#তোকেই_ভালোবাসি
#লেখনীতে_আমেনা_আক্তার_আখি
#পর্বঃ৬
“কেমন আছো?”
মেয়েটা ইয়াশকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে।এদিকে মিথিলা কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে।ইয়াশ মেয়েটিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে স্মিথ হাসার চেষ্টা করে বলে,
“ভালো আছি নীলু।বাকি কথা ভিতরে গিয়ে বলি?!”
কথাটা বলে ইয়াশ ঘরের ভিতর চলে যায়।নীলা ওখানে দাড়িয়ে ইয়াশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে লজ্জামিশ্রিত হাসে।মিথিলা নীলার দৃষ্টি অগোচরে ওকে ভেঙিয়ে ভিতরে চলে যায়।
বেশ কিছুটা সময় ব্রিশাম নেয় সবাই।দুপুরে খাওয়ার ডাক পড়তে সবাই হাত মুখ ধুয়ে খেতে চলে যায়।নিচে পাটি বসিয়ে খেতে দেওয়া হয়েছে সবাইকে।প্রথমে ছেলেদের খেতে দেওয়া হয়েছে।ইয়াশের দুই মামা,ইকবাল হক, মিনহাজ হক, ইয়াশ আর ইয়াশের বড় মামার ছেলে বসেছে।
ইয়াশের দুই মামী সাথে নীলা আর ইয়াশের ছোট মেয়ের ছেলে রায়না খাবার পরিবেশন করছেন।সাথে তিতলি হক আর রুকমা হক টুকিটাকি সাহায্য করছেন।
মিথিলা শুধু নীলা আর ইয়াশের দিকে তাকিয়ে আছে।দুজনে হেসে হেসে কি সুন্দর গল্প করছে।ইয়াশের খাবারের দিকটা শুধু নীলা দেখছে এটা মিথিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে।যদি পারত তো নীলার দু গালে দুটা থাপ্পড় দিয়ে ইয়াশের থেকে সরায় দিত।কিন্তু তাও তো সম্ভব না।তাই মিথিলা ন্যাকামিগুলি দেখে গেল শুধু।
ছেলেদের খাওয়া শেষ হলে মেয়েদের খেতে বসতে বলা হলো।মেয়েদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে যে যার বরাদ্দকৃত রুমে চলে যায়।ইফা,মিহু,মিথিলাকে নীলা আর রায়নার ঘরে আপাতত শুতে দেওয়া হয়েছে।সবাই রুমে এসে একটা ভাতঘুম দিয়ে নিল।
—————————-
শো শো বাতাস বইছে।মিথিলা,মিহু,ইফা তিনজনই শীতে একজায়গায় জুবুথুবু হয়ে দাড়িয়ে আছে।দুপুরে ঘুমানোর পর সবাই বিকালের দিকে ঘুরতে বের হয়েছিল।নীলাদের বাড়ির থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে একটা সুন্দর নদী বয়ে গেছে।সেটা দেখতেই সবাই এসেছিল।নীলা সবাইকে বলেছিল ওখানে বাতাস শীত লাগতে পারে,সবাইকে শীতের পোশাক পড়ে আসতে বলেছিল।কিন্তু তখন কেউ তা আমলে নেয়নি।এখন পস্তাচ্ছে।নীলা আর রায়না ওদের তিনজনের সামনে গিয়ে দাড়ায়।রায়না মুখ টিপে হেসে বলে,,
“কি আপুরা কেমন লাগছে?তোমাদের তো শীতের পোশাক পড়ে আসতে বলেছিল!কিন্তু তোমরা শুনলেই না।এখন ভুমিকম্পের মতো কাঁপা-কাঁপি করো।হি হি!”
রায়নার কথায় নীলা ওকে ধমক দিয়ে বলে,, “চুপ কর রায়না!”
ফের মিথিলাদের দিকে তাকিয়ে বলে,, “ইফা,মিথিলা,মিহু আপু চলো আমরা বাড়ি চলে যাই। তোমাদের এই শীতে থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।আর এমনিতেই একটু পর সন্ধ্যার আযান দিবে!”
মিহু, ইফা নীলার কথায় সায় দিয়ে বলে,, “হ্যাঁ চলো!এমনিতেই অনেক শীত লাগছে।আরেকটু থাকলে বরফ হয়ে যাবো।গ্রামে এত শীত!”
মিথিলার নীলার কথাতো পছন্দ হয়নি। নিশ্চয়ই ভালো সাজার জন্য এত সুন্দর সুন্দর কথা বলছে।যাতে সবাই ওকে পছন্দ করে ইয়াশ ভাইয়ের বউ বানিয়ে নিয়ে যায়।তারউপর ইফা আর মিহুর সায় দেওয়া একদমি ভালো লাগল না।ওদের কথা শেষ হতেই হালকা চিল্লিয়ে বলে ওঠল,
“এখনি কেন যাবা তোমরা?এতই যখন শীত লাগছে তাহলে এসেছিলে কেন?যত্তসব!”
