#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩৮
১১৭.
পুতুল জীবনের কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে আছে।যেখানে কে তার আপন।আর কে তার পর বুঝতে চাইছে না।মা,বাবা-র প্রেমের বিয়ে ছিল।কিন্তু সংসার বেশি দিনের হলো না।মাস কয়েক ব্যাবধানে হেরে গেলো রাজিয়ার দেখা স্বপ্নের ঘর।সেই কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো লন্ডভন্ড হলো তার জীবন।তা আর ঠিক হলো না।রাজিয়ার মতো আর কোনো মেয়ে যেন ভালোবেসে ঠকে না যায়।আর কোনো মেয়ে তার স্বপের পুরুষকে পাওয়ার আশায় মা,বাবার সম্মান কে ধূলিসাৎ না করে দেয়।যদি করে তা কিন্তু আহামরি সুখের হয় না।কিন্তু আমাদের মেয়েদের আঠারো পূর্ণ হওয়ার আগেই যে সময়টা যায়।তাতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।পর পুরুষের মিষ্টি কথায় ভুল পথে পা দিয়ে দেই।জীবনের মোড়টা তখনই পরিবর্তন হয়।মা,বাবার কোনো কথা তখন আর ভালো লাগে না।এক সময় মনে হয়।তারাই আমাদের শত্রুর।কি অদ্ভুত না।যে মা নয় মাস সন্তানকে গর্ভে নিলো।তার কথা ভাবার সময় নেই।যে বাবা তাকে মানুষের মতো মানুষ করতে দিন,রাত পরিশ্রম করছে।মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে।তার জন্য মায়া,সহানুভূতিটুকু তখন কাজ করে না।প্রেমের জোয়ারে সে ভেসেছে।তার সাথে অনাকাঙ্গিত কিছু না হওয়া পর্যন্ত থামবে না।তারপর একদিন ভালোবাসার মানুষটি তাকে মাঝ পথে ফেলে চলে যায়।তখন নিজের মধ্যে ডিপ্রেশন,হতাশা ছাপ ফেলে।নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছে যাকে।নিজের মৃত্যু চাই।অবশেষে নিজ বাড়িতেই নিজের ছোট বেলা মনে পড়ে না।তার বাড়িতে যেখানে ছোট থেকে সে হেঁসে খেলে শৈশব,কৈশর কা*টলো।তার সেই প্রিয় ঘড়টিতে একাত্বিবোধ কিছু সময় কাটতেই।নিজের বিবেকের কাছে হেরে গিয়ে গলায় ওড়না বসিয়ে মারলো টান।পায়ের নিচের চেয়ারটা লাথি মারতেই সেটা ঘরের এক কোণে পরে রইল।ফ্যানের সাথে তার প্রিয় রঙিন ওড়না ঝুলছে।তার সাথে নিজের জীবনটা সেখানেই আ*টকে।নিশ্বাস নিতে না পেরে চোখ উল্টে আসলো।হাত,পা তখন ছোড়াছুড়ি করছে।সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কেউ তার ঘরের দিকে ছুটে আসুক।আর তাকে বাঁচিয়ে দিক।কিন্তু কেউ আসলোনা।সবাই নিজেদের কাজ নিয়েই ব্যাস্ত।মা,বাবা জানলো না।তার আদরের কলিজাটা ওই ঘরের দরজা, জানালা বন্ধ করে নিজের জানটা দিয়ে দিয়েছে।যখন জানলো।যখন দেখলো।তখন কি হলো?
