#_ল্যাম্পপোস্টের_ঘোলাটে_বাতি ।
#_পর্ব = ৪৩
” খালা বলো, আসো ভিতরে আসো। ”
বৃষ্টি আগে রুমের মধ্যে প্রবেশ করলো তার পিছনে সজীব প্রবেশ করলো। বৃষ্টি হাতের টিফিন বক্স রেখে শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে খালাকে সালাম করলো। সজীব ভেবেছিল তার খালা হয়তো বাংলা সিনেমার রিনা খানের মতো পা সরিয়ে নেবে। কিন্তু তার সেই ভাবনা না ঘটিয়ে সজীব এর খালা বৃষ্টিকে দুহাত দিয়ে ধরে খাটের উপর বসালো। সজীব লক্ষ্য করল তার খালার চোখে পানি টলমল করছে মনে হয় যেন এখনই গড়িয়ে পরবে।
” বৃষ্টি বললো, আমাকে ক্ষমা করে দিবেন খালাম্মা সেদিন আমি ভুল করে আপনাকে অনেক কিছু বলে ফেলেছি। এখন আপনি আপনার সন্তান মনে করে আমাকে মাফ করবেন প্লিজ নাহলে আমরা যতই ভালো থাকতে চাই না কেন সেটা অসম্ভব। ”
” খালা বললো, সেদিন আমারও অমন নিকৃষ্ট মনের পরিচয় দেয়া ঠিক হয়নি। আমি শুধু আমার নিজের দিকটায় চিন্তা করেছি কিন্তু যদি একবার তোমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতাম তাহলে হয়তো এমন হতো না। সজীব বাবা মানে আমার দুলাভাই সবসময় মনে মনে তোমাদের সাপোর্ট করেছে। কিন্তু আমি বিরোধিতা করেছি বলে আপা দুলাভাই কেউ কিছু বলে নাই। তবে আমি বুঝতে পারছি যে আমার মারাত্মক ভুল হয়েছে কিন্তু কীভাবে নিজের ভুলটা স্বীকার করবো পথ পাচ্ছিলাম না। সেদিন তোমাকে আর তোমার পরিবারকে অপমান করে এসেছি তাই আবার কোন মুখে গিয়ে দাঁড়াবো বলো? ”
” এভাবে বলবেন না প্লেট! আমি আপনার সন্তানের মতো তাই এভাবে বলে আমাকে লজ্জা দিবেন না। আর আজকের এই ঈদের আনন্দের দিনে মন খারাপ করে থাকার কোন মানে হয় না। আপনি এতটা সহজ ভাবে আমাদের মেনে নিবেন ভাবতে পারিনি। সত্যি বলছি আজকে ঈদের আনন্দ হাজার হাজার গুণ বেড়ে গেল। আপনার প্রতি আমার অজস্র নিঃস্বার্থ ভালবাসা অবিরাম অন্তহীন। ”
” আমার নিজের কোন সন্তান নেই, সজীব আর মাহি ওরা দুই ভাই বোন হচ্ছে আমারও সন্তান। আমার সবকিছু সন্তানের স্বপ্ন ওদের মাধ্যমে পূরণ করতে চাই। তাই আমি চাই না আমার জন্য ওদের কেউ একজন কষ্ট পাকা। ”
” আপনার জন্য নিজের হাতে রান্না করে নাস্তা নিয়ে এসেছি, আপনি খেলে আমি খুব খুশি হবো। ”
” অবশ্যই খাবো, আমি ঈদে বার কোরবানির সময় কখনো শহরে থাকি না। যত কষ্ট হোক তবুও গ্রামের বাড়িতে যেতাম মা-বাবা আর আপা দুলাভাই সজীব মাহি এদের সঙ্গে ঈদ কাটাতে। কিন্তু এ বছর সজীব এর জন্য যাওয়া হলো না, সজীব আমাদের সকলের সঙ্গে রাগ করে আছে। মাহির কাছে বলেছে গ্রামের বাড়িতে নাকি যাবে না তাই আমিও গেলাম না। ”
” আপনি সজীবকে কতটা ভালবাসেন সেটা এমন মহানুভবতা দেখলে বোঝা যায়। এখন এসব কথা বলে আমরা কেউ মন খারাপ করবো না চলুন নাস্তা শুরু করবেন। ”
★★★
