#নীলফড়িং
#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#পর্ব ১৬
.
.
পুস্পিতা রুমে বসে তার আব্বু কে মা কে খুব মিস করছিল। তাই সে কান্না করছিল। চোখ বন্ধ করে তাদের কে নিজের পাশে অনুভব করছিল। এমন সময় তার মুঠো ফোনটা বেজে উঠল। আচমকা হওয়ায় সে একটু ভয় পেয়ে উঠল। ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখল ফাইয়াজ স্যার লেখা। সে চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে ফোন রিসিভ করল।
……হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
…..ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি কী করছ? কোথায় আছো?
……আপনার রুমে আছি। বসে আছি কেনো?
……তবে একটু বারান্দায় এসো।
পুস্পিতা ভালো করে নিজের চোখ মুছে নিয়ে বারান্দায় এগিয়ে গেল, সেখানে গিয়ে রাস্তায় উঁকি ঝুঁকি মেরে স্যারকে খুঁজছিল। হঠাৎ তার পাশ থেকে স্যারের কন্ঠ শুনে চমকে উঠল। পাশে তাকিয়ে সে প্রচুর অবাক হলো।
……কাকে খুঁজছ?
……আপনি ওই খানে কী করছেন?
…..পড়ে বলছি। এখন যার জন্য ডেকেছি সেই কাজটা করে নেই। এখানে আসেন।
এই বলে ফাইয়াজ দুজন লোক এনে দাঁড় করিয়ে দিল। যা দেখে পুস্পিতা আবেগী সুরে বলে উঠল।
……মা আব্বু তোমরা কেমন আছো?
……এতক্ষণ ভালো ছিলাম না রে মা এখন তোকে দেখে খুব খুব ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
…..আমিও এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমরা ব্রেকফাস্ট করেছ?
…..(তারা চুপ হয়ে গেল)
……এর মানে এখনো ব্রেকফাস্ট করো নি? মা দেখেছ কটা বাজে? প্রায় ১১ টা এখনো তোমরা ব্রেকফাস্ট করো নি? তোমরা মনে করো এটা শুনে আমি এখানে ভালো থাকতে পারব? প্লিজ মা, আব্বু তোমরা নিজেদের খেয়াল রাখো। আচ্ছা আমি তো এত জলদি বিয়ে করতে চাইনি তোমরাই জোর করলে তবে এখন কেনো এত কষ্ট পাচ্ছ?
……তুই মা হ তারপর বুঝবি কেনো তোকে জোর করেছি।
……আচ্ছা বাবা তা না হয় বুঝলাম, এখন ব্রেকফাস্ট বানিয়েছ নাকি তাও বানাও নি?
…..হুম তোর খালামণি আর ফুপি মিলে বানিয়েছেন।
……তবে আগে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করবে তারপর এসে আমাকে বলবে ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছ, ততক্ষণ আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব যাও।
……তোর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না আমরা করে নেবো।
……মোটেই না, যাও। আর শোনো তোমরা আমার রুমে এলে আমাকে একটা ফোন দিয়ে আসবে ওকে?
