#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#অন্তিম_পর্ব
“খুব হাসা হচ্ছে সকলের। আমিও চলে এসেছি। দেখবো কতদিন আর হাসতে পারিস তোরা।”
তাবাসসুম সকলের হাসিমাখা চেহারা দেখে হাত মুঠোবদ্ধ করে আছে। সেও তার মায়ের হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করে। আকস্মিক কারো আগমনে আফরাজ সমেত সকলে পিছু মোড়ে। তাবাসসুম সকলকে বিড়ম্বনায় ফেলতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
“আমাকেও বলতে আমিও আসতাম। আফটার অল সেকেন্ড ওয়াইফ আফরাজ এর।”
এ কথায় যেনো কেউ পাত্তা দিলো না এমন ভান করলো। তাবাসসুম সেদিক চোখ দিয়ে মনেমন গা’লি ছুঁড়ে দেয়। আফরাজ এর নিকটে যেতে নিলে নাজীবা সপথে হাজির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ভান ধরল যেনো সে তার স্বামীর পাশে কাউকেই সহ্য করতে পারবে না। মুখ ঘুরিয়ে তাবাসসুম এর দিকে তাকিয়ে বলে,
“খবরদার আর এক কদম বাড়ালে তোর পা আর পা থাকবে না। যেখানে আছিস সেখান থেকে সোজা উল্টো পায়ে ফিরিয়ে যাহ্। এই ঘরপরিবারে তোর হক নেই বললেই চলে।”
নাদিম হাত তালি দিয়ে সামনের দিক ইশারা করে। তাবাসসুম চোখ ঘুরিয়ে মা-কে ধরে রুমের দিকে এগালো। নাজীবা ফিক করে হেসে দেয়। নাদিম পরিবারের সকলের সাথে কথাবার্তা বলে আফরাজ কে সঙ্গে নিয়ে কেবিনে ঢুকে পড়ে। যে যার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে। আফরাজ বলে,
“কালকের পার্টিতে গেস্ট হিসেবে সতর্ক থাকিস। তাবাসসুম এর বিশ্বাস নেই। নাজীবা-র ক্ষতি করে দিতে পারে। আমি চাইছি কালকে শরীয়ত মোতাবেক তাবাসসুম এর মুখের উপর তালাক বলে দিতে! শোন সিরিঞ্জ এনেছিস না?”
নাদিম মাথা নেড়ে সিরিঞ্জ-টা এগিয়ে দেয়। আফরাজ পকেটে ভরে রাখল। দু’জনে একে অপরকে আশ্বাস দিয়ে যে যার মত চলে যায়। দিনে কাজটি সম্পন্ন করার জন্য আফরাজ রুমের যাওয়ার সময় এক স্টাফকে ভাড়া করে রাখল। তখনি তার নজরে অচেনা এক মেয়ের চেহারা সামনে এলো। চেহারাটা এখানকার নয় তা মেয়ের গড়ন বলে দিচ্ছে। মেয়েটার নজর বুঝিয়ে দিচ্ছে সে চোরামি করে এসেছে। তার যাওয়ার পথ কোনদিকে তা অনুসরণ করার সময় রইল না আফরাজ এর। রুমে নাজীবা একলা হওয়ায় রুমের দিকেই অগ্রসর হয়। কিন্তু মাঝপথে বিষয়টি নাদিম-কে জানিয়ে রাখার কথা ভাবল। ফোন বের করে নাদিমকে মেসেজ করে দিলো।
সকাল ১১টায় ফাংশন শুরু হলো। একের পর এক টুরিস্ট গেস্ট আসছে। তাদের মাঝে ফাহিম পরিবারের সদস্যগণ উপস্থিত। নাজীবা-কে কোনোভাবেও হাতছাড়া করছে না আফরাজ। সর্বক্ষণে নজরে রেখেছে। স্বামীর মাত্রাতিরিক্ত ফোকাস নিয়ে নাজীবা বিরক্তবোধ করছে। হঠাৎ মনে হলো তার ওয়াশরুমে যেতে হবে। বিনা সংকোচে স্বামীর হাতায় গুঁতো মে’রে বলে,
“আমি ওয়াশরুমে যেতে চাই।”