তখন,তখন মা,বাবার চিতকারে বাড়ির দেয়ালটাও কেঁপে ওঠে।যে সন্তানকে মা,বাবা বিশ’টা বছর লালন-পালন করলো।মানুষের মতো মানুষ বানাতে চাইলো।সেই সন্তান দুইদিনের প্রেমের জন্য।তাদের বিশটা বছরের
ভালোবাসা।তাদের স্নেহ,মায়া,মমতাকে লাথি মে’রে চলে গেছে না ফিরার দেশে।তবুও মা,বাবা সন্তানের মৃত্যু বছরের পর বছর ঘুরে যায়।তারা ভুলতে পারেনা।নামাজের শেষে মোনাজাত আল্লাহ দরবারে তাদের একটাই চাওয়া।তাদের সন্তান যেন ভালো থাকে।তাদের আযাব,তাদের কষ্ট যেন মা,বাবা নিজের করে চায়।আত্মহত্যা কখনোই সমস্যার সমাধান নয়।আত্মহত্যা করলে শুধু এই সুন্দর পৃথিবী হারাবে না।তোমার আখিরাত,তোমার জান্নাত হারালে। আত্মহত্যা জগন্য।যা আমাদের সবকিছু ঠিক করে দিতে নয়।বরং নিঃশেষ করে দেয়।আরে আত্মহত্যা কেনো করবে?যার জন্য করলে দিন শেষে দেখা যায় সে অন্য কারো সাথে খুব ভালো আছে।মাঝ থেকে তোমার মা,বাবার বুক খালি হলো।যে তোমার ভালোবাসা মাঝ পথে ছেড়ে চলে যায়।তাকে দেখিয়ে দেও।তাঁকে ছাড়া তুমিও দিব্যি ভালো আছো।আর কারো জন্য না হোক।অন্তত যাদের জন্য তুমি এই দুনিয়ায় আসলে তাদের মুখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকো।মা,বাবা-র দিকে মায়া,এবং হাসি নিয়ে তাকালেও সুন্নত আসে।তাদের জন্য নিজেকে ভালো রাখো।এবং নিজেকে শক্ত রাখো।যাতে পরিবর্তিতে তোমাকে কেউ দূর্বল ভেবে আঘাত করা তোও দূরের কথা।তোমার ব্যাপারে কিছু ভাবতে গেলেও দশবার চিন্তা করে।
পুতুলের চোখে এক অন্য সূচনা দেখা যায়।পুতুল নিজেকে একটু একটু করে শক্ত করছে।নিজের সাথে করা অন্যায় জবাব সে ঠিকই ফিরিয়ে দেবে।সেটা সময়ের সাথেই দিবে।পুতুল বাড়িতে ফিরে এসেছে।সেই ঘটনার আজ পনেরো দিন হতে চলল।পুতুল বেঁচে আছে।এবং সুস্থ আছে।এতটুকুতেই বাড়িটায় আবারও প্রাণ ফিরে আসে।সবার মুখে হাসি ফুটে।তাকে নিয়ে মামা,মামী,ছোট তিন ভাইয়ের আহ্লাদে শেষ নেই।কিন্তু মামাকে নিজের সুস্থতার খবরটুকু ব’লে সেই যে ঘরে খিল দিয়েছে।আর বের হয়নি।নিজের ক্যারিয়ার গড়তে পুরোটা সময়ই বইয়ের মধ্যে দিয়েছে।সামনে তার এইচএসসি পরীক্ষা।এরপর তার স্বপ্নের দিকে আরেক পা এগিয়ে যাওয়া।
পুতুলের মনে কি চলছে তা রাবেয়া জানে না।শুধু এতটুকু জানে মেয়েটা বাঁচুক নিজের মতো করে একটু বাচুঁক।তারপর সময় করেই না হয় ছেলের জন্য হাত চেয়ে নিবেন।কিন্তু অর্পণকে হারানোর ভয়টা মনের মাঝে গাড়ো হয়েছে।তাইতো অসীম তালুকদার ছেলের জন্য পুতুলের কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব রাখতেই সে বেঁকে বসে।এসব বিয়ে সাদি সে করবে না।আর যখন শুনলো অর্পণ তালুকদার তাকে ভালোবাসে।সেটা আজ থেকে নয়।অনেক বছর ধরে তখন পুতুলের বিবেক নাড়া দেয়।একে তোও বিয়ে করবে না।তার ওপর প্রেমের বিয়ের কথা, প্রশ্নই আসে না।তখনই সাফ সাফ না করে দেয়। অসীম তালুকদার পুতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
