#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৬||
৭১।
অগ্রহায়ণের সুশীতল হাওয়া জানালা গলে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। এলোমেলো ঘরে এদিক-ওদিক শপিং ব্যাগ ছড়ানো। ব্যাগগুলো ঠেলে একপাশে রেখে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো লিনাশা। ইদের এক সপ্তাহ পরই নায়ীবের সাথে তার বিয়ে।
নায়ীব আর লিনাশার তিন বছরের প্রেমের সম্পর্ক। তাদের দেখা হয়েছিল বইয়ের দোকানে। শহরে সেই বছর ফাল্গুন মাসে পনেরো দিনের বই মেলা হয়েছিল। লিনাশা সেদিন সন্ধ্যায় তার পছন্দের একটি বই কেনার জন্য মেলায় এসেছিল। ভাগ্যক্রমে একটি স্টলে সেই বইটি পাওয়া গেলো। লিনাশা যে-ই বইটিতে হাত দিতে যাবে, তার আগেই একজন যুবক সেই বইটি নিয়ে নিলো। লিনাশা ভ্রূ কুঁচকে সেই যুবকটির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। অপরিচিত একটি মেয়ের এমন অদ্ভুত চাহনি দেখে ছেলেটি লিনাশাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কোনো সমস্যা?”
লিনাশা বইটি কেঁড়ে নিয়ে বলল,
“এই বইটি কেনার জন্য আমি অনেক দূর থেকে এসেছি।”
এবার ছেলেটি লিনাশার হাত থেকে বইটি টেনে নিলো। আর বলল,
“এটা লাস্ট পিস, আর এটা আমার লাগবেই।”
লিনাশা কিছু বলার আগেই ছেলেটি বইয়ের দাম দিয়ে দিলো। লিনাশা বইটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এদিকে ছেলেটি বই নিয়ে চলে গেলো। আর লিনাশা দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, বইটা কি অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না?”
দোকানদান মাথা নেড়ে বলল,
“এটা লিমিটেড ছিল। বইটি আর বের হবে না।”
লিনাশা মলিন মুখে হাঁটতে লাগলো। মনে মনে লেখককেই বকাবকি করছিলো সে। কেমন লেখক, অল্প কিছু বই বের করেই হারিয়ে গেছে! হঠাৎ লিনাশার সামনে সেই অপরিচিত ছেলেটি এসে দাঁড়ালো। এবার লিনাশা বলল,
“কি সমস্যা?”
“বইটি কি আপনার খুব প্রয়োজন?”
“হ্যাঁ। কিন্তু স্টক আউট।”
“আপনি চাইলে আমি আপনাকে বইটি ধার দিতে পারি।”
“কেন?”
“কারণ আমি কাউকে হতাশ করতে চাই না।”
“আপনি কোথাকার হিতৈষী।”
“এই দেশেরই। এই জেলারই। কাছেই আমার বাড়ি।”
“এতোকিছু জানতে চাই নি। বাই দা ওয়ে, আপনি আমাকে বই ধার দেবেন কীভাবে?”
“এই যে হাত দিয়েই দেবো। আমি আপনাকে হাতে হাতে দেবো, আর আপনি আমাকে হাতে হাতেই ফেরত দেবেন।”
লিনাশা ভ্রূ নাচিয়ে বলল,
“সেটাই তো জানতে চাচ্ছি। আপনি আমাকে কোন আক্কেলে বিশ্বাস করছেন?”
ছেলেটি হাসলো। বলল,
“আমি মানুষ দেখেই বুঝতে পারি, সে কেমন। আমার মনে হলো, আপনি বইটি পড়েই আমাকে ফেরত দেবেন। এমনকি বেশ যত্নও করবেন। বইয়ে দাগ দেওয়ার আগে একশো বার ভাববেন।”
লিনাশা অবাক হয়ে বলল,
“আপনি পাক্কা কোনো জ্যোতিষী।”
ছেলেটি আবার হাসলো। এরপর বুক পকেট থেকে একটা কলম বের করে বইয়ের উপর কিছু একটা লিখে লিনাশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। লিনাশা অবাক চোখে ছেলেটির যাওয়া দেখছে। এরপর আকাশসম বিষ্ময় নিয়ে বাসায় এসে বইটির পাতা উল্টাতেই দেখলো, সেখানে ছেলেটির নাম আর ফোন নম্বর লেখা। লিনাশা তা দেখে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। জীবনে প্রথম কোনো ছেলে তাকে ফোন নম্বর দিয়েছে, বেশ ভালোই লাগলো তার৷ বার কয়েক আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো সে। হয়তো অভিনব কৌশলে নম্বর আদান-প্রদান করে প্রেম করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলো। বেশ ভাব আসলো লিনাশার। সেই নম্বরটিতে কল দেওয়ার তীব্র বাসনায় দু’দিনেই বইটি শেষ করে ফেললো সে। এরপর দু’দিন পর সন্ধ্যায় কল করলো নম্বরটিতে। বেশ ব্যস্ত মানুষ তো! চার বার কল দেওয়ার পরও ধরলো না? অভিমান হলো লিনাশার। কিন্তু ফিরতি কল এলো রাত দশটার একটু পর। লিনাশার মান-অভিমান ভেঙে গেলো মুহূর্তেই। গলা খাঁকারি দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে কলটা রিসিভ করলো সে। এরপর ওপাশ থেকে ছেলেটি বলে উঠলো,
“হ্যালো, নায়ীব তামজিদ বলছি।”
“আমি লিনাশা মেহেরা।”
“জ্বি, কোনো প্রয়োজন!”