আফরাজ ‘চলো’ বলে টেনে নিয়ে যায়। নাজীবা হা করে তাকিয়ে স্বামীর সঙ্গেই গেলো। তাবাসসুম বুঝতে পারছে আফরাজ তার কারণে নাজীবার সঙ্গ ছাড়ছে না। তবে তা কতক্ষণ? এই ভেবে শ’য়’তানি হাসি দেয় আপনমনে তাবাসসুম। তার ভাড়া করা পুষ্প নামের মেয়েটিকে চোখের ইশারায় সিরিঞ্জ-টা এগিয়ে দেয়। আফরাজ এর পেছনের যেতে ইশারা করল। সিরিঞ্জ-টা হলো এক রোগীর এইচআইভি ভাইরাসের রক্তের। সে সংগ্রহ করেছে তার সতীনকে তীব্র কষ্টে মৃত্যুর মুখে ফেলার জন্য। পুষ্প মুখে কাপড় পেঁচিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগালো। তাবাসসুম প্রশান্তির শ্বাস ছেড়ে হিয়া দেয়ান এর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু হিয়া দেয়ান কেনো যেনো নিজের ভারসাম্য ধরে রাখতে পারছেন না। তিনি আলতো হাতে মেয়েকে ধরে বসে পড়লেন। মায়ের অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে ‘কি হলো মম’ বলে উঠে। হিয়া দেয়ান মাথা নেড়ে ‘কিছু না’ বোঝায়। মনেমন তিনি নিজেও শরীরের অবস্থার অবনতি নিয়ে চিন্তিত।
আধাঘণ্টা পর এওয়ার্ড পর্ব শুরুর ঘোষণা করা হলো। আফরাজ এর সঙ্গে তাবাসসুম দাঁড়িয়ে যেতে এগোলেও কদম পেরুতে পারে না। কিংবদন্তি হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। নাজীবার সুস্থ শরীর দেখে তার মাথার মধ্যে অজস্র প্রশ্নের ঘুরপাক খায়। তৎক্ষণাৎ পুষ্প কে ফোন লাগাল। ফোন ধরল না মেয়েটা। হঠাৎ একজন-কে পাশে এসে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে তাবাসসুম নিজে-কে স্বাভাবিক করে নেয়। নাকিব ওরফে নাদিম এসে বলে,
“যাকে খুঁজছো সে আর ফিরে আসবে না। সাবধানে থেকো তার কাছে দেওয়া সিরিঞ্জের ব্লাড যেনো আবার তোমার শরীরে না যায়?”
তাবাসসুম পাল্টা প্রশ্ন করার পূর্বেই সেখান থেকে নাদিম ভীড়ের মধ্যে মিলিয়ে যায়। আফরাজ বিবিজান এর সঙ্গে এওয়ার্ড রিসিভ করে সকলের সামনে বলে,’এই অংশটা কখনো পেতাম না আমার বিবিজান কে ছাড়া। সে আছে বলেই আমি পরিপূর্ণ। থ্যাংকিউ ফর কামিং মাই লাইফ বিবিজান।’
নাজীবার হিজাবের উপর চুমু এঁকে দেয়। মাস্কের আড়ালে লাজুক হাসে। কাজল আমতা আমতা করে নাদিম এর পাশে এসে দাঁড়ায়। সে পুরো রাত কান্না না করে ভেবেছে। সে যেমন বুঝতে না পেরে বাড়াবাড়ি করল তেমনি নাদিমের মাত্রাতিরিক্ত রা’গ দেখানো উচিৎ হয়নি।
দু’জনেই মৌনব্রত পালন করছে। কিন্তু নাদিমের এই মৌনতা পছন্দ হলো না। সে আক্ষেপের গলায় বলে,’বিয়ে করে আমার অর্ধাঙ্গিণী হতে চাও? একটা ভুলকে মাফ করে এই তোমার পথের ফকিরকে জীবনের বড় অংশ বানাতে দিবে? তোমার মনের মত সম্পদশালী না হলেও আমার হৃদয়ের ছোট আঙ্গিনায় যত্নে গড়া ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। সেখানে তুমি আরামে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে পারবে। কোনো অভিযোগ হলে নির্দ্বিধায় বলে দেবে,কোনো প্রকার মৌনতা আমি আমাদের মাঝে চাইছি না। আরেকটা কথা পরনারীর প্রতি রা’গ থেকে আমায় নিয়ন্ত্রণ করে যেও তবুও বোনের প্রতি আমার ভালোবাসার নিখুঁতটার পরীক্ষা করতে চেও না।’
নাদিম এর প্রতিটি কথা শুনে মুখ চেপে কান্না নিবারণ করতে লাগে কাজল। কিঞ্চিৎ মুহূর্ত পর তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। কাজল পরম প্রিয়তমের আশ্রয় পেয়ে আহ্লাদী গলায়,’বিয়েতে আমি রাজি’ বলে দেয়। শুনে দুষ্টুমির হেসে নাদিম বলে,’তবে একটু অসভ্যতামি করা উচিৎ কি বলো?’
