স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি #পর্ব_৩৪(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) #লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

0
320

#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_৩৪(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

প্রভাতের আলো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। দূর গাছের ডাল থেকে পাখির কিচিরমিচির ডাক ভেসে আসছে। স্মৃতি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল। আঁখি জোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এটা তার নিজের কক্ষ নয়। তবে কি সে সারারাত বাবা-মায়ের কক্ষ নিদ্রা গিয়েছিল। কালকের কথা স্মরন হতেই বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো। তার মা বোধহয় জীবনে তার সাথে কথা বলবে না। বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। উঠে কক্ষের বাহিরে আসলো। বাসার পরিবেশ কেমন শীতল লাগছে। রান্না ঘরের দিকে দৃষ্টিপাত হতেই স্মৃতি স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। ধীর পায়ে মায়ের দিকে অগ্রসর হলো স্মৃতি। রান্না ঘর থেকেই স্মৃতির দিকে দৃষ্টি যায় মুনিয়া বেগমের। সে কড়া কণ্ঠে মেয়েকে জবাব দেন,

–খবর দার আর এক পা আমার দিকে এগোবি না। আপাতত তোর মুখটা আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না। মায়ের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই বুকটা কেঁপে উঠলো স্মৃতির। আজ নিজের দোষেই নিজের পরিবারের কাছে এত অবহেলা পেতে হচ্ছে তাকে। স্মৃতি বিলম্ব করল দ্রুত পায়ে নিজের কক্ষ চলে গেল। সেখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে বোধহয় দম বন্ধ হয়ে মারা যেত। পৃথিবীতে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলে কোনো যায় আসে না। কিন্তু বাবা-মা মুখ ফিরিয়ে নিলে অনেক কিছু যায় আসে।

ঘড়ির কাঁটায় দশটা বাজতে যায় আবিদ রহমান এখনো ঘুম থেকে উঠছে না দেখে, মুনিয়া বেগম চিন্তায় পড়ে গেলেন। দ্রুত পায়ের স্বামীর কক্ষের দিকে ছুটে গেল। শতবার ডেকেও আবিদ রহমানের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সাথে সাথে সাড়া বাড়িতে ছেয়ে গেল মুনিয়া বেগমে হৃদয় কাঁপানো চিৎকার। মুনিয়া বেগমের চিৎকার শুনে স্মৃতি আর মুনতাসীর দু’জনেই কক্ষ থেকে ছুটে আসে। মুনিয়া বেগমকে কান্না করতে দেখে স্মৃতির কলিজা শুকিয়ে যায়। বাবার কিছু হয়ে গেল না তো আবার! বাবার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কিভাবে ক্ষমা করবো। স্মৃতির ভাবনার মাঝেই মুনতাসীর বলল,

–কি হয়েছে মামি চিৎকার করলে কেনো?

–দেখ না তোর মামা কথা বলছেন না। কাল রাতে অনেক চিন্তা করছিল। তাই আমি সকালে ডাকিনি। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে ভেবে ডাকতে এসে দেখি উঠছে না। তাড়াতাড়ি গাড়ি বের কর তোর মামাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। তোর মামার কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচতে পারবো না। আজ যদি তোর মামার কিছু হয়ে যায়। তাহলে আমি স্মৃতিকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না। মানুষটাকে অর্ধেক মেরে ফেলেছে স্মৃতি। মায়ের কথা গুলো তীরের মতো বুকে গিয়ে বিঁধল স্মৃতির। সে শুধু নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। তার জবাব দেওয়ার কোনো ভাষা জানা নেই। মুনতাসীর বিলম্ব না করে গাড়ি গিয়ে এসে, আবিদ রহমানকে নিয়ে গাড়ির কাছে গেল। স্মৃতি গাড়িতে উঠতে চাইলে মুনিয়া বেগম রাগান্বিত হয়ে বলল,

–একদম গাড়িতে উঠবি না। তোকে দেখলেই মানুষটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তোর এই মুখ আর মানুষ টার সামনে নিয়ে আসবি না।

