ফুলকৌড়ি পর্ব(৫) #লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

0
220

#ফুলকৌড়ি
পর্ব(৫)
#লেখনীতে_শারমীন_ইসলাম

বিশাল বড়ো দোতলা বাড়িটা এখন ফাঁকা।কোথা-ও কোনো শব্দ নেই।বাড়ির ছেলেমেয়ে গুলো বাড়িতে না থাকলে,এই নীরব পরিবেশটা বিরাজ করে।তরকারির শেষ বাটিটা ডাইনিং টেবিলের উপর রেখেই,ধপ করে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন স্বান্তনা রহমান।সকাল বেলা থেকে একজন একজন করে খাওয়াতে খাওয়াতে তিনি প্রায়সই ক্লান্ত হয়ে পড়েন,ঠিক ক্লান্ত নয় হাঁপিয়ে উঠেন।বড় ভাইয়ের অসুস্থতার জন্য বড়ো ভাবী এই সময়টা রান্নাঘরে থাকতে পারেন না, দিতে পারেন না।
যদিও চেষ্টা করেন।তবে রানী সবকিছু গুছিয়ে দিলে-ও, এই সকালের সময়টায় বারবার উপর নিচ করে ছেলেমেয়েদের ডেকে তুলে রেডি করে একের পর একজনকে খাইয়ে বের করে দিতে দিতে তিনি হাঁপিয়ে উঠেন।মেয়েটা উনার কথা মোটামুটি শুনতে মানতে চাইলেও,ছেলেটার যে বাহানাবাজির শেষ নেই।নিজ ইচ্ছায় কখনো ঘুম থেকে উঠবে-না,তাকে ডেকে ডেকে পাগলপ্রায় হয়ে যাওয়ার পর উঠবে।ক্লাস ফোরে পড়া ছেলে এখনো নিজে একা ব্রাশ করবে-না,নিজ হাতে খাবে না।সমস্ত কাজগুলো নিজে গো করবে না, তিনি করিয়ে দিতে গেলে-ও অযুহাত আর বাহানার শেষ নেই।
আর খাওয়ার বিষয়েতো বাহানাবাজিতে সুপার এক্সপার্ট একবারে ডিগ্রীধারী।ছেলের এই সকালবেলার রোজকার বাহানায় তিনি অতিষ্ট হয়ে হাঁপিয়ে যান।তারউপর একেক জনের স্কুল কলেজ, ভার্সিটি, অফিস টাইম আলাদা হওয়ায়, সকাল বেলা আর নিয়ম করে একসাথে খাওয়া হয়ে উঠেনা।যদিও জাহিদ সাহেব সুস্থ থাকাকালিন নিয়মটা বেশ জোরালো ভাবে চলতো।সে যার যখন অফিস আদালত,স্কুল কলেজ টাইম হোক না কেনো।নির্দিষ্ট একটা টাইমে সবাই একসাথে ডাইনিংয়ে হাজির হওয়া,এবং খাওয়া।স্বান্তনা রহমানের খুবকরে মনে হয়,ভাইজানের নিয়মের সিদ্ধান্তগুলো খুবই ভালো ছিলো।হাতাশার শ্বাস ফেলে মাথা কাত করে টেবিলে এলিয়ে দিলেন তিনি।

‘কি-রে, ওভাবে টেবিলে মাথা লাগিয়ে শুয়ে পড়েছিস কেনো?ক্ষুধা লাগছে খেয়ে নিবিতো।নাকি শরীর খারাপ লাগছে?

নীহারিকা বেগমের কথায় মাথা তুলে বসলেন স্বান্তনা রহমান।বললেন– শরীর খারাপ নয়,আর ক্ষুধার জন্যও শুয়ে পড়িনি।আমার ওই বাহানাবাজ ছেলেটা বাড়িতে নেই,তাই ভেবে একটু শান্তি করছি।

‘ওভাবে বলিস কেনো?ও একটু চঞ্চল তবে,আমাদের বাড়ির আশে-পাশের অন্যান্য ছেলেদের মতো অত-শত মাত্রাধিক দুষ্ট তো নয়।

‘তোমার মাত্রাধিক ধৈর্য্য তাই তোমার কাছে ওর দুষ্টিমিগুলা মাত্রাছাড়া মনে হয়না,বুবু।কিন্তু আমার অত ধৈর্য্যসহ্য নেই।তাই আমারও অতশত সহ্য হয়না।কি জ্বালানটা জ্বালায় সারাদিন দেখেছো।ছেলে না হয়ে যদি আরও একটা মেয়ে হতো,কিছুটা শান্তি থাকতে পারতাম।ওর জন্য মাঝে-মধ্যে আমার আর দুনিয়াদারি করার ইচ্ছে করে না।

জাহিদ সাহেবকে খাইয়ে,খাবারের এঁটো পাত্রগুলো নিয়ে আসতেই চলতি পথে কথা হলো দু’জায়ের।ছোটো জায়ের বিরক্তমাখা কথাগুলো শ্রবন করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকলেন নীহারিকা বেগম।বললেন।