লজ্জা পেয়ে কাজল মিইয়ে গেল। নাজীবা ভাই-হবু ভাবীর এরূপ দৃশ্য দেখে চোখের উপর হাত রেখে বলে,
“ওপস আমি কিছু দেখিনী সরি।”
দু’জনে হকচকিয়ে গেলো। নাদিম মাথা চুলকে তখনই সরে যায়। কাজল পড়ল বিপাকে। পালিয়ে যেতে নিলে নাজীবা দিলো না। বরং তাকে ধরে আবদারের ঝুলি নিয়ে বসে পড়ল। তাবাসসুম এর মাথা ঘুরছে। সে হিয়া দেয়ান এর পাশে বসে পড়ল। আফরাজ ,আকবর,নাদিম আর জনাব ইসমাইল সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাদের স্ত্রীগণ রিসোর্টের ভেতরের রুমে আছে। আফরাজ বুকের উপর হাত ভাঁজ করে বলে,
“আজ পরিবারের সবাইকে সাক্ষী মেনে তোমাকে তিন তালাক দিচ্ছি। এক তালাক আমার বিবিজান-কে অপদস্থ আর ভাইরাস আক্রান্ত করার প্রচেষ্টা করায়, দুই তালাক মা-মেয়ে মিলে জঘণ্য পরিকল্পনা করার জন্য আর তিন তালাক আমার জীবন থেকে সরে যাওয়ার জন্য। আলবিদা।”
নিজের কথা ব্যক্ত করে রাফিকে কল দিয়ে ডাকে। তাবাসসুম এর মুখে কোনো কথা নেই। কেনো না প্রথম তালাকের কারণ শুনে বুঝে গিয়েছে তার শরীরে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। বোবার মত মায়ের দিকে তাকায়। তার মায়ের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। হাত-পা অজান্তেই বেঁকে যাচ্ছে। প্যারালাইজের লক্ষণ বলা চলে। রাফি লেডি গার্ডস নিয়ে তাবাসসুম আর তার মা-কে ধরে উঠালো। তাবাসসুম আড়চোখে আফরাজ এর দিকে তাকায়। বোবার মুখে কথার বুলি না থাকলেও হৃদয়ের মাঝে অগ্নি ঠিকই জ্বলছে। হুংকার ছেড়ে তৎক্ষণাৎ হাতের ব্যাগ থেকে ছোট আতরের বোতল নিয়ে বোতলের মুখ খোলে নেয়। কেউ কিছু বোঝার পূর্বেই চিৎকার করে উঠে নাদিম। তিনজন হতভম্ব হয়ে গেল। আফরাজ এর হাতের উপর এসিড পড়তে গিয়েও পড়ল না। নাদিম এসে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। একারণে তার হাতে এসিড লেগে যায়। লেডি গার্ডস গু’লিবিদ্ধ করে দেয় তাবাসসুম এর শরীরকে। মুহুর্তেই তাবাসসুম এর শরীর র’ক্তা’ক্ত হয়ে গেলো। তবুও তার মুখে তৃপ্তির হাসি। সে নাজীবা-কে মৃত্যু দিতে না পারলেও তার ভাইকে পুড়াতে পেরেছে। এই যেনো তার জীবনের সার্থকতা। হিয়া দেয়ান মেয়ের নিথর শরীরের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগেন। কথা বলার জো নেই। রাফি তাবাসসুম এর লা’শ কে নিয়ে তদন্তহীন ঝামেলা মেটাতে গেলো। নাদিমের গার্ডস এর মাঝে হৈচৈ লেগে গিয়েছে। গার্ডস নিয়ে তৎক্ষণাৎ নাদিম-কে হসপিটালাইজ করে। আফরাজ চিন্তিত। নাজীবা স্বামীকে ধরে চোখের পানি ঝরাচ্ছে। গতরাতেও ভাইকে পেয়ে সুখের পানি ঝরিয়ে ছিল। অথচ এক রাতের ব্যবধানে এমুহুর্তে চোখের থেকে বেদনার পানি ঝরাছে। মিসেস ফেরদৌসী বউমা কে টেনে বসিয়ে দেন।ছেলেকে ইশারায় নাদিম এর খোঁজ নিতে ইঙ্গিত দেন। অপারেশন কেবিন থেকে মাস্ক খুলে ডক্টর বের হলেন। সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়।
ডক্টর বলেন,
