নিশীভাতি #সূচনা_পর্ব মুশফিকা রহমান মৈথি

0
1512

বিয়ের দিন ভোরে হুমায়রার জন্য গচ্ছিত সমস্ত গহনা এবং টাকা নিয়ে পর-পুরুষের সাথে পালিয়ে গিয়েছে তার-ই আপন মা জুবাইদা। যখন ব্যাপারখানা জানাজানি হলো, লজ্জায় মুখ দেখানোর উপায় রইলো না শামসু মিঞার। তার স্ত্রী আতিয়া খাতুন ক্ষণে ক্ষণে কপাল চাপড়াচ্ছেন আর বিক্ষুদ্ধ স্বরে বলতে লাগছেন,
“নষ্টা মাইয়াডা মুখ দেহানোর উপায় রাখলো না। দুধ কলা দিয়া এত্তোদিন কালসাপ পুষলাম। আজকার দিনডায় ফন তুলতে হইলো। আমার বুবুডার জীবনডা ফানাফানা করি লাইলো। এহন বিয়াডা হইবো ক্যামনে! ওই নষ্টারে পাইলি ওর একডাও চুল রাখুম না। শয়/তা/নের বা/চ্চা”

আতিয়া খাতুন ম বর্গীয় গা/লি দিতেও ইতস্তত করলেন না। রাশাদ দাদীকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু নাতীর কথা গায়ে মাখালেন না আতিয়া খাতুন। এদিকে শামসু মিঞা উঠানে বসে রইলেন। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। কিংকর্তব্যবিমূঢ় চোখে চেয়ে আছেন মাটির দিকে। উপস্থিত আত্মিয়দের মাঝে কানাগোসা হতে লাগলো। জুবাইদার চরিত্রের নানানবিধ বিশ্লেষণ সেখানে ফুটে উঠলো। তার স্বামী অর্থাৎ কাওছারকে কোথাও দেখা গেলো না। হয়ত কোথাও মদ খেয়ে ঢুলে পড়ে আছে। শামসু মিঞার জীবনকে এক কথায় ব্যাখ্যা করতে বললে “পুরোটাই বৃথা” এই দুটো শব্দই সবার আগে মাথায় আসবে। সারাটা জীবন মানুষের বর্গাচাষ করে যা একটু নিজের জমিজমা কিনেছে, ভেবেছে ছেলেমেয়ে, নাতী পুতীকে কে নিয়ে সুখে জীবন কাটাবে। কিন্তু হলো কই? মেয়েটা অল্প বয়সে প্রসবের সময় মারা গেলো। ছেলেটার মদ, জুয়ার বাজে নেশা ধরলো। যা একটু পুতনীর বিয়ে দিয়ে সুখ কামাতে চেয়েছিলো। পুত্রবধু তার বহু কষ্টে অর্জিত সম্মানে কলঙ্ক লেপে দিলো। এতো বড় বড় ছেলে-মেয়ের মার কি একটু ও বাধলো না এমন নোংরা চিন্তা করতে? পালাবি পালাবি টাকা পয়সা, গয়নাগাটি নিয়েই পালাতে হলো। কিছুক্ষণ পর বর পক্ষ আসবে। কি মুখ দেখাবে।

দরজার এক কোনায় দাঁড়িয়ে সকল রঙ্গ নিশ্চুপভাবে দেখলো হুমায়রা। যখন জন্মেছিলো দাদা খুব শখ করে নাম রেখেছিলো হুমায়রা বিলকিস। বিলকিস যে দুনিয়ায় রাজ করে। আজ নিজের পরিস্থিতি দেখে নিজের নামটিকে বিদ্রুপের ন্যায় লাগছে। সকলের এক একটা মন্তব্য কানে বিষের মতো লাগছে। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া শুন্য। কোনো মন্তব্য নেই, উচ্চ বাচ্য নেই। এমনকি চোখখানাও শুষ্ক।