“বইটা পড়া শেষ।”
নায়ীব বেশ অবাক হলো। সে তো ভুলেই গিয়েছিল। মনে পড়তেই মুচকি হেসে লিনাশার সাথে কুশল বিনিময় করলো। জিজ্ঞেস করলো,
“বইটি কেমন লেগেছে?”
আরো বললো, লিনাশা যেন এক বাক্যে বইটির চমৎকার একটা রিভিউ দেয়। নায়ীবের এমন গম্ভীর কথাবার্তায় লিনাশা হাঁপিয়ে উঠছিল। প্রেমের কথা কম, পড়ালেখার কথায় যেন বেশি ছিল তাদের কথোপকথনে। লিনাশা বেশ বিরক্ত। জীবনে প্রথম কোনো ছেলে তাকে নম্বর দিয়েছে, তাও এমন আঁতেল! লিনাশা কল কেটে ঘুমিয়ে পড়লো। এর কয়েকদিন পর বইটি ফেরত দেওয়ার জন্য তাদের দেখা হলো একটি রেস্টুরেন্টে। বেশ ফিটফাট পোশাক পরেই আগমন ঘটলো নায়ীব তামজিদের। সেদিন নায়ীব লিনাশার হাবভাব দেখেই বুঝে ফেললো, এই সুদর্শন যুবকটিকে লিনাশার ভালো লেগেছে। একজন পুরুষের জন্য এটা বেশ মজার বিষয়, যে কোনো মেয়ে তাকে পছন্দ করেছে, আর সে এটা ধরতেও পেরেছে। তবে নায়ীব বেশ ভদ্র। সে লিনাশার পছন্দের প্রতি সম্মান রাখলো। বেশ ভালোই কথাবার্তা হলো তাদের। আধুনিক যুগের বিস্তর প্রভাবে দু’জনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরও আদান-প্রদান হলো। ব্যস, লিনাশা পেয়ে গেলো সুযোগ। প্রায়ই এটা-সেটা নিয়ে নায়ীবকে মেসেজ করতো সে। নায়ীবও ধীরে ধীরে লিনাশার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লো। দু’জনের বয়সের ব্যবধান মাত্র পাঁচ বছর। আর তখন লিনাশা পড়তো অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। কিন্তু বয়সের তুলনায় বেশ ইম্যাচিউর ছিল সে। আর নায়ীব সেই ইম্যাচিউর মেয়েটিকেই একদিন ভালোবেসে ফেললো।
নায়ীব মনে করে প্রেমিকাদের অন্তত প্রেমিকের সামনে একটু ন্যাকা বোকা হতে হয়। তবেই প্রেম জমে। নায়ীব আর লিনাশা বেশ ভালোভাবেই তাদের প্রেম জমিয়েছে, যার পরিণতি আজ বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছে।
(***)
প্রায় আধা ঘন্টা বিছানায় বিষণ্ণ মনে শুয়ে ছিল লিনাশা। আজ রমজানের প্রথম সপ্তাহ শেষ। এক সপ্তাহ আগেই আহির সাথে ক্ষণিকের জন্য দেখা হয়েছিল তার। নিজের মিথ্যে অহমিকায় সেদিন আহির সাথে কথা না বলেই বেরিয়ে এসেছিল রেস্টুরেন্টটি থেকে। পরবর্তীতে নায়ীব বোঝানোর পর সেখানে আবার গিয়েছিল। কিন্তু গিয়ে দেখল আহি বেরিয়ে গেছে। লিনাশার ভীষণ খারাপ লাগছে। আহির সাথে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। আরেকবার দেখা হলেই জড়িয়ে ধরবে তার প্রিয় বান্ধবীকে। কতো বছরের জমানো অশ্রু গড়িয়ে পড়া বাকি! এতোগুলো বছরে কতোশত কথা জমে আছে। সবটাই তো আহিকেই শুনাবে সে। আহি ছাড়া কে আছে তার?