–ও মা আমি যাই না আমার সাথে এরকম কর না। আমি আর কখনো এমন করব না। আমাকে তোমাদের সাথে যাব। আমাকে তোমাদের সাথে নিয়ে চলো।আমি বাসায় থাকলে দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাব।

–মামি এসব কথা বলার সময় নেই। মিষ্টি পাখি তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বস। মুনতাসীরের কথায় কেউ কোনো উত্তর করল না। আবিদ রহমানকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ায় তাদের মূল্য লক্ষ্য।

হসপিটালের করিডরে সবাই বসে আছে।আবিদ রহমানকে ডক্টর দেখছেন। মুনিয়া বেগম মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে আছেন। স্বামীর চিন্তায় যেন পাগল হয়ে গিয়েছে। ছন্নছাড়া দেখাচ্ছে তাকে। স্মৃতির নিজেকে ভিষণ অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। আজ তার জন্য সুখী একটা পরিবার মুহুর্তের মধ্যে বিষাদে রুপ নিল।

প্রভাতের আলো আঁধারকে সম্পূর্ণ রুপে গ্রাস করে নিয়ে চারিদকে রশ্মি ছড়িয়ে দিয়েছে। হসপিটালের কোলাহলে স্মৃতির নিদ্রা ভেঙে যায়। স্মৃতির বাবা স্ট্রোক করেছেন। অতিরিক্ত টেনশন থেকে স্ট্রোক করেছে। ডক্টর আবিদ রহমানকে চিন্তা মুক্ত রাখতে বলেছেন। উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছেন। সেজন্য স্মৃতি কাল থেকে এক মুহূর্তের জন্য বাবার সামনে যায়নি। বাবার কেবিনের সামনে বসে রজনী পার করে দিয়েছে। স্রুতি কাল এসে বাবাকে দেখে গিয়েছে। আবার ভরে আসবে বলে জানিয়ে ছিল। প্রভাতের আলো ছড়িয়ে পরতেই হসপিটালে ছুটে এসেছে। সাথে নানান রকমের খাবার রান্না করে নিয়ে আসছে। স্মৃতিকে বিধস্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে স্রুতি স্মৃতির দিকে এগিয়ে এসে বলল,

–এখানে বসে আছিস কেন?

–আমার অনেক সুখ লেগেছে তাই।

–আশ্চর্য! তোকে একটা সোজা প্রশ্ন করলাম আর তুই ত্যাড়াবাকা উত্তর দিলি। আমার সাথে কি সোজা ভাবে কথা বলতে পারিস না। তোর সাথে কথা বলাই বৃথা কাকে কি বোঝাচ্ছি আমি। যার জন্য আজ নিজের বাবা হসপিটালের কেবিনে শুয়ে আছে। সে আর বড় বোনকে কিভাবে সন্মান করবে। স্রুতির কথায় স্মৃতির ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। আঘাত কাছের মানুষ গুলোই দেয়। দূরের মানুষ কখনো আঘাত দিতে আসে না। স্রুতির কথায় স্মৃতির নিরুত্তর রইল। স্রুতি আর বিলম্ব করল না বাবার কেবিনের দিকে চলে গেল।

মুনতাসীর এসে স্মৃতির মুখের সামনে এসে খাবার ধরলো,

–খেয়ে নে মিষ্টি পাখি কাল থেকে না খেয়ে আছিস। এভাবে থাকলে তুই অসুস্থ হয়ে পড়বি। তোর অসুস্থতার খবর মামা জানলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। মামার জন্য হলে-ও তোকে ভালো থাকতে হবে। সুস্থ থাকতে হবে।

–আমাকে এক বোতল বি’ষ এনে দিবেন মুনতাসীর ভাই। তাহলে সারাজীবনের জন্য সবাইকে শান্তি দিয়ে যেতে পারতাম। আমার আর এসব ভালো লাগছে না। আমার এই অশান্তি থেকে মুক্তি চাই।

