চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা #ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া #পর্ব-৩৭

0
464

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩৭
১১৫.
অর্পণের পাগলামি দেখে অসীম তালুকদার ছেলেকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলেন।কিন্তু অর্পণ এখান থেকে যেতে চায়না।সে যাবে না।

তার পুতুল যে এখনো তার ডাকে সারা দেয়নি।সে যাবেনা।তিনজন পুরুষের সাথে দস্তা দোস্তি করে হাফিয়ে যায়।মাটিতে দুই পা ভাজ করে বসে পড়ে।ছেলের এই কষ্ট মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।

এইদিকে রেনুর ঘরের দরজা মিলন,সাজু এসেই আরো আগেই খুলে দেয়।রেনু দরজা খোলা পেয়ে বের হতেই বাড়ির অবস্থা দেখে দরজার সাথে এলিয়ে পরে যান।মিলন,সাজু মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।

ওরা আমার আপুকে মেরে ফেলেছে।আমার আপু আর নাই।ওই দুষ্ট লোকগুলো খুব খারাপ।খুব খারাপ।আমি এদেরকে ঘৃনা করি।মিলনের কথায় কোনো প্রতি উত্তর রেনু করেনি।ছেলেদের কে সরিয়ে ভীরু পায়ে উঠোনে পা রাখে।স্বামীর কাঁধে হাত রাখতেই হাতটা রক্তে লাল হয়ে যায়।

এই শুনছেন।আপনি এভাবে মরার মতো পড়ে আছেন কেন?আপনি তাড়াতাড়ি উঠুন।ওরা আপনার পুতুলকে মেরে ফেলবে।জলদি যান।ওকে নিয়ে আসুন।ওহ খুব কষ্ট পাচ্ছে।আপনি তোও পুতুলের বাপ।তাইলে বাপের সামনে কি করে মেয়েকে ছিনিয়ে নিল?কি করে?আপনি কেন প্রতিবাদ করলেন না?ওদের কাছ থেকে কেন আমাদের মেয়েকে রক্ষা করতে পারলেন না?কেন আমার মেয়েকে বাড়িতে এসে পুড়িয়ে মারবে।কেন?উঠুন আপনি।আপনার এসব নাটক দেখার সময় আমাদের নেই।আপনি মাটিতে পড়ে ভং করবেন।আর আমি চুপচাপ দেখব।এসব চলবে না।আপনি আমার মেয়েকে নিয়ে আসুন।কোথা থেকে নিয়ে আসবেন আমি জানি না?শুধু জানি আমার মেয়ে ফিরে আসবে।তার স্বপ্নটা এখনোও অসম্পূর্ণ।তার এত বছরের সাধনা এভাবে মিথ্যে হতে পারে না।কি হলো আপনি উঠেন না কেন?বুঝছি।আপনি ভালো কথা শুনবেন।দাঁড়ান দেখাচ্ছি মজা।রেনু রান্না ঘর থেকে কলসি নিয়ে এসে সবটুকু পানি স্বাধীনের মাথায় ঢেলে দিল।

মাথায় হালকা আঘাত লাগায় রক্তগুলো পানির সাথে ধুয়ে যাচ্ছে।চোখে পানি পড়তেই জ্ঞান ফিরে আসে।কিন্তু স্বাধীন কোনো কথা ব’লে না।একধ্যাণে পুড়ে যাওয়া ঘরটার দিকে তাকিয়ে রয়।চোখের সামনে ছোট্ট পুতুলের মুখটা ভেসে ওঠে।তার পুতুল হাঁসছে,খেলছে,দৌড়াচ্ছে।ওই তো,দুই পাশে লাল ফিতা দিয়ে দুটো বেনি করা।সে বাড়ির আঙ্গিনায় বড় আম গাছটার নিচে দাড়িয়ে কি সুন্দর আম কুরাচ্ছে।আবার সেই আম ওড়না আঁচলে তুলে নেয়।ওড়নায় ভরে গেলে বড় বালতিতে রাখতে যায়।আম রাখার সময় নিজেও একটা কাচা আমে কামড় বসিয়ে দিলো।টক আমে তার দাঁত সিরসির করে।তবুও আম খাওয়া বন্ধ হয়নি।মনের সুখে আম খেতে খেতে অপর একটি আম মামার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।যার মানে মামা তুমি খাবে।স্বাধীন না ব’লে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই সে হাসতে হাসতে হাওয়া মিলিয়ে গেলো।