(***)
খানস গ্রুপে আজ বেশ বড়সড় ভাবেই ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। ইফতার শেষে তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে সবার সামনে এনে দাঁড় করালো। আহি বেশ বিরক্ত। তবুও উজ্জ্বলের কথামতো সে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে অভিনয় করার চেষ্টা করছে। তাজওয়ার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনারা তো জানেনই এই মাসে আমার এনগেজমেন্ট হয়েছিল। আজ আমি আমার ফিয়োন্সের সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দেবো। মিট উইথ মাই লাভলী ফিয়োন্সে, ওয়াসিকা কবির আহি। এন্ড ওয়ান এন্ড অনলি বিউটিফুল ডটা’র অব মিস্টার রিজওয়ান কবির।”
আহি উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিতেই ভীড়ের মাঝে তার চোখ আটকে গেলো আফিফের দিকে। অনেকদিন পর আফিফকে দেখলো সে। ইদানীং ক্লাসে যায় না আফিফ। অফিসে কাজের চাপ বেড়েছে, তাই হয়তো। আহি চোখ সরিয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“খুব শীঘ্রই আহি আমাদের বিজনেস গ্রুপে জয়েন করবে।”
সবাই হাততালি দিচ্ছে। আহি নিচে নেমে আসতেই তাজওয়ার তাকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল,
“নেমে এলে যে!”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“সবই বুঝলাম, কিন্তু তোমার বিজনেস গ্রুপে জয়েন হচ্ছি, এটা কেন বললে?”
“কেন, ভুল কিছু বলেছি?”
“অবশ্যই। আমি বিজনেস করবো না। আমি আর্টিস্ট হবো, আর এটাই আমার ড্রিম। আর আমার এসব ভালো লাগে না। অন্তত এদিক থেকে কি আমি স্বাধীনতা পাবো না?”
তাজওয়ার আহির কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“সব করতে পারবে তুমি। পাশাপাশি এই বিজনেসটাও দেখবে।”
তাজওয়ার আহির চুলে হাত ডুবিয়ে দিলো। আহি বেশ অস্বস্তিবোধ করছে। কিন্তু তাকে সহ্য করতে হবে। নয়তো সে তার আসল ধাপে যেতেই পারবে না।
এদিকে আফিফ অফিস থেকে বেরিয়ে দেখলো তাজওয়ার আর আহি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। এমন দৃশ্য দেখে হুট করেই মনটা ভারী হয়ে এলো তার। আফিফ অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য দাঁড়ালো। কিন্তু গাড়ি ডাকলো না। আনমনেই হাঁটতে লাগলো ফুটপাত ধরে। আহিকে তাজওয়ারের সাথে দেখে কেন খারাপ লাগবে তার? এটাই তো হওয়ার ছিল। আফিফ হাঁটতে হাঁটতেই পা ফসকে ফুটপাত থেকে রাস্তায় পড়ে গেলো। তখনই দু’টি হাত তাকে উঠানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আফিফ মুখ তুলে তাকাতেই দেখলো আহি। আফিফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি!”
আহি আফিফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,
“রোজা রেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন হয়তো। শরীরটা বেশ খারাপ মনে হচ্ছে! বাইক আনেন নি?”
“না।”
“আমি রিকশা ডেকে দিচ্ছি।”
“দরকার নেই।”
“অন্যকিছু ভাববেন না। আপনি একদিন আমাকে রিকশা ঠিক করে দিয়েছিলেন। সেদিন আমি একটু অসুস্থ ছিলাম। আজ মনে হলো, আপনি অসুস্থ। আফটার অল, আপনি আমার বান্ধবীর হাসবেন্ড। এতোটুকু ফর্মালিটি রাখা আমার দায়িত্ব।”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ফর্মালিটি!”
আহি রিকশা ঠিক করে দিয়ে বলল,
“কেন ইনফর্মাল কিছু তো আপনি আশা করতে পারেন না!”
আফিফ কিছু না বলেই রিকশায় উঠে পড়লো। রিকশা চলে যেতেই আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আফিফের মায়া কি সে আদৌ ছাড়তে পারবে? যদিও আজকাল তেমন একটা কষ্ট হয় না। জীবন তাকে এতো বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে যে আর কষ্ট পেয়ে অশ্রু গড়ানোর শক্তিটুকুও তার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। কষ্টগুলো এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস হয়েই বেরিয়ে আসে।
চলবে-