‘বাড়ির মধ্যে দুই একটা ওরকম না থাকলে চলেনা।তাই বলে তুই যা বলিস,ও অতোটাও না।

স্বান্তনা রহমান আবারও বকা শুরু করলেন।ছেলের চৌদ্দ গুষ্টির ষষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগলেন।এবাড়ির কার কার জন্য এই ছেলে এতোটা বাহানাবাজ হয়েছে,বিগড়ে গেছে বলতে লাগলেন।তারমধ্য প্রথম সারিতে নীহারিকা বেগমকেও ছাড়তে ভুললেননা।তাকে দোষারোপ করেও কথা শোনালেন।কথার প্রেক্ষিতে নীহারিকা বেগম শুধু মৃদু হেসে গেলেন।এই দোষারোপের মধ্যে যেও শান্তি আছে।ভালো লাগা আছে।এবাড়ির সব ছেলেমেয়েগুলা যে উনার এক একটা শরীরের অংশ।সেই অংশ গুলো যতক্ষণ আঘাত,কষ্ট না পায় ততক্ষণ তিনি ভালো থাকেন।আর সেই অংশগুলোর মধ্যে থেকে একটা যদি ব্যথা পায়,সামন্য মুরছা যায় তিনিযে কিছুতেই ভালো থাকতে পারেন না।এটাই যে তার সংসার,এই সংসারের প্রানহীন জিনিসগুলোর ব্যথাও যে উনার প্রানে অনুভাবিত হয়।সেখানে এই বাড়ির ছেলেমেয়েগুলোতো উনার সেকেন্ডে সেকেন্ডে চলিত নিঃশ্বাস।স্বান্তনা রহমানকে শাান্ত করাতে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন।

‘এই ছোটো, আম্মা খেয়েছেন?উনি তো আবার একটু বেলা না গড়ালে খেতে চান না।

ছেলেমেয়েদের বকা যেমন ভাবীর শুনতে ইচ্ছে করেনা।তেমন নিজেও সামন্য দু-একটা ধমক দিলেও,অতিরিক্ত বকেন না।ধৈর্য্য নিয়ে সবকিছু হ্যান্ডেল করেন।কিন্তু এত বছর সেই মানুষটার সান্নিধ্যে থেকে,সবকিছু মোটামুটি আয়ত্ত করতে পারলেও এই অতি ধৈর্য্য জিনিসটা তিনি আয়ত্ত করতে পারেননি।বললে আর চাইলেই কি সবটা হয়!তপ্ত শ্বাস ফেললেন স্বান্তনা রহমান।বাড়ির সবচেয়ে ছোটো সদস্য হওয়ায় নাফিমকে সবাই মাত্রাধিক আদর করে, ভালোবাসে।আর তার সম্পূর্ণ ফায়দা লুটে ওই বদমায়েশ ছেলেটা।ওই বাদর ছেলের বড়োমা বলতে, সব আবদার ওখানে।আর তেনার বড়োমাও তেমন।সেই ছেলের নামে উল্টো পাল্টা কথা ধৈর্য্য নিয়ে শুনবেন।নাহ,তেমনটা কখনো হওয়ার নয়।সে কারনেই যে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলা বেশ বুঝলেন স্বান্তনা রহমান।

‘কোথায় খুইয়ে গেলি?কি জিজ্ঞেস করেছি শুনতে পাস নি।আর রানিও বা কোথায় গেলো?

‘আম্মা এখনো খাননি।আমি জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম,উনার রুমে খাবার দিয়ে যাবো কি-না।উনি বললেন ডায়নিংয়ে এসে খাবেন।আর রানীতো কেবলমাত্র ওর রুমের দিকে গেলো।

স্বান্তনা রহমানের কথা শেষ করার আগেই রানী সেখানে হাজির হলো।বললো–কিছু দরকার ভাবীজান?

‘বেলা কতো হলো খেয়াল আছে।রোজরোজ আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে কেনো?তোমরা খেয়ে নিতে পারো না।যাও আম্মাকে ডেকে নিয়ে এসো।

আজ্ঞা পেতেই রানি চলে গেলো।নীহারিকা একটু বিরক্ত হয়ে ফের স্বান্তনা বেগমকে বললেন।–ক্ষুধা লাগলে যে যার মতো খেয়ে নিবি,আর কত বলবো তোদের।আমার জন্য অপেক্ষা করে বেলা গড়ানোর কোনো মানে আছে!

স্বান্তনা বেগম মাথা উঁচু করে এবার চেয়ারে সটান হয়ে বসলেন।বললেন–তোমার জন্য অপেক্ষা করি কে বললো!তুমিতো মানুষ নও, যন্ত্র।তোমার আবার ক্ষুধা, ঘুম,ব্যাথ,খারাপ লাগা ভালো লাগা আছে নাকি।এগুলো আমরা জেনেও তোমার জন্য অযথা অপেক্ষা করতে পারি?তোমার মতো যন্ত্রের জন্য অপেক্ষা করতে আছে নাকি?

রান্নাঘরের এঁটো জিনিসগুলো ধুইয়ে ডায়নিংয়ে এলেন নীহারিকা বেগম।স্বান্তনা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।-রেগে যাস কেনো?আচ্ছা আমি অপেক্ষা করতে বলে ভুল করে ফেলেছি।ক্ষমা কর আমাকে।যাই হোক রাগারাগি পরে করিস,বেলা অনেক গড়িয়েছি এবার তো খেতে শুরু কর।

চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে হঠাৎই কৌড়ির কথা মনেহলো উনার।ফের ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন–মেয়েটা খেয়েছে?

হঠাৎ খেয়াল হলোনা স্বান্তনা বেগমের।বললেন–কোন মেয়েটা?

—কৌড়ি।

সকালের এতো ব্যস্ততায় মেয়েটার কথাতো ভুলেই বসেছিলেন স্বান্তনা বেগম।কাল একটা নতুন সদস্য যে তাদের বাড়িতে এসেছে,এটাতো মনেই ছিলো না উনার।মুখটা অসহায় ভঙ্গিমা করে নীহারিকা বেগমের দিকে তাকালেন তিনি।যাতে যা বোঝার বুঝে নিলেন নীহারিকা বেগম।তবুও কৈফিয়তের স্বরে স্বান্তনা’রহমান বললেন।

‘বিশ্বাস করো বুবু,আমার মেয়েটার কথা একটু বলতেও খেয়াল ছিলো না।নাহলে..

