দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ২৪ (শেষ অংশ) #আদওয়া_ইবশার

0
558

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৪ (শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার

রাকিবকে দুঃখি দুঃখি ভাব নিয়ে তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে চটে যায় দৃষ্টি। চোখ পাকিয়ে মেজাজ দেখিয়ে বলে,

“সাহস কত! রক্তিম শিকদারের বউয়ের দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে ! চোখ সরান বলছি এক্ষুণি। নইলে কিন্তু ঐ চোখ তুলে কুতকুত খেলব আমি।”

তৎক্ষণাৎ রাকিবের ফাঁকা ঠোঁট দুটো একটা আরেকটার সাথে চেপে যায়। ঘনঘন পলক ঝাপটে অসহায় কন্ঠে বলে,

“এইটা কিছু হইলো সুন্দরী? তুমি এইভাবে আমারে ছ্যাকা না দিলেও পারতা।”

তার এহেন সাহস দেখে ভড়কে যায় দৃষ্টি। সে বর্তমানে রক্তিম শিকদারের বউ। এটা জানার পরও কিভাবে এই চামচা তাকে সুন্দরী ডাকে? এর একটা বিহিত আজকে করতেই হবে। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“চামচার বাচ্চা চামচা! পিঁপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে, কথাটা শুনেছেন তো! যদি বিয়েশাদী করার আগেই মরার শখ না জাগে তবে আজকের পর যেন কখনো আমাকে ঐ নামে ডাকা না হয়। সুন্দর ভাবে, ভদ্রভাবে ভাবি ডাকবেন আমাকে। না না, শুধু ভাবি ডাকলে হবেনা। ভাবির সাথে মা যোগ করে ভাবিমা ডাকতে হবে। এখনই একবার ভাবিমা ডাকুন। দ্রুত।”

মুখ বাঁকায় রাকিব। তাচ্ছিল্যতার সাথে বলে,

“অ্যাহ্! আসছে ভাবিমা! শখের তুলা আশি টাকা না?এই রাকিব মরতে স্বীকার তবুও তোমার মতো সুন্দরীরে ভাবি ডাকতে স্বীকার না। সেখানে কি না ভাবিমা! নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফেরুল্লাহ।”

তার এহেন কথায় রাগে যেন এবার দিশাহারা দৃষ্টি। গরম চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে জানতে চায়,

“ডাকবেন না ভাবিমা?”

“কখনোই না।”

“এই শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি, ডাকবেন না ভাবিমা?”

এবারও অস্বীকার যায় রাকিব। দৃষ্টি সাথে সাথে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় যে পাশে রান্নার সামগ্রী সাজিয়ে রেখেছে সেখানে চলে যায়। কাটাকুটির জন্য মাঝারি সাইজের একটা বটি এনেছিল ঐদিন বাজার থেকে। সেটা হাতে নিয়ে খ্যাপা বাঘিনীর মতো তড়িৎ বেগে ছুটে আসে রাকিবের কাছে। চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

“তবে মর আজকে এই সুন্দরীর হাতে। ভালোই ভালোই বলছিলাম কথা কানে নিলিনা। এবার জান দিয়ে কর্মফল ভোগ কর।”

হতভম্ব রাকিব দৃষ্টির আচানক আক্রমণাত্মক রূপ দেখে ঘাবড়ে যায়। লাফিয়ে সোজা ঘরের সীমানা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। দৌড়ের সাথে তুতলিয়ে বলে,

“এ কেমন সর্বনাশা কান্ড। সুন্দ.. থুক্কু ভাবিমা! মেহেরবানী করিয়া হাত থেকে ঐটা রাখেন। আপনি খুন করে জেলে গেলে আমার ভাইকে সন্নাস জীবন পাড় করতে হবে। শুধু আপনি কেন? আজ থেকে পৃথিবীর সকল সুন্দরী আমার মা। কালো গুলোর থেকে যেকোন একটা আমার বউ। এবার হাত থেকে ঐটা সরান।”

রাকিবের কথা শেষ হবার আগেই পকেটে থাকা ফোনটা বেজে ওঠে। খ্যাপা বাঘিনীর সামনে দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করে কথা বলার সাহস হয়না তার। বাড়ির ছোট্ট উঠোন পেরিয়ে গেটের বাইরে গিয়ে সিএনজিতে বসে বুকে হাত দিয়ে কতক্ষণ বিরবির করে বলে,

