#_ল্যাম্পপোস্টের_ঘোলাটে_বাতি ।
#_পঞ্চম_পর্ব ৷
– বললাম , কি বলছেন আপনি ? খালার মেয়ে তুলি আর তার মামাতো বোন খুন হয়ে গেছে ? আমি তো লাল বিল্ডিংয়ের সামনে থেকে ওদের কাছ থেকে পিঠা রিসিভ করে নিয়ে চলে আসলাম । তারপর আর তো কোনো কথা হয়নি আমাদের , আর চার বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছি বলে সবার মোবাইল বন্ধ করে রাখছি ।
– শফিক বললো , সত্যি বলছি স্যার আমরা এমন খারাপ কাজ করিনা । আমাদের মধ্যে সজীব খুব ভালো একটা ছেলে , সজীব সিগারেট পর্যন্ত খায় না কখনো ।
– পুলিশ বললো , দেখুন আমাদের হেফাজতে নিচ্ছি তারমানে তো এই নয় যে সাজা হয়ে যাবে । কিন্তু সন্দেহ ভাজন ব্যাক্তিকে পুলিশের হেফাজতে রাখা আমাদের কর্তব্য ।
– জাফর ভাই বললেন , দেখুন স্যার সজীব স্টুডেন্ট একটা ছেলে । সামনে তার অনেক বড় ভবিষ্যত পরে আছে কিন্তু এই সময় একটা মিথ্যা পুলিশের ঝামেলা হয়ে গেলে জীবন টা নষ্ট হয়ে যাবে ।
– পুলিশ বললো , অপরাধ যদি না করে তাহলে তো জীবন নষ্ট হবার প্রশ্ন আসে না । আর আমরা তো এতকিছু জবাবদিহি করবো না , আমাদের কাজ আমরা করবো ।
( এমন সময় পিছনের এক পুলিশের মোবাইল বেজে উঠলো , তিনি রিসিভ করে কাকে যেন জরুরি হাসপাতালে ভর্তি করাতে বললেন । আর দ্রুত তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে যেভাবেই হোক বাচাতে হবে এমন কিছু বললেন ।)
– চিকন পুলিশ জিজ্ঞেস করলো , কি হইছে ?
– মোবাইলে কথা বলা পুলিশ বললো , যেই মেয়ে দুটোর লাশ পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে একজন জীবিত আছে । মর্গে উঠানোর সময় একজন তার হাতের রগে রক্ত চলাচল অনুভব করে । তারপর দেখে সত্যি সত্যি মেয়েটা জীবিত আছে তাই সেই মেয়ে কে সদর হাসপাতালে ভর্তি করাতে বললাম । যদি মেয়েটা বেঁচে যায় তাহলে তার স্বীকারোক্তিতে ধর্ষক আর খুনিকে ধরা সহজ হবে ।
– চিকন পুলিশ বললো , হুম এটা অবশ্য ভালো একটা খবর । এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন দোয়া করো মেয়েটা যেন সুস্থ হয়ে যায় । তাহলে তুমি যদি নির্দোষ হও তোমার জন্য একটা সুবিধা হবে । কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাকে আমাদের সাথে হাজতে থাকতে হবে ।
– বললাম , দেখুন স্যার আমি তো এখানেই আছি , যদি প্রয়োজন পরে তাহলে আমাকে নিয়ে যাবেন । আমি কথা দিচ্ছি শহর ছেড়ে বা এই মেস ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না । কিন্তু তবুও স্যার আমাকে আপাতত থানায় নিয়েন না প্লিজ স্যার ।
– আমাদের তো এখনই প্রয়োজন তাই তো তোমাকে নিতে আসছি চলো তাড়াতাড়ি ।
★★
অজস্র অনুরোধ অগ্রাহ্য করে পুলিশ তাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে আমাকে নিয়ে থানায় রওনা দিল । মেসের সবাই ইতিমধ্যে জেগে গেছে আর তারাও মধ্যে রাতের আধারে এই অবিস্মরণীয় আকস্মিক ঘটনা উপভোগ করছে ।
আমাদের মেস পৌরসভার মোড় থেকে খালিশপুর থানা মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ । রাস্তা দিয়ে পুলিশের সঙ্গে হাটছি , এই রাস্তা আমার দীর্ঘ চার বছরের পুরনো পরিচিত রাস্তা । রাস্তার ক্লান্ত কুকুরটাও এখন কোন এক বন্ধ দোকানের পাশে হয়তো ঘুমিয়ে পরেছে । রাত ২/৩ টার পরেও অনেকদিন এই রাস্তা দিয়ে থানার সামনে চা খেতে গেছি । থানার সামনের চায়ের দোকান সারাদিন সারারাত খোলা থাকে । আমি শফিক আর রকি মাঝে মাঝে এমন গভীর রাতে চা খেতে আসতাম । কিন্তু তখনকার সেই রাতের হাঁটা আর আজকের এই হাঁটার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে ।