কথা শেষ করতে দিলেন না নীহারিকা বেগম।দু বাচ্চার মা হয়ে গিয়েছে অথচ,স্বান্তনা সেই সদ্য এবাড়িতে আসা কিশোরীর মতোই অবুঝ রয়ে গেছে।অবুঝ থাকারই তো কথা, মেয়েটার মনে যে মারপ্যাঁচ নেই।এতো বছর সংসারে কতো ঝঞ্জাট,উত্থানপতন গেছে,তবুও মেয়েটা আগে যেমন সহজ সরল মনের ছিল।এখনো তেমনটাই আছে।তিনি বললেন।

‘এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কি হলো?আমি তোকে চিনি না,নাকি জানি না!খেয়াল না থাকতেই পারে,আমারও তো মেয়েটার কথা খেয়াল ছিলো-না।তাই বলে কি সেটা অন্যায় হয়ে গেলো?

‘বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথদ নয়,তবে মেয়েটার কথা-তো খেয়াল রাখা উচিত ছিলো।সেটার জন্য বললাম।

স্বান্তনা রহমানের ছোটো মুখ করে বলা কথাটা শুনে নীহারিকা বেগম সংগোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।মেয়েটা এরকমই।তার ছোটো ভুল গুলোও তার অনেক বড়সড় ত্রুটি বলে মনেহয়।মাঝেমাঝে অন্যায় ভেবেও তো আফসোস করে।নীহারিকা বেগম হাজার বুঝিয়ে পারেন না।অথচ সেই স্বান্তনার সামনে দিয়ে আরও আরেক জা উনার কতো ত্রুটি করে চলে গেলো।সেটা থেকেও শিক্ষা নিলোনা মেয়েটা। বরাবরই উনারই আদর্শ, চালচলনকে আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করেছে স্বান্তনা। স্বান্তনা বেগমের কাঁধে হাত রাখলেেন তিনি।ফের স্বান্তনা সরূপ বললেন।

‘আচ্ছা ঠিক আছে।সামন্য বিষয় নিয়ে মন খারাপ করে মুখ ছোটো করার মতো কিচ্ছু হয়নি।আমি দেখছি।

নীহারিকা বেগম কৌড়িকে ডাকতে ছুটলেন।সেদিকে তাকিয়ে রইলেন স্বান্তনা রহমান।কবে যে উনিও একটু সবদিক দিয়ে সবার খেয়াল ধ্যান রাখতে পারবেন।কে জানে?এক ছেলে নিয়েই যেখানে তিনি ধৈর্য্যহারা হয়ে পড়েন,ছেলে কাছে থাকলে তার বাহানায় নিজেকে ভুলতে বসেন।সেখানে সবার খেয়াল খোঁজ রাখা সত্যিই সম্ভব কি?তাহলে নীহারিকা নামক নারীটা পারে কি করে?অসুস্থ স্বামীকে সামলে,এবাড়ির সকল ছেলে-মেয়ের আবদার, চাওয়া, পাওয়া পূর্ণ করতে?যেখানে তিনি স্বান্তনা রহমান এক ছেলের বাহানাবাজিতে কাতর হয়ে পড়েন!পারেন কি করে গোটা সংসারের ভালোমন্দ সবকিছু একহাতে সামলিয়ে,ওই একটা নারীমস্তিস্কে সবার খোঁজ খেয়াল রাখতে?ভাবীর মতো তিনি হতে পারবেন কি-না, জানা নেই।তবে ওই গুনি নারীটির মতো হওয়ার সাংঘাতিক লোভ উনার।বরাবর ওই গুনি নারীটির মতো,উনার গুনে গুণান্বিত হতে চান তিনি।

জানালার গ্রিল ধরে নিজের জীবনের এলোমেলো হয়ে যাওয়া সমীকরণ গুলো নিয়ে ভাবনায় ডুবে আছে কৌড়ি।কাল সে কোথায় ছিলো আর আজ কোথায়?বাবাও তো!কাল তিনি এই সময়টাতে লাশ হয়ে রইলেও দুনিয়ায় বুকে ছিলেন।আর আজ তার মৃত্যুর একটাদিন পার হতে চলেছে।সময়টা কতো দ্রুত চলে যায়।স্রোতের চেয়েও জেনো তার গতিবিধি আরও দ্রুতগামী।কারও কষ্ট, ক্লেশ, যাতনার কাছে, সেই নিষ্ঠুর সময় নামক গতিবিধিটা থেমে নেই,তার জেনো কারও কোনো কষ্ট ক্লেশ, খারাপলাগা ভালোলাগাতে থেমে থাকলে চলেনা।সে তার রবের হুকুমে স্বাধীনচেতা হয়ে আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে।বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কৌড়ির।সঙ্গে দুচোখ বেয়ে দুফোঁটা নোনা অশ্রু।কারও পায়ের এগিয়ে আসার শব্দ নিজের রুমের পানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বুঝতে পেরেই,সদর্পে দু’হাতে চোখের অশ্রুঝরা মুক্তগুলো মুছে নিলো সে।পায়ের শব্দটা তার পিছনে এসে থামতেই,পিছে ফিরলো।

‘কৌড়ি।তুমি আবার-ও কান্নাকাটি করছো?

ম্লান হাসলো কৌড়ি।নীহারিকা বেগমের কথার জবাব দিতে গিয়েও,দিতে পারলো না সে।মাথা নিচু করে নিল।
পরপর কয়েকটা ঢোক গিলে গলা স্বাভাবিক করে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো—আমি কাঁদছি না-তো।

‘মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে চাইছো?এতো সহজ?