“আইম সরি টু সে এসিড বাজেভাবে লেগেছে মিস্টার নাদিমের বাম হাতে। কয়েকমাস পর বাম হাতটা নাড়াচাড়া করতে পারবেন তার আগে নয়। কিন্তু ওষুধের উপর রাখতে হবে যেনো হাতটা অচল না হয়ে পড়ে। আর দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে এসিডের দাগটা আজীবন রয়ে যাবে। ভারী কাজ করতে হলে হেল্পিং হ্যান্ড লাগবে। নাউ পেশেন্ট ইজ রেস্টিং। আফটার হাফ আওয়ার উই শিফট হিম ইন দ্যা কেবিন।”
নামাজ রুম থেকে বের হয়ে অপারেশন রুমের দিকে আসছিল কাজল। এসেই ডক্টরের কথা শুনে ফেলে। চোখ-মুখের বেহাল দশা বানিয়েছে। কাজলের বাবা ডক্টরের কথা শুনে মনেমন মেয়ের ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি জানান। অনড় কাজল। বাবার মুখের দিকে চেয়ে বলে,
“যাকে ভালোবাসি তাকে কখনো পরিস্থিতির খাতিরে ফেলে চলে যাবো না আমি। আমার নাদিম অচল হলেও তাকে আমি স্বামী রুপে মেনে নেবো। তবে তাকে ছাড়া অন্য কেউ নয়!”
মেয়ের কথায় কাজলের বাবা খুশি হলেন। এবার নাদিম এর জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষা শুধু।
ঘুম ভাঙে নাদিমের। পাশে কান্নাময় চেহারা নিয়ে বোন-কে বসে থাকতে দেখল। বোনের হাত ধরতে ডান হাত উঠাতে নিলে নাজীবা নিজে ভাইয়ের হাত ধরল। নাদিম বলে,
“তোর সুখকে বাঁচিয়েছি বিনিময়ে আমার খুশিকে প্রাধান্য দিস।”
ভাইয়ের কথার অর্থ বুঝতে পেরে নাজীবা মাথা নাড়ল। নাদিম সকলের সাথে টুকটাক কথা সারলেও তার চোখজোড়া এক রমণীর উপস্থিতি খুব করে অনুভব করছে। জানে না মেয়েটা নিজের কি হাল করেছে? আদৌ সুস্থ আছে কিনা বুঝতে পারছে না। লজ্জায় বোনের শ্বশুরবাড়ির কাউকেও জিজ্ঞেস করছে না। বোন কি ভাববে তা ভেবে মৌন রইল। অথচ নাজীবা ভাইয়ের অস্থিরতা ঠিকি ধরতে পেরেছে। কেশে সকলকে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। তখন দীমি পায়ে প্রবেশ করে কাজল। তার দিকে শীতল নয়ন ফেলল নাদিম। মেয়েটার চোখের কোণে পানি চকচক করছে। পুনরায় রাতের কথাটি তুলে বলে,
“আমাকে কি আর বিয়ে করবে কাজল্লতা? আমি কি আর তোমার স্বামীর যোগ্য রয়েছি? নাকি আমার এই এসিড পোড়ানো হাত দেখে অযোগ্য হয়ে পড়লাম। তুমি নিসংকোচে বলতে পারো। আমি নিজ হাতে আমার কাজল্লতার বিয়ে অন্যপারে দেবো। আমি অযোগ্য হলেও আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা কখনো মিথ্যা হবে না।”
“ব্যস চুপ করুন। এতো কথা বলতে বলেছি আমি? ব’দ’মাই’শ হা’রা’মজা’দা কু’ত্তা।”
গা’লি ছুঁড়ে কোনো দিকবেদিক না মেনে নাদিমের নিকট ছুটে গিয়ে ওষ্ঠজোড়া মিলিয়ে দেয়। নাদিম এর চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেলো। তার হবু অর্ধাঙ্গিণী এতো ফাস্ট জানা ছিল না তার! কাজল পরম আবেশে নাদিম এর পাশে খানিক স্থান জুড়ে বসে দুজোড়ার শুকনো ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিচ্ছে। আফরাজ তার শা’লকের প্রাইভেসির জন্য সকলকে নিয়ে রিসেপশনে চলে যায়। আকবব,রাফি,জনাব ইসমাইল থাকল হাসপাতালে। আফরাজ মহিলাগণ কে রিসোর্ট এ না রেখে বাসায় ছেড়ে হসপিটালে ফিরে আসল।
পাঁচ মাস তিন সপ্তাহ পর…..