থানায় এনে আমাকে লোহার খাঁচার মধ্যে রাখা হয়েছে , কি এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল । নিজের জন্য খারাপ লাগছে খুব কিন্তু খালার বড় মেয়ে তুলি ধর্ষিত হয়ে মারা গেছে ব্যাপারটা দুঃখজনক । তার ক্ষুদ্র জীবনে সে প্রকৃতির আর এই পৃথিবীর মানুষের নিষ্ঠুরতম রুপ দেখে গেল । পুলিশ বললো একজন নাকি বেঁচে আছে , কে যে বেঁচে আছে সেটা জানতে পারলে ভালো হতো । ধুর না , আমার ভালো হবে কেন , যেই বাঁচুক না কেন কিন্তু আমার যে মিথ্যা অপবাদ রটেছে সেটাই ভাবা দরকার । যদি একজন সত্যি সত্যি বেঁচে যায় তাহলে আমি মুক্তি পাবো ইনশাআল্লাহ ।
রাত প্রায় শেষ হয়ে গেছে , বাকি সামান্য সময়টাতে ঘুমানোর চেষ্টা করা বৃথা কারণ চাইলেও আর ঘুম আসবে না । রাতটা নাহয় আজকে ভেবে ভেবে পার করে দিই ।
,
,
বসে বসে ঝিমাচ্ছি আর কখন যে তন্দ্রা এসে গেল বুঝতে পারছি না । কারো ডাকে তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল , তাকিয়ে দেখি জলিল ভাই , জাফর ভাই , শফিক আর রকি দাঁড়িয়ে আছে লোহার সিকের সামনে ।
সকালের নাস্তা নিয়ে আসলো ওরা , আর এখন নাকি তারা সদর হাসপাতালে যাবে । দুজনের মধ্যে যে বেঁচে আছে তার কি অবস্থা সেটা দেখার জন্য ।
তারা আমাকে মানসিক ভাবে সাহস দিয়ে মনটা ভালো রাখার চেষ্টা করলো । মিনিট পনের পরে তারা বিদায় নিয়ে চলে গেল , আর আমি সজীব নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে দাঁড়িয়ে আছি জেলখানায় ।
থানার বড় দেয়াল ঘড়িতে ১২ টা বেজে গেছে একটু আগে । বড় ঘড়ির পাশে আরেকটা ছোট ঘড়ি কিন্তু সেই ঘড়িতে বাজে ৫ঃ০০ । দুটো ঘড়িই চলছে কিন্তু দুটোর সময় দুই রকমের । থানার মধ্যে কর্মরত কেউ হয়তো বিষয়টা লক্ষ্য করে নাই , কিন্তু আমি তো অযথা বসে আছি তাই আমার চোখে পরলো । একটু পরে আমি অবাক হলাম কারণ থানার মধ্যে বৃষ্টির বাবা মানে স্যার প্রবেশ করলো । আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম , দুজনের মাঝখানে শুধু লোহার শিকল ।
– স্যার বললো , কি ব্যাপার সজীব ? এসব কেমন করে কি হয়ে গেছে ?
– বললাম , আমি এখনো বুঝতে পারছি না স্যার কি থেকে কি হয়ে গেল ?
– তুমি ওই মেয়েদের সাথে কখন দেখা করছো ?
– আপনাদের বাসা থেকে বেরিয়ে আমি হাউজিং মোড়ে এসেছি তখনই খালা কল দিয়ে যেতে বলে । আমি হাউজিংয়ের ভিতর দিয়ে লাল বিল্ডিংয়ের সামনে পর্যন্ত গেছিলাম । তারপর তাদের সাথে দেখা করে পিঠা নিয়ে চলে আসলাম , আর কিছু জানিনা আমি স্যার ।
– তুমি চিন্তা করিও না , সত্যের জয় অবশ্যই হবে আর নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখো । শুনলাম একটা মেয়ে বেচেঁ আছে তার কি খবর ?
– জানিনা আমি , পুলিশরা কেউ কিছু বলছে না । আর আমার মেসের চারজন তাকে দেখতে গেছে সকালে কিন্তু ফেরেনি এখনো ৷
– খেয়েছ কিছু ?
– সকালে নাস্তা করেছি ।
– আমি সন্ধ্যা বেলা কোচিং সেন্টার থেকে ফিরে আরেকবার দেখা করে যাবো । আর পুলিশের সঙ্গে কথা বলে দেখি তো কিছু জানতে পারি কিনা ?