এবার আর চেয়েও কথা বলতে পারলো না কৌড়ি।শুধু মাথা এদিকে ওদিকে নাড়িয়ে না বোঝালো।অর্থাৎ সে মায়ের চোখ ফাঁকি দিতে চাইছেনা।আর তা যে সহজ কথা নয় সেটাও সে জানে।তবে সে কি করবে,বাবা যে তার পৃথিবীর একাংশ ছিলো।আর সেই অংশবিশেষ ডুবে যাওয়ায়,উনার স্মৃতি স্মরণে কান্নারা সময় অসময়ে এসে ভীড় করছে তার দু-নজরে।তবে সে কি করবে।কৌড়ির পরিস্থিতি বুঝে আর কথা বাড়ালেননা নীহারিকা বেগম। নরম স্পর্শে কৌড়ির হাতটা নিজের হাতের মুঠোই নিয়ে সামনে এগোতে এগোতে বললেন।

‘এবার কাঁদলে আমি কিন্তু সত্যিই বকা দেবো তোকে।যে সৃষ্টিকর্তার ডাকে চলে যাওয়ার তাকে কি কেঁদেকেটে তুই কোনোমতেও আটকিয়ে রাখতে পারবি,নাকি কেঁদে কেটে ফিরিয়ে আনতে পারবি?তবুও কেনো এতো মন খারাপ করছিস।আমরা আছি তো।

কথাগুলো স্বান্তনা সরূপ বললেও নীহারিকা বেগমও জানেন,বাবা নামক বটবৃক্ষ নিজের জীবন থেকে একবারে মুছে গেলে কেমনটা লাগে,আর কি অন্তর্দাহ হয়।একটু থেমে তিনি ফের বললেন।—আর মন খারাপ করে সারাক্ষণ রুমে বসে থাকলে চলবে?তুইও এখন থেকে আমাদের বাড়ির আরেকটা মেয়ে।খাবিদাবি,সারা বাড়িময়,মান্য মৌনতার মতো ঘুরে বেড়াবি।আমি কি করছি,ছোটো চাচি কি করছে।সব দেখবি,শুনবি তা না।মন খারাপ করে ঘরে বসে আছে মেয়ে।আর সেই কাল এবাড়িতে এসেছিস,এখনো তোর আঙ্কেলের সাথে একবারও দেখা করেছিস?করিস নি।মানুষটা না-হয় চলতে ফিরতে পারেনা বলে তোর সাথে দেখা করতে আসতে পারছে-না।তাই বলে তুই যাবিনা?আমাকে কতোবার বললো,নীহারিকা মেয়েটাকে একবার আমার কাছে নিয়ে এসো।জানিস তুই?কিন্তু তুইতো কান্নাকাটি করতে মহাব্যস্ত, এই অবস্থায় তোর আঙ্কেলের কাছে নিয়ে যাই কিকরে বল? মানুষটা আমাদের বকবে না?যে তোমরা থাকতে মেয়েটা এতো মন খারাপ করার সুযোগ পায় কি করে?তার বকা শুনবে কে!এখন খেয়েদেয়ে তারসাথে গিয়ে গল্প জুড়বি।

নীহারিকা বেগমের মন ভোলানো কথাগুলো বুঝতে পেরেও,তুই সম্বোধনের মন ভোলানো কথাগুলোয় সত্যিই কৌড়ির মন ভুলিয়ে দিলো,জুড়িয়ে গেলো।যদিও সে বুঝতে পারলো,তাকে অবুঝ বাচ্চাদের মতো কথার ছলে মন ভুলানো হচ্ছে।তবুও,নীহারিকা বেগমের মমতাময়ী কন্ঠের কথাগুলো তাকে মোহগ্রস্ত করলো।নিজের আপন আপন কাওকে মনেহলো তার।

‘বোস।

চেয়ারে বসতে গিয়ে সামনের দিকে নজর পড়লো তার।এবাড়ির বয়োবৃদ্ধা ফাতেমা বেগম এদিকে এগিয়ে আসছেন।খেতে বসবেন হয়তো।উনাকে আসতে দেখে আর বসলোনা কৌড়ি।উনি এসে বসার পর কৌড়ি বসলো।বিষয়টা কেউ নজরবন্দী না করলে-ও ফাতেমা বেগম বেশ খেয়াল করলেন।মনে মনে উনাকে মান্য করার জন্য,কৌড়ির এই শিষ্টাচারে তিনি খুশী হলেন।
তবে মুখের গম্ভীর্য আদলে সেটা প্রকাশ পেতে দিলেন না।কৌড়ি-ও নিজের গায়ে মাথার ওড়না সংযাত করে নিয়ে খেতে বসলো।যেটা বরাবর দাদি আপা শিখিয়ে দিয়েছেন।যেভাবে সে নিজে-ও চলতে চায়।তবে একটু এদিকে সেদিক হলেই যে দাদিআপা রাগ করতেন।আজ তিনি কাছে নেই বলে,উনার নিয়মনীতিগুলো আরও বেশি বেশিভাবে স্মরণে পড়ছে।

‘দিবা দাদুমনি কোথায়?সে খেয়েছে?

