_ল্যাম্পপোস্টের_ঘোলাটে_বাতি । #_পর্ব>>_০৮

0
305

#_ল্যাম্পপোস্টের_ঘোলাটে_বাতি ।
#_পর্ব>>_০৮

জেলা কারাগারে আসার পরে আট দিন পেরিয়ে গেল এরমধ্যে কেউ দেখা করতে আসেনি । আদালত থেকে আমার দু দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছিল কিন্তু মারধর বেশি করে নাই । প্রাথমিক জিজ্ঞাসা করে সামান্য উত্তমমধ্যম দিয়েছে কিন্তু আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসলোনা কেন ? বাবা কি তুলির মৃত্যুর পরে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে ? শফিক আর রকি , ওদের কি হলো ? জাফর ভাই কি ঢাকা চলে গেছে তাই না ?

এসব ভাবতে ভাবতে আমার দিন পেরিয়ে রাত আসে আবার হাহুতাশ করে রাত পেরিয়ে দিন আসে ৷ আমি অপেক্ষা করি একটা নতুন ভোরের সূর্য আসুক , সেই সূর্য আলোকিত করে দিক আমার জীবনের সমস্ত অন্ধকার । প্রতিদিনের মতো রাতটা ঘুরেফিরে ঠিকই আসে , কিন্তু দুচোখের ঘুমটা আর আগের মতো আসে না ।

জেলা কারাগারে আসার নবম দিনে বেলা এগারোটা বেজে গেল তখনই একজন পুলিশ এসে বললো আমার সাথে নাকি কে যেন দেখা করতে চায় । তার পিছন পিছন গিয়ে দেখি শফিক আর রকি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ।

– পুলিশ আমাকে বললো , ” তোমার সময় পনের মিনিট তারমধ্য কথা বলা শেষ করতে হবে । ”

– বললাম , ” ঠিক আছে স্যার তাই হবে । ” তারপর শফিক এর দিকে তাকিয়ে বললাম , ” কেমন আছো তোরা ? এতদিন পরে হঠাৎ করে আসলি কেন ? সবকিছু ঠিক আছে তো ? ”

– শফিক বললো , ” কিছুই ঠিক নেই সজীব , ভালো কোনো সংবাদ তোর জন্য আনতে পারিনি তবে ৪/৫ টা খারাপ সংবাদ আছে তোর জন্য । ভালো কোন ব্যবস্থা করতে পারি নাই বলে আসি আসি বলে আসা হয়ে ওঠে না । ”

– বললাম , ” ভয় দিয়ে লাভ নেই শফিক , যেদিন শেষ রাতে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে সেদিন থেকে বুঝতে পারছি যে আজ থেকে অনেকদিন ভালো কোনো সংবাদ পাবো না । একের পর এক অপ্রত্যাশিত সংবাদ শুনে শুনে আমাকে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে । তাই যা কিছু বলার নির্ভয়ে বলে দে , সময় কিন্তু মাত্র পনের মিনিট । ”

– তুলি হাসপাতালে মারা গেছে সপ্তাহ খানিক আগে।

– সেটা আমি পুলিশের কাছে জানতে পেরেছি , আর কিছু বলার মতো আছে ?

– তুলি কে হত্যা করা হয়েছে , হাসপাতালে তাকে পরিকল্পিত ভাবে খুন করা হয়েছে ।

– সেটা তো আগেই ধারণা করা ছিল ।

– তোর মা খুব অসুস্থ , আর আঙ্কেল কার কাছে কি শুনেছে জানিনা আমরা কিন্তু তুলি যেদিন মারা গেছে সেদিন সন্ধ্যা বেলা আমাকে কল দিয়ে বললো, আমার ছেলের প্রতি আমার কোনো দাবী নেই । ওর কাজের শাস্তি ও পাবে তাই ওর জন্য আমি মিছে আর খাটনি করবো না । আমি বললাম ” আঙ্কেল কি হইছে আপনার ? কেউ কিছু বলেছে ? ” তখন তোর বাবা বললো , ” সজীব কে বলে দিও , যদি কখনো জেল বের হতেও পারে তবুও যেন আমার বাড়িতে আর কোনদিন না যায় । গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সবাই কে বলবো আমার সজীব মারা গেছে , আর তাকে খুলনা শহরে দাফন করে এসেছি । ” এরপর আঙ্কেল আর কিছু বলার সুযোগ দিলেন না ।

– আমি বললাম , ” মায়ের খবর নিয়েছিলি তোরা ?

