কথা দিলাম 🌸❤️
||পর্ব ~ ৭||
কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
“আধভিক বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু? ছাড়ো আমাকে।”
“একদমই না। আগে আমি যেটা করতে বলছি সেটা করো নাহলে ছাড়বো না।”
“উফ! ঠিক আছে, কি করতে হবে?”
“ওয়েট! ওকে এইবার বলো যে, তুমি আমাকে ভালোবাসো।”
“কি? ইম্পসিবল! পারবো না।”
“ফাইন, আমিও ছাড়বো না তাহলে।”
“উফ, কি জ্বালায় পড়লাম। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি। হয়েছে? এবার ছাড়ো!”
“উহুম! কথা দাও, কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে না। সারাজীবন এভাবেই ভালোবাসবে আমাকে।”
“কথা দিলাম!”
ফোনটা বেজে উঠলো আধভিকের। স্ক্রিনে চলতে থাকা ভিডিও টা পজ হয়ে গেছে ফোন আসায়। পপ আপ নোটিফিকেশনে দেখা যাচ্ছে “সিয়ারা” নামটা। আধভিক ফোনটা রেখে দিয়ে দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন এলে আধভিক হাত সরিয়ে একটা বড়ো নিশ্বাস নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে।
“বলুন।”
“গুড মর্নিং এ.ভি.আর.।
“গুড মর্নিং!”
“আব, আমি কয়েকটা ডিজাইন পাঠিয়েছি মেইলে। একবার দেখবেন? সব কটা ক্যাটাগরি থেকে একটা একটা ডিজাইন ড্র করেছি। ঠিক হলে আর গুলো শুরু করবো।”
“আমি দেখে জানাচ্ছি আপনাকে।”
আধভিক ফোনটা রেখে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দেয়। সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলে ফোনটা হাতে তুলে নেয় সে। হঠাৎ করেই ফোনে তারিখটার দিকে চোখ যায় আধভিকের। আবারও সিয়ারার কথা মনে পরে যায় ওর। এই দিনটা অনেক বিশেষ আধভিকের কাছে, এখনও। এক চিলতে হেসে ফোনে গ্যালারি ওপেন করে সিক্রেট ফোল্ডারে চলে যায় আধভিক। একটা ভিডিও ওপেন করে দেখতে থাকে। ভিডিওটা ঠিক কয়েক বছর আগের এই দিনে বানানো, সিয়ারার সাথে। আধভিক উঠে বসে চোয়াল শক্ত করে বলে,
“কথা রাখোনি তুমি সিয়ারা। মিথ্যে বলেছো আমাকে। অনেক বড়ো আঘাত দিয়েছো। দিনের পর দিন মরণ যন্ত্রণার মধ্যে রেখে দিয়েছো।”
আধভিক নিজের ফোনের মেইল বক্স চেক করে দেখে সিয়ারার মেইল আইডি থেকে পিডিএফ এসেছে। সে পিডিএফটা ওপেন করে পুরোটা দেখতেই হাসে।
“যাক, তোমাকে আবার তোমার স্বপ্ন পূরণের রাস্তায় নিয়ে আসতে পারলাম তাহলে? আমার মাথায় কখনও তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কথা আসেইনা। কেন জানো? তুমি কষ্ট পেলে আমি তার দ্বিগুণ কষ্ট অনুভব করি। আমি শুধু চাই তুমি সত্যির মুখোমুখি হও। তারপর সারাজীবনের মতো হারিয়ে যাবো তোমার জীবন থেকে।”
আধভিক “অলরাইট” টেক্সট করে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। এদিকে সিয়ারা নার্ভাস হয়ে ঘরে পায়চারি করছে আর ফোন দেখছে। বারবার রিফ্রেশ করছে এই বুঝি আধভিক রিপ্লাই করলো। অবশেষে আধভিকের রিপ্লাই পেতে আনন্দে নেচে উঠলো সে। ফোনটা দু হাতে ধরে মুখের সামনে নিয়ে একটা চুমু খেলো তারপর বিছানায় গিয়ে সোজা হয়ে হাত ছড়িয়ে শুয়ে পরলো। চোখ বন্ধ করার কিছুক্ষণ পর ফোনটা চোখের সামনে এনে কল কিপ্যাডে গিয়ে কোড নাম্বার টাইপ করতেই সিক্রেট ফোল্ডার খুলে গেলো।