কিছুক্ষণ বাদে বর পক্ষ এলো। ধুমধাম করে বিয়ে করে সুন্দরী রমনীকে বধু রুপে ঘরে তুলবে তারা। ছেলে এবার চার বারের চেষ্টায় সরকারী চাকরি পেয়েছে। নবম গ্রেডের চাকরি। থাকে ঢাকায়। নাম আতিয়ার। বিয়ের বদৌলতেই আসা গ্রামে। বিয়ে করে হুমায়রাকে নিয়ে যাবে নিজের সাথে। পাত্রী হিসেবে হুমায়রা তার থেকে বেশ ছোট। তবুও সে এই বিয়েতে এক পায়ে খাড়া, কারণ কন্যা অনেক সুন্দরী। শুভ্র গোলাপের মতো ছোট্ট সফেদ মুখ, গোলগোল আখি, নেত্রপল্লবগুলো দীর্ঘ। নজর নামিয়ে রাখলে অত্যন্ত মায়াবী লাগে। ছিমছাম শরীর। খুব মোটা বা জীর্ণ নয়। চুল ঘোর আমাবস্যার মতো কৃষ্ণ, ঘন। সব মিলিয়ে হৃদয়কে একবার বিচলিত করার মতোই সুন্দর। তাই বয়সে অনেক ছোট হলেও পাত্র তাকে বিয়ে করবে। কিন্তু এ কি অলক্ষুনে কথা, মেয়ের মা কিনা অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়ে গেছে! কথাটা তাদের কানে পৌছাতে খুব একটা দেরী হলো না। ছেলের বাবা সাথে সাথেই মুখ বাকালেন। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললে,
“শামসু কাকা, এসব কি শুনি?”

শামসু মিঞা উত্তর হাতড়ালো, কিন্তু হাতে কেবল শুন্যতা পেলো। বরপক্ষের মুখে মুখে নানানবিধ কথার সৃষ্টি হলো। যার সবচেয়ে বেশি যেটা প্রাধান্য পেলো তা হলো,
“যে মেয়ের মা এমন, মেয়ে কতই বা ভালো হবে? সৌন্দর্য দিয়ে কি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবো”

রাশাদ ভরা মজলিশে বোনের নামের এমন অপবাদ সইতে পারলো না। অনুনয়ের সাথে বললো,
“আমার বোনকে নিয়ে বাজে কথা বলবেন না, তার চরিত্রকে বদনাম করবেন না”

রাশাদের কথার বিপরীতে এক আত্মীয়া বলে উঠলেন,
“শুনেছি, চেয়ারম্যানের ছেলে বহুদিন ধরে হুমায়রার পেছনে ঘুরে। সে তো একবার তারে উঠায়ে লইবার চাইছিল। চরিত্র ভালা হইলে কি এমন করে”

রাশাদের মেজাজ খারাপ হলো। ক্রোধিত নয়নে তাকালো আত্মীয়ার দিকে। আত্মীয় মানুষগুলো সময়ের চেয়ে অসময়েই যেনো নিজেদের কুৎসিত রুপখানা প্রদর্শন করে। যখন আপনার দিন ভালো থাকে, তখন তারা চিনির মতো আপনার সাথে মিশে যায়। বিপদের সময় চিরোতার থেকেও তিক্ততা জাহির করে। রাশাদ শীতল, থমথমে স্বরে বলল,
“উল্টাপাল্টা কথা কেনো বলছেন? কবে আমান তাকে উঠিয়ে নেবার কথা বলেছে! হ্যা, সে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু আমরা ফিরিয়ে দেবার পর থেকে সে হুমায়রার ধারে কাছেও ঘেষে নি”
“হইছে, হইছে। আর শাক দিয়ে মাছ ঢাইকো না”

মাঝখান থেকে আতিয়ারের বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন,
“এতো কিছু বুঝি না। সব জেনে শুনেও গরীবের ঘরে বিয়ে দিতে চাওয়ার একটাই কারণ মেয়ে সুন্দর, পরিবার ভালো। শামসু চাচা তো আজকের পরিচিত নন। যদিও কাওছার মদ খায়, আমি সেটা অদেখা করেছি। কিন্তু মেয়ের মার চরিত্র খারাপ সেটাতো অদেখা করা যায় না। তাই এই বিয়ে হবে না। ক্ষমা করবেন”

আতিয়ার একবার নিচু গলায় বললো,
“বাবা, আরেকটু ভাবুন। মেয়ে তো এমন নাও হতে পারে”
“চুপ করো তুমি”

শামসু মিঞা ছুটে এলেন। অনুরোধ করে বললেন,
“আমার বুবু ভালা মাইয়্যা। এমন করবেন না দোহায় লাগে। আপনারা যা চাইবেন আমি দিমু। এই ভিটা বেইচ্যা দিমু দরকার পরলে। কিন্তু বিয়া ভাইঙ্গেন না। দোহায় লাগে”

