ্য ক্ষমতা কম ছিল, কথার পিঠে কথা বলায় নালিশ করেছিল। তারপর বাবা ম্যাচে থাকতে দেয়। ছোঁয়া আপুর সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল। সেখান থেকেই একটু ভালো পরিচয়। তাই বাবাও তাদের সাথে আমাকে রাখতে দ্বিধা করেনি। যদিও বড় আপুদের সমস্যা একটাই। তারা শুধু আমার টাকায় খাওয়ার চেষ্টা করত। এইটুকুই সমস্যা হয়েছে। আর না। মোহনা একটু ভুল বুঝেছিল তাদের। এবং আমাকে নিয়ে আ…

মাহতিম গাড়ি থামিয়ে অহনার কথা শুনছিল। হঠাৎ করেই বলল,‘আমি প্রশ্নটা কী করেছিলাম তোমায়?’

অহনা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,‘পৌঁছে গেছি আমরা?’

‘যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর না দিয়ে আমাকেই প্রশ্ন করছ।’

‘কী জিজ্ঞেস করেছিলে?’

‘এটাই যে তোমার গ্রামে কী সমস্যা? তোমাকে কেন সবসময় শহরেই কাটাতে হচ্ছে?’

‘বললাম তো ভয় পায় আমাকে নিয়ে, তাই!’

‘কেন ভয় পায়?’

‘আচ্ছা শুনো, তুমিতো কখনোই আমাকে সুন্দরী বলবে না সেটা জানি। তবুও আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আরও মিষ্টি ছিলাম। সবাই নাকি তাকিয়েই থাকত। সেবারে পাঁচ বছরের একটা মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। আমাদের গ্রামের তরুণ নামের একটা ছেলে। এটা থেকেই বাবা-মা ভয় পেয়ে যায়। আমি তখন দশ বছর বয়সী ছিলাম। যদি আমার দিকেও কারো কুনজর পড়ে বা ক্ষতি করার চেষ্টা করে, তাই মা আমাকে মামার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। আমার সমবয়সী মামাতো বোন আছে। একসাথে খেলে বড়ো হয়েছি। বাবারো চিন্তা দূর হলো।’

‘এতক্ষণে বুঝলাম। তবে এবার থেকে তুমি আমার দায়িত্বে। কোনো ক্ষতি হতে দেব না। আর শোনো, তুমি আমার কাছে ভুবনমোহিনী রূপবতী‌।’

অহনা মাহতিমের কথা গ্রাহ্য করল। যেন কথাটা স্বাভাবিক,
‘আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। এবার বাড়ি চলো।’
_
কথা বলার এক পর্যায়ে নীরবতা চলল মোহনা আর ইমনের মাঝে। একটু পর ইমন বলল,‘সে আপনার ভালোবাসা বুঝেনি। তাই বলে আপনার সুখের পথে বাধা হতে পারে না। আপনি তার কথা ভেবে প্রতিনিয়ত নিজের ক্ষতি করছেন।’

‘ভুলতে পারিনা। প্রথম ভালোবাসা ছিল তো। তার সব স্মৃতি ভুলতে গেলেও যেন কষ্ট হয়। এর থেকে পরিত্রাণ পাব কী করে?’

‘একদম সোজা, খারাপ স্মৃতিগুলো ভুলতে হলে প্রথমে ভালো স্মৃতি তৈরি করতে হবে। ভালো স্মৃতিগুলোই অতীতের কথা ভুলিয়ে দেবে। বর্তমানে যদি আপনি খুশির উৎস খুঁজে পান, আরও উত্তম কিছুর মাধ্যমে তাহলে ভুলতে পারবেন কলুষিত অতীত। আমার কথা বুঝেছেন?’

মোহনা কিছুক্ষণ ভাবল। ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে আছে ইমনের দিকে। ছেলেটা যে এত সুন্দর কথা বলতে পারে তা তার জানা ছিল না। আজ অবাক হচ্ছে। তবে কি ছেলেটার পুরুষত্ব জাগ্রত হচ্ছে? সে কি কথা বলা শিখে গেছে? পরক্ষণেই বলল,‘আপনাকে ভ্যাবলা বলে অপরাধ করেছি। পারলে মাফ করে দেবেন। আপনি তো মস্ত জ্ঞানী।’

‘জ্ঞান প্রকাশ করতে হলে বুঝি জ্ঞানী কথায় বুঝিয়ে দিতে হয়? আপনি অনুভব করলেই পারতেন।’

মোহনা কিছুটা নড়ে বসল। বলল,‘আপনার কথা তো বললেন না। কী হয়েছিল আপনার মায়ের?’

