উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-৩৭||

0
730

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৭||

৭৪।
আহি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আফিফের দিকে। আফিফের হাতে টিস্যু। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার দৃষ্টি আফিফ আর আহির দিকে। আহি কিছু বলতে যাবে তখনই তাজওয়ার আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কি হলো, দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমি আমার ফিয়োন্সের শাড়িটাই নষ্ট করে দিয়েছো। শাড়িটা তো এই মুহূর্তে পরিস্কার করে লাভ নেই। অন্তত জুতো জোড়া তো মুছে দাও।”

আফিফ হাঁটু গেড়ে বসতেই আহি সরে দাঁড়ালো। তাজওয়ারের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“বেশি বাড়াবাড়ি করছো তুমি!”

“তোমার কেন এতো সমস্যা হচ্ছে!”

“তুমি জানো কেন সমস্যা হচ্ছে। তোমাকে বলেছি আফিফ পদ্মের…”

তাজওয়ার আহির ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিলো। এরপর আহির ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে বলল,
“অন্যের স্বামীর প্রতি তোমার এতো মায়া থাকা উচিত না।”

আহি তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তার চোখ দু’টিতে স্পষ্টভাবে অশ্রু ভীড় করেছে। তাজওয়ার তা দেখে বাঁকা হাসলো। আহি তাজওয়ারের হাসি দেখে বলল,
“ভেবেছি, তোমার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু না। আমার বাসায় মুনিয়া খালা আর চুনি আছে, ওরা কখনো আমার পায়ে থাকা অবস্থায় আমার জুতোয় হাত দিতে পারে নি। আর তুমি এতোগুলো মানুষের সামনে আমার চেয়ে বয়সে আর সম্মানে বড় একটা মানুষকে বলছো আমার জুতো পরিস্কার করে দিতে? অন্যের স্বামী হোক, আর যাই হোক, আফিফের একটা সম্মান আছে। ও শিক্ষিত ছেলে। ও তোমার অফিসে যোগ্যতা নিয়ে এসেছে। এসব কাজ করতে আসে নি।”

তাজওয়ার জোর গলায় আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে কি কাজ দিয়েছি ভুলে গেছ? তাড়াতাড়ি আহির জুতো জোড়া মুছে দাও।”

আফিফ এবার আহির পায়ে হাত দিলো। তাজওয়ার সরে অন্য পাশে গিয়ে বসলো। তাজওয়ারের বন্ধুরাও বেশ আয়েশ করে বসেছে, যেন তারা কোনো নাটক দেখতে বসেছে।
আহি ইতস্ততবোধ করছিল। আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“অন্য কেউ হলে অপমানিত হতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মোটেও খারাপ লাগছে না।”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কি!”

আফিফ তার হাঁটুর উপর আহির ডান পা’টা উঠালো। ধীরে ধীরে আহির পা মুছে দিতে দিতে বলল,
“তাজওয়ার খান সেদিনের প্রতিশোধ ভালোভাবেই নিচ্ছে।”

আহি আফিফের কথা শুনে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার দূরে বসে আছে। সে আফিফের কথা শুনছে না। আফিফ আবার বলল,
“আমার জন্য তুমি তাকে নিয়াজীর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলে। আমার জন্য তুমি তাকে এমন একটা কাজ করতে বাধ্য করেছিলে, যেটা সে করতেই চায় নি। আমার জন্য তুমি কিছু করলেই, সে তার দ্বিগুণ আমাকে ফিরিয়ে দেবে। তাহলে কেন করছো আমার জন্য এসব?”

