#নীলফড়িং
#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#পর্ব ১১
.
.
গাড়ী এসে থামল হসপিটালের সামনে। হায়রে আমার ইচ্ছে পূরণ হবে না রে কখনো। ডাক্তার প্রেমিক আর বর জুটলে এমনই হবে, বাসা থেকে হসপিটাল, আর হসপিটাল থেকে বাসা অব্দি সীমাবদ্ধ। ৫ মিনিটের জন্যই না হয় একটু অন্য কোথাও গাড়ী থামিয়ে নিত। কিন্তু না সোজা এসে হসপিটালের সামনেই থামাতে হলো। এই ভাবতে ভাবতে মুড অফ করে, আস্তে আস্তে গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়িয়ে গেলাম। স্যারের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম সে ঠোঁটের মাঝে আঙুল রেখে মিটমিট করে হাঁসছে, একটু সন্দেহ হলো আমাকে দেখে আবার হাসছে না তো। আমি একটু ভালো করে নিজেকে দেখে নিলাম। দেখলাম না সব ঠিকঠাক আছে, তাই গাড়ীর দরজা লাগিয়ে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই স্যার গাড়ীর জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বলে উঠলেন।
…….তুমি যাবে কখন?
…….হয়ত ১ টার সময়।
……হুম আমি এসে যাবো।
এই বলে স্যার গাড়ী ড্রাইভ করতে শুরু করল। আর আমি একটু মুখ খুলেই হেঁসে দিলাম। যাক তাও বলেছে তো।
উপরে উঠে সেই পেশেন্ট কে দেখলাম, না আগের তুলনায় আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। তাই তাকে দেখে চেম্বারে চলে এলাম। সেখানে সিরিয়াল শেষ করে। ঘড়িতে দেখলাম ১২:৪০ মিনিট তাই নিজেকে একটু ঠিক করে গুছিয়ে নিলাম। আর একটু সময় বসে ১০ মিনিট আগেই বেরিয়ে পড়লাম।
দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ পুরো ১টা যখন বাজে তখন দেখলাম, দূর থেকে তার গাড়ী আসছে, আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম। সে আমাকে দেখে গাড়ী থামিয়ে দিল। গাড়ীতে উঠে বসতেই দেখলাম সামনেই কয়েকটা রজনী গন্ধার স্টিক তার সাথে লাল রঙের গোলাপ রাখা আছে। বুঝলাম সে অতটা আন রোমান্টিক ও নয়।
স্যার গাড়ী চালিয়ে এগিয়ে গেল। কিছুদূর আসতেই দেখলাম স্যার আমাদের বাসার রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে গেল।
……স্যার রাস্তা তো পেছনে রয়ে গেল?
……হুম (মুচকি হেঁসে)
……আমরা কী কোথাও যাচ্ছি?
……দেখি?
স্যারের হাঁসি দেখে বুঝলাম সে দেখেছে রাস্তা পেছনে ফেলে আসছে। কিন্তু এত শট করে উত্তর দেওয়ার কী আছে? বলবি তো ভালো করেই বলে দে? না তা কেনো বলবে?
গাড়ী এসে থামল কাকলির মোর অবস্থিত গার্ডেন ইন রেস্তোরাঁর সামনে।
……নামো।
আমি নেমে দাঁড়িয়ে যেতেই স্যার ও নেমে গেল। এরপর স্যার ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল রেস্টুরেন্টের ভেতর। একটা চেয়ার টেনে আমাকে বসতে বলল। আমি বসে যেতেই সেও বসল।
…….এখানে কেনো?
…….ভাবলাম আজ এখানে বসেই রুগী দেখব।
……আপনি সিরিয়াসলি বলছেন?
……আচ্ছা একটা কথা বলো তো? মানুষ এখানে কেনো আসে?
…….খাবার খেতে।
…….তবে আমরাও নিশ্চয়ই খাবার খেতেই এসেছি।
…….জ্বি?
…….এখানে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?
আমি আর কথা বাড়ালাম না। বুঝতে পারছি স্যারের কথার মানে। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিলাম, স্যার বলে উঠলেন।
…….ভাই ডাক্তার যখন হয়েই গেছি তবে এমন ভাবেই ঘুরতে হবে। নয়ত ঘোরা ক্যান্সেল।
এবার খুব হাঁসি পাচ্ছিল, বাট নিচের দিকে তাকিয়েই বসে রইলাম। বুঝতে পারছি স্যার আমার শাড়ি পড়ার কারণ বুঝে নিয়েছেন, তাই একটু লজ্জা লাগছে।
স্যার খাবার অর্ডার করল। কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার চলে এলো।
দুজনে খাবার শেষ করে উঠে আসলাম। বিল মিটিয়ে বের হয়ে এলাম রেস্টুরেন্টে থেকে। গাড়ীর কাছে এসে আমি দাঁড়িয়েই রইলাম পেছন থেকে ঘুরে দেখলাম স্যার গায়েব, এতক্ষণ তো আমার পাশেই ছিল হঠাৎ কোথায় গেল? এর মধ্যে রাস্তার উপার থেকে ছুটে আসলো। গাড়ীর দরজা খুলে উঠে বসে পড়ল। আমিও বসলাম, বসতেই সে একটা আইসক্রিম আমার সামনে ধরল। আমি হাঁসি মুখে তার হাত থেকে আইসক্রিমটা নিলাম।
…….আপনি?