…..হুম ঠিক আছে।
…..আচ্ছা যাও।
তারা চলে গেল, যাওয়ার আগে কয়েকবার পিছু ফিরে নিজেদের মেয়েকে দেখল, ফাইয়াজ ইশারায় পুস্পিতা কে কান্না করতে বারণ করে সেও তাদের সাথে এগিয়ে গেল।
পুস্পিতা আরও কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো আকাশ পানে তাকিয়ে। আর ওদিকে ফাইয়াজ তার শশুড় শাশুড়ী কে নিজে বসে থেকে ব্রেকফাস্ট করিয়ে তারপর সে সেখান থেকে চলে এলো।
বিকেল দিকে পুস্পিতা সবার সাথে বসে কথা বলছিল, মানে সে বলছিল কম শুনছিল বেশি। ঠিক তখনই তার ফ্যামিলির সবাই তাকে দেখতে এলো। সবাইকে দেখে পুস্পিতা খুবই আনন্দিত হলো। সবার কাছে গিয়ে সবার আদর লুফে নিলো।
সবাই খুব হাসি-ঠাট্টায় মেতে রইল, সন্ধ্যা পার করে সবাই চলে গেল।
পুস্পিতার ফ্যামিলির সবাই যেতেই এক এক করে এলাকা বাসীরা আসতে শুরু করে দিলো। সবাই নতুন বউ দেখতে আসছে, কিন্তু সবই চেনা মুখ।
রাতে পুস্পিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো মন খারাপ লাগছে তার ভীষণ তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো সে। তখনই কেউ এসে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল, এবার আর তার ভয় লাগল না, কারণ এখন সে বুঝতে পারছে এটা কে? সে চোখ বন্ধ করে তার ভালোবাসা কুড়িয়ে নিচ্ছে।
……এখানে কেনো এই ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছো? তা আবার শীতের কিছু না পড়ে? ঠান্ডা লেগে যাবে, এখন কিন্তু ছুটি চাইলেও ছুটি দেবে না। কারণ অল রেডি ছুটি নিয়েছ কয়েক দিনের, তাই বুঝে শুনে কাজ করো ম্যাডাম।
……ছুটি না দিলে তাতে কী আপনি তো আছেন আপনার ভালোবাসা দিয়ে সব ঠিক করে দিবেন।
……ভালোবাসা দিয়ে সব হয় না ম্যাডাম কিছুটা সাবধানতার ও প্রয়োজন আছে।
……এর জন্য আপনি আছেন তো? এই যে এখন যেমন চাঁদর হয়ে গেলেন।
ফাইয়াজ হাঁসল, পুস্পিতার কথা শুনে। তারা আরও কিছুক্ষণ এভাবেই দাঁড়িয়ে রইল বারান্দায়।
সকাল সকাল সবার সাথে বসে ব্রেকফাস্ট করছিল পুস্পিতা, ফাইয়াজ। ব্রেকফাস্ট করে সব মেহেমান বিদায় নিবে।
খাবার শেষ করে একে একে সবাই যার যার পথে রহণা দিলো। সবাই চলে যেতেই ফাইয়াজ আর পুস্পিতাও রেডি হয়ে চলে গেল পুস্পিতার মা বাবার কাছে।
সেখানে এসে পুস্পিতা তার মা বাবা কে পেয়ে খুবই আবেগী হয়ে পড়ল। ফাইয়াজ আজ আর তাদের কিছু বলল না কারণ তাদের আবেগ ঘন মূহুর্ত গুলো তাকেও আবেগী হতে বাধ্য করে দিয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সবাই বসে গল্প করতে শুরু করে দিলো, সবাই নানান প্রশ্ন করে যাচ্ছে ফাইয়াজ কে, সে বুঝতে পারছে এখন, এই দুদিন পুস্পিতার কত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সে এত কথা এমনিতেও বলে না কখনো, বাট আজ বলতে হচ্ছে। তার নিজেকে আদালতের আসামি মনে হচ্ছে, যাকে উকিল একে একে এক গাধা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে। আর সে চুপচাপ উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। আজ পুস্পিতার খুব হাঁসি পাচ্ছে, কারণ সে জানে তার স্যার এত কথা বলতে পছন্দ করে না। তাই সে মুখ চেপে হাঁসছে। তার প্রশ্নের ই তো ঠিক করে উত্তর দেয় না সে, সব সময় উল্টো জবাব দেয়, এখন বোঝো ঠেলা স্বামী জান।
বিকেল দিকে ফাইয়াজ ছাদের এক কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে পুস্পিতার লাগানো ফুল গুলো মনযোগ সহকারে দেখছিল। ঠিক তখনই সেখানে জুঁথি চলে আসলো।
……কী গো দুলাভাই কী দেখছেন?
