ছায়া মানব ২
৪৪.
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চৌধুরী বাড়িকে আলিঙ্গন করে আছে হাজারো বাতি। বিভিন্ন রঙের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা। মেহমানরা আসা শুরু করেছে। রোস্তম আর সুমাও এসেছে। অহনা সাধারণ একটা গাউন পরেই নিচে এসেছে। মা-বাবাকে দেখে তার আনন্দের সীমা-পরিসীমা নেই। মাহতিমকে চারপাশে খুঁজল কিন্তু পেল না। অনেকক্ষণ তাকে দেখা যাচ্ছে না। মোহনা কোথা থেকে দৌড়ে এসে অহনাকে বলল,‘নিহা আপুর সাজ হয়েছে কিনা দেখে আসি, চলো।’
অহনাও পা বাড়ায়। সুমা আনিফা এবং মাহিনূরের সাথে গল্পে লেগে পড়ে। রোস্তমও মামুন এবং তার সহচরদের সাথে সাক্ষাৎ করে।
নিহার সাজা এখনো শেষ হয়নি। একটু পর পরই বর্ষণ এসে টহল দিয়ে যাচ্ছে। পার্লার থেকে আসা মহিলারা এতে বিরক্ত হয়ে পড়ল। বর্ষণ পর পর এসেই শুধু জিজ্ঞেস করছে, ‘আপনাদের কিছু লাগবে কী?’
তারা বার বার না করলেও পরবর্তীতে এসে পুনরায় জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে। এভাবেই তার সময় যাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়েই বলল,‘এত সাজতে হবে না। চুন-হলুদের প্রলেপ দেওয়া বন্ধ করো। ওকে এমনিতেও সুন্দর লাগে।’
মোহনা এমন অধৈর্য বর্ষণকে ঠেলে বের করে দেয় ঘর থেকে। দরজা লাগিয়ে অহনাকে নিয়ে ঢুকে। পর পরই নিজে তৈরি হয়ে নেয়। সোনালী রঙের গাউন পরে অহনার সাথেই। যদিও মন খারাপ। এমন একটা দিনের জন্য কেনা ড্রেস গায়ে দিতে পারেনি। সাজলো না মোহনা। চুলগুলোকে ছেড়ে দিয়ে ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক লাগিয়েই বলল, ‘আমি তৈরি।’
নিহা অবাক হয়ে বলল,‘আমি তিন ঘন্টা ধরে বসে আছি। তোমার মতো হালকা সাজে বের হয়ে যেতে পারলেই হতো।’
ইতোমধ্যে নিহাকেও সাজানো শেষ হয়েছে। অহনা আর মোহনা তাকে দুপাশ থেকে ঘুরে দেখছে। মোহনা বলেই বসল,‘আমার ভাই হয়েছেতো কী হয়েছে। দেখো, বিয়েতে কেমন করে নাকানিচোবানি খাওয়াই।’
অহনা রসিকতা করে বলল,‘ভাবছি, ভাইয়া আজকে চোখ ঠিক কোন দিকে রাখবে? আমার মনে হয় না তোমার দিকে ছাড়া, ভিন্ন দিকে রাখতে পারবে।’
নিহা ভীষণ লজ্জা পেল। পর পরই তাকে নিচে নেওয়া হলো। বর্ষণ অপেক্ষা করছিল কখন নিহা নামবে। নিহাকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে তার চক্ষু শীতল হয়ে গেল। অজানা ভালোলাগা আঁকড়ে ধরল। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিহার দিকে। হালকা গোলাপি লেহেঙ্গার সাথে পার্টি মেকআপ। নিচে নেমে আসতেই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল বর্ষণ। অহনা সরে এলো অনেকটা। মাহতিমকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না।
পার্টিতে আসা একটা ছেলে অহনার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা মাত্র খেয়াল করল অহনা। তেমন কোনো পদক্ষেপ না নিয়েই সে ফোন হতে নিয়ে মাহতিমকে কল করল। সবাই মামুন চৌধুরীর ছোট ছেলে মাহতিমকেও খুঁজছে। অথচ পাচ্ছে না। আনিফা বলল,‘একটু পরেই এসে পড়বে। আশেপাশেই আছে হয়ত।’
অহনা বাড়ির বাইরে গেল মাহতিমকে খুঁজতে। তার পেছনে গেল কিছুক্ষণ আগে লক্ষ্য করা ছেলেটা, নাম আরিয়ান। অহনা তাকে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে ওঠল। পাশ কেটে চলে যেতেই পেছন থেকে ডাকল,‘এই যে মিস!’
অহনা থমকে দাঁড়ায়। ছেলেটার অভিসন্ধি ভালো ঠেকছে না তার। বলল,‘বলুন।’
‘অনেকক্ষণ থেকে আপনাকে লক্ষ্য করছি।’
‘সেটা আমি আগেই দেখেছি। কোনো দরকার ছিল কি?’