মিথিলা কথাটা বলে অন্যদিকে চলে যায়।ইফা মিহুর দিকে তাকিয়ে বলে,, “আপু এর মাথায় কী গ্যাসটিক হইছে নাকি?এম্নে কথা কয় কে?”
“চুপ কর! দেখছি আমি।”
মিহু মিথিলার দিকে এগিয়ে যায়।মিথিলার পাশে দাড়িয়ে বলে,,
“কি হয়েছে বল তো?এখানে আসার পর থেকে তোর মেজাজ গরম হয়েই আছে?সমস্যা কি!”
মিথিলা মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলে, “কিছু না চলো!ভালো লাগছে না আমার!”
মিথিলা যেতে মিহু হতাশ দৃষ্টিতে তাকায় মিথিলার দিকে।কি হয়েছে এই মেয়ের?কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে।এই রাগ দেখাচ্ছে তো এই ভালো।মিহু এতো ঘাটেনা।পরে জিজ্ঞেস করে নিবে।
——————————
নীলাদের বাড়ি থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে একটা দু’তলা বাড়ি রয়েছে মিথিলাদের সবাইকে ওখানে থাকতে দেওয়া হয়েছে।নীলাদের বাড়িতে চারটা রুম।একটায় নীলা আর রায়না থাকে।একটায় নীলার ভাই থাকে।আর দুটোতে ইয়াশের মামারা।যায়গা না হওয়ার দরুণ মিথিলাদের এখানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।নীলা,রায়না আর ইয়াশের দুই মামী এসে রুমগুলো পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে।বাড়িটা কেমন ভুতুরে টাইপ।কয়েকবছর ধরে খালি পড়ে আছে।আগে যারা এই বাড়িতে থাকত তারা নাকি শহরে চলে গেছে কয়েকবছর হলো।
“ভাউ!”
মিথিলা,ইয়াশ,মিহু,ইফা,নীলা,রায়না,নাবিল সবাই মিলে বাড়িটার ছাদে গল্প করছিল।নীলা আর নাবিল বাড়িটার ব্যাপারে কথা বলছিল ভুতপ্রেত নিয়ে। তার মাঝে হঠাৎ রায়নার ‘ভাউ’ বলাতে সবার যেন যায় যায় অবস্থা।মেয়েটা যে অতিমাত্রায় ফাজিল মিথিলা, মিহু এই কয়েকঘন্টায় টের পেয়ে গেছে।
নাবিল, নীলা ধমক দিতে পানসুটে মুখ বানিয়ে চুপ হয়ে যায় রায়না।সবাই স্বাভাবিক হতে নীলা বলতে শুরু করে,
“জানো আমার দাদিমার কাছ থেকে শোনা,এই বাড়িতে যারা থাকত।খুবই হাসিখুশি সুখী পরিবার ছিল তারা।আনন্দে দিন কাটত।বাড়ির সবার আদরের একমাত্র মেয়ে ছিল তনিমা।সারাদিন হেসেখেলে নাকি তার দিন কাটত।হঠাৎ একদিন শোনা গেল এই বাড়ির মেয়ে তনিমা নাকি,পাশের গ্রামের ছেলেকে নিয়ে ভেগেছে।দুই গ্রামে রটিয়ে গেল কথাটা।তনিমার বাবা,মাকে সবাই থু থু করত।বাইরে বেরোনই যেত না গ্রামের মানুষের জন্য।এরকম করতে করতে কয়েকবছর কেটে গেল।তনিমার মা,বাবা তাদের মেয়েকে মৃত ধরে নিয়েছিল।কিন্তু আদরের একমাত্র মেয়ে তাকে কি এত সহজে ভোলা যায়।সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল।গ্রামের মানুষও তনিমা নাম টাকে ভুলে বসেছিল।সেসময় হঠাৎ একদিন তনিমা এ বাড়িতে আসে।তনিমার বাবা,মা তো প্রথমে তনিমাকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠেছিল।একমাত্র আদরের মেয়ের কি দশা হয়েছিল এটা দেখে দুজনে চোখে জল ছেড়ে দিয়েছিল।তনিমা বাবা,মায়ের সামনে যায়,দুজনের দিকে তাকিয়ে কাতর কন্ঠে বলে,, “সে আমায় ভালোবাসেনি।মা,বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিও।” এটুকু বলে তনিমা তার ঘরে চলে যায়।আর তার পরেরদিন তনিমার লাশ বের হয় ওর ঘর থেকে।রাতেই হয়ত ফাসি নিয়েছিল তনিমা।এই ঘটনার পরপরই তনিমার বাবা,মা এ বাড়ি ছেড়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায় এখান থেকে।এখন প্রায় প্রায় নাকি ওই তনিমার রুমটা থেকে মেয়েলী কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে।অস্পষ্ট সুরে কি যেন বলে চলে মেয়েটা।”
এটুকু বলে শ্বাস নেয় নীলা,তখন নাবিল বলতে শুরু করে,
“আর এই তনিমার কান্নাস্বর নাকি আমাদের গ্রামেরই একজন শুনেছে।রাতে মাছ মেরে সে নাকি এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তখন বাড়ি থেকে চাপাস্বরে কান্নার আওয়াজ পায়।এক মুহুর্ত দেরি না করে সে নাকি চলে গিয়েছিল এখান থেকে।ঘটনা কতটা সত্য তা আমরা জানি না।”
নাবিল থামতে ইফা ভীতকন্ঠে বলে,, “নাবিল ভাই,আমরা এখানে থাকব না তোমাদের ওই বাড়িতেই থাকব চলো।দরকার পড়লে উঠোনে থাকব।তাও এখানে না!”