আহি পা সরিয়ে ফেলতেই আফিফ উঠে দাঁড়ালো। আহির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে আর পদ্মকে একা ছেড়ে দাও।”

আহির ভীষণ রাগ উঠলো। সে হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। আফিফ একনজর তাজওয়ারের দিকে তাকাতেই দেখলো তাজওয়ার বেশ উৎসুক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে আহি একপাশে এসে দাঁড়ালো। হাতে থাকা ব্যাগটা ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। মিনমিনিয়ে বলল,
“কি ভেবেছো আফিফ? আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই আমাকে যা ইচ্ছে শোনাবে? আমি তোমাকে আর কখনোই ইম্পোরটেন্স দেবো না। আমাকে পদ্ম বলেছিল, তাই আমি নিয়াজীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। আর যদি তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকতো, তবুও আমি একটা না একটা স্টেপ নিতাম। আফটার অল আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড বিপদে পড়েছিল! কিন্তু তুমি ভাবছো, তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। তোমার জন্য কি এখন আমি পদ্মের সাথেও যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলবো?”

আহি চোখ মুছে বলল,
“ঠিক আছে। তোমাদের ভালোর জন্য আমি এখন সেটাই করবো। তোমাদের জীবনে ঝড় আসলেও আমি ফিরে তাকাবো না। এখন তোমার বউকে কোলে নিয়ে বসে থাকো তুমি। ইডিয়ট ম্যান।”

আহি পেছন ফিরতেই দেখলো আফিফ তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আহি আফিফকে দেখে চেঁচিয়ে বলল,
“যাও এখান থেকে। এখানে কি করছো?”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “সরি।”

“তোমার সরি আমার লাগবে না। নিজেকে কি ভাবো তুমি, হ্যাঁ? একমাত্র তুমি ছাড়া কি আমার জীবনে কি কোনো পুরুষ নেই? এখন আর আমার সামনেও এসো না। পদ্মের সাথেও আমি আর যোগাযোগ রাখবো না। তোমরা বউ জামাই মিলে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যাও।”

আফিফ হাসলো। আহি চোখ বড় বড় করে আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি হাসছো?”

“তোমার কথা শুনে হাসি পেয়ে গেলো।”

“তুমি আসলেই একটা ইডিয়ট। আজ যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। এখন থেকে প্রতিদিন তাজওয়ার তোমার সাথে এমনই করুক। খুশি হবো আমি।”

আফিফ এবারও মুখ চেপে হাসলো। তা দেখে আহি হনহনিয়ে চলে গেলো।

(***)

হেমন্তের রাত। খোলা আকাশের নিচে মত্ত হয়ে আছে কিছু কপোত-কপোতী। আহি অবাক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন পবিত্র মাসেও তাদের মধ্যে কোনো শৃঙ্খলা নেই। এমন একটা অসুস্থ পরিবেশে কীভাবে সে তার বাকী জীবন কাটাবে, ভাবতেই তার শরীরটা অসার হয়ে আসছে। আহি তার সামনে থাকা ঝুলন্ত রঙ-বেরঙের বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ তার কোমড়ে কারো স্পর্শ পেতেই আহি চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“তাজওয়ার প্লিজ, ভালো লাগছে না এসব।”

কথাটি বলতে বলতেই আহি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, তাজওয়ারের বন্ধু অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। আহি অর্ণবকে দেখে রীতিমতো অবাক হলো। ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তুমি এখানে?”

অর্ণব বাঁকা হেসে বলল,
“কেন? অন্য কাউকে আশা করেছিলে বুঝি!”

আহি অর্ণবের পাশ কেটে চলে আসতে যাবে তখনই অর্ণব তার হাত ধরে আটকালো। আহি এক ঝটকায় অর্ণবের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার সাথে এমন নোংরামি করবে না।”

অর্ণব হেসে বলল,
“নোংরামির কি দেখলে, আহি!”

অর্ণব এরপর চোখ বন্ধ করে বুকে হাত রেখে বলল,
“আহ, নামটা উচ্চারণেই এতো শান্তি পাচ্ছি! না জানি তোমার মাঝে ডুব দিলে কতো শান্তি পাবো।”

আহি কথাটি শুনেই সশব্দে অর্ণবের গালে চড় বসিয়ে দিলো। অর্ণব গালে হাত দিয়ে কুৎসিত হাসি হেসে বলল,
“সবাই ড্রাংক। এই মুহূর্তে আমি ছাড়া কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না।”

অর্ণব আহির হাত চেপে ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল,
“শাড়িতে কোনো মেয়েকে এতো চমৎকার লাগতে পারে, আমি কখনো ভাবতেই পারি নি।”

আহি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“তাজওয়ার কোথায়!”