‘পরিচিত হতে চাইছি। আপনি কি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন?’
‘জ্বী, আমার হাজব্যান্ডের জন্য। এখনো এসে পৌঁছায়নি।’
‘তার মানে আপনি বিবাহিত?’
আরিয়ানের ব্রু কুঁচকে এলো। তার বিশ্বাস হতে চাইল না অহনা বিবাহিত।
অহনা বলল,‘জ্বী! দুটো বাচ্চাও আছে।’
‘ওহ আচ্ছা!’
আরিয়ান চলে যেতে চাইল পাশ কেটে। ফ্লার্ট করতে এসে দুই বাচ্চার মাকে পাবে ভাবতে পারেনি। এরই মাঝে মাহতিম এসে গেল। হাতে তার দুটো শপিং ব্যাগ। আরিয়ান মাহতিমকে দেখে একটু থামল। বলে ওঠল,‘হাই মেমে, কী অবস্থা?’
অহনার পাশাপাশি আরিয়ানকে দেখে বেশ অবাক হলো মাহতিম। দূর থেকে বলল,‘ভালো! কখন এলে? এখানে কী করছ?’
‘একটু আগেই এলাম।’
তারপর মাহতিমের কাছে এগিয়ে গিয়ে কিছুটা ঝুঁকে বলল,‘মেয়েটার সাথে ফ্লার্ট করতে এসেছিলাম। কিন্তু এসে জানলাম সে বিবাহিত এবং দুই বাচ্চা আছে। সত্যি ভাই, আমি ছ্যাঁকা খেয়ে গেলাম।’
মাহতিম অহনার দিকে তাকিয়ে হাসল। পর পরই বলল,‘তার দুই বাচ্চার বাবা আমি।’
আরিয়ান চমকে ওঠে,‘কিই! তুমি বিয়ে করলে কবে?’
মাহতিম অহনার কাছে এগিয়ে গেল। অহনা বলল,‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে? এতবার কল করলাম কিন্তু ধরলে না কেন?’
আরিয়ান হা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাহতিম অহনাকে বলল,‘যার কাছে নিজেকে দুই বাচ্চার মা প্রমাণ করেছ সে আমার বন্ধু। কয়েকদিন আগেই দেশে ফিরেছে। কলেজ ফ্রেন্ড আমরা। আশিশের সাথেই এসেছে।’
আরিয়ান বলল,‘বুঝলাম না। কবে বিয়ে করলে মেমে? বাচ্চাও হলো কীভাবে? তুমিতো বাইরে ছিলে।’
‘ভাবীর সাথে ফ্লার্ট করতে আসলে নিজেই কেস খেয়ে যাবে। ভেতরে চলো।’
ভেতরে গিয়েই মাহতিম মোহনাকে কানে ধরে নিয়ে এলো। একটা ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলল,‘সরি! একটু লেট করে ফেললাম। আমি আগেই গিয়েছিলাম তবে অফিস থেকে কল করেছিল। সব সামলে আসতেই দেরি হলে। আশা করি এই ড্রেসটা পছন্দ হবে।’
মোহনা বেশ খুশি হয়ে যায়। দ্রুত সে পোশাকটা পরতে যায়। মাহতিম সাথে সাথেই অহনার হাত ধরে ওকে নিয়ে গেল ঘরে। হাতে আরেকটা ব্যাগ তুলে দিয়ে বলল,‘কী ভেবেছ, আমি তোমার কথা ভাবব না? তুমি শুধু মোহনার কথাই বললে নিজের কথা কেন নয়?’
অহনা কিছুটা ইতস্তত করেই বলল,‘আমার দরকার ছিল না।’
‘কিন্তু আমার দরকার আছে। আমি চাই তুমি এটা পরেই আমার সামনে আসো।’
অহনা মজা করে বলল,‘অনুষ্ঠানটা ভাই আর নিহা আপুর জন্য। তুমি কি নিজের মনে করছ নাকি আবার?’