ফাতেমা বেগমের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নীহারিকা বেগম।শ্বাশুড়ি মা’কে ঠিক কি বলবেন ভেবে পেলেন না।
স্বান্তনা রহমানের গালে চিবানো খাবার-ও ধীমে হয়ে এলো।একমাত্র মেয়ের মেয়েকে যে, তিনি এবাড়ির সব ছেলেমেয়েদের থেকে সামান্য হলেও একটু বেশি ভালোবাসেন।এটা এবাড়ির সবাই জানে।তাই বলে তার সব আহ্লাদ পূর্ণ করতে হবে, ন্যায় অন্যায় ভুল বিবেচনা না করে!একটা পোস্ট গ্রাজুয়েশন মেয়েকে,এখনো ছোটো ভেবে তার ভুল চিন্তা ভাবনাকে প্রশ্রয় দেওয়াটা, ঠিক ভালো লাগেনা স্বান্তনা রহমানের।এজন্য তো তিনি নানদের চোখের বালী।তিনি এখন বাড়িতে নেই,তাই কিছুটা হলেও স্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছেন।দীবা মেয়েটা খারাপ এটা তিনি বলছেন না,মেয়েটার মাথায় ভুলভাল চিন্তাগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে খারাপ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে।যা এখন ভোগ করছে মেয়েটা।না গিলতে পারছে আর না ভোগ করতে পারছে।সম্পর্ক নিয়ে এমন ঝুলন্ত অবস্থায় আছে মেয়েটা।আর স্বান্তনা রহমানের শ্বাশুড়ি সব জেনেশুনেও,নিজের মেয়েকে কিছুই বলেন না।সবাই যখন চুপচাপ রানী তখন কিছুটা বিব্রত হয়ে উত্তর দিলো।

‘আম্মা,দীবা আম্মা এখন খাবে-না বলছে।সে খেতে আসে নাই শুনে,বড় ভাবীজান আমারে ডাকতে পাঠিয়ে ছিলেন।তার দরজায় শব্দ করতেই বললো, বিরক্ত না করতে।তার সময় হলে সে ঘুম থেকে উঠে খেয়ে নেবে।

ফাতেমা বেগম,নাতনীর এহেন আচারনে মনেমনে একটু বিরক্ত হলেন।তবে ক্ষুনাক্ষরেও সেটা মুখাবয়বে প্রকাশ করলেন না।দীবার বিষয়টা সেখানেই সমাপ্ত হলো।যেটা নীহারিকা বেগম মানতে পারলেও স্বান্তনা রহমান মানতে পারলেন না।তবে মুখ ফুটেও কিছুই বললেন না।কারও ভয়ে নয়,শ্বাশুড়িকে সীমহ করার গুনটাও তিনি তার পাশে বসা ভদ্রমহিলার থেকে রপ্ত করেছেন।এবং মান্য-ও করেন।কিন্তু মাঝেমাঝে অসহ্য এসব কারবার দেখে মুখ খুলতে বাধ্য হন।পাশে বসা ভদ্রমহিলার সকল গুন রপ্ত করতে, চাইলেও তার মতো ধৈর্য্য সহ্য তিনি এখনো রপ্ত করতে পারিননি।বিধায় সবকিছু ধৈর্যের বেলায় এসে খামতি পড়ে যায়।শ্বাশুড়ির কথায় ভাবনায় ভাঁটা পড়ে যায় স্বান্তনা রহমানের।তিনিও শ্বাশুড়ির প্রশ্ন মোতাবেক কৌড়ির উত্তর শোনার জন্য তার মুখের দিকে তাকালেন।

‘তুমি কোন ক্লাসে পড়ছো,মেয়ে?

খেতে খেতে কৌড়িকে বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করলেন ফাতেমা বেগম।মেয়েটার খাবারের শালীনতা শিষ্টাচারও উনার বেশ পছন্দ হলো।মনেহয়,মেয়েটা বেশ শান্তশিষ্ট প্রকৃতির।উনার নাতনীদের মতো উড়নচণ্ডী টাইপের নয়।কালকে মেয়েটাকে শাড়ী পরা অবস্থায় দেখে, মান্যতার বয়সী মনে হয়েছিলো উনার।কিন্তু আজ ড্রেস পরা অবস্থায় দেখে তো বেশ ছোটো ছোটো মনেহচ্ছে মেয়েটাকে।তাই তিনি আচমকা প্রশ্নটা করলেন।কৌড়িও গালের খাবারটা চিবানো বন্ধ রেখে নমনীয় গলায় উত্তর দিলো।

‘এবার ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষা দেবো।তিনমাস পর আমার পরিক্ষা।

কথাটা বলে মাথা নিচু করে নিলো কৌড়ি।বাবার ইচ্ছে ছিলো কৌড়ি ডাক্তার হবে।মানব সেবা করবে।সেই মোতাবেক পড়ালেখা করে আসছিলো।তবে জীবনের মধ্যে দুপুরে এসে থেমে গেছে সে।এবার কি আর বাবার স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারবে।অন্যের আশ্রিতা এখন, কে পড়াবে তাকে আর।ইন্টার পরিক্ষাটা পর্যন্ত দিতে পারবে কি-না, তার ঠিক নেই।ডাক্তার হওয়া তো শুধুই ঘুমের ঘোরে থাকা বিলাসবহুল স্বপ্নের মতো ছাড়া কিছুই না।
সবাই চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগী হলেও আর খাবারে মনোযোগী হতে পারলোনা কৌড়ি।সেটা খেয়াল করলেন নীহারিকা বেগম।নিজ মনে ভাবলেন কিছু।ফের নিজের পাশে বসা কৌড়ির হাতখানার উপর নিজের হাতের মৃদু স্পর্শ রাখতেই, কৌড়ি উনার দিকে ফিরলো। সেটা দেখে মুখে মৃদু হাসি টেনে নীহারিকা বেগম চোখ দিয়ে ইশারা করলেন খাবার খেতে।ইশারা লক্ষ্য করে খাবার খেতে মনোযোগী হলো কৌড়ি।যদিও খেতে ইচ্ছে করলোনা তার।

‘কি-রে কাল এসেছিস,আর আজ একদিন পূর্ণ করেই তবে আমার সাথে দেখা করার সময় মিললো তোর।এত মন খারাপ ছিলো?আমি একবার যেতে চেয়েছিলাম। নীহারিকা বললো,তখন তুই ঘুমিয়ে গিয়েছিলি।