–কিন্তু তুই করেছিস টা কি? যার জন্য পরিবারের মধ্যে এত অশান্তি হচ্ছে। স্মৃতি উত্তর দিল না৷ মুনতাসীরের হাত থেকে খাবার নিয়ে খেতে শুরু করল। কাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। ভিষণ ক্ষুদার্থ ছিল স্মৃতি। তাই কোনো রকম ভনিতা করল না। মুনতাসীর কিছু না বলে আবিদ রহমানের কেবিনের দিকে চলে গেল।

সাত দিন পর……

আজকে আবিদ রহমানকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। এই সাতদিনে স্মৃতির মুখ একবার ও দেখেননি উনি। স্মৃতি দু’দিন থেকেই বাসায় চলে আসছিল। সবার সামনে বাবা-মায়ের সন্মান নষ্ট করতে চায় না সে। আবিদ রহমান ঠিক করল আজকেই স্মৃতির সাথে বিয়ের বিষয়ে কথা বলবে। আবিদ রহমান দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছেন। ওঠার জন্য পা ফ্লোরে রাখতেই স্মৃতি আবিদ রহমানের কক্ষে প্রবেশ করল। বাবার পাশে বসে মলিন কণ্ঠ বলল,

–জানি আমার জন্য তোমার মনে ঘৃণার জন্ম নিয়েছে। তোমার কাছে আমি কিছু সময় চাইছি। একটু সময় কথা বলেই চলে যাব। আর তুমি যদি মনে কর। আমার সাথে কথা বলতে চাও না। তাহলে আমি এখনই চলে যাব। তবুও তুমি অস্থির হইয়ো না আব্বু।

–বল কি বলতে চাস?

–আমাকে তুমি মাফ করে দাও আব্বু। আমি বাঁচতে চাই। তুমি আমাকে বাঁচাও। এই অভিশপ্ত জীবন নিয়ে আর বাঁচতে পারছি না। আমি ভুল করেছি সে ভুল ঠিক করতে পারবো না। কিন্তু নিজেকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করতে তো পারি। তুমি আমাকে যা বলবে আমি তাই শুনবো। শুধু তোমরা আমাকে দূরে ঠেলে দিও না। তোমরা আমাকে দূরে ঠেলে দিলে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। এই কয়দিন আমি ভিষণ করতে উপলব্ধি করতে পারছি। তোমাদের ভালোবাসা ছাড়া আমি ভিষণ অসহায়। আমাকে একবারে মে’রে ফেল আব্বু। এভাবে তিলে তিলে শেষ করে দিও না। আমি আর নিতে পারছি না৷ এভাবে থাকলে আমি দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাব।

–তোকে মাফ করতে পারি। তবে একটা শর্তে, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করছি আমার সিদ্ধান্তের ওপরে কোনো কথা বলবি না। যদি নিজের চোখে বাবার লা’শ দেখতে না চাস। তাহলে আমাকে শান্তিতে ম’রতে দেওয়ার জন্য হলে-ও আমার শর্তে রাজি হয়ে যাস। দেখ মা আমি তোর বাবা তোকে ছোট বেলা থেকে বড় করেছি। হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছি। নিজ হাতে খাইয়েছি। সেই বাচ্চা মেয়েটা আজ এত বড় হয়ে গিয়েছিস। যে নিজের ভালো নিজে বুঝতে শিখে গিয়েছিস। বাবা-মায়ের কথা না ভেবে নিজের কথা ভাবতে শুরু করেছিস। আমি তোকে সময় দিব না। আজকের দিন ধরে তোর হাতে মাত্র পাঁচ দিন সময় আছে। আমি তোর বিয়ে ঠিক করেছি। তোকে যার সাথে বিয়ে দিব। তাকে তোর সবকিছু খুলে বলবো। বিয়েটা হয়ে গেলে তোকে রিহাবে পাঠিয়ে দিব। তোর বোনের সাথে তোর সম্পর্ক ভালো না। আমি আজ আছি কাল নেই। তাই তোর মাথার ওপরে একটা ছায়া তৈরি করতে চাইছি। আশা করছি আমার সিদ্ধান্তকে তুই সন্মান করবি।