আম্মু আপনাকে জোর করার সাধ্য আমার নেই।আমি শুধু আমার ছেলের দিকটা ভেবেই বলেছিলাম।আপনার দিকটা একবারও ভাবা হয়নি।আসলে মেয়ের বাবা কখনো হয়নি তোও।তাই বুঝতে পারিনি।একটা মাত্র ছেলে।তার কষ্টটা চোখে দেখতে পারছিলাম না।তার কান্না,তার কষ্ট,তার আপনাকে হারানোর ভয়টা।আমি বাবা হয়ে মানতে পারিনি।তাই সেই তালেপুর গ্রাম থেকে ছুটে আসছি। চেয়ারম্যান হয়ে নিজের লোকের দ্বারা প্রস্তাব পাঠাই নিই।ভাবলাম ছেলের জন্য আর কিছু হোক বা না হোক।সে একটা ভালো কাজ করেছে।ওহ আপনার মতো নরম মেয়েকে ভালোবেসেছে।আপনার মতোও মেয়ে যে ঘরে যাবে।তার কষ্ট নামক জন্তনা থাকবে না।
আপনি হচ্ছে আসমানের চাঁদ।আপনাকে আমার বাড়ির পুত্রবধূ করে নয়।একটা মেয়ে করে নিয়ে যেতে চাই।যার অভিভাবক,যার মা,বাবা হওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হবে।আমার ঘরে কোনোকিছুরই কমতি নেই।তবে হ্যা,একটা মেয়ের কমতি ছিল।কিন্তু আপনাকে পেলে সেই কমতি আর থাকবে না।আমার একটা মেয়ের বাবা হওয়ার যে ইচ্ছে, যে আপসোস ছিল!তা আর থাকতো না।কিন্তু আপনাকে আমি জোর করতে পারিনা।ছেলের জন্য খারাপ লাগছে।কিন্তু সয়ে নিব।ছেলে হয়তো একটু আকটু পাগলামি করবে।তবুও সমস্যা নেই মানিয়ে নিতে পারব।আজ পর্যন্ত কখনো কেউ আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় নিই।সেটা নিজ ব্যাবসার কাজে কিংবা মানুষের জন্য সমাজ সেবায়।আমাদের পারিবারিক বিজনেস আমাকে দুই হাতে উচ্চ শেকড়ে টেনে নিয়ে গেছে।সমাজ আর মানুষকে যেমন সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলাম।তেমনই তাদের ভালোবাসা,দোয়া আর সম্মান দুই হাতে কুড়িয়ে পেয়ে ছিলাম।কখনোই খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় নিই।এই প্রথমবার কেউ আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।আর আমি চুপচাপ মেনে নিলাম।তবে মেয়ের বাবা না হওয়ার আপসোসের পাশাপাশি আরেকটা যোগ হলো।আমি আমার সন্তানের জন্য এই প্রথম কিছু দিতে পারলাম না।সে সব সময় বলতো তার একটা জিনিস চাই।প্রত্যেক জম্মদিনে এটাই তার সর্বপ্রথম ওহ সর্বশেষ বুলি হতো।আমি বলতাম কি চাও।কিন্তু সে বলতো সময় হোক চেয়ে নিব?আর আমি হেঁসে সায় দিতাম।আর আজ তার ত্রিশতম জম্মদিনে তার প্রিয় ভালোবাসার মানুষটিকে চাইছে।কিন্তু আমি তার বেস্ট গিফটটা দিতে পারলাম না।সে অপেক্ষায় থাকবে।কিন্তু তাকে বলার মতো শব্দ আমার মুখে আর আসবে না।তোমার নতুন জীবনের জন্য দোয়া রইলো।
অসীম তালুকদার নিরাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে।অপরদিকে পুতুল তার যাওয়ার প্রাণে তাকিয়ে রইলো।মানুষটা তার কাছে এক মুঠো আশা নিয়ে এসেছিলো।দেখা করলো কালো পর্দার আড়ালেই দাঁড়িয়ে।কথাও বলল।কিন্তু তার পরবর্তীতে পুতুল নিজ লিখাটায়।তার বক্তব্য জানিয়ে দিতেই অসীম তালুকদারের মুখের হাসি কালো আঁধারে ঢাকা পরে।পুতুল নতুন করে সংসার নিয়ে ভাবতে চায় না।তার ওপর যাকে ঘৃনা করে তাকে ভালোবাসবে কি করে?আর ভালোবাসা সবার জন্য রঙিন হলেও পুতুলের কাছে তা শুধুই নীল বিষ।যার বিষে তার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল।তাতে সুখ কম দুঃখের গল্পটা একটু বেশিই।আর এমন জীবন পুতুল চায় না।তাই তোও বাবার মতো লোকটা তার দূয়ার এসে হাত বাড়াতে চাইলো।মেয়ে ব’লে স্বীকৃতি দিতে চাইলো।তাকেই প্রত্যাখান করলো।পুতুল এসব প্রেমের মায়া জড়াবে না।সে তার স্বপ্ন নিয়েই ব্যাস্ত।
চলবে….
পর্বটা তাড়াহুড়ো করে লিখেছি।গল্পের মেইন চরিত্রটা পুতুলের।আর বাকি সবাই দুধ ভাত।