– হ্যাঁ তোদের এলাকার উপজেলা স্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনদিন । গত পরশু বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে ।

– কিভাবে জানলি ?

– তোর বোন মাহি কল দিছিল তোর নাম্বারে , তখন তার সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি ।

– আর কোন খবর আছে ?

– হ্যাঁ , আমাদের কলেজ থেকে তোর নাম কাটা হয়েছে । পত্রিকায় তোর নামের সাথে আমাদের কলেজ নামটাও চলে আসে । তাই চেয়ারম্যান স্যার তার প্রতিষ্ঠানের দুর্নাম রটাতে চাননা বলেই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে । গতকাল এক অনলাইন সাংবাদিক এসেছিল তখন তোর বিষয় জিজ্ঞেস করাতে চেয়ারম্যান স্যার বললো , ” সজীব এর নাম আমি কলেজ থেকে কেটে দিয়েছি , আমি চাইনা কোনো খুনি , ধর্ষক আমার প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট অর্জন করুক । ”

– বললাম , বাহহ দারুণ চমৎকার তো , চেয়ারম্যান স্যারের বুদ্ধির প্রশংসা করা দরকার ।

– আরো দুটো খবর আছে ।

– আরো আছে ?

– হ্যাঁ , রফিকুল স্যার মানে বৃষ্টির বাবা তার জীবনের সমস্ত উপার্জন বেশি মুলধনের আশায় একটা সংস্থায় জমা করেছিলেন । সংস্থাটা ডেসটিনি এর এনজিওর মতো একটা কিছু ছিল কিন্তু সেই সংস্থা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে গেছে । স্যারের সব টাকা হারিয়ে গেছে আর সেই টেনশনে স্যার স্টোক করেছেন । স্যারের অবস্থা বেশি ভালো না খুলনা আবু নাসের হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন কিন্তু সেখান থেকে ফেরত দেয়া হয়েছে তাই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে ।

– বলিস কি ? তাহলে স্যারের পরিবারের এখন কি অবস্থা ? তোরা একটু স্যারের পাশে থাকতে পারতি স্যারের তো বড় কোন ছেলে নেই ।

– তার কোন দরকার নেই , তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো তোর আমার চেয়ে আরো বড় গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ফিরে এসেছে ।

– মানে ?

– বৃষ্টি তার যে খালাতো ভাই রাফসানকে ভালবাসত সে মারা যায়নি । রাফসান ফিরে এসেছে , এবং তিনই এখন ওই পরিবারের বিপদের ছাতা ।

– রাফসান কিভাবে ফিরে এসেছে ?

– আমি তেমন কিছু জানিনা , আবু নাসের হাসপাতালে স্যার কে দেখতে গেছিলাম । তখন সেই অপরিচিত যুবককে দেখে মনে খটকা লাগলো । প্রথমে ভেবেছিলাম অন্য কোনো আত্মীয় স্বজনরা হবে কিন্তু বৃষ্টি বললো ওই নাকি সেই রাফসান ।

– বৃষ্টি অনেক খুশি হইছে তাই না ?

– জানিনা কারণ নিজের বাবার মুমূর্ষু অবস্থায় তার প্রেমিক ফিরে আসাতে বৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পাইনি আমি ।

– আল্লাহ আল্লাহ করি স্যার যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে , কত ভালো একজন মানুষ ।

– আপাতত নিজের জন্য আল্লাহ আল্লাহ কর , তোর জন্য আমাদের রাত দিন সমান হয়ে গেছে । দেড় মাস পরে সপ্তম পর্ব সেমিস্টার ফাইনাল পরিক্ষা আর এমন সময়ে এত বড় বিপদ ।

– আমার যা হবার হবে , তোরা ঠিকমত পড়াশোনা কর , আর মাহির কাছে কল দিয়ে বাবার কাছে কে কি বলেছে সেটা জিজ্ঞেস করে জানার চেষ্টা কর ।

– তা ঠিক বলেছিস , আঙ্কেল নিশ্চয়ই বাসায় গিয়ে এ বিষয় আলোচনা করেছে । আজকেই তাহলে মাহির কাছে কল দিয়ে জানতে হবে আঙ্কেল কে এমন কি বলা হয়েছে ?