“এ কেমন বউ রে ভাই! যেমন খ্যাপা গুন্ডা শিকদার তেমন তার খ্যাপা বাঘিনী। একেবারে খাপে খাপ, মর্জিনার বাপ।”

মুখ গোল করে কতক্ষণ লম্বা শ্বাস টানে। মস্তিষ্ক শান্ত হতেই তৎপর হয়ে পকেট থেকে ফোন হাতে নেয়। রিসিভ করে কানে ধরতেই ঐপাশ থেকে ভেসে আসে রক্তিমের গালির বর্ষণ। চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ধেয়ে আসা একের পর এক গালি হজম করে নেয় রাকিব। দ্বিতীয়বার ঐ বাঘিনীর সামনে যাবার সাহস না থাকাই রক্তিমকেই সাহস যুগিয়ে বলে,

“কি একটা মাইয়ারে বিয়া কইরা ঘরে তুলছেন ভাই! মাইয়া তো না পুরাই বোম্বাই মরিচ। আপনার ঐ বোম্বাই মরিচ আপনি আইসা নিয়া যান। আমার দ্বারা সম্ভব না। মাফ করেন।”

কথাটুকু শেষ করে তৎক্ষণাৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে একেবারে ফোন অফ করে রাখে রাকিব। সিএনজি ড্রাইভারকে নিজের বাসার ঠিকানা দিয়ে শরীর ছেড়ে সিটে বসে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এক দিকে বউ বটি হাতে জান নিতে তাড়া করছে। অপরদিকে স্বামী বাংলা গালিতে কান পচিঁয়েছে। কি ভয়ানক পরিস্থিতি! বাপের জন্মে মনে হয় আগে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়নি।গোল্লায় যাক সব কিছু। আজকের ঘটনা যতদিন পর্যন্ত রাকিবের মন-মস্তিষ্কে থেকে যাবে ততদিন পযর্ন্ত এই বাঘ, বাঘিনীর সামনে পরবেনা সে। প্রয়োজনে হাতে চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকবে। তবুও এদের সামনে পরবেনা। কি সাংঘাতিক বাবা রে বাবা! একটুর জন্য তার জানটা বেঁচে গেল।

****
রাকিব বিদায় নেবার কতক্ষণ পরই উদ্ভ্রান্তের মতো বাড়ি এসে উপস্থিত হয় রক্তিম। তার এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় দৃষ্টি। উৎসুক হয়ে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় দৃষ্টির কোমল হাতটা আকড়ে ধরে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায় বাড়ির সীমানা ছেড়ে। হতবম্ভ দৃষ্টি মনের প্রশ্ন মনেই চেপে রাখে। রক্তিমের এমন বেহাল অবস্থা দেখে চিন্তার পাশাপাশি তার আচমকা অধিকার খাটানো স্পর্শে দৃষ্টির মন জমিনে সৃষ্টি হয় অনুভূতির আন্দোলন। একদিকে হঠাৎ স্পর্শে হৃদয়ের উচাটন, অন্যদিকে চিন্তা। দুইয়ে মিলে স্তব্ধ দৃষ্টি।

বাহারি রঙের ঝলমলে আলোয় সজ্জিত শিকদার বাড়ি। চারিদিকে উৎসব মুখোর আমেজ। বিয়ের পর এই প্রথম স্বামীর হাত ধরে শশুড়ালয়ে পা রাখল দৃষ্টি। এ যেন সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে এক অন্যরকম অনুভূতি। যে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা দৃষ্টির ক্ষেত্রে কষ্টসাধ্য। দৃষ্টির হাত নিজের শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দি রেখেই লম্বা কদমে সদর দরজা ডিঙিয়ে হলরুমে উপস্থিত হয় রক্তিম। চারিদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেসব কিছুই যেন ঢুকছেনা তার মস্তিষ্কে। মমতাময়ী মায়ের সন্ধানে ছটফট করছে তৃষ্ণার্ত চোখ দুটোর কুচকুচে কালো মণি। কাঠিন্যতার খোলস ভেঙ্গে বাচ্চাসুলভ হৃদয়টা ব্যকুল হয়ে আছে মায়ের ভালোবাসার ছোট্ট একটা স্পর্শে স্বর্গীয় সুখ পাবার লোভে। রক্তিমের আকুল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে একসময় চোখের সামনে স্পষ্ট হয় মায়ের আদল। এক পলক মা’কে দেখেই তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে মাথা ঝুঁকিয়ে নেয় রক্তিম। আলগা হয় হাতের বাঁধন। নিজের শক্ত হাতের মুঠো থেকে মুক্তি দেয় দৃষ্টির নরম হাতটা। অবাক হয় দৃষ্টি। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের নত মুখের দিকে। রক্তিম আসার খবর পেয়ে এতোক্ষনে শিকদার বাড়ির সকল আত্মীয়-স্বজন ভীড় জমিয়েছে ড্রয়িং রুমে। যে রক্তিম শিকদার সর্বদা বুক ফুরিয়ে কঠোর চিত্তে মাথা উচিঁয়ে ঘুরে বেড়ায়। আজ সেই রক্তিম শিকদার মায়ের সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কোনো এক বাচ্চা বড়সড় কোনো ভুল করে মায়ের সামনে অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে। এমন এক অকল্পনীয় দৃশ্য দেখার পর কারো চোখ স্বাভাবিক থাকতে পারে? অত্যধিক আশ্চর্যিত ভঙ্গিতে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ দৃষ্টিতে অঘাত বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে মা-ছেলের দিকে।

কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে বিয়ে বাড়ি একদম নিশ্চুপ। দুরু দুরু বুকে মায়ের দিকে এগিয়ে যায় ইতি। কাধে হাত রেখে চাপা স্বরে বলে,

“তোমার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে মা। শুধুমাত্র তোমার একটা ডাকের অপেক্ষায়। আর দূরে সরিয়ে দিয়োনা। সমস্ত মান-অভিমান ভুলে কাছে টেনে নাও প্লিজ!”

রেহানা বেগম নিরব মূর্তিমান দাঁড়িয়ে। মৌনতা ভেঙ্গে কন্ঠলানী দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়না। অপলক তাকিয়ে শুধু দেখে যায় নত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা সন্তানকে। যে সন্তান তাকে প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ বুঝিয়েছে। আদো আদো কন্ঠে মা ডেকে মন, প্রাণ জুড়িয়েছে। স্বার্থক করেছে নারীসত্তাকে। সেই প্রথম সন্তান যে সন্তান নিজের ছোঁয়ায় পূর্ণ করেছে নারীসত্তাকে,সেই আদরের টুকরোটাকে এতোদিন পযর্ন্ত বাড়ি ছাড়া রেখেছে রেহানা বেগম। একটা ভুলের শাস্তিস্বরুপ মায়ের কোল থেকে তাড়িয়ে বানিয়ে দিয়েছে এক ছন্নছাড়া পথিক। মা হয়ে সে কিভাবে পেরেছিল প্রথম সন্তানের প্রতি এতো কঠোর হতে?পথভ্রষ্ট করে এলাকার গুন্ডা, মাস্তানে পরিণতি করেছে আদরের সন্তানকে। এ যন্ত্রণা যে এতোদিন পর বড্ড পুড়াচ্ছে রেহানা বেগমকে। সন্তান শত অন্যায় কাজ করলেও কি কখনো কোনো মা পারে এভাবে দূরে সরিয়ে দিতে? রেহানা বেগমের মাতৃহৃদয় তো এতো কঠোর ছিলনা। তবে কিভাবে এতো বড় অন্যায় করে বসল নিজের সন্তানের প্রতি! ছেলেকে এভাবে অবহেলায় পথভ্রষ্ট করে সে নিজেও তো বর্তমানে এক অপরাধী নিজের বিবেকের কাছে। এ বিবেক কেন আগে জাগ্রত হয়নি? নির্দ্ধিধায় এতো বড় অন্যায় করার পরই কেন আজ এতোদিন পর উপলব্ধি হচ্ছে তা? নিজের বিবেকের কাছে নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ আজ রেহানা বেগম। সাহস হচ্ছেনা মায়ের দাবী নিয়ে রক্তিমের সামনে দাঁড়াতে। তবে না দাঁড়িয়েও যে উপায় নেই। বিবেক জাগ্রত হবার পরও কিভাবে পারবে ছেলেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। মায়ের মনটাও যে আর বাঁধা মানছেনা। সমস্ত দ্বিধা,জড়তা কাটিয়ে ইচ্ছে করছে সন্তানকে কাছে টানতে। রেহানা বেগমের কোমল মাতৃহৃদয় যখন দ্বিধা, জড়তা, অপরাধবোধে পৃষ্ঠ হয়ে ব্যর্থ সন্তানকে বুকে টেনে নিতে। তখনই উন্মোচন হয় অভিমানী মাতৃসত্তা। কান্নার ঢোক গিলে অভিমানে ঠাসা দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“আমি না হয় পাগল-মাথা নষ্ট, বিবেকহীন হয়ে মায়া মমতা সব ভুলে গিয়েছিলাম। তাই বলে তুই ও সব ভুলে যাবি? এই শিক্ষা দিয়ে তিলে তিলে বড় করেছি তোকে? আমার জানা মতে কোনো সন্তানকেই তো আমি কঠোর হবার শিক্ষা দেইনি। সন্তান যাতে কোমল হৃদয়ের অধিকারী হয় সেজন্য নিজের সমস্ত মায়া, মমতা ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে বড় করেছি। তবে কেন আমার একটু কঠোরতা দেখে তুই তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দিয়েছিস? কেন আমি বকলেই দূরে সরে যেতে হবে তোকে? কেন পারিস নি মায়া দেখিয়ে আমাকে মানিয়ে নিতে? একবার আমাকে জড়িয়ে ধরে মা বলে ডাকলে কি পারতাম এতোটা পাষাণ হতে? এতো বড় হবার পরও মা’কে কিভাবে মানাতে হয় সেটা জানলিনা। জানলি শুধু মা’কে কিভাবে সমাজের চোখে অপরাধী বানিয়ে রাখতে হয়। অপদার্থ কোথাকার!”

