#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৫||
৭০।
পুষ্প বাসায় এসেই উজ্জ্বলকে আহির ব্যাপারে জানালো। সব শুনে উজ্জ্বলের চোখেমুখে বিষণ্ণতা ছেয়ে গেলো। এমন কিছু শুনবে সে আশাও করে নি। উজ্জ্বল পুষ্পকে বলল,
“আমাকে আহির ফোন নম্বরটা দে।”
পুষ্প বলল,
“সিমটা ওর বাবার নামে রেজিস্ট্রার করা। ফোনে বেশি কথা না বলাই ভালো।”
“চিন্তা করিস না। দেখা করেই কথা বলবো।”
পরের দিন উজ্জ্বল আহিকে কল করলো। আহি কল রিসিভ করতেই উজ্জ্বল বলল,
“তোমার প্রিয় রেস্টুরেন্টের নাম বলো?”
আহি শুরুতেই এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। ওপাশে নিরবতা দেখে উজ্জ্বল বলল,
“আহি, শুনতে পারছো?”
“হ্যাঁ, আপনি!”
“গলার স্বর শুনেও চিনতে পারছো না? ওহ আচ্ছা, ফোনে তো আমাদের প্রথম কথা হলো।”
“আচ্ছা, চিনেছি। উজ্জ্বল ভাইয়া।”
উজ্জ্বল চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“একদম চমৎকারভাবে চিনলে। মনটা লাফিয়ে উঠলো।”
“মানে?”
“মানে টানে পরে হবে৷ আগে দেখা করো। কথা আছে।”
আহি একটা রেস্টুরেন্টের নাম বললো। উজ্জ্বল বলল,
“ওকে, আজই দেখা হচ্ছে তাহলে। বিকেলেই আসি। বিকেলের শহর অনেক চমৎকার। আর কাল থেকে রোজা শুরু। এরপর সব বন্ধ হয়ে যাবে। তাই আজই দেখা করি।”
আহি হাসলো আর বলল, “আচ্ছা।”
(***)
আহি বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো। অনেকদিন পর আবার সেই রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে আহি। লিনাশার সাথে কফি খেতে প্রায় সেখানে যাওয়া হতো। কলেজ ছুটির পর লিনাশা আর আহি সেই রেস্টুরেন্টে এসে এক ঘন্টা বসে আড্ডা দিতো। এখানের বার্গারটাও তাদের প্রিয় ছিল। আহি রিকশা থেকে নেমেই কিছুক্ষণ রেস্টুরেন্টটের গেটের দিকে তাকিয়ে ছিল। পুরোনো হয়ে গেছে গেটটি। এই কয়েক বছরে শহরে অত্যাধুনিক সব রেস্টুরেন্ট খুলেছে। এই জায়গাটা সেই তুলনায় কিছুই না। শুধু স্বাদের কারণে এখনো টিকে আছে। আহি ভেতরে ঢুকতেই দেখলো সেই ফোন বুথের পাশে রাখা এক জোড়া চেয়ার। রেস্টুরেন্টটির আকর্ষণীয় স্থান এই ফোন বুথ। পুরোনো দিনের স্মৃতি হিসেবে রাখা। এখানে যারা এসেছে, এই বুথে ঢুকে টেলিফোন রিসিভার কানে নিয়ে একটা ছবি না তুলে কখনো যায় নি। আহি আর লিনাশাও এই কাজ করেছে। ছবিটা লিনাশার কাছেই ছিল।
অতীত মনে পড়তেই আহির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। সে এবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে উজ্জ্বলকে খুঁজতে লাগলো। নিচ তলায় বসার জায়গা অল্প। উপরেই বিস্তর পরিসরে বসার ব্যবস্থা আছে। আহি উপরে উঠে দেখলো দক্ষিণের খোলা আসনে আয়েশ করে বসে আছে উজ্জ্বল। আহি তার সামনে এসে দাঁড়াতেই উজ্জ্বল তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আহিকে বসতে বললো।
আহি আর উজ্জ্বল মুখোমুখি বসে আছে। দু’জনই নিরব। সৌজন্যমূলক হাসি হেসে উজ্জ্বল বলল,
“কি অর্ডার করবো?”