পুতুল,তার আম্মা কই?মাটি থেকে উঠতে গিয়ে আহহহ করে উঠল।তার পুরো শরীরের মারের দাগ।সে ব্যাথা সয্য করে,দাঁড়ানো চেষ্টা করে।ডাকতে থাকে।

-; আম্মা।আম্মা আপনি কই?আমার পুরো শরীরের মারের দাগ।আম্মা আপনি দেখে যান।আপনার ছেলেরের গ্রামের কিছু পাঁজি লোক মারছে।আমি হাঁটতে পারছি না।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আম্মা।পুরো শরীর ব্যাথায় নীল হয়ে আসছে।আপনি তেল গরম করে আপনার মামীর কাছে দিয়ে যান।সে আমায় যেন ভালো করে মালিশ করে দেয়।আপনি তোও জানেন।দিনের পর দিন বিছানায় পড়ে থাকতে পারবো না।হার খাটাখাটুনির মানুষ আমি।দিন রাত যার পরিশ্রম করে ঘাম ঝড়ে।হালাল পথে অর্থ উর্পাজন করে।সে কি সুয়ে,বসে দিন কাটাতে পারে।আম্মা।আম্মা।ওহ আপনিও আমার কথা শুনে আসছেন না।ঠিক আছে আমি এভাবেই মাটিতে পরে থাকব।যতখন না আপনি আপনার ছেলেকে ঘরে না পাঠাচ্ছেন।ততখন পর্যন্ত আমিও ঘরে যাব না।আমি এভাবে পরে মরে থাকব।যাব না।কোথাও যাব না।

আমমম্মা।

স্বাধীনের চিতকারে রাতটা আরো ভয়াবহ হচ্ছে।রেনু স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে শব্দ করে কাঁদছে।তার পাশে দুই ছেলে কাঁদছে।তাদের কারো দিকে তার মনযোগ নেই।শুধু পুতুলকে খুজঁছে।স্বাধীন আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেই অসীম তালুকদারের কথামতো জিহান,রিহান তাকে হাসপাতালে নিয়ে ছুটে।অসীম তালুকদার ছেলের পাগলামি সামলাতে পারছেন না।এইদিকে রাবেয়া তার ফোন ধরছে না।কি করবেন মাথা কাজ করা করছে না?কোনোরকম ভাইকে ফোনে সবটা বলতেই সে নিজেই ফোন করে গ্রামের থানা থেকে লোক পাঠাচ্ছেন।সাফিন তালুকদারের কথামতো পুলিশ আসতেই আসতেই সকালের আলো ফুটছে।ফজরের আজান কিছুখন আগেই শেষ হয়ে গেছে।প্রতিদিনের মতো পুতুল আজ ভাইদের ডাকেনি।তাদের নামাজের জন্য বিরক্ত করেনি।আর না নিজে অযু করে নামাজের জন্য দাঁড়িয়েছে।অথচ আজ পুতুল কাউকে না ডাকলেও সবাই জেগে আছে।ভোরের আজানে তাদের নড়চড় নেই।পুলিশ এসেই পুরো বাড়িটা দেখছে।আগুনে পুড়ে যাও ঘরটাতে ভালো করে পরখ করে ফোনে কাউকে তথ্য দিচ্ছে।সেই তথ্য মতাবেগ পুলিশ অফিসার এগিয়ে আসে অসীম তালুকদারের দিকে।থানার ওসি তার কথাগুলো ব’লে চলে যান।অসীম তালুকদার ছেলের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।অর্পণের পাগলামির জন্য ডাক্তার এই বাড়িতে আনতে খবর নিয়েছিল।কিন্তু,ছুটির দিন হওয়া ডাক্তার নেই।স্বাধীনকে যে ডাক্তার দেখানো হয়েছে।সেই ডাক্তার সাহেবকে এই বাড়িতে এনে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দেন।অর্পণ গাড়িতে মরার মতো পরে আছে।ঘুমের মেডিসিন শেষ হলেই আবার পাগলামি করবে।চোখের সামনে ছেলের কষ্ট দেখে তার বুক ফাটছে।তাহলে ওই মেয়েটিকে যারা হারালো।তাদের কেমন হচ্ছে?সেইসব ভাবতেই ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়।মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন।পুতুলের অন্যাকারীদেরকে শাস্তি দিবেন।ওদেরকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিবেন।