“এই দিনটার কথা আমি ভুলিনি। কখনও ভুলতেও পারবো না। তোমার একেকটা ছেলে মানুষীর কথা আমার অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে। কতটা বদলে গেছো এখন তুমি। কয়েক বছর আগের আধভিকের সাথে এখনকার আধভিকের কোনো মিল নেই। অবশ্য আমিই দায়ী এর জন্য। আজ যদি উপায় থাকতো তাহলে আমি আবার চেষ্টা করতাম তোমাকে আগের মতো করে তোলার কিন্তু এখন আমাদের পথ আলাদা।”
সিয়ারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসে। ফোন রেখে নিজের ডেস্কে বসে ড্র করা শুরু করে। দুটো ডিজাইন ড্র করে আড়মোড়া ভাঙে। তারপর উঠে বিছানায় শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে পরে। গত রাতে ঘুম না আসায় ড্র করে ফেলেছিলো প্রত্যেকটা ক্যাটাগরি থেকে একটা করে ডিজাইন। এখন ভীষণ টায়ার্ড লাগছে তাই না শুলে হবে না।
পরেরদিন,
“সিয়ারা? ফোন কেন ধরছিলেন না? আমি কখন থেকে ফোন করছি জানেন?”
“স্যরি, আমি একটু ঘুমিয়ে পরেছিলাম।”
“হোয়াট? আপনি, আপনি ঘুমিয়ে পরেছিলেন? লাইক সিরিয়াসলি? আপনি কি কখনও কোনো কিছু সিরিয়াসলি নিতে জানেন না?”
“আমি…
“আমি আর আপনার থেকে কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমারই ভুল যে আমি আপনাকে আবার বিশ্বাস করেছি। আপনাকে হেল্প করতে না বলে অন্য কাওকে বললে সে এটলিস্ট চেষ্টা করতো কাজটা কমপ্লিট করার। এভাবে আপনার মতো নিশ্চিন্তে পরে পরে ঘুমাতো না। শিট!”
“আপনি একবার…
“একবার? বারবার বিশ্বাস করলেও, সুযোগ দিলেও পরিণাম একই থাকবে। কারণ এটা আপনি মিসেস সিয়ারা। যে কি না বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে জানে না। আরো একবার আমাকে সবার সামনে ছোটো হতে হবে। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে বারবার আমায় অপদস্ত করার জন্য। আমি তো এটাই ডিজার্ভ করি আপনার থেকে এতকিছুর পরেও।”
আধভিক রেগে কল কেটে ফোন বিছানায় ছুড়ে ফেলে। আর এক ঘণ্টা পর ওর মিটিং ক্লাইন্টের সাথে। কিন্তু কি মিটিং সে করবে? মিটিংয়ে কি দেখাবে? ডিজাইনই তো রেডি নেই। সকাল থেকে সিয়ারাকে সে সমানে টেক্সট, কলস করেই গেছে কিন্তু কোনো রেসপন্স আসেনি। তখন তো ওর ভয় উঠে গেছিলো, এইভেবে যে সিয়ারার কোনো ক্ষতি হয়নি তো? কিন্তু নাহ? সে কি জানতে পারলো? সিয়ারা ঘুমাচ্ছিলো। অসহ্য হয়ে সে বিছানায় বসে পরলো কপালে দু আঙুল রেখে। ভাবতে লাগলো, একটু বেশিই কি বলে ফেললো সিয়ারাকে? সেই সময় হঠাৎ করে নোটিফিকেশন সাউন্ড কানে আসে ওর। ফোন হাতে নিয়ে দেখে মেইল এসেছে। মেইল বক্স ওপেন করে দেখে সিয়ারা পিপিটি পাঠিয়েছে। কাঁপা কাঁপা আঙুলে সেটা ওপেন করতেই আধভিক স্তব্ধ হয়ে যায়।
“ওহ গড! এটা আমি কি করলাম? ওর কথা না শুনেই এতো কিছু শুনিয়ে দিলাম ওকে? আমি সিওর ও গতকাল সারাদিন ডিজাইন বানিয়ে গেছে। নাহলে এতগুলো ডিজাইন কমপ্লিট করা সম্ভব নয়। আমি ওকে বলেছিলাম সব করতে হবে না বাট ও নিজের বেস্টটা দিয়ে যত কটা ডিজাইনস দরকার সবটা করেছে। আর আমি কি না এতগুলো কথা শোনালাম ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে?”