আহি মুচকি হেসে বলল, “জাস্ট কফি।”
“আর কিছু?”
“উহুম।”
উজ্জ্বল দু’কাপ কফি অর্ডার করে টেবিলের উপর দুই হাত রেখে ঝুঁকে বসলো। আহি বলল,
“ভালো আছেন?”
উজ্জ্বল হেসে বলল,
“আমি তো বেশ বিন্দাস থাকি। তুমি বলো, কি অবস্থা তোমার!”
“ভালোই।”
“মোটেও না। পুষ্প আমাকে জানিয়েছে সব।”
আহি মলিন মুখে বললো,
“না ঘুরিয়ে সোজাসুজিই বলি। আমি আসলে তাজওয়ার খানকে বিয়ে করতে চাই না। এর জন্য অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ আছে। ওর সম্পর্কে অনেক খারাপ তথ্য আছে। কয়েক মাস আগেই ওর এক্স আমাকে ওর ব্যাপারে অনেক কিছুই বলেছে। ওর নারী আসক্তি বেশি। আর এমন একজনকে জেনেশুনে কেউ বিয়ে করতে চায়বে না। এরপর ওর পারিবারিক পরিবেশ বেশ উৎশৃঙ্খল। ওখানে আমি এডজাস্ট করতে পারবো না। সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার হলো, বাবা আমাকে একপ্রকার বাধ্য করছে। হুমকি দিচ্ছে। তাজওয়ারের বাবা আমার নানাকে গুম করিয়ে ফেলেছে। উনার লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাই নানু-মামারা আমাকে নিতে চায় না। মাকেও তারা সাহায্য করছে না। আমি এখন কি করব?”
“কখনো পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো নি?”
“মা আর আমি পালিয়ে গেলাম না হয়। কিন্তু এরপর আমার বন্ধুরা, তাদের পরিবার, আমার মায়ের পরিবার, সবার জীবন সংকটে পড়বে।”
“তোমার মনে হয় তোমার জন্য এতোগুলো মানুষের ক্ষতি করবে?”
“রাদ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। প্রথম আঘাত তো ওকেই করবে। আর ওর কিছু হলে আমি কি সহ্য করতে পারবো? মামাদের কিছু হলে মা কি সহ্য করতে পারবে? আর এভাবে পালিয়ে কতোদিন? একটা পার্মানান্ট সলিউশন দরকার।”
উজ্জ্বল চুপ করে রইলো। টেবিলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মিনিট খানিক। গম্ভীরমুখে কি যেন ভাবছে সে। আহি হতাশ হয়ে পড়ছে। একটা পথ কি আদৌ খুলবে না-কি উজ্জ্বল অপারগ হবে। নিরবতা ভেঙে উজ্জ্বল বলল,
“তুমি সময় নাও। রিলেক্স থাকো। তাজওয়ারের সাথে এমন একটা ব্যবহার করবে যেন তুমি ওকে ভালোবাসো না, আবার বিশ্বাস করতে চায়ছো। তোমার বাবার ব্যাপারে তুমি যতোটা নেগেটিভ সবটাই তার সাথে শেয়ার করবে। তোমার সৎ মায়ের সাথেও তোমার মনোমালিন্য হয়। তুমি তোমার সেই ফ্রাস্ট্রেশন ওর সামনে প্রকাশ করবে। ও তোমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য অনেক কিছুই বলবে। তখনই তুমি ওর সান্ত্বনায় শান্ত হয়ে ওকে এটা বোঝাবে, বাবার চেয়ে তুমি ওকে বেশি বিশ্বাস করো। আর এরই মধ্যে ঠান্ডা মাথায় তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। তোমার বাবার আর লাবণির ব্যাংক ডিটেইলস নেওয়া শুরু করো।”
“এসব দিয়ে কি হবে?”
