#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_৪০
বিকেলে সমুদ্র আরভীদের বাড়িতে যায়। কাল রাতে আফিফা আফরোজ আসতে বলেছিলেন বলেই এই মূহুর্তে এই বাড়িতে আসা।
সমুদ্র বাড়িতে প্রবেশ করার পর পর’ই আফিফা আফরোজ আরভীকে ফোন করে জরুরি তলব করেন। আরভীও বিনা বাক্যে মায়ের আদেশে বাড়ি ফিরে। যদিও আরভী ধারণা করতে পারছে এই মুহূর্তে আফিফা আফরোজ কেন ডেকেছেন আরভীকে।
বাড়ি ফিরার পর আরভী বুঝলো আরভীর ধারনাই ঠিক ছিলো। সমুদ্র ও আরভীর সাথে কাল রাতের ঘটনা নিয়েই কথা বলতে আফিফা আফরোজ আরভীকে এ সময় বাড়ি ফিরতে বলেছেন।
আরভীকে আসতে দেখে আফিফা আফরোজ ইশারা করলেন উনার পাশে বসার জন্য। মায়ের আদেশ পেয়ে সমুদ্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আফিফা আফরোজ এর পাশে বসে আরভী।
বর্তমানে ড্রয়িং রুমে সমুদ্র ও আরভী দুজনেই উপস্থিত। তাই আর সময় ব্যায় করতে চাইলেন না আফিফা আফরোজ। সোজা আসল কথায় যেতে চাইলেন। সে জন্যই আরভী ও সমুদ্রের উদ্দেশ্য প্রশ্ন করলেন,”অবিবাহিত ছেলে-মেয়েদের রাতের আধারে দেখা করা অনুচিত, তা কি তোমরা জানো? তোমরা যদি একে অপরকে পছন্দ করে থাকো তাহলে আমাকে জানাও, আমি তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবো। তা না করে তোমরা কেন এভাবে রাত-বিরেতে দেখা করো?”
“মা আমি সকালেই আমার দিকটা স্পষ্ট তুলে ধরেছি সবার সামনে। এখানে আবার একে অপরকে পছন্দ করার কথা উঠছে কেন? আমি দেখা করতে চাই না সমুদ্রের সাথে। সমুদ্র নিজেই আসে আমার সাথে দেখা করতে।”
“যে চলে গেছে তাকে নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই। বরং যে আছে তাকে নিয়ে ভাবা উচিত আমাদের। তুই আমাকে কিচ্ছুটি না জানালেও আমি জানি তুই কেন রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিস। মা হই তোর। তোকে দেখলেই বুঝে যাই তোর ভেতরে কি চলছে। তুই নাহিদ চৌধুরীকে রাজনীতি থেকে সরাতে চেয়েছিলি আর এতে সফলও হয়েছিস। নাহিদ চৌধুরীর করা অধিকাংশ অপরাধ সবার সামনে প্রকাশ পেয়েছে। সে যে ক্ষমতা, ধন-সম্পদের লোভে পড়ে খারাপ পথে চলেছে সব কিছুই এখন তার হাতের বাইরে। এখন এমন এক অবস্থা হয়েছে যে নিজের দেশেও শান্তিতে মাথা উচু করে থাকতে পারছে না। পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সে এভাবেই শাস্তি পাচ্ছে। বাকি শাস্তি না হয় রবের উপর ছেড়ে দে। রব আছেন তো সবার করা পাপ-পূর্ণের হিসাব নেওয়ার জন্য।”
“কিন্তু মা!”
“কোনো কিন্তু না। তোমার মতামত আমি পরে নিবো। আগে সমুদ্রের সাথে একটু কথা বলা প্রয়োজন।” কথাটি বলে সমুদ্রের দিকে তাকান আফিফা আফরোজ। শান্ত স্বরে সমুদ্রকে বলেন,”আচ্ছা সমুদ্র, কিছু মনে করো না বাবা। তোমাকে আমি অনেক পছন্দ করি ছেলে হিসেবে। কিন্তু আমি কেন তোমার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিবো তা কি তুমি বলতে পারো?”
“কারন আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারবো আপনার মেয়েকে আমার থেকে ভালো কেউ বাসতে পারবে না।”
“তোমার ভাইও কিন্তু এই একই কথা বলেছিলো।”
“আপনার মেয়ে আগে কেমন ছিলো তা পুরোপুরি জানি না আমি। তবে যতোটুকু মনে হয় অত্যন্ত কোমল মনের ছিলো। কিন্তু এখন সে হয়েছে হৃদয়পুরের মেয়র আরভী রায়হান। আর যেরকম ত্যারা প্রকৃতির হয়েছে আপনার মনে হয় আপনার মেয়ের সাথে ছল করে আমি বেঁচে থাকতে পারবো? এছাড়া যাকে দেখে ভালোবাসা কাকে বলে জানতে পেরেছি তার সাথে কিভাবে ভালোবাসার নাটক করি বলুন তো!”
সমুদ্রের এ কথা শুনে আফিফা আফরোজ সামান্য হেসে প্রতিত্তোর করলেন,”সরি সমুদ্র। কিন্তু আমি এখন আর কারো কথায় বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে তুমি আসলেই আমার মেয়েকে ভালো রাখবে।”
“ভালোবাসা কি প্রমাণ করা যায় আন্টি? ভালোবাসা তো কেবল অনুভব করা যায়।”
“যদি কখনো আমার মেয়ের উপর থেকে তোমার মন উঠে যায় বা যদি তোমার মনে হয় আমার মেয়েকে আর তোমার ভালো লাগছে না, তখন? তখন কি এই অনুভূতির কথা একবারও তোমার মাথায় আসবে?”
আফিফা আফরোজের প্রশ্নে সমুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবলো। তারপর মনের মধ্যে অসীম আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করে আফিফা আফরোজকে শুধালো,”আপনাকে ছোট্ট একটা গল্প বলি আন্টি?”
আফিফা আফরোজ সমুদ্রের চোখের দিকে তাকালেন। সমুদ্রের চোখে স্পষ্ট এক ধরনের ঝলক দেখতে পেলেন। হয়তো সমুদ্র নিশ্চিত এই গল্প শোনার পর আফিফা আফরোজ আর সমুদ্রের ভালোবাসার উপর প্রশ্ন তুলবেন না।
আফিফা আফরোজ সমুদ্রকে অনুমতি দিতে বললেন,”গল্প! বলো।”
আফিফা আফরোজের অনুমতি পেয়ে আরভীর দিকে দৃষ্টি স্হাপন করে সমুদ্র নিজের গল্প বলতে শুরু করে,”আজ থেজে আট বছর পূর্বে ভোরের প্রথম প্রহরে একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলো একটা ছেলে। কিন্তু ছেলেটি হয়তো তখন বুঝে নি প্রেমের পড়ার বিষয়টি। কেননা যদি তখন বুঝতো তাহলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকে নিজের করে পাওয়ার জন্য মাঠে নেমে পড়তো। এখন প্রশ্ন করতে পারেন ছেলেটি সেদিন প্রেমে পড়েছে তা নিশ্চিত হলো কিভাবে! যেখানে সে নিজেই জানতো না সে প্রেমে পড়েছে। তাহলে উত্তরে আমি বলবো ছেলেটি যদি সেদিন প্রেমে নাই পড়তো তবে কেন ঘন বর্ষার বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে পানিতে ভিজে থাকা পিছল গাছে উঠে কদম ফুল পেড়ে মেয়েটির জন্য রেখে আসবে? কেন’ই বা ফুল হাতে পেয়ে মেয়েটির প্রতিক্রিয়া কি হবে তা দেখার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে? থাক সে কথা, ছেলেটি একসময় বুঝতে পারে ছেলেটির জীবনে প্রেম এসেছে, মনে বসন্তের রঙ লেগেছে। কিন্তু নিষ্ঠুর প্রকৃতি হয়তো ছেলেটির প্রেম গ্রহণ করতে চায় নি। আর তাই তো প্রেমে পড়ার অনুভূতির সাথে পুরোপুরি পরিচিত হওয়ার আগেই মেয়েটি ছেলেটির জীবনের সব রঙ চুরি করে হারিয়ে যায়।
ছেলেটি ছন্নছাড়া হয়ে উঠে। পথে-ঘাটে পাগল হয়ে খুজে ফিরে। ছেলেটি এক সময় ধরেই নেয় মেয়েটি ছিলো কালবৈশাখী ঝর স্বরুপ। যে হুট করে চলে এসে সব কিছু ধ্বংস করে না বলেই চলে গেছে। তবুও ছেলেটির মনে কোথাও একটা আশার প্রদীপ জ্বলে উঠে। হয়তো কোনো এক পরিচিত পথের বাকে এই অপরিচিত মেয়ের দেখা পাবে।
ছেলেটির চাওয়া সত্যি হয়। পরিচিত পথের বাকে অপরিচিত সেই মেয়েটির দেখা পায়। কিন্তু আফসোস মেয়েটি তখন আর ছেলেটির নয়। যেই বসন্তের রঙ মেয়েটি ছেলেটির মনে লাগিয়েছিলো সেই বসন্তের রঙ অন্য কেউ তার মনে রাঙ্গায়। ছেলেটির পুরো পৃথিবী থমকে দাঁড়ায়। এই দুজনকে একসাথে দেখে সহ্য করতে পারবে না তার মন তাকে তা জানান দেয়। আর তাই তো ছেলেটি পরিবার ছেড়ে, শহর ছেড়ে পাড়ি জমায় অপরিচিত নতুন এক শহরে। তারপর অনেক সময় পেরিয়ে যায়, অনেক ঘটনা ঘটে যায়। পরিশেষে আট বছর পর ভাগ্য ছেলেটিকে আরো একটা সুযোগ দেয়। এবার আপনি’ই বলুন, এতো বছর ধরে ছেলেটা যাকে চেয়ে এসেছে তাকে যদি নিজের অর্ধাঙ্গিনী রুপে পায় তবে কি সম্ভব মেয়েটার উপর থেকে মন উঠে যাওয়া? অতি কষ্টের পর আমরা যা পাই তার মোহ কি কাটে কখনো?”
এ গল্প যে সমুদ্রের নিজের তা বেশ বুঝতে পারছে আফিফা আফরোজ। জীবন কত অদ্ভুত! তখন যদি আরভী মিনহাজের প্রেমের না পড়ে সমুদ্রের প্রেমে পড়তো তাহলে হয়তো পরিস্থিতি আজ ভিন্ন হতো। এসব ভেবে আফিফা আফরোজের ভেতর থেকে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে। সমুদ্রকে আর কিছুই বলার নেই আফিফা আফরোজের। এতো কিছুর পর আর কি’ই বা বলার থাকতে পারে ছেলেটিকে। এখন তো উল্টো ছেলেটির জন্য কষ্ট হচ্ছে। আট বছর কি আর মুখের কথা? পুরো ২৯২০ দিন প্রেম দহনে পুড়েছে ছেলেটা।
অন্যদিকে আরভীর জায়গা থেকে আরভী ঠিক। কোনো মেয়েই চাইবে না নিজের বাবার খুনীর পরিবারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে। কোনো মেয়েই চাইবে না এক ভাইয়ের থেকে ধোঁকা খেয়ে আরেক ভাইকে বিশ্বাস করতে। আবার এসবে সমুদ্রেরও কোনো দোষ খুজে পাচ্ছেন না উনি। উনার নিজের’ই তো মাথা ধরে যাচ্ছে এতো কিছু ভাবতে গিয়ে। এ কেমন গোলক ধাধা সৃষ্টি হলো মেয়েটার জীবনে?
আফিফা আফরোজ কি বলবেন খুজে না পেয়ে শেষে সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করলেন,”তুমি গাজীপুরে জব করো তাই না?”
“না ছেড়ে দিয়েছি। আপাতত বেকার হয়ে আপনার মেয়ের পিছু পিছু ঘুরছি। আপনার মেয়ে হ্যাঁ বললেই কিছু একটা করবো।”
সমুদ্রের এ কথায় আরভী সমুদ্রকে তাচ্ছিল্য করে বলে,”আমি কেন একটা বেকার ছেলেকে বিয়ে করবো?”
“জনসেবা ম্যাডাম। আপনি আমাকে বিয়ে করে জনসেবা করবেন।”
সমুদ্রের প্রতিত্তোরে আরভী সমুদ্রের দিকে বিরক্তি চোখে তাকায়। ছেলেটার কাছে কি সব কথার’ই এরকম উল্টোপাল্টা জবাব প্রস্তুত থাকে? তাই হবে হয়তো।
আফিফা আফরোজ ভেবে পেলেন না কার পক্ষ নেওয়া উচিত হবে। নিজের মেয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বললে ছেলেটি কষ্ট পাবে। যে কিনা এতো বছর ধরে অপেক্ষা করছে উনার মেয়ের জন্য। অপরদিকে ছেলেটির পক্ষ নিয়ে কথা বললে উনার মেয়ে কষ্ট পাবে। যার জন্য সহজ নয় সব কিছু মেনে নেওয়া। তাই অনেক ভেবে-চিন্তে আফিফা আফরোজ এই সিদ্ধান্তে এলেন এরা কি করবে তা এরা নিজেরাই ভাবুক। তার জন্যই উনি আরভীর দিকে তাকিয়ে বললেন,”তুমি প্রাপ্ত বয়স্ক। আশা করছি নিজের ভালো মন্দ বুঝবে। সময় নাও, সময় নিয়ে ভাবো কি করবে। কিন্তু মনে রেখো, একজনের পাপের শাস্তি আরেকজনকে দিও না।”
চলবে…..