ছায়া মানব ২
৫.
সময় অনেকটা গড়িয়েছে। বারোটা ছুঁইছুঁই। আনিফা বেগম খাবার বেড়ে বসে আছে অধীর আগ্রহে। মাহতিম এখনো আসছে না। প্রতিদিনকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা। কলিং বেলের শব্দ শুনে আনিফা তড়িঘড়ি ওঠে দরজার কাছে যান। ক্লান্ত অবস্থায় মাহতিম ঘরে ফিরেছে। আনিফা দরজা বন্ধ করেই বলল,’ফিরেছিস ভালো কথা। তোর বাপ আসলো না কেন? বারোটা কেটে একটা হতে চলল। বাপ-ছেলের আসার নাম গন্ধ নেই। আমাকে জ্বালিয়ে মারছিস।’
মাহতিম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। মায়ের দু কাঁধে হাত রেখে বলল,’আমার মিষ্টি আম্মা, কাজ ছিল আমার। বাবা আর কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসবে। আমাকে পাঠিয়ে দিল।’
‘ এই কাজের জন্যই না কবে বাপ-ছেলের অবসান হয়। কোনদিকে খেয়াল নেই। শুধু কাজ আর কাজ।’
‘ কি করব বলো? আমি যে আর পাঁচটা চাকরিজীবীর মতো নই। তুমি খুব ভালো করেই জানো। আমাদের মতো মানুষের কাছেই এই দেশ ন্যস্ত। কী করে দায়িত্ব অবহেলা করি?’
‘ পৃথিবীতে আর কারো কোনো কাজ নেই, দায়িত্ব নেই। সব তোর আর তোর বাপের জন্য।’
মাহতিম বুঝল অবস্থা হাতের বাইরে। কপালে হাত দিয়ে বলল,’মাথাটা খুব ব্যথা করছে। আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি কেমন? খুব খিদেও পেয়েছে। দ্রুত কিছু খেতে দিও।’
আনিফা কিছুক্ষণের জন্য ভাবনার জগতে ডুব দিল। আনমনে হেসে ওঠে বলল,’কতো বড়ো হয়ে গেছিস। যখন ছোট ছিলি তখন কি বলতি জানিস?’
‘আমিতো ছোট ছিলাম তাই না? জানব কী করে?’
‘ বলতি, আম্মা, মাথাতা ইত্তু ইত্তু তিপে দাওনা গো। এখন আর বলিস না। বড়ো হয়ে গেছিস!’
মাহতিম আনিফাকে জড়িয়ে ধরে,’আমার মিষ্টি আম্মা!’
মাহতিম নিজের ঘরের দিকে রওনা দেয়। আনিফা তার জন্য খাবার তৈরি করে।
মাহতিম নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ পেল। ঠিক কোথা থেকে শব্দটা কানে আসছে বুঝতে পারল না। শোনার চেষ্টা করল কিন্তু পরক্ষণেই শব্দ থেমে যায়। মাহতিম ক্লান্ত তাই নিজের ঘরে চলে যায়। গোসল করে নিচে নেমে আসে। আনিফা খাবার বেড়ে দিতেই মামুন চৌধুরী আসে। বাবা-ছেলে একসাথেই খাবার খায়। খাওয়ার মাঝখানেও তারা কাজ নিয়ে কথা বলে দেখে আনিফা রেগে গেল,
‘সারাদিনতো কাজই করো তোমরা। সব কথা কী বাইরে শেষ করা যায়নি? চার-পাঁচ ঘন্টার জন্য বাড়ি আসলে, তাও কাজের কথা?’
মাহতিম চুপ হয়ে গেল। মামুনও আর কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নিল।
মাঝরাতে আচমকা দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠল অহনা। ঘামছে খুব। ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। শান্ত হওয়ার জন্য পানির গ্লাস হাতে নিতেই সেটা পড়ে যায়। ঝনঝন করে আওয়াজ হতেই অন্যরা জেগে ওঠে। অর্পি ঘুম ঘুম চোখে তাকায়। ছোঁয়া আচমকা ওঠে বসে। অহনাকে কাঁপতে দেখে দ্রুত ওর কাছে আসে,
‘ কি হয়েছে অহনা? কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছ?’
অর্পি ঠোঁট বাঁকা করে বলল,’ধুর এতরাতে এসব কাহিনী করার কোনো মানে হয়?’
বলেই দীর্ঘ হাই তুলল। অর্পি রেগে গিয়ে বলল,’পানি আন।’
না চাইতেও ছোঁয়া পানি এগিয়ে দেয়। অহনা ঢকঢক করে পানি পান করল। অর্পি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,’কি হয়েছিল?’
অহনা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,’ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছি!’
‘ কি দেখেছিলে? বলো আমাকে!’
‘দেখলাম একটা কালো ছায়া আমাকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। খুব বিদঘুটে জায়গা সেটা। খুব ভয় হচ্ছিল। ক্রমশ অন্ধকারে তলিয়ে গেলাম। চিৎকার করলাম, কেউ শুনল না। আমার সাথে আরো একজন ছিল। কেউ একজন আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছিল, পারেনি। তাকেও যেতে হলো অন্ধকারে।’
‘ কে সে?’