অর্ণব হেসে বলল,
“তাজ ব্যস্ত আছে। হয়তো আজ সারারাত সে ব্যস্ত থাকবে। তুমি তো ওকে ভালো রাখতে পারছো না। তাই ভালো থাকার জন্য তাকে অন্য জায়গায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।”

আহি অর্ণবকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমাদের মতো অসভ্য ছেলেদের জায়গা নরকে।”

অর্ণব হাসলো আর বলল,
“মনে হচ্ছে তাজকে ইদানীং এসব জ্ঞান একটু বেশিই দিচ্ছো। কিন্তু আমাদের তাজকে এতো সহজে তুমি পরিবর্তন করতে পারবে না।”

আহি উল্টো পায়ে পিছিয়ে যেতেই অর্ণব আহির কোমড় ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো। আহি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। অর্ণব তা দেখে বলল,
“তুমি অন্তত একদিন আমাকে সময় দাও। এরপর তুমি যা চাইবে আমি তোমাকে তাই এনে দেবো।”

আহির চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। সে ভেজা কন্ঠে বলল,
“তুমি আমাকে যেমন ভাবছো, আমি তেমন মেয়ে নই। আমাকে ছাড়ো বলছি। আমি এসবে ইন্টারেস্টড নই, প্লিজ।”

অর্ণব আহিকে আরো জোরে চেপে ধরলো। আহি অর্ণবের শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। হঠাৎ পেছন থেকে অর্ণবের পিঠে সজোরে কেউ ঘুষি মারলো। অর্ণব ভারসাম্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তেই আহিও ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। কারণ সে আহিকেই ধরে রেখেছিল। কিন্তু আহির পিঠ মাটি স্পর্শ করার আগেই সেই মুষ্টিবদ্ধ হাতটি উন্মুক্ত হলো। মানুষটি শক্ত করে আহির হাতটা আঁকড়ে ধরলো। এরপর আহিকে নিজের দিকে টেনে এনে বলল,
“তুমি ঠিক আছো!”

আহি কাঁপা কন্ঠে বললো, “আফিফ, তুমি এখনো যাও নি?”

“যাই নি। ভালোই তো হয়েছে যাই নি। আমি যদি এখন চলে যেতাম, কি হতো?”

আহি চুপ করে রইলো। আফিফ গম্ভীরমুখে বলল,
“তোমাকে কে বলেছে এখানে আসতে? আহি, এই জায়গা তোমার জন্য না।”

“তাজওয়ার নিয়ে এসেছে আমাকে।”

“আমার চেয়ে তুমি ওকে ভালো করেই চেনো। ও তোমাকে নিয়ে আসতে চাইলে, তুমি আসবে কেন? আর এই কয়েক মাসে আমার ওকে আরো ভালো করেই চেনা হয়ে গেছে।”

এদিকে অর্ণব মাটি থেকে উঠে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
“এই ফকিরের বাচ্চা, তোর সাহস কি করে হয়, আমার গায়ে হাত তোলার?”

আফিফ আহিকে আড়াল করে দাঁড়ালো। অর্ণব আফিফের গায়ে হাত উঠাতে যাবে তার আগেই আফিফ হাত ধরে বলল,
“তোমরা আমাকে অনেক অপমান করেছো, আমি সহ্য করেছি। কিন্তু আমার সামনে কোনো মেয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারবে না। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবো, এটা আশা করো না।”

অর্ণব হাসলো। শব্দ করেই হাসলো। এরপর আফিফকে হালকা ধাক্কা দিলো। আহি আফিফের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“আফিফ, চলো এখান থেকে চলে যাই। আমি চাই না, আমার কারণে তোমার কোনো সমস্যা হোক।”