আধভিক সাথে সাথে কল করে আবার সিয়ারাকে। কিন্তু ফোনটা সুইচ অফ! খারাপ লাগে আধভিকের। সে জানে সিয়ারা খুব কষ্ট পেয়েছে। এভাবে অতীত টেনে কথাগুলো না শোনালেও পারতো সে। কিন্তু সে’ই বা কি করবে? তাঁর ভিতরেও তো এতদিনের জমা কষ্টগুলো ঘুসছে।
“মিটিংয়ের পর একবার কল করতে হবে ওকে। ততক্ষণ না হয় নিজেকে একটু টাইম দিক।”
আধভিক অফিসের জন্য বেরিয়ে যায়। একজন মডেলকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। ডিজাইন পছন্দ হলে মডেলও উনি ওদের কোম্পানি থেকে চুজ করতে পারেন।
“ড্যাড আজকে তুমি প্রোডাকশন হাউজে চলে যাও। আমাকে একটু জরুরি মিটিংয়ে যেতে হবে।”
“ঠিক আছে সাবধানে যা। বেস্ট অফ লাক!”
আভাস বাবুকে বলে আধভিক দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। যত তাড়াতাড়ি মিটিং শেষ হবে ততো তাড়াতাড়ি সে সিয়ারার সাথে কথা বলতে পারবে। অফিসে যেতে যেতে আরেকবার ফোন করলো সে সিয়ারাকে কিন্তু সুইচ অফ বলছে এখনও।
অন্যদিকে,
সিয়ারা শুয়ে রয়েছে চুপচাপ। চোখের জলে বালিশটা ভিজে গেছে। দরজায় টোকা পরলে চোখ মুছে উঠে বসে ও।
“কে?”
“আমি! কি ব্যাপার? আজ ঘর থেকে বেরোসনি যে? কিছু হয়েছে?”
দেবাংশু ঘরে ঢুকে এলে সিয়ারা চুপ করে বসে থাকে। দেবাংশু বুঝতে পারে সিয়ারার মন খারাপ। কিন্তু কি নিয়ে সেটা বুঝতে পারে না। এই মুহূর্তে জানতে চাওয়া ঠিক হবে না ভেবে কথা ঘুরিয়ে সে বললো,
“এভাবে মুড অফ করে বসে থাকিস না। রেডি হয়েনে। বেড়াবো।”
“কোথায়? আজকে না দেব। আজকে…
“আমি বাড়তি কোনো কথা শুনতে চাই না। যেটা বলেছি সেটা কর। চুপচাপ রেডি হয়েনে নাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আজ অনেকদিন পর বেড়াবো আমরা।”
সিয়ারা ভাবলো মানা করাটা ঠিক হবে না। তাছাড়া ওর মনটাও একটু ভালো হবে হয়তো বেরালে। তাই রেডি হতে চলে গেলো দেবাংশুর কথা মতো। রেডি হওয়ার পর সুধাংশু বাবুকে বলে দেবাংশু আর সিয়ারা বেড়িয়ে গেলো। একটা ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্ট-এ ওরা গেলো যেখানে সেলিব্রিটিদের বেশি আনাগোনা। একটা টেবিলে বসে, আশেপাশের পরিবেশটা সিয়ারা উপভোগ করতে লাগলো। হালকা সফট মিউজিক বাজছে যার কারণে আরো বেশি ভালো লাগছে সিয়ারার।
“একটু হলেও কি মন ভালো হয়েছে ম্যাডাম?”
