#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_৩৮
“সমুদ্র!” বলে চিৎকার করে উঠে আরভী। ভয়ে সমুদ্রের হাত শক্ত করে চেপে ধরে চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে নেয়।
আরভীর এ কান্ড দেখে সমুদ্র উচ্চস্বরে হেসে উঠে। আরভী বুঝতে পারলো না সমুদ্র হাসছে কেন আর কিভাবেই বা হাসছে। দোতলা থেকে পড়ে কেউ বুঝি হাসতে পারে? আরভীর তো হাতে, পায়ে ও কোমরে বেশ ব্যাথা করছে। কোমরটা বুঝি ভেঙেই গেলো। আচ্ছা হাত-পা ও কি তবে ভেঙে গেছে?
আরভী আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। নিজের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সবকিছু অক্ষত অবস্থায় আছে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব? হঠাৎ আরভী খেয়াল করলো তারা বালুর উপরে আছে। তারমানে আরভী ও সমুদ্র ছাদ থেকে সোজা এই বালুর উপরে পড়েছে। তার জন্যই বেশি কিছু হয় নি দুজনের।
বাড়িতে কিছু কাজ করাতে হবে বলে কাল এই বালু আনিয়েছিলো আরভী। ভাগ্যিস কাল বালু আনিয়েছিলো নয়লে আজ কি অবস্থা হতো! ভাবা যায় এসব?
সমুদ্র এখনো হেসেই চলেছে। হাসতে হাসতে শুয়ে পড়েছে বালুর উপরে। আর আরভী রণচণ্ডী রুপ ধারণ করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চোখ থেকে আগুনের ফুলকি ঝরাচ্ছে। এই ছেলে এমন কেন? এই ছেলের কি কোনো কান্ড জ্ঞান নেই? একটু আগেও তো আরভীর উপর রাগ দেখাচ্ছিলো আর এখন এমন ভাবে হাসছে যেনো খুব মজার কিছু একটা ঘটেছে।
আরভী ক্ষিপ্ত গলায় সমুদ্রকে প্রশ্ন করে,”আপনি কি পাগল? এরকম কেউ করে? এখানে যদি বালু না থাকতো তাহলে কি হতো ভাবতে পারছেন?”
“কি আর হতো? আমাদের হাত-পা ভাঙ্গতো। আমরা কয়েকদিন হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকতাম, গুনগুনিয়ে গান গাইতাম। আর সাধারণ জনগণ নিজেদের আদর্শ মেয়েরের এই অবস্থা দেখে আফসোসের স্বরে বলতো আহারে আমাদের মেয়র পঙ্গু হয়ে গেছেন। তারপর আপনাকে আপনার সো কলড ফিয়ন্সি আপনাকে রেখে পালাতো। তা দেখে আমি মহৎ ব্যাক্তিত্বের পরিচয় দিতে আপনাকে বিয়ে করে নিতাম।”
আরভীর এখন নিজের মাথা ইট দিয়ে বাড়ি মেরে ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সামান্য একটা প্রশ্নের এতো বিস্তারিত উত্তর! এখন তো এ উত্তর শুনে আরভীর’ই মাথা ঘুরাচ্ছে।
আরভী আশেপাশে তাকালো। বালুর সাথে তো ইটও আনিয়েছিলো। সেই ইট এখনই লাগবে আরভীর। মাথা ফাটানোর জন্য। না না, আরভীর মাথা ফাটাতে নয়, সমুদ্রের মাথা ফাটাতে।
ওই তো। পাশেই ইট রাখা আছে। আরভী উঠার চেষ্টা করলো ইট আনার জন্য। কিন্তু উঠতে গিয়ে আর্তনাদ করে আবার বসে পড়ে। কোমরে হাত রেখে অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,”আমার কোমর।”
সমুদ্র আরভীকে এরকম করতে দেখে আবার হেসে উঠলো। তবে এবার হাসার সাথে সাথে বালুতে গড়াগড়িও খেতে লাগলো। আর বললো,”কি ভেঙে গেছে? এবার আপনাকে কে বিয়ে করবে ললনা?”
একে তো সমুদ্রের একটু আগে করা কান্ডে আরভী সমুদ্রের উপর রেগে আছে। তারউপর এখন যেভাবে হাসছে তাতে আরভীর রাগ আরো বেড়ে চলেছে।
আরভী আর নিজের রাগ সামলাতে না পেরে সমুদ্রের দিকে সামান্য ঝুকে সমুদ্রের কলার টেনে ধরে।
সমুদ্র একবার কলারের দিকে তাকায়। তারপর আবার আরভীর চোখের দিকে তাকায়। চোখে চোখ রেখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”আগেই বলেছিলাম, মরতে হলে আপনাকে নিয়ে মরবো। আমি মরে যাবো আর আপনি অন্য কারো বুকে মাথা রেখে ঘুমাবেন তা কি করে হয় ললনা? আপনার মাথা শুধু মাত্র আমার বুকে ঠেকবে। আপনার মন, দেহ, রুহ সব কিছুর উপর কেবল আমার অধিকার থাকবে।”
“আর যদি দুজনেই মরে যেতাম? কোন অধিকারে পরকালে আমার রুহকে নিজের বলে দাবী করতেন?”