‘ভাবতে ক্ষতি কী? কিছুদিন পর আমারও হবে। আমি সত্যিই খুব এক্সাইটেড। ইশশ্, আজকের দিনটা যদি আমাদের হতো?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাহতিম। অহনা বলল,‘এবার তাহলে বাইরে যাও, তোমার দেওয়া উপহারটাই পরব।’
মাহতিম অহনার কপোলদ্বয় স্পর্শ করল,‘তোমার কি কোনো চাওয়া পাওয়া থাকে না আমার কাছে? কখনো মুখ ফুটে চাও না কেন? মাঝে মাঝে দেখি, গিফট না দেওয়ার কারণে ব্রেক আপ হয়। অথচ তুমি কখনোই আমার কাছে কিছু চাও না। আমিও বোকা, নিজ তাগিদে কী নেব বুঝতেই পারি না।’
অহনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,‘বিয়ের পর লাগবে। লবণ, পেঁয়াজ, মরিচ হতে মাংস পর্যন্ত সবকিছুর লিস্টই ধরিয়ে দেব। এখন আপাতত চাওয়ার নেই। বিয়েটা একবার করে নাও। তারপর বুঝবে চাওয়া পাওয়া কতটুকু।’
বাড়ির বাইরেই ছদ্মবেশে কেউ একজন ঘুরছে। হঠাৎ করেই ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই মোহনার চোখ গেল। ছদ্মবেশী লোকটাকে চিনল না সে। পার্টিতে কেউ কেন মুখ ঢেকে আসবে? এমন তো কোনো নিয়ম ছিল না
মোহনা বেশ খানিকটা অবাক হয়েই নিচে নেমে এলো। তার উদ্দেশ্য সেই মুখ ঢাকা লোকটাকে দেখবে। কিন্তু বাইরে এসে কাউকেই দেখতে পেল না। সে ফিরে গেল ভেতরে। হালকা নীল গাউন পরেছে। মোহনাকে দেখেই আরিয়ান এগিয়ে এলো। অথচ মোহনা না দেখার ভান ধরেই চলে গেল। পাত্তা না পেয়ে আরিয়ান পেছন থেকে ডাকল তাকে। মোহনা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। সে জানে ছেলেটার মতলব। আসার পর খেয়াল করেছিল, সে অল্প সময়ে প্রায় অতিথি হয়ে আসা সব মেয়ের সাথেই কথা বলে নিয়েছে।
মোহনা একপাশে ইমনকে দেখতে পেল। সে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল এক দৃষ্টিতে। কাছাকাছি আসতেই চোখ সরিয়ে নেয়। চশমা ঠিক করে বলল,‘আয়োজন পছন্দ হয়েছে?’
মোহনা চারিদিকে তাকায়,‘রেগে যাব না আমি।’
‘আয়োজন পছন্দ হয়েছে কিনা তার উত্তর আপনি রেগে যাবেন না। দুঃখিত! বুঝতে পারিনি।’
‘আপনি কখনোই আমার কথা বুঝেন না। এজন্যই ঝগড়া হয়। এখন আমার সাথে চলুন।’
‘কোথায়?’
‘ভূতের ডিনার করাবো আপনাকে দিয়ে। আমার ভালো লাগছে না সমাগমে। একটু বাইরে যেতে চাই। প্লিজ চলুন।’
ইমন আর না করেনি। মোহনাকে নিয়েই বাইরে যায়। সাথে সাথেই বিহান এসে হাজির। মোহনার কপাল কুঁচকে আসে,
‘তুমি এখানে?’
বিহান মোহনার হাত চেপে ধরে। ইমনের রাগে কপালে ভাঁজ সৃষ্টি হয়। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। বিহান অনুনয় করে বলল,‘তুমি কেন এমন করছ? এতটা রাগ করে থেকো না। কথা দিলাম, এবার আর ভুল করব না। একবার হারিয়ে বুঝেছি আমি। দ্বিতীয়বার হারাবো না।’
‘একবার বিশ্বাস করে ঠকেছি দ্বিতীয়বার করব না। চলে যাও। না হয় চিৎকার করে সবাইকে ডাকব।’
‘না, আমি যাব না। আমি রিস্ক নিয়ে তোমার কাছে এসেছি চলে যাওয়ার জন্য নয়। প্লিজ আবার ফিরে আসো আগের মতো করে।’
মোহনা চারিদিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজল। কিন্তু পেল না। হঠাৎ করেই বলল,‘আমার বয়ফ্রেন্ড হয় গেছে। চাইলেও আর ফিরতে পারব না।’
‘কে তোমার বয়ফ্রেন্ড?’
মোহনা ইমনকে দেখিয়ে বলল,‘এই দেখো। আমার বয়ফ্রেন্ড। তোমার থেকেও সুন্দর, শক্তিশালী, বুদ্ধিমান।’
বিহান পুরোপুরি দেখল ইমনকে। পর পরই বলল,‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। এটা হয়ত তোমার কোনো আত্মীয় হবে।’
মোহনা কোনোরকমে দম নিয়ে ইমনের হাত নিজের সাথে মিশিয়ে নিল,‘কী হলো ইমন! বলছ না কেন, তুমি আমার কে?’
কথাটা বলার সাথে সাথেই মোহনা ফটকের দিকে তাকাল। একটু আগে যে ছদ্মবেশী লোককে দেখেছে সে ভেতরে ঢুকছে। কেমন অদ্ভুত দেখতে। মোহনা দ্রুতই ইমনের হাত ছেড়ে দিয়ে সেদিকে রওনা দিল।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম