#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_৩৩(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
স্মৃতি গলায় ফাঁ’স লাগাতে যাবে এমন সময় স্মৃতির বাবা-মা আসে কক্ষে। স্মৃতিকে গলায় ওড়না পেঁচাতে দেখে, আবিদ রহমানের অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। কোনো কথা না বলে দৌড়ে এসে স্মৃতিকে ধরে নামায়। স্মৃতি আর স্মৃতির মধ্যে নেই। প্রচন্ড পাগলামি শুরু করে দিয়েছে। স্মৃতির বাবা স্মৃতিকে নিজের এক হাতে আগলে রেখেছে। কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের পকেটে থেকে ড্রা’গ’স বের করে স্মৃতির হাতে দিল। ড্রা’গ’স পেয়ে স্মৃতির মনে হলো নিজের জান ফিরে পেয়েছে। ড্রা’গ’স শরীরের মধ্যে প্রবেশ করতেই পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল। স্মৃতি বাবার কোলে নেতিয়ে পড়ল। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে স্মৃতি। আবিদ রহমান মুনিয়া বেগমের সাহায্য স্মৃতিকে বিছানায় শুয়ে দিল। মুনিয়া বেগম স্বামীর কর্মকাণ্ড বিস্ময় নয়নে পর্যবেক্ষণ করছে। বিয়ের এতগুলো বছর হয়ে গেল। মানুষটার হাতে কখনো সিগারেট পর্যন্ত দেখেনি। সেই স্বামী আজ নেশাদ্রব্য পকেটে করে নিয়ে আসছে। ভাবতেই কষ্টে বুকটা ভারি হয়ে আসলো। আবিদ রহমানকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। মুনিয়া বেগম বিস্ময় কণ্ঠে বলল,
–তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাইছো? আবিদ রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
–দেখো মেয়ে টা আমাদের। তাই তাকে বাঁচাতে আমাদেরই হবে। এভাবে থাকলে আমার মেয়েটা মা’রা যাবে স্রুতির মা। বাবা হয়ে নিজের মেয়ের ধংস দেখতে পারছি না। আমি যতই রাগ করে থাকি না কেনো মেয়েটা আমার তাই আঘাত টা আমার বুকেই লেগেছে। স্মৃতিকে এভাবে বাসায় রাখা ঠিক হবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্মৃতির চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে। আমার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমি আজ আছি কাল নেই। স্রুতির সাথে ও স্মৃতির সম্পর্ক আগের মতো নেই। দু’জনের বনিবনা হয়নি। আমি যদি না থাকি। তাহলে আমাদের স্মৃতির কি হবে? তাই আমি চাই স্মৃতির বিয়ে দিতে চাইছি। যে স্মৃতির সবকিছু জেনে স্মৃতিকে গ্রহন করবে। আমি তার হাতেই আমার মেয়েকে তুলে দিব৷ স্মৃতির মাথায় একটা বট গাছের ছায়া বড্ড প্রয়োজন। আমি চলে গেলে যদি দুই বোনের আবার রেসারেশি শুরু হয়ে যায়। আমার স্মৃতির মাথায় হাত রাখার মতো কেউ থাকবে না। যত দ্রুত সম্ভব পারো ছেলে দেখা শুরু কর। তোমার হাতে ভালো পাত্র থাকলে, পাত্রের নাম বল। আমি কালই ছেলের বাসায় যাব। আমাদের মেয়েকে বাঁচাতে হবে স্রুতির মা।
–তুমি হার্টের রোগী বেশি চিন্তা কর না। আল্লাহ একজন আছেন। তিনি সবকিছু আগের মতো করে দিবেন। তুমি এমন কথা বল না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে? তুমি স্মৃতিকে বিয়ে দিতে চাইছো বেশ ভালো কথা। আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আমরা যার তার হাতে আমাদের মেয়েকে তুলে দিতে পারি না। দেখে শুনে যোগ্য মানুষের হাতে স্মৃতিকে তুলে দিতে হবে।
–ইমন কে তোমার কেমন লাগে?