(***)

এদিকে অর্ণব জোরে জোরে তাজওয়ারের নাম ধরে ডাকলো। তাজওয়ার একটু পর বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। তাজওয়ারের সাথে বেরিয়ে এলো একটি মেয়ে। মেয়েটার পরণের জামা-কাপড় এলোমেলো। মেয়েটাকে দেখে আহির চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। যেই মানুষটার সাথে তার সংসার করতে হবে, সেই মানুষটা যদি এমন হয়, তখন কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। এরই মধ্যে তাজওয়ারের বাকি বন্ধুরাও বেরিয়ে এলো। তাদের মধ্যে সজিব ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন, অর্ণব?”

অর্ণব সজিবের কথা উত্তর না দিয়ে তাজওয়ারকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
“তাজ, তুই কোথায় ছিলি এতোক্ষণ?”

তাজওয়ার তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বলল,
“সজিবের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।”

আহি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মিনমিনিয়ে বলল,
“আড্ডা দিচ্ছে!”

অর্ণব বলল,
“তুই আড্ডা দিচ্ছিস, আর তোর ফিয়োন্সে ব্যস্ত তোর পারসোনাল এসিস্ট্যান্টের সাথে।”

আফিফ আর আহি অবাক দৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাকালো। অর্ণব রুক্ষ দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস, সে একটা ক্যারেক্টার লেস।”

আফিফের এবার রাগ উঠে গেলো। সে অর্ণবের কলার ধরে তাকে ঘুরিয়ে নাক বরাবর ঘুষি মেরে বলল,
“আরেকবার আহিকে নিয়ে বাজে কথা বললে, আমি তোকে মেরে ফেলবো।”

তাজওয়ার এসে আফিফের কলার ধরতেই আহি তাজওয়ারের হাত ধরে বলল,
“তুমি তোমার বন্ধুর কথা বিশ্বাস করো না। তোমার বন্ধু মিথ্যে কথা বলছে। ও নিজে আমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। আফিফ তো আমাকে ওর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে।”

অর্ণব বলল,
“তাজ, তুই তো আমাকে চিনিস। আমি কি তোর ফিয়োন্সের সাথে এমন কিছু করতে পারি?”

তাজওয়ার আহির দিকে তাকালো। আহির চোখে জল। আর তার দৃষ্টি তাজওয়ারের হাতের দিকে, যেই হাত দিয়ে সে আফিফের কলার ধরে রেখেছে। তাজওয়ার এবার চোখ-মুখ কুঁচকে তার এক হাত দিয়ে আফিফের গলা চেপে ধরে অন্য হাত মুঠো করে আফিফের মুখে ঘুষি মারতে লাগলো। আহি তাজওয়ারকে সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আহির এই অস্থিরতা তাজওয়ারকে আরো হিংস্র করে তুলছে। সে আফিফকে মাটিতে ফেলে তার পেটে লাথি মারতে লাগলো। এসব দেখে আহি মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো। আফিফকে মার খেতে দেখে আহির চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছিলো তার। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো আহি। অস্থির লাগছিলো তার। হাত-পাও অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। হাত দিয়ে শক্ত করে মাটি আঁকড়ে ধরে আছে আহি। তাজওয়ারের চোখ আহির দিকে পড়তেই সে থেমে গেলো। আহির দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে, দ্রুত তার কাছে এসে বসলো। আহি অস্থিরভাবে ছটফট করছে। আফিফ মাথা তুলে আহিকে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করতেই অর্ণব এসে আফিফের পিঠে আরেকটা লাথি মারলো।

এদিকে তাজওয়ার আহির হাত ধরে বলল,
“কি হয়েছে তোমার?”