খালার বাসা থেকে বেরিয়ে সজীব আর বৃষ্টি দুজন মিলে বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। যেহেতু ঈদের দিন তাই বাস সহজে পাওয়া যায় না আর তাছাড়া সী-বিচ এলাকায় এই মুহূর্তে যাবার সময় অনেক ভীড় হবে। কিছুক্ষণ পরে তারা ইঞ্জিন চালিত ইজিবাইকে উঠে সী-বিচ রওনা দিল তবে ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা বেশি।
এই সেই সী-বিচ, ছয় বছর আগে ২০১১ সালে কোন এক পড়ন্ত বিকেলে সমুদ্রের জলে লাল সূর্যের ছায়া সাক্ষী রেখে সজীব আর বৃষ্টির পরিচয়। ছয় বছর পরে আজ অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, অনেক নতুন নতুন প্রেমিক প্রেমিকা ভীড় জমাচ্ছে। অথবা এখানে বহুবছর অাগে ঘুরতে আসা দম্পতি জীবনের শেষ লগ্নে আজও মাঝে মাঝে আসে। বালুকণায় হাঁটতে হাঁটতে হয়তো তারা পুরনো স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। চোখ দুটোর পাতা ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায় মনের অজান্তেই। সজীব আর বৃষ্টি দুজন যদি বিয়ে করে সংসার শুরু করে তাহলে আজ থেকে অনেক বছর পরে তাদেরও আজকের দিনগুলো মনে পরবে।
সজীব আর বৃষ্টি দুজনে হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে, এমন একটা দিনের জন্য হয়তো তারা অপেক্ষায় ছিল অনন্তকাল ধরে। আকাশে হালকা মেঘ আছে তবুও সূর্যের তাপ মোটামুটি অনেক বেশি। কিন্তু এতে করে মানুষের সমুদ্র দেখা বন্ধ হচ্ছে না, যারা প্রিয় মানুষের সাথে কিংবা পরিবারের সাথে ঘুরতে এসেছে তারা ঠিকই রৌদ্রের তাপ সহ্য করে হেঁটে বেড়াচ্ছেন।
” বৃষ্টি বললো, তোমার সাথে এই পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে এভাবে হাঁটতে পারবো কখনো ভাবিনি। মনে হচ্ছে স্বপ্নের মাঝে আমি হেঁটে বেড়াচ্ছি কোন এক স্বপ্নের রাজ্যে। আর সেই রাজ্যের রাজকুমার আমার হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছে। ”
” সজীব বললো, আমার কিন্তু সম্পুর্ন বিশ্বাস ছিল যে একদিন ঠিকই তোমাকে নিয়ে আমি এই লবনাক্ত সমুদ্রজলে হাঁটু সমান পা ভিজিয়ে হাঁটবো। ”
” আমি তো তোমাকে ভালবাসার চেয়ে কষ্ট বেশি দিয়ে ফেলেছি তবুও এত বিশ্বাস কেন? ”
” আমার বিশ্বাস ছিল আমার নিজের ভালবাসার প্রতি, মন থেকে তোমাকে চেয়েছিলাম। আর কোন কিছু মন থেকে যদি চাওয়া হয় তাহলে প্রকৃতি সেই চাওয়া অবশ্যই পুরন করবে। যদি পূরণ না হয় তবে বুঝতে হবে সেই চাওয়ার মাঝে কোন ভুল ছিল। ”
” এটা কি চিরন্তন সত্য কথা নাকি তোমার নিজের কাছে মনে হয় তাই বলছো? ”
” আমার নিজের কাছে মনে হলো। ”
” ওহহ। ”
” ঝিনুকের মালা কিনবে? ”
” কিনে দেবে? ”
” হ্যাঁ দেবো যদি তোমার পছন্দ হয়। ”
” তাহলে কিন্তু আমার ঝিনুক আর শামুকের তৈরি যা যা পছন্দ হবে সবকিছু কিনে দিতে হবে। ”
” ঠিক আছে পকেটে যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ না করবো না। ”
” তাহলে থাক, এখনো সারাদিন পরে আছে তাই আগে থেকে টাকা খরচ করে বসে থাকতে চাই না। ”
” বাহহ বউ আমার খুব হিসেবি? ”
” নয়তো কি? ”