অমায়িক ব্যবহারের এই কাকু নামক মানুষটাকে কৌড়ি কয়েকবার দেখেছে।তবে উনি তখন সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন।বাবা আর কাকুর মধ্যে খুবই ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও,তাদের পরিবারের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক ছিলোনা।বাবা ঢাকাতে এলে কাকুর সাথে দেখা করতেন,এবাড়িতেও আসতেন।খেয়েদেয়ে যেতেন।যেটা কৌড়ি বাবার মুখে শুনেছে।কাকুও কোনো কাজে গ্রামে গেলে,বাবার সাথে যোগাযোগ করতেন,তাদের বাড়িতে থেকে আমোদ আহ্লাদ করে চলে আসতেন।সেই হিসাবে কাকু নামক মানুষটাকে চেনা কৌড়ির।তবে উনার
এক্সিডেন্টের কথা শুনে বাবা এসে দেখে গেলেও,কৌড়ির তারপর আর কাকুর সাথে দেখা হয়নি কখনো।

‘কি-রে এখনো মন খুব খারাপ?কিন্তু কি আর করার আছে আমাদের বল!সবাইকে তো একদিন যেতেই হবে সে পথে।কারও যে ছুটকারা নেই সে পথ থেকে।এইযে আমিও সময় গুনছি?কবে আমার ডাকটাও চলে আসে।

‘এসব কি কথা বলা শুরু করেছেন।মেয়েটাকে আপনার কাছে আনলাম মন ভালো করতে আর আপনি আরও মন খারাপ করে দিচ্ছেন।

নীহারিকা বেগমের মিষ্টি ধমকে মলিন হাসলেন জাহিদ সাহেব। এই পঙ্গুত্ব জীবন উনার আর ভালো লাগেনা।না মরে এরকম অন্যের দায়ভার হয়ে বেঁচে থাকার থেকে মনে হয় মরে যাওয়ায় ভালো। তবে নীহারিকার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা,বিরক্তহীন সেবা।তাকে বাচিয়ে থাকতে সাহস জোগায়।তবে নিজেকে মাঝে মাঝে নীহারিকার বোঝা মনেহয় উনার।উনার জন্য নাহীরিকার একদন্ড ফুরসত নেই।কোথা-ও যাওয়ার শান্তি নেই।নিজেকে খেয়াল করারও যো-টুকু পর্যন্ত নেই।নীহারিকা বেগমের রাগান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন।

‘তোমরা সত্যি কিছুতেই মানতে চাওনা নীহারিকা।এরকম ধমক দিয়ে সত্যটাকে আড়ালে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করো।তাই বলে সত্য কি মিথ্যা হয়ে যায়?সত্য যে অনিবার্য।প্রভুর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতা।সেই সত্যকে আড়ালে ডাবিয়ে রাখলে সত্য কি কখনো মিথ্যা হয়ে যাবে?যাবে না।কখনোই যাবার নয়।

থামলেন জাহিদ সাহেব। পাশে বসা কৌড়ির মাথায় হাত রাখলেন।ফের নরম কন্ঠে বললেন।–চিরন্তন বাস্তব বলে
সত্যকে মেনে নেওয়া সেখ,মা।তবে দুঃখ কষ্ট কম ছোঁবে তোকে।দূর্গম পথ সহজ মনে হবে।এই কঠিন পৃথিবীতে চলতে গেলে দুঃখ কষ্টে পতিত হয়ে মুরছা গেলে চলবে না।সত্যকে মেনে নিয়ে নিজেকে শক্ত কর।সামনের দিন গুলো সহজ হবে।

অন্যকে উপদেশ মুলক বানী শোনানো সহজ বিষয়।কিন্তু সেটা অপরপক্ষের মানা ঠিক তার বিপরীত বিষয়।এটা জাহিদ সাহেব জানেন।ক্ষনিকের এই পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা মায়া,টান,ভালোবাসা তো এমনি এমনি সৃষ্টি করেনি।আর পিতামাতার মতো মহামূল্যবান সম্পর্কও।সেই পিতামাতা জীবন থেকে ডুবে গেলে,সূর্য অস্ত যাওয়ার মতো নিজের জীবনটাও অস্তমিত মনেহয়।নিজের বাবার মৃত্যুতে সেটা অনুভব করেছেন জাহিদ সাহেব।আর সামনে বসা এই মেয়েটার তো পিতামাতা দু’জনেই অস্তমিত।বাবা মা সমতুল্য চাচা চাচি থেকেও নেই।আর দাদি সে-ও যে ডুবুডুবু ভাব।আর সেই মেয়েটাকে এসব বানী শুনিয়ে কি সহজে শান্ত করা যায়?মেয়েটা যে কখনো বাচ্চা।সেই বাচ্চা মনে কতো আঘাত একটার পর একটা নির্মমভাবে হানা দিয়ে চলেছে।আর মেয়েটা ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।এটাও বা সত্য মানার থেকে কম কিসে?

প্রসঙ্গ পাল্টে জাহিদ সাহেব আরও বিভিন্ন কথা কৌড়ির সাথে বলতে থাকলেন।মেয়েটাও চুপচাপ শুনল সহজে উত্তর করলোনা।এবাড়ির এই মানুষটা বাদে সর্বত্র মানুষগুলো তার অপরিচিত।তবে এই মানুষটাও যে খুব পরিচিত এমনটাও নয়।বিধায় উনার সাথে সহজ হয়ে কথা কৌড়ির একটু সংকোচ হলো।তবে মানুষগুলো ভিষন ভালো। তার রক্তের সম্পর্কিত চাচা চাচির মতো অন্ততঃ নয়।