– খালার কি অবস্থা ?

– চারদিন রান্না করা বন্ধ ছিল , মেসের সবাই হোটেলে খেয়ে খেয়ে বিরক্ত হয়ে গেছিল । সবাই নতুন বুয়া রাখার জন্য মিটিং ডাকলো , আমি খালার সাথে গিয়ে এ বিষয় কথা বললাম । পরদিন থেকে খালা রান্না করতে আসে নিয়মিত তবে কারো সাথে কথা বলে না তেমন । তোর বিরুদ্ধে খালার কোন অভিযোগ নেই কিন্তু তার ভাই নিজের মেয়ে আর ভাগ্নীর খুনিকে ছেড়ে দেবে না । কিন্তু খুনির শাস্তি হোক সেটা আমরাও চাই তবে তার জন্য যে তোর মত নির্দোষ মানুষকে ফাঁসাচ্ছে । মামলার সবকিছু তিনিই টাকা পয়সা দিয়ে চালাচ্ছেন ।

– তিনি হয়তো আমাদের চিনেন না তাই আমাকে দোষী ভেবে বসে আছে । আশা করি খুব তাড়াতাড়ি তার ভুল ভেঙে যাবে আর আমিও কারাগার থেকে বেরিয়ে মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস নেব ।

– সেই দিনটা কবে আসবে ভাই ?

– জানিনা তবে আল্লাহর কোরআন শরিফে বলা একটা আয়াত আছে , ” হে মুমিন মুসলমানগণ তোমরা বিপদে ধৈর্য হারা হয়ে যেও না , মনে রেখ আল্লাহর সাহায্য খুবই নিকটে । ” ‌‌‌‌তাই একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে চুপচাপ হয়ে আছি আমার বিশ্বাস আমি মুক্তি পাবো । কিন্তু আমার এই মুক্তির আগেই যদি আমার পারিপার্শ্বিক সবকিছু হারিয়ে যায় তখন সেই মুক্তিতে আনন্দ কি ? বাবা নাকি গ্রামের বাড়িতে যেতে নিষেধ করেছে , বৃষ্টির পুরনো ভালবাসা ফিরে এসেছে । তাহলে আর কি করা যায় বল ?

– জীবন কখনো কারো জন্য থেমে থাকে না , তুই বেরিয়ে আঙ্কেল কে সবকিছু বোঝানোর দায়িত্ব তোর কাছে । বৃষ্টির কথা চিন্তা করে লাভ নেই , তবে আমরা দোয়া করি স্যার যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে । তবে তোর চিন্তা সবার আগে ।

– সময় প্রায় শেষ তোরা তাহলে এখন যা ।

– হ্যাঁ চলে যাবো , আবার কবে দেখা হবে জানিনা রে বন্ধু , জেলের মধ্যে আগে কখনো কারো সাথে দেখা করতে আসিনি । এখান থেকে ওখানে আবার সেখান থেকে ওখানে যেতে যেতে ক্লান্ত । আবার নিচ থেকে কিছু টাকা পয়সা চালান করা লাগে কি একটা অবস্থা নে ভাই ।

– আচ্ছা সমস্যা নেই , আল্লাহ ভরসা ।

– ভালো থাকিস সবসময় ।

– তোরাও ।

★★★

মনটা খারাপ নাকি ভালো বুঝতে পারছি না , একা একা করার কিছু নেই কাউকে বলার কিছু নেই । যদি সাহিত্যিক হতাম তাহলে বিভিন্ন গল্প কল্পনা করে রেখে দিতাম । দুঃখ-কষ্ট নিয়েই মানুষের জীবন, কিন্তু দুঃখের পর সুখ আসবে , এটাই ধ্রুব সত্য । প্রশান্ত মনই হচ্ছে শক্তির আসল ফল্গুধারা । মন প্রশান্ত হলে অন্তরের শক্তি জাগ্রত হয় এবং আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভবকে সম্ভব করে । শোষিতরা শোষিতের হাতেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় । যে কখনো সম্মান পায় নি সে জানে না অন্যকে কিভাবে সম্মান করতে হয় ।