“দেখে-শুনেই লাফ দিয়েছি। এখানে বালু না থাকলে কখনোই লাফ দিতাম না। রাগের বসে উল্টোপাল্টা কাজ করার অভ্যাস আমার নেই।”
সমুদ্রের কথা শেষ হতেই এক জোড়া পায়ের শব্দ এসে থামে এখানটায়। কে এসেছে তা দেখার জন্য আরভী ও সমুদ্র দুজনেই তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। দেখতে পায় দাঁরোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ানকে দেখে আরভী একবার নিজের দিকে ও সমুদ্রের দিকে তাকায়। তারপর তাড়াতাড়ি করে সমুদ্রকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে।
অপরদিকে দারোয়ান এখানে এসে ‘থ’ বনে গেছে। অদ্ভুত ধরনের শব্দ পেয়ে উনি এখানে এসেছিলেন। এসেই যে এরকম কিছু দেখতে পাবেন তা কখনোই ভাবেন নি উনি। না চাইতেও উনার মনের মধ্যে নানা ধরনের প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করলো।
সমুদ্র দাঁরোয়ানের মনোভাব বুঝতে পারে। হুট করে কিছু দুষ্টু বুদ্ধি সমুদ্রের মাথায় খেলে যায়। আর তাই তো খানিকটা চিৎকারের স্বরে বলে উঠে,”বাঁচাও বাঁচাও। ললনা আমার ইজ্জত হরণ করছে।”
সমুদ্রের এরকম চিৎকার শুনে দারোয়ান নিশ্চিত হলেন উনি যেরকমটা ভাবছিলেন সেরকম’ই কিছু একটা হচ্ছিলো এখানে। নয়তো আরভী ম্যাডাম ও এই ছেলেটি এখানে এভাবে বালুর উপরে একজন আরেকজনের উপর ঝুকে থেকে কি করবে?
দাঁরোয়ান এবার বড়সড় ঢোক গিলে অমতাঅমতা করে বললো,”ম্যাডাম! আপনি এমনটা করতে পারেন না। আপনি একজন মেয়র হয়ে এমন করলে বাকিরা তো আরো সাহস পেয়ে বসবে।”
“এই কখনো শুনেছেন কোনো মেয়ে ছেলেদের ইজ্জত হরণ করেছে?” আরভী দারোয়ানের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটি ছুড়ে দেয়। যার প্রতিত্তোরে দারোয়ান বলে,”না শুনি নি। কিন্তু নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি।”
আরভী কিছু বলবে তার আগেই আফিফা আফরোজ উপস্হিত হলেন এখানে।
“আরভী, কি হচ্ছে এখানে?” আফিফা আফরোজ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করেন।
আরভী আফিফা আফরোজকে দেখে কিছুটা দমে যায়। ঘটনাটি যে বাজে ভাবে প্রকাশ পেয়েছে সবার সামনে তা বেশ বুঝতে পারছে আরভী। সব হয়েছে এই সমুদ্রের জন্য। এই লোকের জন্যই এরকম একটা বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাও আবার নিজের মায়ের সামনে।
আরভী আফিফা আফরোজকে কি বলবে তা ভেবে পাচ্ছে না। সমুদ্র ছাদ থেকে আরভীকে নিয়ে লাফ দিয়েছে তা বললে কেউই বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করার কথাও না। কেননা পাগলও নিজের ভালো বুঝে। একটা পাগল কখনোই ছাদ থেকে এভাবে লাফ দিবে না।
“কি হলো? কিছু বলছো না কেন? আর এখনো এভাবে বালুর উপরে বসে আছো কেন দুজনে?”
“মা পা’টা একটু মচকে গেছে। উঠতে পারছি না।”
আরভীর এ কথা শুনে আফিফা আফরোজ এগিয়ে আসেন আরভীর দিকে। আরভীকে ধরে উঠিয়ে সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলেন,”বাড়ি চলে যাও এখন। কাল দিনের আলোতে একবার দেখা করে যেয়ো। কিছু কথা আছে তোমাদের সাথে।”
——
ফ্লোরে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে মিনহাজ। চোখ তার পানিতে টইটম্বুর। কি নিদারুণ যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের বা’পাশে। মনে হচ্ছে এই বুঝি জীবন থেমে গেলো এখানেই। শুনেছি মৃত্যুর আগ মূহুর্তে নাকি জন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রত্যেকটি ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠে। মিনহাজের চোখেও তো ভাসছে। তবে কি ফুরিয়ে এলো মিনহাজের দিন? জীবনের অন্তিম মূহুর্তে কি চলে এসেছে মিনহাজ?