” তবুও চলো যেহেতু ঝিনুকের মালা কেনার কথা বলেছি তাই একটা মালা কিনে দেবো। ”
” ঠিক আছে চলো। ”
|
|
হাটতে হাঁটতে তারা রৌদ্রে ক্লান্ত হয়ে গেল, কিছুক্ষণ বসার জন্য একটা হোটেলে বসলো। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের তীরে কাঁকড়া ভাজি খেতে অনেক সুস্বাদু। সজীব এর আগে যতবার এসেছে ততবারই সে একা একা খেয়েছে। কাঁকড়া অর্ডার করে তারা সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে, সমুদ্রের ঢেউ আপন গতিতে বারবার তীরে এসে উপচে পরছে। সমুদ্রের মাঝে অনেক গুলো জাহাজ নোঙর করা হয়েছে, ছোট ছোট স্পিড বোট করে দর্শনার্থীরা সমুদ্রের মাঝে গিয়ে আবার ফিরে আসছে।
” বৃষ্টি বললো, তোমার কি মনে আছে এখানেই কিন্তু তোমার আমার প্রথম দেখা হয়েছে। সেদিন তোমার কাছে আমরা ছবি তুলতে চেয়েছিলাম আর তুমিও খুব সুন্দর করে আমাদের ছবি তুলে দিয়েছিলে। ”
” হ্যাঁ সবকিছু মনে আছে, এমনকি সেদিনের সেই ছবি আজও আমার মোবাইলে আছে। সেদিন তুমি নীল শাড়ি পরে ছিলে আর আজ ছয় বছর পরে-ও তুমি নীল শাড়ি পরে আছো। ”
” আচ্ছা তুমি আমার কি দেখে প্রেমে পরেছিলে? ”
” জানিনা তবে শুধু জানি প্রতিদিন অসংখ্যবার সেই ছবি দেখতে ভালো লাগতো। বারবার দেখতাম আর বারবার কেবল নতুন মনে হতো, আমি তোমার ছবি দেখতে গিয়ে কখনো বোরিং ফিল করিনি। ”
” সেদিন যদি তুমি আমাদের ছবিগুলোর মধ্যে তোমার একটা ছবি দিতে তাহলে ভালো হতো। ”
” চেয়েছিলাম কিন্তু সাহস হয়নি। ”
” কেন? অনুমতি না নিয়ে ছবি সেভ করে রাখতে পারো কিন্তু নিজের ছবি অনুমতি ছাড়া দিতে ভয় লাগে তাই না? ”
” আমি যে তোমার ছবি রেখেছিলাম তুমি জানতে না কিন্তু যদি আমার ছবি দিতাম তাহলে তো তুমি বুঝে যেতে তাই না? ”
” আমি বুঝলে কি খুব অসুবিধা হতো? ”
” নাহহ খুব ভালো হতো। ”
” তাহলে? ”
” জানিনা আমি হয়তো এমনটা ভাগ্য সাজানো ছিল।
” গতকাল রাতে পাশের রুমের সেই ভাবির কাছে কিছু কথা শুনে এখনো মনে পরলে হাসি পাচ্ছে, আচ্ছা তুমিও কি তার মতো হবে নাকি? ”
” কার মতো? ”
” ভাবির স্বামীর মতো। ”
” আমি তাকে দেখিনি। ”
” আরে দেখতে হবে কেন? ভাবি বললো তাদের নাকি বিয়ের দশ মাস পেরিয়ে গেছে কিন্তু তার স্বামী তবু একটা রাতও ঘুমাতে দেয় না। তুমি কি বিয়ের পরে এমন কিছু করবে? ”
” করলে কি বাধা দেবে? ”
” বাধা দেবো না কিন্তু তাই বলে প্রতিদিন? ”
” এসব কথা বাদ দাও। ”
” কেন লজ্জা করে? ”
” লজ্জা হচ্ছে তোমাদের জন্য তাই আমার জন্য লজ্জা মানায় না। আমি বাদ দিতে বলছি কারণ যদি আগুন জ্বলে তাহলে নেভানো কষ্টকর। ”
” আমি একটা জিনিস ভাবছি। ”
” কি? ”
” আমরা কাল বা পরশু কক্সবাজার যাই চলো। ”
” কেন? ”
” ঘুরতে। ”
সজীব এর মোবাইল বেজে উঠলো, সজীব কথা বন্ধ করে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে মিতু কল করেছে।
” বৃষ্টি বললো, কে কল দিয়েছে? ”
” সজীব বললো, মিতু। ”
#চলবে…
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)