প্রতিবারের মতো এবারও মায়ের অভিযোগের তীরে বিদ্ধ রক্তিম। তবে এবারের অভিযোগ গুলো হৃদয়ে একটুও রক্তক্ষরণ ঘটায়নি। বরং মনে হচ্ছে হঠাৎ যেন লিলুয়া বাতাস মাতাল হাওয়ায় রূপবদল করেছে। সেই এক দলা মাতাল হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে ধীকধীক জ্বলতে থাকা অগ্নিশিখা ধপ করেই নিভিয়ে দিয়ে গেছে। স্বস্তির অনুভূতিতে জুড়িয়ে গেছে খরাপ্রবণ মন জমিন। এবার শুধু মায়ের মমতার পরশে সেই খরা প্রবণ মন জমিনে ঝুমঝুমিয়ে শীতল বর্ষণ নামার পালা। যে বর্ষণে হৃদয় কুটিতে জমে থাকা দগদগে ক্ষত পরিষ্কার হয়ে নতুন উদ্যোমে নেমে আসবে একরাশ স্নিগ্ধতা।

রক্তিমকে আগের মতো নত মস্তকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাহস করে দৃষ্টি রক্তিমের একটা হাত আকড়ে ধরে। উদ্যোমী স্বরে বলে,

“সময় এসেছে ভুল-ভ্রান্তি সুধরে নিয়ে নতুন করে পথ চলার। নিজেকে এবার অন্ধকার থেকে বের করে আনুন। মা-বাবার কাছে সন্তান কখনো বড় হয়না। এগিয়ে যান মায়ের কাছে। মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন। উগলে দিন ভিতরে জমে থাকা সবটুকু কষ্ট। মাথা তুলে তাকান। দেখুন ঐ মানুষটা চোখে-মুখে কত আকুতি নিয়ে তাকিয়ে আছে। একটাবার মা বলে ডেকে দেখুন। সব ভুলে আপনাকে নিজের কোলে ঠাই দিবে। মায়ের কাছে সন্তান কখনো খারাপ হয়না। মায়েরা উদার হয়। তারা কখনো সন্তানের ভুল মনে রেখে আজীবন সন্তানের থেকে দূরে থাকতে পারেনা।”

থমথমে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে সকলের মাঝে। উপস্থিত প্রত্যেকে মৌনতা বজায় রেখে মুখিয়ে আছে মা-ছেলের মিলন মুহূর্ত দেখার অপেক্ষায়। একটু একটু করে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারাচ্ছে রক্তিম। শরীরটা একেবারে ভেঙ্গে আসছে। বন্ধ চোখ জোড়া কেমন জ্বারাপোড়া করছে। মনে হচ্ছে চোখ মেলে তাকালেই ফেঁটে রক্ত গড়িয়ে পরবে। মাথাটাও ঝিমিয়ে আছে। দাঁতে দাঁত পিষে টলতে টলতে মায়ের দিকে এগিয়ে যায় রক্তিম। কান্না গুলো জমাট বেঁধে লাল হয়ে ওঠা চোখ দুটো মেলে তাকায় মায়ের দিকে। সাথে সাথে টুপটাপ দুচোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পরে দু-ফোঁটা নোনাজল। পাষাণ রক্তিমের চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে! বিষয়টা দৃষ্টিগোচর হতেই এক প্রকার হোচট খায় উপস্থিত সকলেই। সেদিকে রক্তিমের কোনো ধ্যান নেই। হাঁটু মুড়িয়ে ধপ করে বসে পরে মায়ের সামনে। নিজের দুহাতের মাঝে মায়ের হাত দুটো যত্ন করে তুলে নিয়ে কপালে ঠেকায়। কাঁপা স্বরে বলে,