– ঠিক আছে স্যার আসসালামু আলাইকুম ।
– ওয়া আলাইকুম আসসালাম ।
★★
স্যার পুলিশের সঙ্গে কি কথা বলেছে জানিনা , আর এদিকে না এসে চলে গেছে । আধা ঘণ্টা পরে শফিক আর রকি আসলো , হাসপাতালের খবর বেশি ভালো না ৷ তুলি বেঁচে আছে আর তার মামাতো বোন মারা গেছে কিন্তু তুলির অবস্থা খারাপ, এখনো জ্ঞান ফিরে আসে নাই । খালার বস্তিতে সবার ধারণা আমি নাকি খুন করেছি , তবে দুএকজন নাকি আবার আলাদা মন্তব্যও করেছে ।
বিকেল বেলা কোচিং শেষ করে স্যার আসার কথা বলেছেন কিন্তু তিনি আসেননি । সন্ধ্যার পরে জাফর ভাই শফিক আর রকি আসলো আবারও । তেমন কোন ভালো খবর নেই , মেসের মধ্যে রান্না হচ্ছে না আজকে । সবাই দুপুরে হোটেলে খেয়েছে আবার রাতেও একই ব্যবস্থা করতে হবে ।
– শফিক বললো , তোর মোবাইলে বৃষ্টি নামে সেভ করা নাম্বার থেকে কল এসেছিল অনেকবার । গ্রাম থেকে তোর বাবাও কল করেছিলেন , ভাবছি মোবাইল বন্ধ করবো । নাহলে কাকে কি জবাব দেবো বল ?
– জাফর ভাই বললেন , তাতে সমস্যা আরো বৃদ্ধি পাবে , মোবাইল বন্ধ দেখে তারা বেশি চিন্তা করবে ।
– বললাম , পরের বার আসার সময় মোবাইল টা নিয়ে আসবি , পুলিশের কাছে অনুরোধ করে কথা বলবো বাড়িতে । আপাতত বাড়িতে যেন কিছু না জানে , নাহলে যে মা-বাবা আরো বেশি কষ্ট পাবে ।
– শফিক বললো , কাল সকালে আবার হাসপাতালে যেতে হবে , ডাক্তাররা ঠিক মতো চিকিৎসা করে কিনা কে জানে ?
– আচ্ছা ঠিক আছে তাই কর ।
– ঠিক আছে চিন্তা কম করিস যেকোন একটা ভালো সমাধান হবে ইনশাআল্লাহ ।
– জাফর ভাই বললেন , আগামীকাল রবিবার একটা উকিল ধরে জামিনের ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখতে হবে , নাহলে তো কোর্টে চালান করে দেবে ।
– রকি বললো , সেটাই ভালো হবে আমরা সবাই মিলে কিছু কিছু টাকা দিয়ে উকিলের ব্যবস্থা করতে হবে ।
– বললাম , জাফর ভাই আপনারা তাহলে যান এখন কাল সকালে আবার দেখা হবে ।
– ঠিক আছে ভালো থেকো ।
,
,
আরো একটা নির্ঘুম রাত সামনে এসে উপস্থিত হয়ে গেল । হঠাৎ করে জীবন কোন গলিতে পৌঁছে গেল বুঝতে পারছি না । কান্না করতে চাইলে কান্না করা যায় না কারণ অতিরিক্ত শোক আসলে কান্না করা যায় না । তবুও হাহুতাশ করে রাত্রি পার করতে হবে তাছাড়া উপায় নেই নিরুপায় ।
পরদিন সকালে সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ টা আমার কাছে পৌঁছে গেল । শফিক আর রকি হাঁপাতে হাঁপাতে থানার মধ্যে এসে বললো , সজীব সর্বনাশ হয়ে গেছে ।
– বললাম কি হইছে ?
– নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ধর্ষন করে হত্যার নিউজ ছাপা হয়েছে , আর সেখানে তোর নাম উল্লেখ করা আছে ।
– আমি শফিকের হাত থেকে পত্রিকাটা নিয়ে নিজ চোখে দেখলাম , ” খালিশপুরে রেললাইনের পাশে দুটো মেয়েকে ধর্ষন করে হত্যার চেষ্টা । একটা মেয়ে নিহত হয়েছে এবং আরেকজন মুমূর্ষু অবস্থায় খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি । খালিশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন , ধর্ষকের মধ্যে একজনকে তারা আটক করতে সক্ষম হয়েছেন । এবং তার বাকি সহযোগীদের আটক করার চেষ্টা চলছে । আটক কৃত ধর্ষকের নাম ” সজীব ” তিনি খুলনা সিটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর ছাত্র । ”
– বাকি টুকু পড়ার আগেই দেখলাম বৃষ্টি বাবা মানে স্যার আসলো এবং তার হাতেও পত্রিকা । পত্রিকাটা ভাজ করা ছিল এবং সেই ভাজের মধ্যে শুধু দেখা যাচ্ছে ” দিগন্ত ” । তারমানে স্যারও নিউজ টা পড়েছেন ।
★★
#বিঃদ্রঃ-
#_গল্প টা অনেক বড় হবে , তাই সচারাচর যারা বড় ধরনের গল্প অপছন্দ করেন তাদের কাছে বিরক্ত লাগতে পারে ৷ অনাকাঙ্ক্ষিত সেই বিরক্তির কারণ হবার জন্য আমি দুঃখিত ।
শরীর টা অসুস্থ , মন মানসিকতা আরো বেশি খারাপ তাই পর্ব ছোট হয়ে গেছে । ভুল ত্রুটি মার্জনীয় ।
চলবে….
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব) ।