“যারা অনেক টাকার মালিক, তাদের অবৈধ টাকায় তাদের নিয়ে ডুবে। একবার যদি এমন কোনো শক্ত খবর পাওয়া যায়, তোমার বাবা তো সোজা লক আপে। এখন বোকার মতো কেইস করে কোনো লাভ নেই। আগে প্রমাণ যোগাড় করো। বিয়ে তো এখন হচ্ছে না। তাহলে অধৈর্য হচ্ছো কেন? এই একমাসে তুমি এই কাজটিই করবে। আর তাজওয়ার মুসলিম ছেলে। অন্তত রোজার মাসে তোমাকে বিরক্ত করবে না। তুমিও ওকে একটু ধর্মের কথা শোনাবে। এই একমাস তোমার জন্য প্লাস পয়েন্ট। প্রথম কাজ তোমার বাবাকে সরানো। আর এই কাজে তোমাকে সাহায্য করবে তাজওয়ার নিজেই। তুমি এমনভাবে ওকে ফাঁসাবে, যাতে ও নিজেই তোমার বাবাকে পথে বসিয়ে দেয়। আর এরপর ওকে ফাঁসানো অনেক সহজ। কিন্তু স্বল্প সময়ের জন্যই পারবে। তাই তাজওয়ারের বিরুদ্ধেও শক্তপোক্ত প্রমাণ লাগবে।”
“আমি কি পারবো এসব করতে?”
“দেখো, তোমাকে তো পারতেই হবে। আমি তোমাকে আশ্বস্ত করছি আমি আমার সাধ্যের মধ্যে সবটা করবো। দেখো আহি, এরা প্রভাবশালী। এদের সাথে বাগবিতণ্ডায় জেতা যায় না। বুদ্ধি দিয়ে খেলতে হয়। তুমি তাদের বিরুদ্ধে যতো ব্রেইন ইউজ করবে। তত তারা তোমার পেছনে থাকবে আর তুমি জয়ের সন্নিকটে পৌঁছাবে। এতেও যদি কাজ না দেয় তাহলে সেই স্টেপটা নিতে হবে, যেটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। কিন্তু আমার মনে হয় সেই স্টেপটা আপতত ভুলে যাওয়া ভালো।”
“কোন স্টেপ?”
“এটা আমি এখন তোমাকে বলবো না। দেখা যাবে এটা মাথায় ঢুকলেই তুমি অস্থির হয়ে সেই কাজ করে ফেলবে।”
“সুইসাইড!”
“পাগল তুমি? এটা কোনো সলিউশনই না। খবরদার এমন বোকা বোকা কাজ করলে। আমার উপর আস্থা রাখো। প্রমিজ করছি, তোমাকে আপদগুলোর কাছ থেকে উদ্ধার না করে আমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি না।”
আহি হাসলো। উজ্জ্বলের কথায় অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। তার কথায় যে কেউ তাদের দমে যাওয়া সাহস ফিরে পাবে। যেমনটা আহি পাচ্ছে।
(***)
উজ্জ্বল আর আহি কথা বলছিল। এমন সময় একজন যুবক তাদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। আহি মুখ তুলে নায়ীব তামজিদকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। নায়ীব হেসে বলল,
“কেমন আছেন, মিস ওয়াসিকা?”
আহি হেসে বলল,
“ভালোই। আপনার কি অবস্থা?”
“আমিও বেশ ভালোই।”
নায়ীব উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বলও কৌতূহলী দৃষ্টিতে নায়ীবের দিকে তাকিয়ে আছে। আহি বলল,
“বসুন না।”
“না, আপনারা বসুন। আমার স্পেশাল গেস্ট আসবে। আপনাকে দেখে এদিকে এলাম।”
“আচ্ছা।”
আহি উজ্জ্বলকে বলল, “উনি আমার ডক্টর।”
উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বললো, “ডক্টর!”
“সাইকায়াট্রিস্ট।”
উজ্জ্বল অবাক চোখে আহির দিকে তাকালো। নায়ীব উজ্জ্বলের চাহনি দেখে বুঝলো উজ্জ্বল আহির ব্যাপারে বেশিকিছু জানে না। অথচ আহি নির্দ্বিধায় উজ্জ্বলের সামনে এমন একটা বিষয় খোলাসা করে ফেললো। নায়ীব কিছু বলার আগেই পেছন থেকে মেয়েলী কন্ঠের কেউ একজন বলে উঠলো,
“নায়ীব।”
নায়ীব পেছন ফিরে তাকালো। মেয়েলী কন্ঠ শুনে আহিও সামনে তাকালো। এদিকে নায়ীব মেয়েটির দিকে এগিয়ে তার হাত ধরলো। আহি তা দেখে উঠে দাঁড়ালো। আহির চোখে-মুখে বিষ্ময়। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নায়ীব সরে দাঁড়াতেই মেয়েটির চোখ এবার আহির দিকে এসে ঠেকলো। মুহূর্তেই থমকে গেলো সে। নায়ীব তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আহির দিকে তাকালো। এরপর তার হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“লিনাশা, কি হলো? দাঁড়িয়ে গেলে কেন?”