সারা সকাল দুপুরটা কৌড়ির একাকিত্ব কেটে গেলে-ও, বিকালের দিকে আবারও হৈচৈ পূর্ণ পরিবেশের মিলনমেলা শুরু হলো তার রুমে। মৌনতা চারটার পর স্কুল থেকে এসেই, কোনোমতে খাওয়া গোসল সেরে তারসাথে ওটাএটা নিয়ে বকবক শুরু করে দিলো।চিকনচাকন গড়নের ফর্সা মেয়েটা বেশ কৌতুহলী আর চঞ্চল।তবে প্রচন্ড মিশুকে স্বভাবের।তার অতি মিশুকতা সহজে মানুষ,তার কাছের মানুষ হয়ে যেতে বাধ্য।

‘কাল তোমার রুমে আসা নিষেধ ছিলো,এজন্য তোমার কাছে আসতে পারিনি আমি।সকালে স্কুল ছিলো,যদি-ও আমি যেতে চায়নি।আম্মুর বুকিনিতে যেতে হয়েছে।আর বাবা দাদাভাইরা জানলে বকবে,আমি স্কুল কেনো যায় নি।তাই,সকাল থেকে এই পর্যন্ত তোমার কাছে আসতে পারি নি।কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো,আমি স্কুলে থাকলেও মন আমার তোমার কাছে আসার জন্য,তোমার সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করছিলো।তবে চেয়েছিলাম টিফিন পিরিয়ডে বাসায় চলে আসবো।কিন্তু তখন বাসায় আসলে আম্মু আমাকে খুব পিটানি দিতো।আর জানো আমার একটা ছাগলী বান্ধবী আছে,সে-ও আমাকে কিছুতেই আসতে দেয়নি।বাড়িতে আম্মু আর স্কুলে তিন্নি।আসলে ওর বা কি দোষ।ও স্কুলে না আসলে আমার ক্লাসে মন বসে না।সেখানে আমি না থাকলে, ওর ও তো ভালো না লাগার কথা।যাই হোক কাল যখন তোমাকে দাদাভাই এবাড়িতে নিয়ে এলো,আমি মনে করছিলাম।দাদাভাই বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে।তবে সাদা শাড়ীর জায়গায় লাল একটা শাড়ী পরলে, দাদাভাইয়ের বউ হিসাবে তোমাকে কিন্তু দারুন মানাতো।একদম পারফেক্ট জুড়ি।তুমি কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে।দাদাভাইয়ের পাশে কিন্তু তোমাকে দারুন মানায়।তবে…

এত কথার জের ধরে একটু থামলো মৌনতা।কৌড়ির ডগর ডগর নিষ্পলক নজরের পানে চেয়ে ফের দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললো–তবে যখন আমি শুনলাম তুমি দাদাভাইয়ের বউ না,আমার যে মন খারাপ হয়েছিলো।তোমাকে কি করে দেখাই!দেখানোর হলে সত্যিই তোমাকে দেখাতাম।আমি আরও ভেবেছিলাম,আজ স্কুলে গিয়ে আমার বান্ধবীদের তোমাকে দেখাতে নিয়ে আসবো।যে আমার দাদাভাই কি সুন্দর একটা বউ নিয়ে এসেছে দেখ তোরা।কিন্তু হলো না।

কৌড়ি আশ্চর্য হয়ে মৌনতার কথাগুলো শুধু নীরব শুনে গেলো।এই মেয়ে এসব বলছেটা কি!অজানা কারনে গায়ের নুইয়ে থাকা লোশম গুলো কাটা দিয়ে উঠলো।তবুও সেদিকে লক্ষ্যনেই তার,সে মৌনতার অনর্গল নড়ে যাওয়ার ঠোঁটের পানে তাকিয়ে আছে।কে এই দাদাভাই?তাকে কালকে নিয়ে আসা মানুষটা?সমস্ত গা ঝাঁকি দিয়ে শিহরে উঠলো কৌড়ির।

‘চলো ছাঁদে যাই?

আশ্চর্যতা দমন না হওয়ার কারনে,মৌনতার প্রস্তাব কর্নে বোধাহয় গেলোনা কৌড়ির।সেটা না বুঝেই কৌড়ের হাত শক্তপোক্ত করে ধরলো মৌনতা।ফের বললো—চলো ছাদে যাই।আমাদের ছাদটা খুব সুন্দর। আপু এখনো ভার্সিটি থেকে আসেনি। আপু আসলে তখন নাহয় রুমে বসে সবাই গল্প করবো।

কৌড়ি হ্যা না বলার সময় পেলো না।তার আগেই চঞ্চল পায়ে মৌনতা,তাকে নিয়ে ছাঁদে যাওয়ার উদ্দেশ্য চললো।অতি ছটফটি মেয়েটা সিঁড়িতে দ্রুত পা রাখতে যেয়ে,উপুড় হয়ে পড়ে নিতে গিলেই দু’হাতে সামলে নিলো তাকে কৌড়ি।ফের বললো—পড়ে যাবে তো মৌনতা।আস্তে চলো।

ব্যথা পেয়েও মিষ্টি হেসে দিলো মেয়েটা।মনহলো এরকম ব্যথা তার নিত্য পাওয়ার অভ্যাস আছে।বললোও তাই মেয়েটা।–দিনে এরকম দুই একবার অকারণে পড়ে যাই আমি।তাই ছোটো দাদাভাই আমাকে ডাকে আছাড়বিবি বলে।

আছাড়েবিবি!ভাবার আর সময় পেলোনা কৌড়ি।তার আগেই আবারও হাতে টান পড়ায় সিঁড়িতে ধপাধপ পা রাখতে হলো তাকে।

