#নীলফড়িং
#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#পর্ব ১৭
.
.
প্রায় ৫/৬ মাস এভাবেই চলে গেল। অনেক ব্যস্ততার মাঝেও একটু আনন্দ ছিলো দুজনে তো ছিলো পাশে। এক সাথে। বাট আজ জানতে পারল পুস্পিতা টেনিং এর জন্য প্রায় এক মাসের জন্য ঢাকা যেতে হবে। উফ বড্ড খারাপ লাগছে তাই একা একা ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিলো পুস্পিতা। কীভাবে সবাইকে ছেড়ে এই একটা মাস পাড়ি দেবে সে। কান্নাও পাচ্ছিল খুব খুব, কিন্তু কান্না থামিয়ে রেখে কোনো এক দিকে তাকিয়ে আছে সে। উঁচু উচু বিল্ডিং গুলো দাঁড়িয়ে আছে একটু শ্বাস নেওয়ার জায়গার ও যে বড্ড বেশি অভাব রয়েছে এই এলাকা জুড়ে। শুধু রাস্তা ছাড়া আর একটু জায়গাও কেউ অবশিষ্ট রাখে নি। চাঁদটা ও ভালো দেখা যায় না ছাদ থেকে, এত উচু বিল্ডিং থাকলে কীভাবে চাঁদ দেখে মানুষ? তার আজ চাঁদটা দেখার খুব ইচ্ছে জেগেছিল। কিন্তু না চাঁদ আর আজ দেখা যাবে না বোধহয়।
……ভাবী তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?
…….হ্যা ফারিজ কিছু বলছিলে?
…….নাহ তেমন কিছু না। কিন্তু তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো এত রাতে?
……নাহ এমনিতেই। তুমি বলো? কিছু বলার ছিলো?
…….হ্যা ভাই ফোন দিয়েছিল, তোমাকে নাকি ফোনে পাচ্ছে না।
…….ওহ হ্যা ফোনটা বোধহয় রুমে রেখে আসছি। (চলে যেতে নিলো)
……ভাবী?
……হ্যা?
……কিছু হয়েছে তোমার?
……আমার কই নাতো।
……আচ্ছা তবে চলো।
দুজনে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলো। পুস্পিতা রুমে গিয়ে তার মুঠো ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল ফাইয়াজ এর ১০ টা মিসড কল জমেছে মুঠো ফোনে সে বুজতে পারছে আজ অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে তার। হয়ত কোনো জরুরি প্রয়োজন ছিলো ফাইয়াজের তাই এত গুলো কল দিয়েছে, সে আর কিছু না ভেবে ফোনে ফাইয়াজের নাম্বার তুলে ফোন দিলো ফাইয়াজ কে।
……হ্যালো কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
……স্যরি আসলে ফোনটা রুমে রেখে ছাদে গিয়েছিলাম।
……এত রাতে একা ছাদে কেনো গিয়েছ?
……কিছু না এমনিতেই। আপনি বলেন ফোন কেনো দিয়েছেন?
……তুমি এত জলদি চলে গেলে যে?
……আসলে ভালো লাগছিল না তাই।
…….কেনো কী হয়েছে আমি কী আসবো?
……নাহ তেমন কিছু না। আপনি বলেন কিছু বলার ছিলো?
…… আগে বলো কিছু হয়েছে তোমার?
……নাহ বললাম তো? আপনার আসতে খুব দেরি হবে?
……হ্যা একটু তো হবে। তুমি বললে চলে আসবো।
…….নাহ থাক পেশেন্ট দেখা শেষ হলেই আসবেন। তারাহুরো করে আসতে হবে না।
……পুস্পিতা কী হয়েছে তোমার?
……কিছু না রাখছি তবে।
……এই শোনো?
কিন্তু পুস্পিতা আর কোনো কথা না শুনেই ফোনটা কেটে দিলো। পুস্পিতা কথা বলবে কীভাবে তার যে কান্নায় গলা ভেঙে আসছিল। সে ফোন রেখে কান্না করতে করতে বিছানায় বসে পড়ল। তার একটুও ইচ্ছে নেই এতদূরে যাওয়ার। জীবনের অনেক গুলো বছর সে তার ফ্যামিলির থেকে দূরে ছিলো পড়ালেখার জন্য, আজ আর তার সেই ধৈর্য নেই দূরে যাওয়ার, তাই সে কান্না করছে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে, পুস্পিতা কান্না থামিয়ে বিছানায় বসে বসে কিছুটা দূরে রেখে দেওয়া খামটা দেখছিল এক ধ্যানে। তখনই তার রুমের দরজার কড়া নড়ে উঠল। কয়েক বার নড়ার পড়ে তার ধ্যান ভাঙল। সে হকচকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠিক করে নিয়ে, দরজা খুলে দেখল ফাইয়াজ দরজায় দাঁড়িয়ে।
…….আপনি এখন? বলেছিলেন তো আসতে নাকি দেরি হবে?