“জানি আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। তবুও পারলে এই পাপী সন্তানকে ক্ষমা করে দিও। সন্তান ভেবে বুকে টেনে নিতে হবেনা। শুধু একটু দয়া দেখিয়ে ক্ষমা করে আমাকে স্বস্থির নিঃশ্বাস নিতে দাও। আর কোনো অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিওনা আমার উপর। হাজারটা অপরাধের ভারে এখন আমি ম্রিয়মাণ। হাঁপিয়ে গেছি। হারিয়ে ফেলেছি সহ্যক্ষমতা। এতোদিনের কঠোরতার খোলসে আবৃত আমিটা আজ খোলস ছেড়ে বড্ড নাজুক। একটু করুনা করো আমাকে। বাঁচতে দাও অপরাধবোধ থেকে। মুক্তি দাও আত্মগ্লানি থেকে। যদি ক্ষমা না পাই, প্রতিটা প্রহর বেঁচে থেকেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে আমায়। জীবন্ত লাশ হয়ে আর বাঁচার ক্ষমতা নেই আমার। হয় সুস্থ্যভাবে বাঁচতে দাও। না হয় একেবারে গলা টিপে মেরে ফেলো। তবুও মুক্তি দাও।”

ছেলের করুন আহাজারি আর চোখের অশ্রু এলোমেলো করে দেয় রেহানা বেগমকে। বক্ষদেশে সৃষ্টি হয় তোলপাড়। বিমূঢ় দৃষ্টিতে কতক্ষণ পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকা ভঙ্গুর রক্তিমের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকায় নিজেও বসে পরে মেঝেতে। পাগলপ্রায় হয়ে জাপ্টে ধরে রক্তিমের মাথাটা বুকে টেনে। সহসা পুরো বাড়ি কেঁপে ওঠে এক মায়ের করুন চিৎকারে। মায়ের কান্নায় পাথর হৃদয়ের রক্তিম নিজেও বাচ্চাদের মতো মা’কে ঝাপটে ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ওঠে। এক তৃষ্ণার্ত মা-ছেলের মহামিলনের সাক্ষী উপস্থিত প্রতিটা মানুষের চোখের কোণেও জল জমে। শান্তিপ্রিয় আজীজ শিকদারের চোখের কোণেও আজ অশ্রু। তবে তা ব্যর্থতার নয়। অদম্য খুশি গুলো আজ যেন সকলের চোখ বেয়ে কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রেহানা বেগমের গগনবিদারী চিৎকার যেন পুরো পৃথিবীকে জানান দিতে চাইছে, তোমরা দেখো। আমার ছেলে আজ আমার বুকে ফিরে এসেছে। শেষ হয়েছে মা-ছেলের নিরব যুদ্ধ, মান-অভিমানের পালা। মমতাময়ী মায়ের পরশে পাষাণতুল্য রক্তিমের চোখ দুটোও আজ সিক্ত। মায়ের আদুরে পরশে তৃপ্ত মৃতপ্রায় হৃদয় জমিন।

চলবে…..

(গতকাল বিশাল একটা পর্ব লিখে আবার নিজের ভুলেই সেটা ডিলেট হবার পর আজ একদম লেখায় মন বসাতে পারছিলাম না। সারাদিনে আর সন্ধ্যার পর থেকে একটু আগ পযর্ন্ত বহু কষ্টে এটুকু লিখেছি। শুধুমাত্র আপনাদের অপেক্ষার অবসান ঘটানোর জন্য। ভালো হোক খারাপ হোক, দয়া করে নিজেদের অনুভূতি জানিয়ে এবার আমার অশান্ত মনটাকে একটু শান্ত করবেন। অনুরোধ রইল।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here