‘ জানি না। তার মুখ দেখিনি। তবে…’
‘ তবে কী?’
‘ কিছু না।’
অর্পি আর কিছু জানতে চাইল না। ওকে ধীরে ধীরে ঘুমাতে বলল। পাশে কিছুক্ষণ বসেছিল। খুবই কঠোর প্রকৃতির মেয়ে অর্পি। কিন্তু এই মুহূর্তে সে ভালো সহপাঠী। মোড সুইং হয় মাঝে মাঝেই। বোঝা দায়!
সকাল হতেই মাহতিম তৈরি হয়ে নেয় অহনার সাথে দেখা করার জন্য। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রংঢং করার অভ্যাসটা মেয়েদের থাকলেও ছেলেদের নেই। কিন্তু মাহতিম আজ নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। তার শ্যামলা মুখশ্রী অনেকটাই মায়াময়। দীর্ঘ চোখজোড়া আরো বেশি আকর্ষণীয়। চাপ দাঁড়ির জন্য তাকে হয়ত আরো কিছুটা সুদর্শন লাগে! গতকাল সকালেই চুল ছোট করেছে। এর জন্য মন খারাপ হয়। যদি চুলগুলো আরো কিছুটা বড়ো হতো তাহলে আরো সুন্দর লাগত। মাহতিম নিজেকে দেখছে ঘুরে ফিরে। উচ্চারণ করল,’প্রথম প্রেম বলে কি কিছু আছে? তার অনুভূতি কেমন হয়? আমার সাথে যা ঘটছে তা কি প্রথম প্রেমের অনুভূতি? হবে হয়ত!’
পেছন থেকে কেউ তার কানের কাছে চিৎকার করে ওঠল। মাহতিম চমকে ওঠে। পেছনে তাকাতেই দেখল ছোট বোন মোহনা দাঁড়িয়ে আছে। মোহনা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,’প্রথম প্রেম কী ভাইয়া?’
মাহতিম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বোনের সামনে নাকানিচোবানি খেতে চায়না সে। কোনরকমে বলল,’সেটা আবার কী? মাথায় দেয় নাকি পায়ে পরে?’
‘ সেটাতো তুমি জানো। আমি বলিনি কথাটা। তুমিই একটু আগে প্রথম প্রেমের অনুভূতি নিয়ে কথা বলছিলে। সেই কখন থেকে দেখছি আয়নায় দাঁড়িয়ে ঢং করছ। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো তুমি হাফলেড…’
‘ একদম চুপ!’
মাহতিম মোহনার মুখ চেপে ধরে,
‘ একদম ফালতু কথা বলবি না। আমার কাজ আছে, তাই বের হচ্ছি।’
মোহনাকে ছেড়ে দিতেই সে বলল,’কেমন কাজ শুনি? কাজ করতে গেলে সাজতে হয়?’
‘কই, আমি সাজিনিতো। আমিতো এমনিতেই সুন্দর। তুই বল, তোর ভাই সুন্দর নয়? তাকে কি সাজতে হয়?’
‘ একদম বাদরের মতো। চুন-হলুদ মাখলেও সুন্দর লাগে না।’
বলেই মোহনা ভেঙচি কেটে দৌড়ে চলে গেল। মাহতিম হাসল। তবে দীর্ঘ না করে ঘর থেকে বের হতেই কল এলো। এই মুহুর্তে কল সে আশা করেনি। বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলল,’জয়ন্ত স্যার!’
মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। কলটা ধরতেই ওপাশ থেকে জয়ন্ত কুমার বলল,’আশা করি ভালো আছ। এই মুহুর্তে অফিসে আসো। খুব বড়ো সমস্যা হতে চলেছে। এক্ষুনি সব না থামালে সব শেষ হয়ে যাবে। মিটিং এ জয়েন করো ফাস্ট!’
‘ জ্বী স্যার, আমি দ্রুতই আসছি।’
মাহতিমের আর কোনোদিকে মনোযোগ রইল না। দ্রুত অফিসে চলে গেল।
এদিকে অহনা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। তমা এবং ফারাহও সাথে আছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও দেখল মাহতিম আসছে না। ফারাহ’র বাড়ি থেকে কল আসে। তাই তাকে চলে যেতে হয়। তমা অহনাকে বলল,’অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।’
‘ আর একটু দেখি! ওনি হয়ত কোনো কাজে আঁটকে গেছেন। নিশ্চয় আসবেন।’
‘ এতো সিউর হলে কিভাবে?’