আহি টেবিল ছেড়ে বেরিয়ে এলো। কয়েক পা এগুতেই লিনাশা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহিও লিনাশাকে ঘুরে যেতে দেখে থমকে দাঁড়ালো। উজ্জ্বল উঠে এসে আহির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“এনি প্রবলেম, আহি?”
আহি কাঁপা কন্ঠে বললো, “লিনু।”
লিনাশা নায়ীবের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“নায়ীব, আমি নিচে নামছি। আমার একটা কাজ আছে।”
কথাটি বলেই লিনাশা নিচে নেমে গেলো। নায়ীব একনজর আহির দিকে তাকালো। দেখলো আহির চোখে-মুখে মলিনতা। ভীষণ অবাক হলো নায়ীব। সেও এরপর নিচে চলে গেলো। উজ্জ্বল বলল,
“মেয়েটাকে চেনো?”
আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার ফ্রেন্ড, লিনাশা। ও পুষ্পেরও ফ্রেন্ড। আমাদের ছোটবেলার বন্ধুত্ব। আমার ভাগ্য খারাপ, আমি তাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমাকে এই ব্যাপারে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, প্লিজ। আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। আমার মতো ভিখারিনী এই পৃথিবীতে নেই।”
(***)
নায়ীব লিনাশার পিছু পিছু এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“লিনাশা, ওভাবে চলে এসেছো কেন?”
লিনাশা নায়ীবকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “সরো তো!”
“তুমি মেয়েটাকে চেনো?”
লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি মেয়েটাকে কীভাবে চেনো?”
“ও আমার পেশেন্ট ছিল।”
লিনাশা থমকে গেলো। ভ্রূ কুঁচকে বলল, “মানে?”
“তোমাকে বললাম না একটা মেয়ের কথা? একটা ছেলেকে ভালোবাসে। শুধু ভালোবাসে বললে ভুল হবে, প্রচন্ডভাবে ভালোবাসে। মেয়েটা মানসিকভাবে অসুস্থ। পারিবারিক অবস্থাও ভালো না। এটাই সেই মেয়েটা। মিস ওয়াসিকা।”
লিনাশার চোখেমুখে বিষণ্ণতা ছেয়ে গেলো। নায়ীবের হাত ধরে বলল,
“ও তোমাকে সব বলেছে?”
“হ্যাঁ।”
“ও কি বলেছে ওর একটা বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল, যাকে হারিয়ে ফেলেছে?”
নায়ীব ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হ্যাঁ।”
“কেন হারিয়েছে?”
“পারিবারিক সমস্যার কারণে। ডিটেইলসে কিছু বলে নি। এইটুকু বলেছে যে ওর বাবার সাথে তার ফ্রেন্ডের বাবার ঝামেলা হয়েছিলো। যার জন্য তার ফ্রেন্ডের বাবা মারা গিয়েছিল।”
লিনাশা থমথমে কন্ঠে বললো,
“আহিই সেই মেয়ে। আমার বড় আপু আহির বাবাকে বিয়ে করেছিল। তুমি জানতে চেয়েছিলে না আমার বড় বোন কোথায়? আমার বড় বোন লাবণি মেহেরা, চট্টগ্রামের নামকরা ব্যবসায়ী রিজওয়ান কবিরকে বিয়ে করে, নিজের বাবা-মাকে মার খাইয়ে চলে গেছে। আর আমার বাবা সেটা সহ্য করতে না পেরে, আমাকে আর মাকে ফেলে ওপারে চলে গেছে। আহির কারণে হয়েছে এসব। ওই মেয়েটার কারণে আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। না ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হতো, না আমি আমার বাবাকে হারাতাম।”
নায়ীব লিনাশার হাত ধরে বলল,
“বাসায় চলো। পাগল হয়ে গেছো তুমি। বাচ্চাদের মতো কথা বলছো।”
“আমি বাচ্চাদের মতো কথা বলছি?”