–কোন ইমন শিক্ষক সাহেবের ছেলে!
–হুম তার কথা বলছি।
–কেনো সে কি করেছে?
–কিছু করেনি আমার তাকে বেশ ভালো লাগে। ছেলেটা অনেক দিন ধরে স্মৃতিকে পছন্দ করে। ইমনের মা আমাকে অনেক কয়দিন বিয়ের কথা বলেছে। আমি স্মৃতিকে উচ্চ শিক্ষিত করাব দেখে না করে দিয়ে ছিলাম। ভাবছি ইমনের সাথে স্মৃতির বিয়ের কথা আগাব। ছেলেটা অনেক ভালো আশা রাখছি স্মৃতির সবকিছু জেনে স্মৃতিকে গ্রহন করবে।
–তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। অর্ধাঙ্গিনীর কথায় আবিদ রহমানের বিচক্ষণ আঁখি জোড়া মুনিয়া বেগমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। তিনি ঢের বুঝতে পারছেন৷ মুনিয়া বেগম তাকে কিছু বলতে চাইছে। মুনিয়া বেগম সংকোচ কাটিয়ে বলল,
–আরাভ ছেলেটা অনেক ভালো। তুমি চাইলে ভেবে দেখতে পারো। তাছাড়া স্মৃতি আরাভকে ভালোবাসে। অভ্রের কাছে শুনেছি স্মৃতির পড়াশোনা ক্ষতি হবে, স্মৃতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে। এসব কথা ভেবে আরাভ স্মৃতির থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। তোমার কি মনে হয় আরাভ এত বছর পর এমনি এমনি এসেছে। স্মৃতির কথা জেনেই এখানে এসেছে। অভ্র স্মৃতি বিপথে যাবার কথা একমাস আগে জেনেছে। আয়েশা অসুস্থ থাকায় আরাভকে জানাতে পারেনি। কালকে আরাভকে জানিয়েছে। আর আজকেই আরাভ বাসায় চলে এসেছে বুঝতে পারছো কিছু। আবিদ রহমানের মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এলো। রাগান্বিত কণ্ঠ স্বরে বলল,
–যে ছেলেটার জন্য আমার মেয়েটা এতটা কষ্ট পেয়েছে। তার হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিতে চাই না। আর সে যখন এতই স্মৃতিকে ভালোবাসে, তাহলে আমার কাছে আসলো না কেন? কাপুরুষের মতো পালিয়ে গিয়েছিল কেন? দূরে গেলেই মানুষের ভালো বৃদ্ধি পায়। বিয়ে করেও তো কত নারী সফল হয়েছে। যেমন পুরুষের সাফল্যের পেছনে নারী রয়েছে। ঠিক তেমনই এখন হাজার নারীর সাফল্যের পেছনে রয়েছে তার স্বামী। আরাভ কি পারতো না আমার মেয়েকে একটা সুন্দর জীবন দিতে! তাছাড়া আমার মেয়ে আর আরাভকে ভালোবাসে না। আমি স্মৃতির মতের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দিব না। আমার মেয়ে যাকে বিয়ে করতে চাইবে। আমি আমার মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিব।
–তুমি এতটা রেগে যাচ্ছো কেনো? তুমি আমার কথার মানেটা বোঝার চেষ্টা কর। আরাভ এখনো আমাদের মতো বিচক্ষণ হয়নি। অনেক সময় চালাক মানুষ ও ভুল করে বসে। আরাভ তার ব্যতিক্রম নয়। তুমি একটা কথা বল তো যাকে মন থেকে ভালোবাসা যায়। তাকে কি আসলেই মন থেকে মুছে ফেলা যায়? আমিও তো একটা ভুল করে ছিলাম। কঠিন ভুল করে ছিলাম। তুমি আমায় ক্ষমা কর নি। এত গুলো বছর ধরে সংসার করছো না। তাহলে স্মৃতির বেলায় কেন এত অনিয়ম। তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও। স্রুতি যেমন অভ্রকে বিয়ে করেছে। ঠিক তেমনই স্মৃতি আরাভকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। আর যদি করে কথা দিলাম আমার তরফ থেকে কোনো রকম বাঁধা প্রদান আসবে না।
–আরাভ কি আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে? যে আমি তার বিষয়টি ভেবে দেখবো।
–সে যদি তোমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, তাহলে তুমি কি করবে?