দেবাংশুর কথায় সিয়ারা কি বলবে বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করতে লাগলো। দেবাংশু সেটা বুঝে হেসে ওর হাতের উপর হাত রেখে বললো,
“আমাদের সম্পর্কটা আমি সহজ করতে চাই সিয়া। আগে আমি তোর ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে চাই। দরকার পরলে সারাজীবন তোকে বন্ধু হিসেবেই আগলে রাখবো, সে সম্পর্কের নাম যাই হোক না কেন।”
সিয়ারা দেবাংশুর মুখের দিকে তাকালে দেবাংশু হালকা হেসে চোখ দ্বারা সম্মতি জানালে। সিয়ারাও হালকা হাসে কিন্তু পরক্ষণেই ওর হাসি মলিন হয়ে যায় ধীরে ধীরে। সিয়ারার নজর দেবাংশুর উপর থেকে সরে পিছন দিকে গেলেই ও দেখতে পায় আধভিক বসে আছে। আধভিকের বিপরীতে একটি মেয়ে বসে আছে যার মুখ দেখতে পাচ্ছে না সিয়ারা কারণ মেয়েটি ওর দিকে পিছন দিক হয়ে বসে আছে ঠিক যেমন দেবাংশু আধভিকের থেকে পিছন দিক হয়ে বসে আছে।
“এ..এটা তো..??”
সিয়ারা কেমন জানো স্তব্ধ হয়ে যায়। সে চিনতে পেরেছে মেয়েটি কে। কেন চিনতে পারবে না? ছোটো থেকে যাকে বড়ো হতে দেখেছে, তাকে চিনতে না পারলে হয়? এতো ওর বোন! আধভিকের সাথে ওর বোনকে বসে থাকতে দেখেও সিয়ারা তাকিয়ে থাকে আধভিকের দিকে। আধভিক নিজের মনে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছে।
“তাহলে কি আধভিক আর বোনের সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই?”
এটা ভাবতে ভাবতেই দেবাংশু সিয়ারার গালে হাত দেয় আর সিয়ারার নাম ধরে ডাকে। সিয়ারা দেবাংশুr দিকে তাকালে দেবাংশু বলে,
“কাজল গালে কীভাবে গেলো তোর? এতক্ষণ তো দেখিনি?”
“কই?”
“আব নাহি হেইন হামকো অ্যাসে জীনা
তেরা হোকে ভিনা তেরা হোনা”
হঠাৎ করেই সিয়ারার নজর আবার আধভিকের উপর পরে। এইবার আধভিকও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
“তুমসে মহাব্বত হেইন হান,
তুমসে মহাব্বত হেইন হান,
বাস তুমসে হান, তুমসে হি হান।”
“হ্যা আগার মহাব্বত তো আখোন সে কেহদে,
শুনু মেইন দিল কি ইয়ে মানু ভি ক্যায়সে?
হ্যা মান তুঝি মেইন মাগার চাহ কে ভি,
ইয়ে হাথ থামু তো থামু ভি ক্যায়সে?”
“ইয়ুন দূর জাকে ক্যায়া ভুল পাওগে?
বাতেন হামারি ক্যায়া ভুল পাওগে?
হাম তো তারাস্তে হেইন, রোকে ভি হাসতে হেইন,
যো দিল আওয়াজ দে ক্যায়া লউট পাওগে?”
সিয়ারা উঠে বেড়িয়ে যায় ওখান থেকে। হঠাৎ সিয়ারার আচরণে দেবাংশু থতমত খেয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না সিয়ারা হঠাৎ করে এভাবে কেন উঠে চলে গেলো। বেশি না ভেবে দেবাংশু সিয়ারার পিছনে চলে যায়। অপরদিকে আধভিক নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে ওদের যাওয়ার দিকে। কিছুক্ষণ আগে দেবাংশুর গলায় সিয়ারার নাম শুনে আধভিকের নজর সামনের দিকে গিয়ে পরে। সে দেখে সিয়ারার গালে হাত দিয়ে রেখেছে দেবাংশু। বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলেও সে একভাবে তাকিয়ে থাকে সিয়ারার দিকে। ঠিক সেই সময় মিউজিক সিস্টেমে গানের লাইনগুলো বেজে উঠলে সিয়ারাও তাঁর দিকে তাকায়। হয়তো তাঁর মতো সেও মিল পেয়েছে তাঁদের পরিস্থিতির সাথে এই গানটার একেকটা লাইনের। আধভিকের তো এটাই ধারণা, এই গানটা তাঁদের জন্যেই তৈরী হয়েছে। আধভিকের হুঁশ ফেরে ক্লাইন্টের ডাকে। সে এখানে এসেছে ক্লাইন্টের সাথে মিটিং অ্যাটেন্ড করতে।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]