…….. ভাবলাম সব সময় তো কাজই করি আজ না হয় একটু তোমার সাথে সময় কাঁটাই।
……কিন্তু পেশেন্ট?
……পেশেন্ট তো তোমার জন্যও অপেক্ষা করছে?
……নাহ মানে আমি ফোন দিয়ে বলে দিয়েছি আজ আসবো না।
……হ্যা আমিও বলে দিয়েছি।
দুজনেই রুমের ভেতর চলে এলো। ফাইয়াজ খুব ভালো করে পুস্পিতা কে পর্যবেক্ষণ করল। সে শার্টের বুতাম খুলতে খুলতে বলে উঠল।
…….একটা টি-শার্ট বের করে দাও।
…….আপনি সত্যি আর যাবেন না?
……আচ্ছা তোমার কী মনে হয় (পুস্পিতার কাঁধে দু হাত রেখে) আমার সহধর্মিণী আমার কাছে মুখ ফুটে কিছু বলেছে আর আমি তা না করেই বসে থাকব? আমি কিন্তু অতটাও খারাপ নই।
পুস্পিতা নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো, সে এতক্ষণ নিজেকে অনেক কষ্টে ঠিক রেখে ছিলো বাট এখন আর পারছে না। ফাইয়াজের মনে হলো তার পায়ের উপর গরম কিছু পড়ল। সে ঠিক করে তাকিয়ে বুঝতে পারলো পুস্পিতার চোখের পানি, যা তার পায়ের উপর ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে। সে সাথে সাথে তার দু’হাতের মাঝে পুস্পিতার মুখটা তুলে নিয়ে দেখল, হ্যা সত্যি পুস্পিতা কান্না করছে। সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল, এভাবে সে কখনো পুস্পিতা কে কাঁদতে দেখে নি, দেখেনি বলতে ভুল হবে দেখেছিল সেই শুভাকাঙ্ক্ষীর ভেদাভেদ চলছিল তখন এক বার, আর বিয়ের পড়ে একবার, কিন্তু সে আর কাঁদতে দেখেনি পুস্পিতা কে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল।
…….এই কাঁদছ কেনো তুমি? কী হয়েছে বলো আমায়? পুস্পিতা প্লিজ বলো?
এবার পুস্পিতা আর নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে ফাইয়াজ কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিলো। এখনো ফাইয়াজ কিছুই বুঝতে পারছে না। তারও যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষটি কে এভাবে কাঁদতে দেখে। সেও খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে ছিলো পুস্পিতা কে।
বেশ কিছুক্ষণ পড়ে। ফাইয়াজ পুস্পিতা কে বিছানার এক পাশে বসিয়ে দিয়ে। ফাইয়াজ পুস্পিতার সামনে হাটু গেড়ে বসে।
……পুস্পিতা কী হয়েছে বলো আমায়?
পুস্পিতা এখনো কিছু বলতে পারছিল না, তাই সে খামটা এগিয়ে দিলো ফাইয়াজের কাছে, ফাইয়াজ খাম দেখে একবার পুস্পিতার দিকে তাকিয়ে এরপর খামটা খুলে পড়তে শুরু করল। চিঠিটা পড়ার পড়ে সেও চুপ করে আধবসা থেকে পুরপুরিই বসে পড়ল মেঝেতে বিছানার সাথে ঠেস দিয়ে। সে পুস্পিতা কে কী বলবে বুঝতে পারছে না। কারণ সে নিজেও তো পুস্পিতা কে ছাড়া এতদিন থাকতে পারবে না।
দুজনেই চুপ করে বসে ছিলো, অনেক সময়। হঠাৎ দরজা ভেজানো থাকায় কেউ দরজা ঠেলে ভেতরে চলে এলো।
……পুস্পিতা, শুনলাম ফাইয়াজ আসছে।
ফাইয়াজের মায়ের কন্ঠ শুনে দুজনেই চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে গেল।
…….কী রে তোদের এমন দেখা যাচ্ছে কেনো? আর দুজনেই এত জলদি চলে এলি যে? কিছু কী হয়েছে?
…….নাহ আম্মু আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। রুমকি কে বলো একটু চা করে দিতে। পুস্পিতা আমার ট্রাউজার আর টি-শার্ট বের করে দাও।
এই বলে ফাইয়াজ ওয়াশ রুমে চলে গেল। যা দেখে সে পুস্পিতার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
…….কী রে কী হয়েছে মামণি?
…….কোথায় আম্মু কিছু না। আমিই বরং গিয়ে চা করে নিয়ে আসছি।
……দাঁড়াও কী লুকাচ্ছ আমার থেকে দুজনে। তুমি এসেছ তখনই আমার একটু সন্দেহ হয়েছিল, কিছু তো হয়েছে। ঝগড়া হয়েছে ফাইয়াজের সাথে, দাঁড়াও আমি তবে ওকে বকে দিচ্ছি।
……নাহ আম্মু তেমন কিছু নয়। ওই আসলে আমাকে এক মাসের জন্য ঢাকা যেতে হবে। এই জন্য
…….কীহ? কিন্তু হঠাৎ কেনো?