–স্মৃতি যদি রাজি থাকে তাহলে বিয়ে দিব। আর যদি রাজি না হয়। তাহলে বিয়ে দিব না। দু’জনের কথার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠলো। মুনিয়া বেগম দরজা খুলতে গেল। ভর সন্ধ্যায় আরাভকে দেখে কিছুটা অবাক হলেন! মুনিয়া বেগম আরাভকে ভেতরে আসতে বলল। আরাভ ভদ্রতা বজায় রেখে মুনিয়া বেগমের সাথে দু’টো কথা বলল। মুনিয়া বেগম আরাভকে বসতে বলল। আরাভ আবিদ রহমানের সামনে বসে আছেন। হৃদস্পন্দনের গতিবেগ তড়িৎ গতিতে ছুটে চলেছে। পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। হাত ধীর গতিতে কাঁপছে। আরাভের হাত কাঁপা দেখে আবিদ রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–কিছু বলবে?
–জি আংকেল কিছু কথা বলার ছিল।
–কি বলতে চাও তাড়াতাড়ি বলো। আমাকে একটু বাহিরে যেতে হবে।
–আমি জানি আমার ওপরে রাগ করে আছেন। বাবা হিসেবে আপনার রাগ করে থাকাটা স্বাভাবিক। তবে আজ আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই৷ স্মৃতিকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিনই আমার ভালো লেগেছিল। কিন্তু শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর দিকে নজর দেওয়া দৃষ্টি কটু দেখায়। আমি আমার মনকে সাবধান করতে থাকি যথেষ্ট চেষ্টা করি স্মৃতিকে এড়িয়ে চলার। আমার মনকে করেছি বহুবার সাবধান। কিন্তু আমার নিয়ন্ত্রণ আমি নিজে করতে পারলেও মনের নিয়ন্ত্রণ নিজে করতে পারি নাই। এরা নিজের হয়েও অন্যের জন্য আকুল হয়ে ওঠে। নিজেও থেকে বেশি ভালোবাসে অন্যকে স্মৃতি অনেক ভালো ছাত্রী। এই বয়সে অনেক ছেলে-মেয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। স্মৃতি যখন আমাকে তার মনের কথা জানালো। বিশ্বাস করুন আংকেল আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সমস্ত সুখ আমার বুকে এসে ধরা দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল শহরে আনন্দের মিছিল শুরু করে দেই। কিন্তু আমি পারিনি কারন আমি শিক্ষক আমার এসব মানায় না। বুকে পাথর জমা করে রাখি। নানান কথা বলে স্মৃতিকে অপমান করি। যেন সে আমার ওপরে রাগ করে ভালো করে পড়াশোনা করে। ভবিষ্যতে সফল হয়ে আমাকে দেখিয়ে দেয়। আমার করা অপমান গুলো দুমড়ে মুচড়ে ফেলে। স্মৃতিকে যতবার আমি আঘাত করেছি। তার থেকে দিগুণ আঘাত আমার বুকে এসে লেগেছে। আমি মনের ভাব সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারি না। আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। কথা বলতে গেলে সব এলোমেলো হয়ে যায়। এত গুলো বছর স্মৃতিকে রেখে আমি কিভাবে ছিলাম। আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানেন। আমি কসম করে বলছি আংকেল। আমার নির্ঘুম রাত সাক্ষী, বুক ভারি হয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস গুলো সাক্ষী। স্মৃতিকে না দেখে থাকাটা আমার কাছে মৃত্যুর সমান মনে হয়েছে। আমি আগে যদি জানতাম স্মৃতি বিপথে চলে যাবে। তাহলে কখনোই আমি এমন ভুল করতাম