নাজীবার দম ফেলার অবকাশ পাচ্ছে না। নিজ হাতে নাদিম ভাইয়ের বিয়ের আয়োজন করছে। কুসুমার ভারী পেট নিয়ে কাজ করা অসম্ভব। অসহায়ের মত তাকিয়ে আছে। তারও ইচ্ছা করছে বিয়ের আনন্দ উপভোগ করতে। সবার ভালোবাসার কাছে পরাজয় হয়ে বসে আছে। নতুন মাসের প্রথম সপ্তাহেও সুখবর শোনা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন ডক্টর।
আফরাজ পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে গোমড়া মুখে বসে আছে। কেমন পাষাণ নারী সে! তার আর্দশ ভাইয়ের বিয়ে বলে সে আর কুসুমা ভাবী রাতের আঁধারেই বাসায় চলে গেল। ফোনের দিকে বারংবার চোখের দৃষ্টি ফেলছে। কোনো ফোন কল অব্দি দিলো না পাষাণ নারীটি। মিসেস ফেরদৌসী ছেলের রুমে এসে তাড়া দিলেন। আফরাজ বিরক্তিকর গলায় বলে,
“যাবো না আমি। যান আপনারা।” ছেলের কথা শুনে মিসেস ফেরদৌসী মৃদু হেসে চলে যান। আফরাজ পাত্তা না পেয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে ঘাপটি মে’রে বসে রইল।
মিসেস ফেরদৌসী-রা আকবর-কে কে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন। জনাব ইসমাইল ছেলের রুমের জানালার দিকে তাকিয়ে উচ্চ গলায় বলেন,
“ব্যাটা মেয়েদের মত মুখ না ফুলিয়ে চলে আয়।”
আফরাজ পা দিয়ে পা’রা দিচ্ছে। হঠাৎ ফোনে নোটিফিকেশন এলো। মেসেজ রেকর্ড বোধ হয়। রেকর্ডিং চালু করতেই নাজীবার কণ্ঠ শুনতে পায়। আক্ষেপের সুরে জলদি আসার জন্য বলছে। আফরাজ ফোন পকেটে ভরে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
বিয়ের মঞ্চে শেরওয়ানি পরিহিত বর জনাব নাদিম মুসসারাত অস্থীর হয়ে বসে আছে। নতুন জীবন শুরুর অনুভূতি তাকে উদগ্রীব বানিয়ে দিচ্ছে। তার হবু স্ত্রীর অপেক্ষায় কাতরাচ্ছে। নাজীবাও আজ ভাইয়ের বিয়ে বলে সৌন্দর্যে মোড়ানো সাজ দিয়েছে। তার বোরকায় স্টোন এটার্চ করা।
গাড়ির হর্ন শুনে নাদিম উৎসুক দৃষ্টিতে চাইল। আফরাজদের দেখে খুশি হলো বটে। মঞ্চের উপর উঠে আফরাজ পরিবার সমেত কোলাকুলি করল। জনাব ইসমাইল আর মিসেস ফেরদৌসী দোয়া দিলেন নতুন বরকে। আফরাজ উৎসুক দৃষ্টি দিয়ে বিবিজান কে খোঁজে চলেছে। দেখা পাচ্ছে না বলে মনেমন রা’গ ঝারছে মেয়েটার উপরে। হাতে গ্লাস ভর্তি শরবত নিয়ে মঞ্চের দিকে আসছিল নাজীবা। জিভে কামড় লাগায় বুঝতে পারল কোনো এক শ’য়’তান খুব করে বকেছে। আফরাজ এর অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। নাজীবা হাসিমাখা মুখশ্রী নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন কে শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করল। স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে বাহুডোরে হাত পেঁচিয়ে বলে,
“জানেন কোনো এক কু’ত্তা বিলাই আমাকে গা’লি দিছে। আমার জিভে জোরে কামড় খাইছি। ব্যাটা কী ব্যাটি যেই গা’লি ছুঁড়ছে তারে আমি পেলে পঁচা নালায় ডুবাবো।”