‘মৌনতা পড়ে যাবে।আস্তে।

শুনলো না মেয়েটার তার কথা।সোজা ছাঁদে নিয়ে গিয়ে তারপর কৌড়ির হাত ছাড়লো।

কাছে অথবা দূরে,আসরের আজানের সুমধুর ধ্বনিটা মুয়াজ্জিনের কন্ঠে হয়তো ভেসে একটু পরেই।ভাদ্রের আকাশে সূর্যের তপ্তের জৌলুশতা কমেনি।তব জ্বলজ্বলে সূর্যের দূরদূরান্ত আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কালো ছোটো ছোটো মেঘের ফালিগুলো।তবুও আকাশটা ঝলমলে।ছাঁদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কৌড়ি।আকাশ থেকে নজরটা সরিয়ে, ছাদের পানে দিলো।নজর শীতল হয়ে এলো তার।হঠাৎই মন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।বিগত দুদিনে হাসি না ফোঁটা ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটলো।

নাম জানা, অজানা ফুল গাছের সমাহারে পরিপূর্ণ ছাদটা।ফুলছাড়াও বিভিন্ন গাছ রেয়েছে।সুন্দরভাবে পরিকল্পনা করে সাজিয়ে গুছিয়ে ছাঁদের এই গাছগুলো রোপন করা হয়েছে। এবং রোজ যে তাতে পরিচর্যা চলে তা প্রতিটি গাছের চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে।

‘এদিকে এসো।

মৌনতার ডাকে আস্তেআস্তে ছাঁদের মধ্যের দিকে পা বাড়ালো কৌড়ি।মৌনতা দক্ষিণ পাশের বড়বড় ড্রামে লাগানো গাছগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে।সেদিকে যেতেই কৌড়ি দেখলো,বড়োবড়ো ড্রামে লাগানো বিভিন্ন গাছে বিভিন্ন ফুল ফুটে আছে।কোনোটার ফুলের পাপড়ী, শুধু গাঢ় লাল।কোনাটার সাদা,গোলাপী পাতা একসাথে।কোনটার আবার গাঢ় মেজেন্টা।অথচ গাছের পাতা,গোড়ার শক্তপোক্ত মুলগুলো একই রকম দেখতে। মৌনতা, ড্রামে লাগানো গাছগুলো দেখিয়ে বললো।

‘জানো,বড়দাদাভাই আর আমার পছন্দ একইরকম।এই
বনসাই গাছগুলো বড় দাদাভাই লাগিয়েছে।আমারও ভিষণ পছন্দ।

কৌড়ি,মোটাতাজা গাছের ফুলের পাতাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে
দেখতে লাগলো।আল্লাহর কি অপরূপ সৃষ্টি।দুঃখী মনও সেই সৃষ্টিতে শান্ত হয়ে যায়।কি আশ্চর্য।

‘দাঁড়াও আমি আম্মুর ফোন নিয়ে আসছি।ফুলের পিক উঠাবো, সাথে তুমি আর আমিও তুলবো।

কথা বলতে সময়,ছুটতে সময় নেই মেয়েটার।ছুটে নিচে চলে গেলো মেয়েটা।কৌড়ি বিবাহিত হয়ে গেলো,বিভিন্ন
ফুলের সমাহারে।অসময়েও বেলী ফুটেছে। ঝাঁকড়া কামেনী ফুলগাছের সবুজ পাতগুলো দেখা যাচ্ছে না, সাদা ছোটোছোট ফুলের সমাহরে।অলকানন্দার হলুদ ফুলগুলোতে সূর্যের আলো পেয়ে,তার হলুদ রঙটা আরও জ্বলজ্বল করছে।রঙ্গনা,জুই,রজনীগন্ধা চামেলিও বাদ নেই।বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস জায়গা করে নিয়েছে ছাঁদের উত্তর ওয়াল ঘেঁষে।সাদা,কালো লাল খয়েরী হলুদের গোলাপ গাছের ও অভাব নেই।
আরও বিভিন্ন গাছ,ফুল হোক বা ফুলছাড়া।যা কৌড়ির নাম জানা নেই।আর কোনো গাছে কি লাগাতে বাকি আছে এই ছাঁদে।আছে হয়তো!

‘এই তোমার নাম কি ফুলকৌড়ি?

চমকে পিছনে তাকালো কৌড়ি।লম্বা চওড়া,ফর্সা একজন সুদর্শন যুবকে নজরে পড়ল তার।ছেলেটা,তার কালো ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গুঁজে নিশ্চল নজরে তাকিয়ে আছে তারদিকে।ভীষন ভয় পেয়েছে কৌড়ি।পিছন থেকে এরকম ভুতের মতো কেউ কথা বলে!কি প্রশ্ন করেছে ছেলেটা সেটা জেনো মাথা থেকে বের হয়ে গিয়েছে।আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিলে কৌড়ি।মৌনতা এখনো আসেনি?হঠাৎই অস্বস্তি ঘিরে ধরলো তাকে।সেই অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিলো সামনের ছেলেটা,তার কথায়।

‘তবে নামের সাথে,তোমার সৌন্দর্যের নিদাারুন মিল আছে।ফুলকৌড়ি।

মৃদুস্বরে বেশ কয়েকবার ফুলকৌড়ি নামটা আওড়ালো ইভান ।ফের গভীরভাবে আশেপাশে নজর বুলিয়ে কৌড়ির মুখপানে নজর শান্ত রাখলো, কৌড়ির অস্বস্তি আরও শতগুণ বাড়িয়ে দিয়ে তার প্রশংসায় গীত গাইলো।

‘তুমি হাজার ফুলের মাঝে একটি জীবন্ত ফুলকৌড়ি।

চলবে….

আমি প্রচন্ড অসুস্থ ছিলাম এটা হয়তে সবাই জানেননা।জাননো উচিত ছিলো।তবে গ্রুপে জানিয়ে দিয়েছিলাম বলে পেইজে আর জানানো হয়নি।দেরীতো এমনিতেই করি,আরও দেরিতে দেওয়ার জন্য স্যরি।তবে ইচ্ছাকৃত নয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here