আহি নিভু নিভু চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। আর শরীরের যতোটুকু শক্তি ছিল সেই শক্তি দিয়েই সে তাজওয়ারের চুলগুলো টেনে ধরলো। তাজওয়ার সজিবকে বলল,
“পানি নিয়ে আয়।”

সজিব পানি আনতেই তাজওয়ার সেই পানি হাতে নিয়ে আহির মুখে ছিটিয়ে দিলো। একটু পর আহি স্বাভাবিক হতেই তাজওয়ারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। এরপর তার কাঁপা শরীর নিয়ে আফিফের কাছে এসে বসলো। আফিফের মাথাটা উঠিয়ে নিজের কোলের উপর রাখলো, অস্ফুটস্বরে ডাকলো, “আফিফ!”

আফিফ চোখ খুলে কাঁপা কন্ঠে বলল,
“এবার খুশি হয়েছো?”

আহি মলিন মুখে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। তখনই তাজওয়ার আহির কাছে এসে তাকে টেনে উঠালো। আহি তাজওয়ারকে আবার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। কাঁপা কন্ঠে বলল,
“যেই ছেলেটা আমাকে বাঁচিয়েছি, তুমি তাকে মেরেছো? তুমি আমাকে কেন এনেছো এখানে? নিলাম করতে এনেছো? আমার বাবা তো আমাকে তোমার কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। তুমিও এখানে তোমার বন্ধুদের কাছে আমাকে বিক্রি করতে এনেছো, তাই না?”

(***)

আফিফের নাক ফেটে গেছে। নাক বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মাথাটাও ভোঁ ভোঁ করছে তার। সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আহির হাত ধরলো। তাজওয়ার কিছু বলার আগেই আফিফ বলল,
“যদি আমার স্ত্রী বা আমার বোনের সাথে বাইরের কোনো ছেলে খারাপ ব্যবহার করতো, তাহলে আমি আপনার মতো নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতাম না। আর আপনি যাকে ভালোবাসেন, তাকে আপনার বন্ধুদের সাথে একা ছেড়ে অন্য জায়গায় ব্যস্ত হয়ে গেছেন? সরি স্যার, আমি আপনার এসিস্ট্যান্ট মাত্র। কিন্তু এমন অসম্মান আমি দেখে থাকতে পারবো না। আমাকে তো বেশ মারলেন। জানি, আপনার আমার প্রতি কেন এতো রাগ। কিন্তু একবার ওই দিকের সিসি ক্যামেরাটা দেখে আসবেন।”

আফিফের কথা শুনে অর্ণব অবাক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো। বাসাটা জিলানের। কিন্তু এই বাসার প্রতিটা স্থান অর্ণবের মুখস্থ। গাছের সাথে লাগানো সিসি ক্যামেরাটা কখনোই অর্ণব খেয়াল করে নি। সে ভ্রূ কুঁচকে আফিফকে বলল,
“কি বলতে চাইছো তুমি?”

আফিফ তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সত্যটা আগে আপনি জেনে নিবেন, তারপর বিচার করবেন। আর বিচার শেষে আহির সাথে দেখা করবেন৷”

আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানুষ খারাপ হতে পারে। তার পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকতে পারে। কিন্তু যাকে আমরা একবার বা এক সেকেন্ডের জন্যও ভালোবেসেছি, তাকে অসম্মান করা যায় না। তাকে বিশ্বাস করতে হয়। তাকে আগলে রাখতে জানতে হয়।”

আফিফ এবার তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভালোবাসা মানে শুধু তার প্রতিই যত্ন নেওয়া, যে আপনার পাশে আছে। ভালোবাসা তো একজন অসৎ মানুষকেও সৎ বানিয়ে ফেলতে পারে। যদি না পারে, তাহলে সেটা ভালোবাসা না। সেটা জেদ আর অহংকার মাত্র।”

তাজওয়ার আহির হাত ধরতে যাবে তার আগেই আফিফ তাকে আটকে দিয়ে বলল,
“আমি আহিকে আপনার সাথে এই মুহূর্তে একা ছেড়ে যেতে পারবো না। আপনি সজ্ঞানে ফিরেই আহির সাথে দেখা করবেন, এর আগে নয়।”