‘ জানি না, মনে হচ্ছে ওনি ওনার কথা রাখবেন।’
‘ এতোটা বিশ্বাস? যাই হোক, আমাকে যেতে হবে। অনেকক্ষণ হয়েছে বের হয়েছি যে।’
অহনা বাধা দিল না তমাকে। চলে গেল তমাও। অহনা একা একা বসে রইল চুপ করে। বার বার মন বলছে মাহতিম আসবে। সে কথা দিয়ে কথা না রাখার মতো ছেলে না। অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে।
মাহতিম যাওয়ার পরেই মিটিং শুরু হয়। জয়ন্তের কথা শোনার জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। ওনি স্বাভাবিক কন্ঠেই বললেন,’কাল দিনের মধ্যে তিনটা শপিং মল থেকে চুরি হয়েছে। কে বা কারা এটা করেছে জানা যায়নি। আজকেও একই ঘটনা ঘটল। এতো এতো পুলিশ প্রোটেকশন থাকতেও চুরির মতো অপরাধ বেড়ে গিয়েছে। এটা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। ব্যক্তির নিজস্ব মালিকানাধীন লকার থেকেও কোটি টাকা চুরি হয়েছে। একজন কর্মচারী হয়ত সেটা দেখে নিয়েছিল তাই তাকে হ’ত্যা করেছে। আমাদের এবার ব্যবস্থা নিতে হবে। যত শিঘ্রই সম্ভব অপরাধীকে শাস্তি দিতে হবে। না হয় দেশের বড়ো বড়ো শপিং মলের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনারা সবাই তৈরিতো?’
উপস্থিত সবাই সমস্বরে বলে ওঠল,’ইয়েস স্যার।’
জয়ন্ত কুমার বলল,’এর জন্য আমাদের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে হবে। দেশের সমস্ত ফোর্সকে কাজে লাগাতে হবে।’
‘ইয়েস স্যার!’
জয়ন্ত সবার উদ্দেশ্যে পুনরায় বলল,’কারো কি এই বিষয়ে কোনো দ্বিমত আছে? বা অন্য কোনো উপায়?’
সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এমন সময় পেছনে বসে থাকা মাহতিম হাত তুলল। জয়ন্ত তাকে আদেশ দিল বলার। মাহতিম বলল,’এতে চোর ধরা পড়বে না। সে আমাদের নাকানিচোবানি খাইয়ে অনায়াসেই সব নিয়ে চলে যাবে।’
জয়ন্ত ব্রু কুঁচকে তাকাল মাহতিমের দিকে। সবাই লুকিয়ে হাসল। বাইরে প্রকাশ করল না। মাহতিম পুনরায় বলল,’পুরো দেশেতো এমনিতেই পুলিশ রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। চোর জানে কোথায় কোথায় পুলিশ থাকবে। যেহেতু প্রথম চুরিগুলো ছিল বড়ো ধরনের। তাই ধারণা করতে পারি তারা কোনো সাধারণ চোর নয়। ট্রেইনিং নেওয়া শেয়ানা চোর তারা। তাদের টার্গেট সবসময় বেশি জিনিসের দিকে। তাই আমাদের উচিত প্রথমে দেশের বড়ো বড়ো শপিং মলগুলো শনাক্ত করা এবং সেখানে লোক পাঠানো।’
মাহতিমের কথাটা পছন্দ হলো সবার। জয়ন্তের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে মাহতিমের থেকে এমনটাই আশা করেছিল। তার উপদেশ সবাই মেনে নেয়।
মাহতিম আবারো যোগ করল,’গত চুরিগুলো আশেপাশেই হয়েছেএবং সিরিয়াল অনুযায়ী। এ থেকে বোঝা যায় তারা ধারাবাহিকভাবে পুরো দেশটাকে লুটে নিতে চায়। ধারনা করছি তাদের পরবর্তী টার্গেট হবে প্রিডম এবং শামস্ এর দিকে। আমরা কাল ঐ দুইটা মলে ব্যবস্থা গ্রহন করব। আশা করছি সফল হব!’
সবাই মেনে নিল মাহতিমের কথা। কেননা এই মুহূর্তে ভালো কোনো যুক্তি অন্য কেউ উপস্থাপন করতে পারেনি।
পরক্ষণেই আশিশ বলে ওঠল,’আমরা সঠিক কোনো তথ্য এখনো জানি না। কিভাবে সিউর হব যে ঐ দুইটাতেই চুরি হবে? হতে পারে তাদের টার্গেট অন্য কোনোটা। এমনটাও হতে পারে, তারা আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য সিরিয়াল মেইনটেইন করেছে। যদি এতে আমাদের কোনো ভুল হয় তাহলে কালকেও অনেক ক্ষতি হবে।’
মাহতিম কিছু বলার আগে জয়ন্ত বলল,’এছাড়া কোনো উপায় নেই। সারাদেশে সর্বক্ষণ পুলিশ নিয়ে বসে থাকলে অন্য জায়গাগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে হুমকির সম্মুখীন হবে। আমার মনে হয় মাহতিমের চিন্তাধারায় কাজ করাটাই উত্তম হবে। আশা করি সবটা ভালোই হবে।’
মাহতিম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বারোটা বেজে গেছে। মনে পড়ল। অহনার সাথে দেখা করার কথা ছিল। তবে কি দেখা হবে না? কি করে হবে? মাহতিমের মনটা খারাপ হয়ে যায়। আজকের মতো সুযোগটা সে হাতছাড়া করে ফেলল।
চলবে….
Sathi Islam : সাথী ইসলাম