…….গাড়ী চালাব নাকি আইসক্রিম খাবো?
…….ওহ তবে খেয়েই না হয় চালাবেন।
…….থাক আমি আইসক্রিম অতটা খাইনা।
…….ওকে এখান থেকেই না হয় একটু খান।
…….(সে মৃদু হেসে) খেতেই হবে?
……হুম আমি কী একা খাবো নাকি?
…….(সে একটু খেলো।) ওকে এইটুকুই।
……..আর একবার।
……জ্বি না ম্যাম এখন আপনিই খান।
এরপর সে গাড়ী ড্রাইভ করতে লাগল।
……..এখন কোথায় যাবে?
…….হুম?
…….বলছি কোথায় যাবে?
…….আপনি যেখানে যাবেন সেখানেই।
স্যার মুচকি হেঁসে গাড়ী ড্রাইভ করতে শুরু করলেন।
গাড়ী এসে থামল বাসার গেইটের সামনে।
…….আজ এতটুকুই থাক বাসার সবাই টেনশন করছে।
আমি গাড়ী থেকে নেমে চলে আসতে নিলাম, প্রায় গেইটের সামনে আসতেই শুনতে পেলাম।
…….পুস্পিতা?
…….জ্বি স্যার?
……এদিকে এসো।
আমি এগিয়ে যেতেই স্যার ফুল গুলো আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল।
……..এটা নিতে ভুলে গেছ।
…….এটা আমার জন্য ছিলো?
…….না হয়ত কোনো পেশেন্টের ভুল করে রেখে গেছে।
এই বলে স্যার মুচকি হাঁসল। আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম স্যারের দিকে, আজকাল একটু বেশিই ফাজলামো করছে স্যার। আমি তার হাত থেকে ফুল গুলো নিয়ে ঘুরে গিয়ে হাঁসতে হাঁসতে চলে এলাম সেখান থেকে। স্যার ও চলে গেলেন তার বাড়ির ভেতরে।
বেশ ভালোই কাটছিল দিন গুলো। সন্ধ্যায় রিপোর্ট দেখাতে নিয়ে এলো চৈতী, ক্যাবিনের দরজা খুলে ভেতরে এসে বসে পড়ল।
…….এই রিপোর্ট।
আমি বসে বসে ফোনে কিছু কাজ করছিলাম। চৈতীর কথা শুনে সামনে তাকিয়ে দেখলাম সে বসে আছে। আমি ফোন রেখে রিপোর্ট গুলো খুলে দেখলাম। রিপোর্ট দেখে বুঝতে পারলাম, ওর প্রেগন্যান্সির মাত্র দের মাস হয়েছে। আমি রিপোর্ট গুলো দেখে কিছু না বলে, কিছু ওষুধের নাম লিখে দিলাম। ওর সামনে রিপোর্টের ফাইলটা দিতেই বলে উঠল।
…….আমাকে এমন কিছু ওষুধ দে যাতে বাচ্চাটা পড়ে যায়।
আমি ওর কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম। যা দেখে ও বলে উঠল।
……আসলে আমার দের বছরের একটা বেবি আছে, এজন্য এখন এই বাচ্চাটা আমি চাইছি না, তাই যেভাবে হোক প্লিজ।
…….যেহেতু আপনার বাচ্চার দের বছর হয়ে গেছে, সেখানে আপনার সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এরপরও এটা আপনাদের ব্যক্তি গত ব্যাপার। বাট বাচ্চার হার্টবিট হয়ে গেছে, এখন আমার দ্বারা এই পাপ কাজ করা সম্ভব নয়। আপনি অন্য ডাক্তার দেখাতে পারেন। আর এখন ওষুধ খেলে আপনার অনেক সমস্যা হতে পারে। তাই আমি কোনো রিক্স নেবো না। স্যরি আপনি চাইলে অন্য ডাক্তার দেখাতে পারেন।
…….প্লিজ কিছু একটা উপায় বল।
……স্যরি আমার জানা নেই কোনো উপায়। আপনি ১ মাসের আগে আসলেও কথা ছিলো, বাট এখন আর আমি কিছু করতে পারছি না। আপনি জানেন একটা বাচ্চার জন্য মানুষ কত কিছু করে? বাহিরে গিয়ে দেখেন অনেক রুগী বসে আছে, তার মধ্যে দুই একজন খুঁজে পেয়েই যাবেন যাদের বাচ্চা হচ্ছে না। যারা মা ডাক শোনার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন, কিন্তু আল্লাহ তাদের একটা সন্তান দিচ্ছেন না। আর আপনাকে দিয়েছে কিন্তু আপনি নিতে চাইছেন না। আপনার মতো হয়ত অনেকে আছে। বাট আমি বলব ওর তো কোনো দোষ নেই তবে ওকে ওর অধিকার থেকে বঞ্চিত কেনো করবেন? ওকে কেনো আপনাদের ভুলের শাস্তি দিবেন?