বিবিজান এর কথা শুনে ঢোক গিলল আফরাজ। মনেমন আর কখনো গা’লি বা বকা দিবে না বলে নিজের কাছে শপথ করে।
নাদিম কে আর অস্থিরতায় ভোগালো না মেয়েপক্ষ। কাজলের কাজিনরা বিয়ের মঞ্চে উঠালো। নাদিম বউয়ের হাত ধরে পাশে বসায়। মিটমিটে হাসির শব্দ বুনল। কাজীও চলে এলেন। কাবিননামা দেনমোহর ধার্য করে দুজনের বিয়ে পড়ানো হলো। সকলে ‘আলহামদুল্লিল্লাহ্’ বলে দোয়া পাঠ করে। কাজল কে ভাবী ডেকে নাজীবা আর কুসুমা দুষ্টুমি করতে লেগে পড়ে।
খাওয়ার পর্ব শেষে অতিথিবৃন্দ বেরিয়ে যায়। কাজলকে ভাইয়ের রুমে বসিয়ে নাজীবা অধীর আগ্রহে টাকা হাতানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। নাদিমকে আকবর আর আফরাজ টিজ করতে করতে রুমের কাছে আনলো। বিবিজান কে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
“বিয়ে হয়েছে তোমার ভাইয়ের। পথের থেকে সরে ঢুকতে দাও তারে। জানো না আজ রাতে তোমার ভাই বিলাই মা’র’বে।”
লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে গেলো নাদিম। নাজীবা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
“হাতের মধ্যে কচকচে দশটা হাজারের নোট রাখো। নাহলে রুমে প্রবেশ করার কথা তো ভুলেই যাও।”
নাজীবার পক্ষ নিতে কাজলের কিছু কাজিনও হাজির হয়ে যায়। যা দেখে আকবর মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,
“ভাই দিয়ে দেহ্। নাহলে আমাদের মত অবলা জোয়ান পুরুষদের হরণ করে নেবে এই মাইয়াগণ। সবগুলোই টাকার ক্ষুধার্ত। টাকা না পেলে আজ রাত আমাদের অন্তিম রাত হয়ে যাবে।”
নাদিম টাকা দিয়ে দেয়। মেয়েরা টাকা পেয়ে ছু’মন্তুর হয়ে যায়। আফরাজ এর নজর তখনও নাজীবার দিকে। আজ মেয়েটা তারে পাগল বানিয়ে ছেড়েছে। নাদিম ভেতরে ঢুকে পড়লে আফরাজ হাই তুলে বলে,
“যাহ্ ব্যাটা ভাবীর কাছে যাহ্। হবু বাচ্চাকে আগলে নিয়ে আদর কর। আমিও গিয়ে আরেকবার বাসর ছাড়ি। আজ নাহয় বাচ্চার প্রসেসিং চালু করব।”
“বকরচকর ব্যাটা। যাহ্ ভাগ এখান থেকে।”
বন্ধুকে লা’থ মা’রতে নিলে আফরাজ তৎক্ষণাৎ দূরে সরে যায়। চোখ টিপ দিয়ে বিবিজান এর কাছে গেল। রুমে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে না পেয়ে বিরক্ত হলো। মেয়েটা খালি খাপছাড়া ভাব নিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। কোথায় তুই জামাইকে পেয়ে আদর করবি তা না উল্টা টইটই করে ঘুরে বেড়াস। ড্রয়িং রুম থেকে হৈচৈ এর শব্দ শুনে আফরাজ উঁকি মেরে দেখল। কাজিনপক্ষ এর সাথে নাজীবা আড্ডা দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে লাঠি একখান হাতে নিলো। তাদের মাঝে গিয়ে বলে,
“সবার টাকা ভাগাভাগি শেষ। একেকটা ডান্ডার বা’রি খেতে না চাইলে যে তার রুমে পালাও।”
তাদের আর পায় কে? হুডমুড় করে নাজীবাকে রেখে পালিয়ে যায়। লাঠিটা রেখে বুকের উপর হাত গুজল আফরাজ। স্বামীর নীরব মেজাজ দেখে আমতা আমতা করে বলে,
“আ আমি আজকে ভাবীর কাছে থাকি কেমন?”