……(মুচকি হেঁসে) ভাবছি শালিকা আমার এখনো কেনো এলো না? এত দেরি হওয়া কী তার সাজে?
……তাই বুঝি? তবে আগে কেনো বলেন নি? আমি তো এমনিতেই এসেছিলাম। আগে জানলে আপনি অপেক্ষা করছেন তবে কবেই চলে আসতাম।
……তাই? ওহ ঠিক আছে এরপর থেকে জানিয়ে দেবো।
…… দুলাভাই আপনি খুব ভালো।
……তাই? যাক কেউ তো বলল। আচ্ছা বাদ দাও তুমি বলো তুমি কবে বিয়ে করছ? আছে তো কেউ পছন্দের?
……..কী যে বলেন দুলাভাই আমি আর প্রেম।
…….কেনো?
……ভালো লাগে না ওসব, তার মধ্যে আম্মু আব্বু শুনলে মেরেই ফেলবে আমায়।
……তাই কিন্তু কেনো?
……তারা সাফ সাফ বলে দিয়েছে প্রেম করবে না। যদি শুনি তবে সেদিনই তোমার জীবনের শেষ দিন হবে।
…….খুব শাসন করে বুঝি তোমাকে?
……নাহ তেমন নয় কিন্তু এদিকে তারা খুব কড়া।
……যাক তবে ঠিক আছে। তুমিও তবে তাদের কথা মেনে চলবে, যখন তারা তোমাকে ভালোবাসে।
…….হুম।
এরপর দুজনে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে নিচে চলে এলো।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট করে পুস্পিতাদের বাড়ির মেহেমান’রাও সবাই চলে গেল।
সন্ধ্যার পড়ে পুস্পিতা আর ফাইয়াজ তাদের বাসায় ফিরে এলো।
এভাবেই দিন গুলো তাদের যেতে লাগল। পরদিন সকাল থেকেই তারা দুজন এক সাথে হসপিটালে যেতে শুরু করে দিলো।
তাদের জীবনটা খুব সুন্দর ভাবেই কাঁটতে লাগল। ভালো আছে তারা দুজন দুজনার সাথে। এভাবেই মাস খানেক কেটে গেল।
হঠাৎ একদিন রাহাত আনোয়ার হসপিটালে দুজনেই ডিউটি পালন করছিল, পুস্পিতার মুঠো ফোনে কল আসলো তার স্যারের, পুস্পিতা পেশেন্ট কে একটু বসতে বলে ফোন রিসিভ করল। ফাইয়াজ তাকে এখনি ক্যাবিনে ডেকেছেন। সে এই পেশেন্ট কে বিদায় দিয়ে, রুম থেকে বের হয়ে এগিয়ে গেল। তার এসিস্ট্যান্ট তাকে জিজ্ঞেস করল।
…….ম্যাডাম কোথায় যাচ্ছেন অনেক পেশেন্ট আছে তো এখনো।
…….আসছি আমি।
তার মন খুব অশান্ত হয়ে আছে, হবেই না বা কেনো? ফাইয়াজ এই সময় তাকে শুধু শুধু ডাকার মতো মানুষ নয়, কারণ সে জানে এখন পুস্পিতা কতটা ব্যস্ত, তবে এই মূহুর্তে এত আর্জেন্ট কেনো? পুস্পিতা তারাহুরো করে হেঁটে এগিয়ে গেল, সে রুমে যেতে নিলো, কিন্তু ফাইয়াজের এসিস্ট্যান্ট বাধা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে পুস্পিতার চোখে রাগ দেখে সরে দাঁড়িয়ে গেল। পুস্পিতা দরজা ঠেলে ভেতরে যেতেই দেখল ফাইয়াজ চুপ করে চেহারে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলো। তাই পুস্পিতা ফাইয়াজের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে উঠল।
…….কী হয়েছে এভাবে ডাকলেন যে?