১১৬.
আমাদের জীবনে কখনো আঘাত না পেলে না-কি ঘুরে দাঁড়ানো যায় না।আঘাত পায় ব’লে মানুষ নিজেকে সূধরে নেয়।আর এই সূধরে নেওয়াটা মানুষের ধর্ম জ্ঞান হয়ে উঠে।নিজেদের ভুলগুলো সংশোধন করে সামনে চলার দিনগুলোকে আরো সুন্দরময় গড়ে তোলে।রাবেয়া অপারেশন রুম থেকে বের হয়ে যায়।ওটির পোশাক চেঞ্জ করে একটা কেবিনে বসেন।একটি নিষ্পাপ মেয়েকে নিজের চোখের সামনে পুড়তে দেখবেন।তা মানতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।ছেলে যাকে ভালোবাসে তাকে একটিবার দেখার শখ জেগেছিল।ভাগ্যিস দেখতে গিয়েছিলেন।তাই তো এই ছোট গ্রামে পা রাখতেই শুনতে পায়।এক অসহায় মেয়ের কান্না।যা তার মতো নরম মনের নারীর সর্বঅঙ্গ কাঁপিয়ে তুলে।মাথায় শুধু একটা চিন্তা ছিল।এই মেয়েটিকে বাঁচাতে হবে।মেয়েটির গল্প এভাবে অসমাপ্ত হতে পারে না।তার লড়াই মাঝ পথে কেন এভাবে থেমে যাবে।সে তো কোনো অন্যায় করেনি।তাহলে তাকে কেন বিনা অপরাধে শান্তি পেতে হবে।যারা দোষী তাদেরকে এটার মূল্য দিতে হবে।তার আগে এই আগুন পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ার আগে উদ্ধার করতে হবে।রাবেয়া ঘরের পিছনদিক দিয়ে পুতুলকে অনেক কষ্টে বের করতে গিয়েছিল।কিন্তু পিছনে জামার শেষ পাড়ে আগুন লাগতেই কোনো দিক দিশা না পেয়ে পুতুলকে পানিতে ধাক্কা দেন।পুতুল যখন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে ব্যাস্ত।তখন রাবেয়া তাকে বাঁচিয়ে নেন।চারদিকের স্বরগোলে,হৈচৈ কেউ পুতুলের পানিতে পড়ার শব্দটা খেয়াল করেনি।গায়ের কাপড় ছিঁড়া।গ্রামের মহিলারদের টানাটানিতে হয়তো তখন ছিড়ে গেছে।তার ওপর শীতের শেষ সিজনের ঠান্ডা পানিতে পরে যাওয়া কাপাকাপি শুরু,আর দেখতে একদম বাজে লাগছিল।পুতুল পানি থেকে উঠতে গিয়ে টের পায় তার একহাত ভেঙে গেছে।প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে।রাবেয়া নিজের গায়ের চাঁদর দিয়ে পেচিয়ে পুতুলকে বুকে টেনে নিলো।পুতুলের অবস্থা খারাপ দেখে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেওয়া হয়।তাকে নরমাল বেডে রেখে টিটমেন্ট করে।অন্য ডাক্তারের আন্ডারে দেওয়া হয়।রাবেয়ার পরিচিত ডাক্তার বান্ধবীকে পুতুলের পুরো ঘটনা বলতেই।তিনি অবাক হন।গ্রামের মানুষ এতটা ডেস্পারেট কেন?জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারবে। মাই গড।ভাবতেই কলিজা কেঁপে ওঠে।

পুতুলের জ্ঞান ফিরে আসতেই নিজেকে হাসপাতালের বেডে দেখতে পায়।নিজের মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখে হার মেনে নিয়েছিল।কিন্তু মা,মামা,মামীর এত কষ্ট এত পরিশ্রম।তার পথে পথে বিপদের সাথে লড়াইয়ের গল্পটা এভাবে ইতি টানবে।মানতে কষ্ট হচ্ছে।সব যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠেছিল।পুতুল তখন নিজের মনোভাব পরিবর্তন করে।সে কেনো মরবে?সে মরবে না!তার বাঁচার অধিকার আছে।হার মেনে নেওয়ার নাম জীবন নয়,লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই যখন জীবন।তখন সে বাঁচবে।এতো কষ্ট করে তীরে এসে তরী ডুবানোর কথা সে ভাবলো কি করে?সে বাঁচবে।আর সেটা বাঁচার মতোই বাঁচতে হবে।যারা তার সাথে অন্যায় করেছে।তাদের কেউ কৈফিয়ত দিতে হবে।পুতুল এদের কাউকে ক্ষমা করবে না।তার সাথে ওই অর্পণ তালুকদারের খবর আছে।তার হিসাবে অর্পণ তালুকদারও তার হাত থেকে রেহাই পাবেনা।যে মিথ্যে কলঙ্ক তার গায়ে লেগেছে তার খেসারত তাকেও গুনতে হবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here