কথা বলার অজুহাত না পেয়ে এটুকু বলে পালাতে নিলে আফরাজ পাঁজাকোলা করে নেয়। নাজীবা ভীতি গলায় বলে,
“দেখেন উল্টাপাল্টা কিছু করলে ভাইকে বলে দেবো।”
“দাও দেখি। আজ আমার শা’লাও বাপ হওয়ার প্রসেসিং নেবে। এদিকে আমি? একবছরের মত হচ্ছে বিয়ে করেছি। বাপ ডাক আর কত দেরিতে শুনবো। আজ আমিও চক্কা মা’র’ব। গেট রেডি বিবিজান।”
নাজীবা মাথা নেড়ে ‘না না’ করছে। ছাড় পেল না। রুমে গিয়ে বিবিজান কে আপন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আফরাজ। মন-মস্তিষ্কে শুধুই এখন তার বিবিজান। সুখের মুহূর্তে আফরাজ ফিসফিসিয়ে বলে,”আমার বিবিজান কে আমি #হৃদয়াঙ্গণ এ আগলে নিচ্ছি।”
পরম আবেশে নাজীবা আঁকড়ে ধরল তার আফরাজ কে।
দু’বছর পর……
কুসুমা তার দু’বছরের বাচ্চা আজিম কে কোলে নিয়ে চিন্তিত মুখে নাজীবার পাশে বসে রইল। আজিম কে বিছানায় শুয়ে দেয়। আজিম তার বড়’মাকে খুব পছন্দ করে। কারণ কুসুমা অসুস্থ অবস্থায় নাজীবা মায়ের মমতায় পালন করতো। হামাগুড়ি দিয়ে নাজীবার কোলে মাথা রাখে। আফরাজ তিনমাস হলো দেশের বাহিরে গিয়েছে। তার সাথে কন্টাক্টও করা যাচ্ছে না। ছেলেটা এমন কেনো? কুসুমা বুঝে না। তার বউত চিন্তায় চোখের নিচে কালি বসিয়ে ফেলেছে। বউ-মার আকস্মিক মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় মিসেস ফেরদৌসী বেশ ভয় পেয়েছেন। জনাব ইসমাইল চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
“আমাদের বউমা ঠিক আছে তো ডক্টর? আপনি কিছু বলছেন না যে?”
“কি বলবো? আপনাদের খুব সর্তক হওয়া উচিৎ। আপনাদের বাড়ির বউ যে তিনমাসের গর্ভবতী সে খবর রেখেছেন?”
ডক্টরের হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী থেকে কথাগুলো শুনে সকলের মুখে হাসি ফুটল। জনাব ইসমাইল ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললেন। তৎক্ষণাৎ আকবরকে মিষ্টির জোগান দিতে বলেন। সেও চাচা হওয়ার খুশিতে আফরাজ কে মেসেজ করে দেয়। অন্যথায়, আফরাজ মিটিং এ ব্যস্ত ছিল। প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিল। তার ফোনে মেসেজ আসায় চোখের দৃষ্টি সেদিক দিতে পারল না। বিদেশে আসার পর থেকেই মিটিং,কাজের চাপে বাসার কারো সাথে কথা বলতে পারছিল না। ফোন দেখার সময় অব্দী পেতো না। আকবর একটু আধটু বাসার খবর সম্পর্কে রেকর্ড পাঠাতো। নাজীবার মেসেজ কল দেখেও রিপ্লাই করতো না। কারণ তারও মন জ্বলত। কাজের চাপে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতো। কাজ যত জলদি শেষ করবে তত জলদি সে বাসায় ফিরতে পারবে।
আড়াইঘণ্টা পরে কেবিনে ফিরে এসে বসল আফরাজ। ফোন হাতে নিয়ে আকবর এর পাঠানো মেসেজটা পড়ল। ‘আমি চাচা হতে যাচ্ছি।’ আফরাজ বুঝল না। পাত্তাহীন রেখে দিল। পরক্ষণে টনক নড়ে। আকবর চাচা হচ্ছে মানে? কথাটা তার মস্তিষ্কে জোয়ার তুলল। ফোন হাতে নিয়ে পুনরায় মেসেজটা পড়ে। হঠাৎ খুশিতে চিল্লিয়ে উঠে। তৎক্ষণাৎ বিবিজান কে কল দেয়। স্বামীর কল পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় নাজীবা। এরোপ্ল্যান মোড অন করে রেখে দেয় ফোন। আফরাজ বিবিজান এর অভিমান বুঝতে পারল। কালকেই শেষ প্রেজেন্টেশনটা রেডি করে ফেলবে। এরপর বিবিজান এর অভিমান ভাঙ্গাতে ফিরে যাবে।
পরের রাত প্রায় তিনটা নাগাদ….