ফাইয়াজ তাকিয়ে দেখল পুস্পিতা দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে পুস্পিতা ঘাবড়ে আছে। ফাইয়াজ কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়ে একটা খাম এগিয়ে দিলো পুস্পিতার দিকে। পুস্পিতা খামটা নিয়ে খুলে দেখল তাতে লেখা আছে, সে শেরে বাংলা মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেছে। যা দেখে সে খুশি হয়ে ধরল তার স্যার কে জড়িয়ে। যা দেখে স্যার বলে উঠল।
……এই এটা হসপিটাল কেউ চলে আসবে তো।
……আসুক তাতে আমার কী? আমি আজ অনেক খুশি, আমি যা চেয়েছি আজ সব পেয়ে গেছি আলহামদুলিল্লাহ। আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হবার দিন, আমি খুব খুব খুশি।
এই বলে পুস্পিতা কান্না করে দিলো। সে ফাইয়াজের বুকে মাথা রেখেই কাঁদছিল।
…….এত খুশি হয়ে কাঁদছ কেনো?
…….জানি না খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে, আমি কখনো ভাবিনি এত জলদি আমার সব স্বপ্ন পূরণ হবে। আপনি সাথে না থাকলে হয়ত এত জলদি সব কিছু হতো না, তাই ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করব না। আপনি সব সময় আমার জীবনের এক শুভাকাঙ্ক্ষী হয়েই থাকবেন। ভালোবাসি আপনাকে অনেক বেশি। এভাবেই সব সময় আমাকে আগলে রাখবেন তো?
…….হুম ইন’শা’আল্লাহ।
এর মধ্যে হঠাৎ রুমের দরজা নক করে উঠল কেউ, তাই পুস্পিতা তার স্যারের থেকে সরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে ছিলো। তার স্যার ও চোখ মুছে বসে গেল।
…….স্যার পেশেন্ট?
……হুম ৫ মিনিট পড়ে আসতে বলো।
……জ্বি স্যার।
……পুস্পিতা তবে যাও তোমার পেশেন্ট ও অপেক্ষা করছে হয়ত।
……জ্বি। আপনি বের হবার সময় দেখা করে যাবেন।
……হুম নিশ্চয়ই।
পুস্পিতা রুম থেকে বের হয়ে হাঁসি মুখে খুবই এক্সাইটেড হয়ে তার কেবিনে ঢুকলো।
……ম্যাম অনেক খুশি খুশি লাগছে আপনাকে?
……হ্যা আজ আমি প্রচুর খুশি। তুমি মিষ্টি এনে সবাইকে দিও এই টাকা দিয়ে। কিন্তু ম্যাম কিছুক্ষণ আগেই তো দেখলাম রহিত মিষ্টি নিয়ে এসেছে বলল ফাইয়াজ স্যার আনতে বলছেন।
……ওহ আচ্ছা ঠিক আছে তবে আর লাগবে না। তবে এটা তুমি রাখো আমার তরফ থেকে।
কিছু টাকা এসিস্ট্যান্ট এর হাতে দিয়ে বলে উঠল পুস্পিতা। এসিস্ট্যান্ট খুশি হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এরপর ধীরে ধীরে সব পেশেন্ট দেখে, দুজনেই বেরিয়ে পড়ল হসপিটাল থেকে।
দুজনে বাসার সবার জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে রহনা দিলো বাসায় যাওয়ার জন্য। দুই বাড়ির সবাইকে মিষ্টি মুখ করিয়ে, দুজনে এক সাথে এবার গেল ল্যাব এইডে। সেখানে রাত ১২ টা অব্দি পেশেন্ট দেখে দুজনে এরপর ফিরে এলো তাদের ছোট্ট সেই রুমটিতে। ভালো আছে তারা অনেক বেশি।
।
।
।
চলবে………..।