‘জানি না। শুধু জানি ওনি আমাকে একা করে চলে গেছেন। বৃষ্টি ছিল খুব। বৃষ্টিতে মায়ের দেহটা লুটিয়ে পড়ল।’
ইমনের চোখ সজল হয়ে এলো। মোহনা যেন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কিছু পেল না। হাত বাড়িয়েও আবার সরিয়ে নেয়।
‘ভেঙে পড়বেন না। প্রিয়জন কখনো হারায় না। তারা আমাদের মনেই থাকে। একদম কাছ থেকেই আমাদের দেখে। হারিয়ে যাওয়া মানে আরো ভালো করে নজর রাখা। আপনার মাও আপনাকে দূর থেকে দেখছেন। আপনার সফলতা, ভালো-মন্দ সব দেখছেন। আপনি কান্না করলে তিনিও কষ্ট পাবেন। তাই কান্না না করে মনকে শক্ত করুন।’

‘হুম।’

ইমনের গলা নরম হয়ে আসে। নাক টেনে বলল,‘আপনার ঘুমানো উচিত! আমার সাথে বসে সময় নষ্ট করছেন।’

মোহনা এগিয়ে গেল ইমনের দিকে। আচমকা ইমন নড়ে ওঠে। বলে ফেলল,‘কী করছেন?’

মোহনা তার কপালে হাত রাখল তারপর বুকে।
‘জ্বর কমেছে‌। এবার আপনি শান্তিতে ঘুমাতে পারেন।’

‘মনে হয় না‌ ঘুমাতে পারব।’

মোহনা কপাল কুঞ্চিত করে তাকাল ইমনের দিকে।
‘কেন? জ্বরতো নেই। তাহলে ঘুমাতে পারবেন না কেন?’

‘সেটা অজানা থাকুক। আপনি যেতে পারেন।’

‘আমি না জেনে যাচ্ছি না। কেন বললেন এমন কথা?’

‘আপনার না জানাই উত্তম হবে।’

‘তবুও বলুন। আমি কিছু মনে করব না।’

ইমন লজ্জা পাচ্ছে। মুখ ফুটে কিছু বলার মতো ছেলে সে নয়। কিন্তু মেয়েটা খুব জেরা করছে।
‘কী হলো? বলুন। কোনো সমস্যা হয়েছে আবার? ঘুমাতে কেন সমস্যা হবে?’

‘আপনার স্পর্শ পেয়ে।’

‘সেটা ভালো কথা।’
পরপরই চোখ কপালে তুলে বলল,‘কী বললেন? আপনি এখন কী বললেন?’

‘কিছু না। আমার ঘুম পাচ্ছে।’

‘বলুন বলছি। না হয় ঘু’ষি মারব বলে দিলাম।’

‘বলেছি আপনার স্পর্শের কারণে আমার ঘুম হবে না।’
পরপরই ইমন বালিশ দিয়ে নিজের মুখ ঢাকল। মোহনা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার ধূর্ত মস্তিষ্ক হয়ত বুঝে গেছে ছেলেটার মনের খবর।

দুমিনিট কেটে গেল। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একটু একটু করে বালিশ সরালো ইমন। কাউকেই সামনে দেখতে পেল না। বুকে হাত দিয়ে শ্বাস নিল। উঠার জন্য পাশে তাকাতেই ভূত দেখা মতো চমকে ওঠে। মোহনা তার পাশেই বসে ছিল এতক্ষণ। ইমন ভীত,‘কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে, কিছু একটা ভুল বলে ফেলেছি।’

মোহনা অকপটে বলল,‘প্রেম করতে হলে সাহসের দরকার। সাহস না থাকলে প্রেমের নাম মুখেও নেবেন না। যা বলেছেন তা নিজের মনেই রাখুন। খবরদার আর কখনো প্রকাশ করতে আসবেন না। আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে ছেড়ে গেছে বলে দয়া হয়েছে আপনার তাই না? দয়া দেখিয়ে সুযোগ নিতে চেয়েছেন? আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। আমার কারো দয়া লাগবে না। আর বিহানের কথা বাদ‌ই দিলাম। অনেকটা সময় চলে গেছে। এখন যদি সে আমার পায়ে ধরেও পড়ে থাকে তবুও মেনে নেব না। ভুলে গেছি সব। সো, সিমপ্যাথি দেখাতে আসবেন না।’

বলেই মোহনা চশমা ঠিক করে চলে গেল। ইমনের ঘর থেকে বের হতেই দেখল অহনা আর মাহতিম আসছে। দ্রুত সে ইমনের ঘরে ফিরে আসে। এসেই দরজাটা বন্ধ করে দিল। ইমন আঁতকে ওঠল। কিছু বলতে যাবে তখনই মোহনা এসে তার মুখ চেপে ধরল,
‘চুপ করুন‌‌। ভাইয়া দেখলে প্রশ্ন করবে। উত্তর কী দেব? তার চেয়ে বরং চুপ থাকুন। আমি একটু পর চলে যাব‌।’

অহনাকে ঘরের সামনে পৌঁছে দিয়ে মাহতিম যাওয়ার সময় খেয়াল করল ইমনের ঘরে আলো জ্বলছে। আচমকা শব্দ‌‌ও হলো। ইমন নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে‌।

চলবে….

Sathi Islam : সাথী ইসলাম

সাথীর পাঠকমহল (পাঠক+পাঠিকা) – Sathi’s Readership

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here