“অবশ্যই। তুমি কি বুঝতে পারছো না, আহি অসুস্থ? তোমার বড় বোন যেই কাজ করেছে, তার জন্য তুমি নিজের দিকটাই দেখছো? তুমি বাবা হারিয়েছো? তাহলে আহি কি তার মাকে হারায় নি? তাদের সম্পর্কের কারণে আহিকে কতোটা সাফার করতে হচ্ছে, তুমি কি জানো? মেয়েটা অসুস্থ। আমি ওর ট্রিটমেন্ট করেছি। ওর হ্যালুসিনেশন হয়। এমন জিনিস ভাবে যেটার অস্তিত্বই নেই। কখন হয় এসব? যখন মানুষ ডিপ্রেশনে থাকে। আর মানুষ ডিপ্রেশনে কেন থাকে? যখন আপন কেউ পাশে থাকে না। আহি মাকে হারিয়েছে, তোমার বোনের জন্য। তার বাবাকে হারিয়েছে, তোমার বোনের জন্য। আহির বাবা তাকে এমন এক ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছে, যাকে আহি বিয়েই করতে চায় না, তোমার বোনের ইন্সপায়ারে। এতোটুকু তো আহি আমাকে বলেছে। তোমার সাথে বন্ধুত্ব করে কি ও সাফার করছে না? এতোটা স্বার্থপর তুমি!”
নায়ীব গাড়ির দরজা খুলে বলল,
“উঠো গাড়িতে। তোমাকে বাসায় নামিয়ে দেবো।”
লিনাশা অশ্রু ভেজা দৃষ্টিতে নায়ীবের দিকে তাকিয়ে রইলো। নায়ীব লিনাশার গালে হাত রেখে বলল,
“সরি, তোমাকে বেশি বলে ফেলেছি। আমি তোমাকে সত্যটা বললাম শুধু। ভুল বুঝাবুঝি বন্ধুত্বে হয়, তাই বলে এমন শাস্তি? আমি জানি তুমিও আহিকে মিস করো। তোমার ওয়ালে সেই ছবিটা আহি এঁকে দিয়েছিল, তাই না?”
“তুমি কীভাবে বুঝলে?”
“এই মাত্র বুঝলাম। তুমিই তো বললে আহি তোমার ফ্রেন্ড। আর আমি তো জানি আমার পেশেন্ট ভালো ছবি আঁকে।”
লিনাশা চোখ মুছে আবার রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়ালো। নায়ীব লিনাশাকে সেদিকে যেতে দেখে গাড়িতে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়ালো, আর আনমনে হাসলো। শেষমেশ তবে দুই বান্ধবীর মিল হতে যাচ্ছে।
(***)
আজ তৃতীয় রোজা। প্রতিদিনের মতো বেলা বারোটায় ঘুম ভাঙলো আহির। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা হাতড়ে ফোন হাতে নিতেই চমকে উঠলো সে। ফোনে পঁচিশটা মিসড কল। রাদ কল করেছে। রাদ এতোগুলো কল কেন করলো? আহি কল ব্যাক করতেই রাদ সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করলো। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তুই কোথায় আহি?”
“এই মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম।”
“এক্ষুণি ন্যাশনাল হসপিটালে আয়। লাবীবকে ওখানে এডমিট করিয়েছি।”
আহি অবাক কন্ঠে বলল, “কি হয়েছে ওর?”
“বাইক এক্সিডেন্ট!”
আহি ভীত কন্ঠে বলল,
“সিরিয়াস কিছু হয় নি তো!”