মিনহাজ সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখের সামনে ফুটে উঠছে একে একে চেনা-পরিচিত প্রত্যেকটা মানুষের ছবি। বাবার ছবি, মায়ের ছবি, সমুদ্রের ছবি। সবশেষে আরভীর ছবি।
মিনিহাজ ঈষৎ হাসে। চোখ থেকে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে। অতি কষ্টে বিরবির করে বলে,” আরু, আমার আরু।”
চোখের সামনে ভেসে উঠে আরভীর সাথে কাটানো মিস্টি মধুর স্মৃতি গুলো। কিন্তু পরমূহুর্তেই আবার ভেসে উঠে কালো অতীতের ভয়ংকর কিছু মূহুর্ত। আরশাদ রায়হাকে হত্যার চিত্র। যা দেখে মিনহাজের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। নাহিদ চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বিরবির করে বলে,”তুমি আমাকে মিথ্যে বলে আরশাদ আংকেলকে খুন করেছো বাবা। তুমি বলেছিলে আংকেলকে শুধু কয়েকদিন বন্দি করে রাখবে। তুমি নিজের সাথে সাথে আমাকেও খুনি বানিয়ে দিলে। আমি এবার উপরওয়ালাকে কি জবাব দিবো?”
মিনহাজের চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। ধীরে ধীরে চোখের সামনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। সারা শরীর অবস হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে আসার আগে মুখে কেবল একটা বাক্য উচ্চারণ করে,”লা ইলাহা ইল্লাহ।”
তারপর! তারপর বুকের মাঝে হঠাৎ করে তীব্র ব্যাথা অনুভূত হয়। চোখে বন্ধ হয়ে আসে। প্রশ্বাস নিতে ভুলে যায় মিনহাজ। সমস্ত শরীর বরফের মতো হিম শীতল হয়ে আসতে থাকে।
সকাল পেড়িয়ে দুপুর গড়ালো। কিন্তু মিনহাজ ঘর থেকে বের হলো না। নাহিদ চৌধুরী সকাল থেকে একটু পর পর মিনহাজের ঘরের সামনে থেকে ঘুরে যাচ্ছেন কিন্তু মিনহাজের কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছেন না। আর না নিজে সাহস করে ভেতরে যেতে পারছেন। কিন্তু এখন উনার চিন্তার পরিমাণ বেড়ে গেছে। কাল রাতেও কিছু খায় নি ছেলেটা।
অনেকক্ষণ দরজার সামনে ঘুরঘুর করে শেষমেশ নিজেকে ধাতস্থ করে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করেন নাহিদ চৌধুরী। দেখতে পান এখনো ছেলেটা ফ্লোরেই শুয়ে আছে। গায়ে কোনো গরমের কাপড় নেই। এই ঠান্ডায় এভাবে ফ্লোরে শুয়ে আছে কেন ছেলেটা? শীত করছে না? এছাড়া এভাবে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। এসব ভেবেই নাহিদ চৌধুরী ধীরে ধীরে মিনহাজের দিকে এগিয়ে গিয়ে মিনহাজের মাথার ধারে এক হাটুর উপরে ভর দিয়ে বসেন।
মিনহাজের মুখের দিকে দৃষ্টি স্হাপন করেন। কিন্তু মিনহাজকে দেখে উনার অন্তরআত্মা কেঁপে উঠে। ঠোঁট জোড়া কেমন নীলচে বর্ণ ধারণ করে আছে ঠান্ডায়। শরীরের রঙও কেমন ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে। মৃতব্যাক্তির মতো দেখাচ্ছে মিনহাজকে। নাহিদ চৌধুরীর ভয় হলো। দারুন ভয়। কিন্তু পরমূহুর্তে নিজেকে মনে মনে ধমক দিয়ে বললেন,”কি সব উল্টাপাল্টা ভাবছি।”
জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলেন উনি। তারপর আদুরে কন্ঠে মিনহাজকে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু মিনহাজ চোখ মেলে তাকালো না। নাম ধরে ডাকার জন্য কোনো সারাশব্দও দিলো না। এবার নাহিদ চৌধুরীর মনে ভয়ের দানা বাসা বাঁধে অনেকটা। উনি কম্পনরত হাতটি মিনহাজের কপালে রাখেন।
মিনহাজের কপালে হাত রাখার সাথে সাথেই উনি হাত সরিয়ে নেন। শরীরের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিয়ে বসে পড়েন ফ্লোরে। শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে যায় উনার। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে অশ্রুতে।
না, এ হতে পারে না। মিনহাজ এভাবে মরতে পারে না। হয়তো শীতে শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। হ্যাঁ এটাই হবে। এসব বলেই নিজের মনকে বুঝ দিলেন নাহিদ চৌধুরী। তারপর চোখের পানি মুছে আবারও নিজের কম্পনরত হাত এগিয়ে নিয়ে যান মিনহাজের নাকের সামনে। কিন্তু কোনো নিঃশ্বাস ফেললো না মিনহাজ। নিঃশ্বাস ফেলবে কি করে? শ্বাস-প্রশ্বাস যে চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে মিনহাজের।
চলবে….
বি.দ্র. : বাস্তবতার সাথে এই গল্প মেলাবেন না। গল্প মানেই কাল্পনিক চিত্র। হয়তো কিছু লেখক-লেখিকা বাস্তবতা তুলে ধরেন। কিন্তু আমি মূলত নিজের কল্পনাকে লেখায় রুপ দেই। তাই বাস্তবতার সাথে গল্পের তুলনা করবেন না। ধন্যবাদ।