আফিফ আহির হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেলো। আহি ভীত চোখে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। তাজওয়ার যে তাকে আটকাচ্ছে না, এতেই বেশ অবাক হয়েছে আহি।

৭৫।

গাড়িতে উঠেই আফিফের দিকে তাকালো আহি। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“থ্যাংক ইউ।”

আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আমি কিন্তু এবার তোমাকে এসবে জড়াতে বলি নি।”

আফিফ হাসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“হাসার মতো কিছু বলি নি।”

আফিফ বলল,
“তখন যা বলেছিলাম, বলে ফেলেছি। মাঝে মাঝে আমি অনেক কথা ভেবে বলি না। রাগ থেকেও এমন কথা বলে ফেলি, যেটার কোনো ভিত্তিই নেই। তাই সরিও বলেছি।”

“সরি বলে মার খেয়ে একদম সব ভুলিয়ে দিয়েছো। সত্যিই আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তাজওয়ার কাউকে খুন করতে দ্বিতীয় বারও ভাববে না।”

“সে তোমার সামনে এই কাজ করতো না।”

“তুমি কীভাবে শিউর হলে?”

“সেটা তোমার জানতে হবে না।”

“সাসপেন্স রেখে কথা বলছো কেন?”

আফিফ হাসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এরপর দু’জনই নিরব। আহি বলল,
“পদ্মকে কি বলবে?”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটাই ভাবছি!”

“ও খুব চিন্তা করবে। আমার জন্য মারামারি লেগেছে শুনলে আমাকে নিয়েও চিন্তা করবে। মেয়েটা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। সেদিন তুমি নিয়াজীর বাড়িতে যাওয়ার পর, ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।”

আফিফ আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি পাশ ফিরতেই সে চোখ সরিয়ে নিলো। আহি বলল,
“সরি।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “সরি কেন?”

“বেশি মেরেছে তাজওয়ার, তাই না?”

“হুম।”

আহি ড্রাইভারকে বলল, হাসপাতালের দিকে ঘুরিয়ে নিতে। আফিফ বাঁধা দিলো না। এই মুহূর্তে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রয়োজন। শরীরটা বেশ ব্যথা করছে তার।

হাসপাতালে পৌঁছে আফিফকে মুখের এক্স-রে করতে বলা হলো। ব্যথার ওষুধও লিখে দেওয়া হলো। আহি ওষুধগুলো কিনে আফিফের হাতে দিয়ে বলল,
“এক্স-রে কাল করতে হবে। চলো, তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।”

“তুমি আমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে? তোমাকেই তো বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য একজন প্রয়োজন।”

আহি চুপ করে রইলো। আফিফ বলল,
“আহি, আমার একটা হ্যাল্প করতে পারবে?”

“হ্যাঁ, বলো!”

“আজ রাতের জন্য আমাকে বাইরে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে? আসলে আমার তেমন একটা বন্ধু নেই। যে আছে সে এখানে থাকে না। বাসায় মা খুব অসুস্থ। এই অবস্থায় আমাকে দেখলে বেশ চিন্তায় পড়ে যাবে। পদ্মকে তো বুঝিয়ে ফেলতে পারবো। মায়ের তো বয়স হয়েছে। বোঝাতে গেলেও বুঝবে না। তাই আমি এই অবস্থায় বাসায় যেতে চাচ্ছি না। বাসায় বলবো, কাজের জন্য বাইরে আছি।”

আহি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“রাদ তো ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। ওখানে সম্ভব না। লাবীব হোস্টেলে থাকে। ওকে ফোন করবো?”