কিন্তু তার অশ্রু কাজে দিল না। রাশাদ কিছুক্ষণ চুপ রইলো। একবার ভেতর ঘরের দিকে চাইলো। বোনের কানে নিশ্চয়ই সব যাচ্ছে। তবুও একখানা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো সে। অবিচল স্বরে বললো,
“আপনারা আসতে পারেন”
“এইদা কি কস রাশাদ?”
“যা বলি ঠিক ই বলি। উনারা বিনা দোষে এখন ই আমার বোনকে হেনস্তা করছেন, না জানি বিয়ের পর কি করবেন! কি দরকার দাদা, আল্লাহ চাইলে আরোও ভালো জায়গায় হুমায়রার বিয়ে হবে।“

রাশাদের কথায় আতিয়ারের বাবার অহমিকায় পাচিলে যেনো আঘাত লাগলো। বেশ চওড়া কণ্ঠে বলল,
“আগে বিয়ে দাও, তারপর না হয় কথাখান বইলো। চলো সবাই”

বলেই সকলে বেরিয়ে গেলো। শামসু মিঞার রাগ হলো রাশাদের উপর। রাগের বশে মেরেই বসলেন। কিন্তু তবুও রাশাদ শান্ত। তার একবাক্য,
“যা হয়েছে, ভালো হয়েছে”

বিয়ে ভেঙ্গে যাবার পর হুমায়রাকে দেখা গেলো নির্বিকার। নির্ভার চোখে জানালার ধারে বসে আসে সে। মা সম্পর্কিত অকথ্য বানীগুলোও কানে আসছে না তার। এ যেনো রোজকার ই কোনো ঘটনা। আতিয়া খাতুন নাতিনের কাছে এসে বসলেন। ধরা গলায় বললেন,
“বুবু খাইতি না?”
“ক্ষিদে মরে গেছে দাদী”

আতিয়া খাতুন মুখ চেপে অশ্রু ছেড়ে দিলেন। আজ নাতিনের জীবনের সুখময় দিন ছিলো। কিন্তু সে অলক্ষী, নষ্ট মহিলা সব ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। মনে মনে সাপসাপান্ত করলেন নিজ পুত্রবধুকে। এদিকে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো রাশাদ। বোনের খোঁজ নেওয়ার সুযোগটি পায় নি সে। অবশ্য সে জানে তার বোন এতোটা দূর্বল নয়। সে নিশীভাতির ন্যায়। প্রদীপ যেমন ঘোর তমসাকে নিজের ক্ষুদ্র আলো দিয়ে গিলে খায়, ঠিক তেমনি হুমায়রাও এই দুঃখের নিকষ আঁধারেও প্রজ্জ্বলিত হবে।

কাওছারের ঘুম ভাঙ্গলো সন্ধ্যায়। বিয়ে বাড়ী, ম/রা বাড়ির মতো শান্ত দেখে সে অবাক হলো। সকাল থেকে কি কি ঘটেছে তার কিছুই জানে না সে। ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে আসতেই নিজের পিতাকে জীর্ণচিত্তে বসে থাকতে দেখলো। কাওছারকে দেখতেই রাগে ফসতে লাগলেন শামসু মিঞা। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালেন যখন কাওছার শুধালো,
“হুমায়রা কই? বিয়া শেষ?”
“কই ছিলি হা/রা/মজা/দা? কোথায় মরছিলি? একে বারে মরতে পারিস না তুই? তুই আর তর বউ একলগে ম/ই/রা গেলেই তো পারতি?”
“হইছে ডা কি? খ্যাসখ্যাস কির ল্যাইগা করতেছো?”