যদি বাবার লা’শ দেখতে না চাস। কথা টা যেন স্মৃতির ছোট্ট হৃদয় টা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। ভেতরের অস্থিরতা বেড়ে গিয়েছে। কেমন জানি ছটফট করছে। স্মৃতিকে নিরব থাকতে দেখে স্মৃতির বাবা আবার বলে উঠলো,

–তোর পছন্দ থাকলে বলতে পারিস।

–আমার কোনো পছন্দ নেই আব্বু।

–আমি আরাভের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছি। আরাভ নামটা কর্নকুহরে আসতেই স্মৃতির ভেতরটা হাহাকারে ভরে উঠলো। সে মানুষটার জন্য আস্ত একটা জীবন শেষ করে দিল। শত-শত রজনী নির্ঘুম কাটিয়ে দিল। যার জন্য চোখের অশ্রুকণা গুলো শুকিয়ে আবার ভিজে উঠতো। যে মানুষটা তাকে একা করে দিয়ে যেতে দু’বার ভাবেনি। কোনোদিন দুঃখের ভাগ নিতে আসেনি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে ভাবে বলেনি চিন্তা কর না আমি আছি। সেই মানুষ টা কোনো সাধনা ছাড়া তাকে পেয়ে যাবে। এটা তো হতে পারে না। স্মৃতি অভিমানে বলেই ফেলল,

–আমি তাকে বিয়ে করব না আব্বু।

–তাহলে ইমনকে বিয়ে কর। ইমন অনেক ভালো ছেলে আশা রাখছি। সে তোমার সবকিছু জেনে তোমাকে গ্রহণ করতে কোনো আপত্তি করবে না। আমি আজই ইমনের মায়ের সাথে কথা বলব। তারা অনেক দিন ধরে তোমাকে নেওয়ার জন্য আকুল হয়ে রয়েছে। বাবার কথায় স্মৃতির মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলো। সে মনে মনে বলল বাবা তুমি এত মানুষ চিনতে শিখলে আর নিজের এলাকার মানুষ চিনতে শিখলে না। ইমন ছেলেটা কতটা বিকৃত মন মানসিকতার তা যদি একটা বার নিজ চক্ষে দেখতে। তাহলে তুমি তার নাম মুখে আনতে না। স্মৃতি কিছুক্ষণ ভাবতে শুরু করল৷ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

–আমাকে আজকের রাতটা সময় দাও আব্বু। আমি তোমাকে কাল সকালে আমার মতামত জানাচ্ছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করার মতো মহৎ কাজ করেছ। তোমাকে ভালো রাখার জন্য হলে-ও ধরনীর সব সুখ তোমায় এনে দিব। তবুও তোমায় কষ্ট পেতে দিব না। কথা গুলো বলেই স্মৃতি চলে গেল।

পরের দিন সকাল বেলা…..

আবিদ রহমান ড্রয়িং রুমে স্মৃতির জন্য অপেক্ষা করছে। স্মৃতি ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলো। সমস্ত মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। আবিদ রহমান মেয়ের অবস্থা বুঝতে পারছেন। কিন্তু সে তো নিরুপায়। স্মৃতি ড্রয়িং রুমে আসতেই আবিদ রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–বল তোমার মতামত কি? তুমি কি চাও?

–আমি ইমনকে বিয়ে করব আব্বু। মেয়ের কথায় আবিদ রহমানের মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠলো। ইমনের নাম শুনতেই মুনিয়া বেগমের মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এলো। আবিদ রহমানের হাসোজ্জল মুখশ্রী দেখে স্মৃতি বুকে প্রশান্তির হাওয়া দোল খেলে গেল। আবিদ রহমান বিলম্ব করল না। ইমনদের বাসার উদ্দেশ্য রওয়া দিল। মুনিয়া বেগম বহু আটাকনোর চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হলো। আবিদ রহমান পাঁচ দিনের মধ্যে মেয়ে বিয়ে দিতে চান। বাবা চলে যাবার সাথে সাথে স্মৃতি মলিন মুখে ওপরে চলে গেল।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here