“হুম, করে দেখো।”

আহি লাবীবকে ফোন করলো। কিন্তু লাবীব রিসিভ করে বলল, সে এখন কক্সবাজার। আফিফ হতাশ হলো। এবার আহি কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা, আমার সাথেই চলো।”

“তোমার বাসায় সম্ভব না।”

আহি হেসে বলল,
“জানি। আমার বাসায় একদমই সম্ভব না। কিন্তু মায়ের বাসায় সম্ভব।”

এরপর আহি আফিফের ফোন থেকেই সালমা ফাওজিয়াকে কল করলো। তারপর সে আফিফের ব্যাপারে বলতেই তিনি আফিফকে নিয়ে আসতে বললেন। এরপর আহি আফিফকে নিয়ে তার মায়ের বাসায় এসে পৌঁছালো। আফিফ বলল,
“আন্টি কিছু মনে করবেন না তো!”

“আন্টির রাজকুমারীর জন্য তোমার এই অবস্থা হয়েছে। তোমাকে তো রাজা বানিয়ে রাখবে।”

আফিফ কিছু বললো না। এদিকে সালমা ফাওজিয়া আফিফকে দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন। সোফা গুছিয়ে দু’টো বালিশ দিয়ে বসালেন। ফল কেটে আনলেন। পানি এগিয়ে দিলেন।
এদিকে টুংটাং শব্দ শুনে রোকেয়া ফাওজিয়া ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। সালমা ফাওজিয়া মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মা, আহি এসেছে!”

রোকেয়া আহির উপর বিরক্ত হলেও আজ আহিকে সামনা-সামনি দেখে কেঁদেই ফেললেন। নাতনিকে জড়িয়ে ধরে কপালে, গালে চুমু খেলেন। অতি স্নেহে আহির হাত জড়িয়ে সোফায় বসলেন। এরপর আফিফের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আফসোস করলেন। আফিফ মোটামুটি লজ্জায় পড়ে গেলো। এখানে এসে যে মারাত্মক ভুল করেছে সে। এমন ভাবে তারা আফিফের দেখাশুনা করছে, মনে হচ্ছে সে শ্বশুড় বাড়িতে এসেছে। আহি আফিফের পাশে বসে বলল,
“বলেছি না, রাজার হালে থাকবে।”

“ওরা কিছু মনে করবে না তো!”

“একদমই না। আমি বলে দিয়েছি আমার কারণেই তোমার এই অবস্থা হয়েছে। আর তোমার মা আর বউ তোমাকে এই অবস্থায় দেখলে চিন্তা করবে তাই বাসায় যাচ্ছো না।”

আফিফ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহি হেসে বলল,
“তুমি পদ্মের হাসবেন্ড মা জানে। নানুকে এই মাত্র জানিয়েছি। চিন্তা করো না, নেগেটিভ কিছু ভাববে না।”

আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি উঠে দাঁড়ালো। আফিফ জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

“বাসায়!”

“তুমি এখানে থাকবে না?”

“না।”

আফিফ ইতস্ততবোধ করতেই আহি বলল,
“আরেহ, চিন্তা করো না। মনে করবে এটা তোমার নিজের বাড়ি। আমার বাড়ি মানেই পদ্মের বাড়ি। আর পদ্মের বাড়ি মানেই তোমার বাড়ি। হয়ে গেলো তো সলিউশন?”

“তুমি থাকলে হয়তো ভালো হতো। আই মিন, আন্টি আর নানুর সাথে তো আমার তেমন পরিচয় নেই। তাই বলছি।”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“মা অনেক ফ্রেন্ডলি। আর আমার এখানে থাকা সম্ভব না। বাবা জানলে সমস্যা হবে। আমি যাই।”

“তুমি একা যাবে?”

“না, রাত বারোটা বেজে গেছে। বাসা থেকে গাড়ি পাঠানো হয়েছে।”

এরপর আহি সালমা ফাওজিয়া আর রোকেয়া ফাওজিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আহি চলে যেতেই আফিফকে একটা রুম দেওয়া হলো। আফিফ সেখানে ঢুকতেই দেখলো আহির আঁকা একটা ছবি দেয়ালে ঝুলছে। আফিফ ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলো। অজানা কারণেই মনটা ভারী হয়ে আসছে তার৷

চলবে-

আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/949803893408050/?mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here