না। আমি দোষী আমি পাপী আংকেল। আমি অনেক বড় ভুল করেছি। আপনি আমার দেহ থেকে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সবকিছু আলাদা করে দিন। তবুও স্মৃতির থেকে আমাকে আলাদা করে দিয়েন না। এতদিন যে আশা নিয়ে বেঁচে ছিলাম। সে আশা যদি নিভে যায়। আমার দুঃখ ফুরবার আগে আমি নিজেই ফুরিয়ে যাব। কথা গুলো বলেই থামলো আরাভ। আঁখি জোড়া রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। কথা গুলো গলায় আঁটকে আসছে। আবিদ রহমান আরাভের কথা গুলো গভীর ভাবে শুনছিল। সে কিছু ভারি গলায় বলল,
–শুনো ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যার মধ্যে ছিটেফোঁটা খাদ থাকা যাবে না। ভালোবাসার মধ্যে খাদ থাকলে সে ভালোবাসা বেশিদিন টিকে না। তোমাকে কে বলেছে তুমি দূরে সরলেই স্মৃতির ভালো হবে। এমনটা ও হতে পারত। যে তুমি স্মৃতির কাছে থেকে স্মৃতিকে দু’হাতে আগলে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আমার মেয়ের জীবন টা অনেক সুন্দর হতো। একটা কথা সব সময় মনে রাখবে। নারীরা ভালোবাসা পেলে শান্ত নদী হয়ে যায়, ভালোবেসে শাসন করলে অবুঝ বাচ্চা হয়ে যায়। অবহেলা করলে হয়ে যায় রৌদ্রতাপ কঠিন অহংকারী। নারী সব পারে, নারী আগলে রাখে, নারী অবহেলায় রাখে, নারী বরাবরই রহস্যময় চরিত্র নারীকে তুমি যা দিবে তা সে দিগুন করে ফিরিয়ে দিবে। সেটা ভালোবাসা হোক কিংবা অবহেলা। আশা করছি বুঝতে পরেছো আমি কি বলেছি। তোমার কথা আমি ভেবে দেখবো। স্মৃতি যদি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। তবেই এই বিয়ে হবে। আর যদি সে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি না হয়। তাহলে এই বিয়ে হবে না। আমি আমার মেয়ের মতের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করব না। আমাকে আজকালকার বাবাদের মতো মনে করবে না। নিজের সিদ্ধান্ত আমি কখনোই আমার মেয়ের ওপরে চাপিয়ে দিব না। তাই এসব আবেগের কথা আমাকে বলে লাভ নেই। আবিদ রহমানের কথায় আরাভ শান্ত নদীর মতো স্থির হয়ে গেল। কণ্ঠনালি দিয়ে আর কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। মুনিয়া বেগম আরাভের জন্য নাস্তা তৈরি করছে। একবার রান্না ঘরে যাচ্ছে। আরেকবার ড্রয়িং রুমে এসে তাদের কথা শুনছে। আরাভের নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে, আজ ভিষণ আফসোস হচ্ছে কেনো সেদিন স্মৃতিকে দূরে সরিয়ে দিল। কেনো সে কাছে টেনে নিতে পারল না৷ আরাভের নিজের কেশগুলো নিজেই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। বুকটা খাঁ খাঁ করছে। জীবনে এমন কিছু ভুল থাকে যা একবার করলে দ্বিতীয় বার শুধরে নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।
চলবে…..
(এতদিন পর গল্প দেওয়ার পরেও যে আপনারা সবাই এতটা রেসপন্স করবেন। তা আমার কল্পনার বাহিরে ছিল। যত তাড়াতাড়ি রেসপন্স করবেন। তত তাড়াতাড়ি পরবর্তী পর্ব পাবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)