শফিক আর রকি চলে যাবার পরে অনেক দিন পেরিয়ে গেল কিন্তু আর কেউ দেখা করতে আসলো না । পুলিশের মধ্যে কেউ আর আমার সাথে এ বিষয় নিয়ে কিছু বলে না । নিজেকে মনে হয় যেন আমি একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি । কিন্তু বুঝতে পারছি যে আমার অবস্থা বনের সেই মহিষ আর হাতির মত হয়ে গেছে ৷

( একটা গল্পের মাঝে পড়েছিলাম , একবার বনের মধ্যে একটা মহিষ দৌড়াচ্ছে তখন সিংহ তাকে বললো , কিরে দৌড়াচ্ছিস কেন ? মহিষ বললো , জঙ্গলে পুলিশ এসেছে হাতি ধরার জন্য । সিংহ বলল তুই তো মহিষ তাহলে তুই দৌড়াচ্ছিস কেন ? তখন মহিষ বললো , আরে ভাই এটা বাংলাদেশ , এই দেশে একবার ধরা পরলে ২০ বছর কেটে যাবে শুধু মহিষ আর হাতি প্রমাণ করতে করতে । “)

আমিও ঠিক তেমন করে পরে আছি , দোষী নির্দোষী প্রমাণ করতে করতে কতকাল কেটে যাবে কে জানে ? সময় এর সাথে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই আর ।

০১ মাস ২৩ দিন পরে বৃষ্টি আমার সাথে দেখা করতে আসলো । আমি বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রীতিমতো হতবাক হয়ে গেলাম , সেই রূপ নেই , আগের মতো মুখের হাসি নেই , চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে । মনের মধ্যে আৎকে উঠলো , স্যার ঠিক আছে তো ?

– বললাম , কেমন আছো বৃষ্টি ?

– ভালো আছি তুমি কেমন আছো ?

– ভালো আছি , স্যার কেমন আছেন ? সুস্থ হয়ে গেছে তো তাই না ?

– বাবা ভালো আছে , স্টোকের জন্য বাবার ডান সাইড প্যারালাইজড হয়ে গেছে । কলেজের চাকরি টা থাকবে না সেটা জানতাম আর তাছাড়া বাবার সকল টাকা পয়সা তো জলে ভেসে গেল ।

– রাফসান ভাই নাকি ফিরে এসেছে ?

– বৃষ্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো , হ্যাঁ রাফসান ফিরে এসেছে । তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা বলার জন্য দেখা করতে আসলাম ।

– বলো ।

– আমরা খুলনা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি , বাবা যেহেতু অসুস্থ তাই এ শহরে থেকে কোন লাভ নেই । তোমার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা , আমাদের আর কখনো দেখা হবে না । বিশেষ ক্ষেত্রে আমিই চাইনা আমাদের আর কখনো দেখা হোক । তোমার সাথে দেখা না করেই চলে যেতাম কিন্তু দীর্ঘ জীবনে আর কোনদিন যখন দেখা হবে না তাই ভেবে ভেবে তোমাকে সাথে দেখা করতে আসলাম । তোমার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইল , আমার বিশ্বাস তুমি খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি পাবে । তারপর নিজের এই জীবনের ধাক্কাটা কাটিয়ে আবারও নিজের পায়ে দাঁড়াবে । মানুষের জীবনে বিপদ আসবে আবার সেই বিপদ মানুষই সমাধান করবে ।

– রাফসান ভাইয়ের সাথে বিয়ে করে তাদের সাথে চট্টগ্রাম চলে যাবে সবাই ?

– মনে করো সেরকমই কিছু ।

– বুঝতে পারছি ।

– তাহলে তো ভালোই , আচ্ছা ভালো থেকো সবসময় , তোমার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে সজীব । গেলাম আমি !

– বৃষ্টি শোনো !

– হ্যাঁ বলো !

চলবে….

( নাজমা আক্তার বৃষ্টি তুমি এইটা কি করলা ? আমাকে জেলের মধ্যে রেখে তুমি তোমার খালাতো ভাইয়ের সাথে চলে যাবে ? আমি মানলেও আমার পাঠক পাঠিকা কিন্তু মেনে নেবে না ।)

লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম ( সজীব )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here