ইফার কথা শেষ হতে মিহু,মিথিলাও একই কথা বলে ওঠে।নাবিল এবার তিনজনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
ইয়াশ তখন ঘড়ি দেখে বলে,,
“অনেক রাত হয়েছে।বাদ দেও এখন,চলো ঘুমাতে চলো সবাই।”
এই বলে ইয়াশ উঠে যায়।নাবিল উঠে ইয়াশের পিছন পিছন চলে যায়।বাকি পড়ে থাকে মিথিলা,মিহু,ইফা,নীলা আর রায়না।নীলাও উঠে পড়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“চলো এবার সবাই যাই।অনেক রাত হয়েছে।রায়না তুইও চলে বাড়ি যেতে হবে আমাদের।”
সবাই উঠে পড়ে নীলা আর রায়না আগে আগে যাচ্ছে পিছনে মিহুকে জড়িয়ে ধরে ইফা আর মিথিলা হাঁটছে।হঠাৎ পিছনে কিছুর শব্দ হতেই,মিথিলা আর ইফা জোরে চিল্লিয়ে উঠে।দুজনের দু’পাশ থেকে চিল্লানোতে মিহু ভয় পেয়ে দুজনকে ছেড়ে দেয়।নীলা আর রায়না পিছনে ঘুরে তাকায়।
রায়না দুজনের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বলে,
“বিড়াল গেছে বিড়াল।আল্লাহ্ এত ভীতু তোমরা!”
বলে আবার হাসতে থাকে।ইফা আর মিথিলা মুখটা ছোট করে হাটতে থাকে।
———————————
“ভাইয়া তুমিও চলো আমাদের সাথে?!”
নীলা কথাটা বলতে, ইয়াশ বলে উঠে, “আমি কেন যাব,নাবিল আছে তো চলে যেতে পারবে।”
ইয়াশের উত্তরে নীলা মুখটা ছোট করে ফেলে।তখন পাশ থেকে নাবিল বলে ওঠে, “ভাই চলো নাহয় আমাদের সাথে,মধ্যরাতে গ্রামটা হেটে দেখো সুন্দর লাগবে।”
নাবিলের বলা কথাটা ভেবে ইয়াশ রাজি হয়ে যায় যকয়।নীলার ঠোঁটে তৎক্ষনাৎ হাসি ফুটে।চারজন যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে পিছন থেকে মিথিলা নিচুস্বরে বলে,
“ভাইয়া আমিও যাব।আমিও এই মধ্যরাতে গ্রাম ঘুরে দেখব!”
“না,আমি কাউকে নিতে পারব না।”
ইয়াশের উত্তর শুনে মাথা নিচু করে ফেলে মিথিলা।তখন পাশ থেকে নাবিল বলে ওঠে, “নাও না ভাই।”
“আচ্ছা আয়।”
মিথিলা খুশি হয়ে ওদের সাথে এসে পড়ে।পাঁচজন হাঁটছে একটা রাস্তা দিয়ে।প্রথমে নাবিল।তারপর ইয়াশ,নীলা।পিছনে রায়না আর মিথিলা।সামনে ইয়াশ আর নীলাকে একসাথে দেখে মনে মনে রাগে ফুঁসতে থাকে মিথিলা।ও কি এসব রংঢং দেখার জন্য এসেছিল নাকি ধুরর!তারউপর পাশে রায়নার বকবকানি।
কয়েক মিনিট হাটার পরে।ইয়াশদের মামাবাড়ি চলে আসে।নীলা,নাবিল,রায়না ওদের বিদায় দিয়ে বাড়িতে ঢুকে যায়।ওরা যেতে ইয়াশ মিথিলার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “চল!”
.
ছোট্ট রাস্তা দুজন পাশাপাশি হাঁটছে।দখিনা বাতাস বহিছে।মিথিলা শাল জড়িয়ে আছে,তাও যেন একটু শীতশীত লাগছে।কয়েক মিনিট হাটার পরই হঠাৎ মিথিলা ইয়াশের হাতের মাঝে হাত গলিয়ে দেয়।ইয়াশ থেমে যায়।বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় পাশে মিথিলার পানে ।মিথিলা স্মিত হেসে মাথা নাড়ায়।আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার ইয়াশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“মধ্যরাত,চাঁদের আলো,দখিনা বাতাস,পাশে প্রিয় মানুষ। এ জীবনে আর কি চাই বলো!এই রাতে প্রিয় মানুষটার কাছে একটাই আবদার এখন থেকে প্রণয় শুরু হলে মন্দ হয়না বলো?!”
চলবে, ইন শা আল্লাহ 🍁
#তোকেই_ভালোবাসি
সকল পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=122116347122106938&id=61553208165829&mibextid=2JQ9oc