…….টেনিং এর জন্য।
পুস্পিতার কথা শুনে সে আর কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। যা দেখে পুস্পিতা ড্রয়ার থেকে ফাইয়াজের জন্য একটা ড্রেস বের করে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। সেখানে গিয়ে সবার জন্য চা বানিয়ে রুমকির কাছে সবার জন্য দিয়ে, দু-কাপ চা নিয়ে রুমে চলে এলো। রুমে এসে দেখল ফাইয়াজ কে দেখছে না, তাই এগিয়ে বারান্দায় গেল, হুম সেখানেই ছিলো ফাইয়াজ।
…….চা।
ফাইয়াজ ঘুরে গিয়ে চা নিলো, এরপর চায়ে চুমুক বসিয়ে সাথে সাথে চা ফেলে দিলো। যা দেখে পুস্পিতা বলে উঠল।
…….কী হলো?
……ওহ আসলে চা বেশি গরম ছিলো।
……পানি এনে দিচ্ছি দাঁড়ান।
…….পুস্পিতা, প্রয়োজন নেই ঠিক আছে। তুমি নিচ্ছ না কেনো?
…….হুম এইতো নেবো।
পুস্পিতা চা নিয়ে এসে ফাইয়াজের পাশে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে ঠোঁট বসিয়ে দিলো।
চা শেষ করে দুজনে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
রাতে খাবার খেয়ে এসে ফাইয়াজ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে ছিলো। একটু পড়ে পুস্পিতা ও এলো। ফাইয়াজ তাকিয়ে দেখল এখনো পুস্পিতার মন খারাপ। বিছানা পরিষ্কার করতে এসেছিল পুস্পিতা, ফাইয়াজ তার হাত ধরে বসিয়ে দিলো।
…….এখানে বসো।
পুস্পিতা বসে পড়ল। পুস্পিতার দু গালে হাত রেখে কপালে হালকা স্পর্শে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলে উঠল।
…….তুমি চিন্তা করো না। শনি শুক্রবার যেহেতু শেরে বাংলা মেডিকেলে ডিউটি থাকবে না আমি চলে যাবো এই দুদিন। আর মাঝে মধ্যে বন্ধ থাকবে যখন তুমিও চলে আসবে, তবেই তো আর এত দিন গ্যাপ থাকবে না। প্রয়োজনে সবাইকে নিয়ে যাবো, তারপরও প্লিজ তুমি এভাবে মন খারাপ করে থেক না। তুমি এমন করলে আমি কীভাবে থাকব? প্লিজ, দেখো এখন কিছুদিন পর পরই এভাবে যেতে হবে তোমাকে, তোমাকে যে একা যেতে হবে তা কিন্তু নয়, আমাকেও যেতে হবে, তাই এটা মনকে বোঝাতে হবে, আমিও তো কয়েকবার গিয়েছি। তাই এভাবে মন খারাপ করার কিছুই নেই।
এই বলে ফাইয়াজ পুস্পিতার মন ভালো করার চেষ্টা করতে শুরু করে দিলো। একটু সুড়সুড়ি দিচ্ছে, নাক ধরছে। গাল ধরছে যার জন্য পুস্পিতা হাঁসতে বাধ্য হলো। দুজনেই এক সাথে খিলখিল করে হেঁসে উঠল।
রাত তখন ১১ টা পুস্পিতা, ফাইয়াজের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। ফাইয়াজ ও চুপ করে পুস্পিতার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
কয়েক দিন পড়ে পুস্পিতার যাওয়ার সময় হয়ে গেলো। গাড়ীতে যাওয়ার কথা ছিলো, বাট ফাইয়াজ চাইছে নিজে গিয়ে এগিয়ে দিয়ে আসবে। তাই রাতের লঞ্চে যাবে, সবাই গিয়ে ওদের এগিয়ে দিয়ে আসলো, ওরা দু’জন একটা ক্যাবিন নিলো। সারারাত দু’জনে ঘুমালো না সারারাত দু’জনে বসেই কাটিয়ে দিলো বিছানার রেলিং এর সাথে আধশোয়া হয়ে, পুস্পিতা ফাইয়াজের বুকে মাথা রেখে বসে ছিলো।
……..তুমি কিন্তু ঠিক করে নিজের খেয়াল রাখবে। একটুও কান্নাকাটি করবে না। সময় মতো খাওয়া-দাওয়া করে নেবে। ফোন সব সময় নিজের কাছেই রাখবে। কী হলো শুনছ আমার কথা?
…….হুম।
ওরা সকালে গিয়ে সেখানে নামলো। এই শুক্রবার সারাদিন পুস্পিতার সাথেই রইল শনিবার সকালে গাড়ীতে উঠে চলে এলো ফাইয়াজ। দুজন দুই-দিকে রয়ে গেল। এভাবেই চলতে শুরু করে দিলো ওদের জীবন। কখনো দুজন ফোনে কথা বলছে। কখনো ম্যাসেজে।
।
।
।
চলবে…………।