আমি আর কিছু না বলে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। চৈতী উঠে আস্তে আস্তে বের হয়ে গেল রুম থেকে।
রুগী শেষ করে আমি হসপিটালের গেইটে যেতেই দেখলাম ফারিজ দাঁড়িয়ে দারোয়ানের সাথে কথা বলছে। আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে।
……ফারিজ আপ স্যরি তুমি এখানে?
…….হ্যা ভাই ফোন দিয়ে ডেকে ছিলো। আসলে ভাই আসার সময় তার ফোন রেখে এসেছিল, আর তা দিয়ে যাওয়ার জন্যই ডেকেছেন।
…….দিয়েছ?
……হ্যা দিয়েছি।
…….তবে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?
…….তোমার অপেক্ষা।
…….আমার অপেক্ষা কিন্তু কেনো?
…….দেখলাম তোমার ক্যাবিনের সামনে রুগী ছিলনা, তাই তোমার এসিস্ট্যান্ট কে জিজ্ঞেস করলাম সে বলল তুমি নাকি এখনি বের হবে, তাই দাঁড়িয়ে আছি তোমার অপেক্ষায়।
……(হাঁসলাম ওর কথা শুনে) আচ্ছা তবে এখন চলো?
……হুম চলো। আচ্ছা দারোয়ান ভাই আসছি কেমন?
…….হুম।
দারোয়ান ওর কথা শুনে হাঁসল। আমরা দু’জন এগিয়ে গেলাম ফারিজ বাইকে উঠে স্টার্ট দিল, আমি উঠে বসে পড়লাম। বাইক চলতে শুরু করল।
এভাবেই সময় যেতে লাগল। হাসি আনন্দ কিছুটা দুষ্টুমির মাঝ দিয়ে।
কয়েক দিন পড়ে আজ বাসায় ফিরে দেখলাম, মা বিয়ের কার্ড নিয়ে বসে আছেন, সম্ভবত সবার নাম লিখছে কার কাছে কোনটা পাঠাবে। আমি সোজা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলাম।
…….মা সব কাজ শেষ?
…….কোথায় শেষ সবে তো শুরু।
……ওহ আচ্ছা। আমি সাহায্য করব কী?
…….করবি? আচ্ছা কর। এই নে এই কার্ড গুলো এই লিস্টের সাথে মিলিয়ে দ্যাখ কারো নাম বাদ পড়েনি তো?
…….মা এত কিছুর কী বেশি প্রয়োজন ছিল? তার থেকে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে আসলেই তো হতো। কোনো ঝামেলা ছাড়া।
…..আরে তুই আমাদের এক মাত্র মেয়ে, তোর বিয়েতে অনুষ্ঠান করব না তো কার বিয়েতে করব? ওই নিচ তালার ভাড়াটিয়া ভাবীর মেয়ের বিয়েতে?
…….মা খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছ তুমি। হ্যা এটা কিন্তু করাই যায়। কারণ আমার বিয়েতে আমি কী আনন্দ করতে পারব বলো? তার থেকে আন্টির মেয়ের বিয়েতে আনন্দ করতে পারব, হ্যা তুমি বরং এটাই করো।
…….থাপ্পড় খাবি বলে দিচ্ছি এসব ফালতু কথা বলবি না একদম। যে কাজ দিয়েছি তা চুপ করে কর।
হুম মায়ের কথায় আমি মুখ গোমড়া করে বসে বসে কাজ করতে শুরু করলাম।
রাতে রুমে বসে বসে একটা বই নিয়ে পড়ছিলাম। কিছু জানার ছিলো, তা জানতে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তখনই মুঠো ফোনটা বেজে উঠল। আমি বইয়ের পাতায় মুখ গুজে ফোনটা রিসিভ করলাম।
……..আসসালামু আলাইকুম। জ্বি কে বলছেন?
……..আমি বলছি, নাম্বার দেখে ফোনটা রিসিভ করা যায় না?
……ওহ স্যরি স্যার। আসলে খেয়াল করিনি।
…….হ্যা শোনো তোমার ম্যাসেঞ্জারে কিছু ছবি দিয়েছি, একটু চেক করে এখনি আমাকে জানাও।
…….জ্বি স্যার।
স্যারের ফোন রেখে আমি ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে দেখলাম কয়েকটা রিপোর্ট এর ছবি দেওয়া ছিলো। চেক করে স্যার যা জানাতে বলেছেন তা জানালাম। এরপর ফোন রেখে বইয়ের পাতায় আবার মুখ গুঁজে দিলাম।
।
।
।
চলবে………….।