“মোটামুটি। মাথায় আঘাত পায় নি। হাত-পায়ে ব্যথা পেয়েছে।”
“আমি আসছি এক্ষুণি।”
আহি ফ্রেশ হয়ে বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিলো। রিজওয়ান কবিরও লাবীবের এক্সিডেন্টের খবর শুনে আহির হাতে টাকা দিয়ে, একটা চেক লিখে দিয়ে বললেন,
“প্রয়োজন হলে তুলে নিও।”
আহি গাড়ি নিয়ে হাস্পাতালে পৌঁছে গেলো। কেবিনের বাইরে এসে দেখলো উজ্জ্বল আর পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প আহিকে দেখে দৌঁড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। আহি পুষ্পকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। পুষ্প কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি লাবীবকে ভীষণ ভালোবাসি, আহি। আমার না কেমন লাগছে আমি তোকে বোঝাতে পারবো না। আমার কারণেই এমনটা হয়েছে। আমিই ওর বাইকে উঠতে চাচ্ছিলাম না। আমার রাগ ভাঙানোর জন্য ও স্টান্ট করছিল, তখনই পেছন থেকে একটা প্রাইভেট কার এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো।”
পুষ্প কথাটি বলতে বলতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। আহি পুষ্পের চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“যাকে ভালোবাসিস, তাকে কেন পাগল বানাবি? তার সাথে কীসের অভিমান? এখনই সুযোগ ভালোবাসার। প্রতিটা সেকেন্ড একে অপরের যত্ন নিবি, আগলে রাখবি, ভালোবাসবি। সবার ভাগ্যে ভালোবাসা থাকে না, পুষ্প। তাহলে পেয়ে কেন অবহেলা করিস?”
উজ্জ্বল আহির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা আসলেই অসাধারণ। যতোবারই দেখে ততোবারই মুগ্ধ হয়।
(***)
রাদ আহিকে দেখে ওষুধগুলো পুষ্পের হাতে দিয়ে বলল,
“এগুলো নার্সকে দিয়ে আসো।”
এরপর আহির হাত ধরে তাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেলো। আহি বলল,
“টাকা নিয়ে এসেছি।”
“লাগবে না আপতত। রিলিজ দেওয়ার সময় লাগবে। লাবীবের জ্ঞান ফিরেছিল। ও বললো আপতত ওর বাসার কাউকে না জানাতে।”
“আচ্ছা, এদিকে নিয়ে এলি কেন আমাকে?”
“অনেকদিন আমার সাথে কথা বলিস নি। এনগেজমেন্টের পর কেমন যেন পালটে গেছিস। তাজওয়ারকে ভালোবেসে ফেলেছিস না-কি!”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“পাগল না-কি তুই? ওই বেটার প্রেমে আমি পড়বো? নো ওয়ে।”
“কাল রেস্টুরেন্টে একসাথে ইফতার করেছিস!”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুই আমাকে দেখেছিস!”
“হ্যাঁ।”
“ডাকিস নি কেন?”
“তোর ফিয়োন্সের সামনে কিভাবে যাবো? আর আমার সাথে আমার কলেজের বন্ধুরা ছিল।”
“শখ করে তাজওয়ারের সাথে খেতে যাই নি। কারণ আছে। তোকে সময় করে সব বলবো।”
“বাদ দে এসব। ওই বেটাকে বিয়ে করতে হচ্ছে কেন? চল পালিয়ে যাই।”
আহি বুকে হাত গুঁজে বলল, “তারপর!”
“বিয়ে করে ফেলবো তোকে।”
“তোর বাবা-মাকে মেরে ফেলবে। চিনিস না খান সাহেবকে! এরপর দেখা যাবে আমার জন্য তুই ঝামেলায় পড়েছিস।”
“তুই রাজি থাকলে আমি সব ঝামেলা কাটাতে পারবো।”
“আচ্ছা, হঠাৎ তুই আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস কেন?”
“বিয়ের বয়স হয়েছে, ভাবলাম তোকেই বিয়ে করে ফেলি। পার্মানেন্ট বেস্ট ফ্রেন্ড পেয়ে যাবো। তাজওয়ারকে বিয়ে করলে আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখা তো সম্ভব হবে না। তোর যে কোয়ালিফাইড ফিয়োন্সে! এর আশেপাশেও আমি নেই।”
আহি রাদের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
“পৃথিবীর কোনো কোয়ালিফাইড পুরুষ, আমার এই এলোমেলো সুপুরুষ বন্ধুকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবে না।”
রাদ আহির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“কীভাবে বলবো আহি? কীভাবে বলবো, তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।”
চলবে-