চড়া গলায় কাওছার কথাটা বলতেই শামসু মিঞা তেড়ে এলো। বয়স্ক জীর্ণ হাতে মারতে উদ্ধত হলেন ছেলেকে। চিৎকার করে বললেন,
“জানিস না কি হইছে? তোর বউ পালাইছে অন্য বেডার লগে। সেই সাথে আমার বুবুর সব সুখ ও লইয়্যা গেছে”

এতো সময় বাদে কাওছারের মাথায় টনক লড়লো। গতরাতের নেশার কুহেলিকা ধীরে ধীরে কাটতে লাগলো। সাথে সাথে নিজ ঘরে ছুটলো সে। বিছানার নিচটা পরীক্ষা করল। না মহিলা তার অর্থ নেয় নি। সেগুলো লুঙ্গির বাজে নিয়েই বেরিয়ে পরলো সে। পেছনে বাবা ডাকলেন বহুবার,
“কই যাস? তোর লজ্জা লাগে না? আবার জুয়া খেলতে যাস? একবার মাইয়্যার কথাও ভাবিস না”

কিন্তু কাওছারের কানে কিছুই এলো না। সে রওনা দিলো তার গন্তব্যে। জুবাইদা চলে গিয়েছে ভালোই হয়েছে। এখন তার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করার মতো কেউ রইলো না। এদিকে শামসু মিঞার চিৎকার করতে করতে কাশি উঠলো। বুক চেপে কাশতে কাশতে বসে পরলেন। রাশাদ পানি খাওয়ালো তাকে। শান্ত হতে বলতেই বৃদ্ধ কেদে উঠলো। আজ তার চেয়ে অসহায় বুঝি কেউ নেই। না ভুল আছে। দরজার ওপারে জানালা ধরে বিস্তৃত আকাশের পানে চেয়ে থাকা সেই অষ্টাদশী। যার মা-বাবা নামক ছায়াটুকুকে মিথ্যে লাগছে।

******

জুয়ার শেষ দানটাও হেরে গেলো কাওছার। যা অর্থ নিয়ে এসেছে তার কিছু অবশেষ নেই। বরং ঋণ হলো আরোও হাজার পাচেক টাকা। বাবা এই টাকা মোটেই দিবে না। কিন্তু অপরপক্ষ তাকে ছাড়বেও না। এখন ই টাকা বুঝিয়ে দিতে হবে। এর আগেও এমন করেছে কাওছার। পরে টাকা দেয় নি। তাই আজ ছাড় হবে না। কাওছার ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,
“আমি টাকা ফেরত দিব”
“শুকনো কথায় চিড়ে ভিজে না। তোমার বিশ্বাস নেই”

এই প্রথম জুবাইদার উপর রাগ হলো। অন্তত গয়নার কিছু রেখে গেলে হতো। না সব নিয়েই পালিয়েছে। তখন পাশ থেকে কানে কানে একটা প্রস্তাব নিলো গ্রামের বাজারের জানু। প্রথমে রেগে গেলো কাওছার। কিন্তু যখন টাকার অংকটা বাড়লো খুব একটা মন্দ ও লাগলো না তার।

*********

নিকষ কালো রাত। আমাবস্যা রুপালী ছাঁদটাকে গিলে খেয়েছে। এখন কেম্বল ই আধার। বিদ্যুৎ নেই। মোম জ্বালিয়েছে হুমায়রা। গোসল সেরে এসেছে। ঘন কেশ এখনও ভেজা। দাদীর জোরাজোরিতে খেতে বাধ্য হয়েছে। এখন ক্লান্ত, শ্রান্ত আখিজোড়া বিশ্রাম চায়। বাড়ির প্রতিটা প্রাণ এখন ঘুমে। বাবা ফেরে নি, সে হয়তো ফিরবেও না। হুমায়রা ট্রাংক থেকে বইগুলো বের করলো। আগামীকাল ভাইকে বলবে কলেজে নিয়ে যেতে। বিয়ে হলো না যখন এখন আর পড়াশোনাতে কমতি রাখবে না। সব গুছিয়ে যেই শুতে যাবে অমনি খেয়াল করলো তার দরজাটা কেউ খুলেছে। পেছনে তাকাতেই আৎকে উঠলো সে। বাজারের চালের আরদের শফি দাঁড়িয়ে আছে……………

চলবে?

#নিশীভাতি
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

[অনেকদিন পর ভিন্ন কিছু লিখেছি, কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না। আমার দ্বিতীয় ই-বুক “চাঁদ বলে হাতটি ধরো” পুরো গল্প পাবেন শুধুমাত্র বইটই এপে মাত্র ৬০টাকায়। শুরুতেই বইটই অ্যাপটি ডাউনলোড করে নিতে হবে। লিংক
https://link.boitoi.com.bd/hxfF
যেভাবে বইটই থেকে ই-বুক ক্রয় করবেন:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here