তাহাজ্জুদ এর নামাজ আদায়ে বসেছে নাজীবা। মিনিট খানেক পর সালাম ফেরানো শেষে তার চোখজোড়া খুলে। পাশে আফরাজ কে দেখে স্তদ্ধ হলো। পরমুহূর্তে খিলখিলিয়ে হেসে স্বামীকে বুকের উপর লুটে পড়ে। রাত দুইটার সময় দেশের মধ্যে পৌঁছেছে আফরাজ।নাজীবা ব্যতীত সকলের আফরাজ এর আগমন বার্তা জানা। জনাব ইসমাইল,আকবর আর নাদিম এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল। আফরাজ এর উতলা মন বিবিজান কে দেখার জন্য ছটপট করছে। নাদিম এর সাথে মজামাস্তির মাঝে মোবারকবাত দিলো। কেনো না নাদিম বাবা হয়েছে সপ্তাহ খানেক হবে। তার কন্যা সন্তানের ছবি দেখেছিল ফোনে। নাম ‘কণিকা মেহজাবিন’ রেখেছে। নাদিম হেসে বলে, ‘তুইও কম কিসে? মাশাআল্লাহ অবশেষে বাচ্চার বাপ হতে চলেছিস।’
আফরাজ হাসল। দু’বছর অপেক্ষার পর তাদের কোলজুড়ে সন্তান আসতে চলেছে। দু’বছর আগেও নাজীবার প্রেগন্যান্সি নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলো। মেয়েটা গর্ভধারণ করতে না পারার কষ্টে নেতিয়ে পড়েছিল। ডক্টর দেখিয়েও লাভ হয়নি। রিপোর্টে সব শুদ্ধ পাওয়া যেতো। বিঘ্নিত মনে নাজীবাও দূরত্ব বাড়ায়। কিন্তু আফরাজ অসীম ধৈর্য্য দ্বারা বিবাহ সম্পর্ককে অটুট রাখে। প্রতিসময় আল্লাহর কাছে মানত করত। সবচেয়ে বড় ব্যাপার আফরাজ তাবাসসুম এর মায়ের সুস্থতা কামনা করে ভালো আশ্রমে রেখেছে। সব হারিয়ে হিয়া দেয়ান এর মাঝে কোনো প্রতিহিংসা নেই। তিনিও মনেমন আফরাজ আর নাজীবার জন্য দোয়া করেন। প্রশান্তির শ্বাস ছেড়ে আফরাজ গাড়ি থেকে নামে।
তড়ফড়িয়ে বিবিজান এর দর্শন পেতে রুমে চলে যায়। সেখানে নামাজরত বিবিজান কে দেখে সেও পরিপাটি হয়ে নামাজে বসে পড়ে। স্বামী-কে পেয়ে নাজীবা আহ্লাদী গলায় বলে,
“আর কিন্তু কষ্ট দিবেন না। নাহলে আমি আমাদের বাবুকে নালিশ দেবো।”
“তাহলে তো আমার বাবুর আম্মুর খুব যত্ন নিতে হবে। নাহয় পুচকা বা পুচকি এসে চ’ড় মা’র’বে।”
কথাটা বলে বিবিজান এর পেটে আলতো হাত ছুঁয়ে চুম্বন দেয় আফরাজ। বিবিজান এর গালে এক হাত রেখে বলে,
“আজীবন আমার হয়ে থেকো বিবিজান , শুধুই আমার হৃদয়ের আঙিনায় #অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ রূপে থেকো।”
স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরে মিহি গলায় বলে,”ইন শা আল্লাহ থাকব।”
আফরাজ বিবিজান কে বুকে আগলে রেখে জানালার বাহিরে আকাশের মধ্যে লুকোচুরি করা মেঘের দিকে চেয়ে থেকে আদুরীয় কন্ঠে কথার ঝুলি খোলে বসে। একফালি চাঁদ এর রশ্নিতে তারা নিজেদের মনভাব প্রকাশ করছে।
সমাপ্ত……
(অতএব, গল্পের সমাপ্তি ঘটলো। ভুলগুলো ক্ষমা করবেন আর গল্পটা নিয়ে আপনাদের মন্তব্য চাই। আশা করি আপনারা মন্তব্য করবেন। কোনো একসময় ইন শা আল্লাহ আবারো নতুন গল্প নিয়ে হাজির হবো। আপনাদের এই লেখিকাকে ভুলবেন না। ফিরব কোনো একদিন ইন শা আল্লাহ। ততদিন ভালো থাকবেন। দোয়া করবেন আমার জন্য।