নিশীভাতি #১৮তম_পর্ব

0
798

#নিশীভাতি
#১৮তম_পর্ব

“দোস্ত সেখানেই থাক। ভুলেও শহরে আসার কথা ভাবিস ও না। আংকেল তোকে পাগলের মতো খুঁজছেন। আমার বাসায়ও লোক পাঠিয়েছিলেন। আমি বলেছি আমি জানি না। আমাকে কিছুদিন ফলোও করা হয়েছিল। আমি জানি না আমার ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে কি না। তবে তুই যেখানেই থাকিস সেখানেই থাক ইলহা”

আদিবার কথা শুনে থমকে গেলো ইলহা। তিক্ত ত্রাশে ঝাঝরা হলো হৃদয়। দলা পাকালো স্বর,
“বাবা কি খুব ক্ষেপে আছে”
“স্বাভাবিক নয় কি? যে মানুষটির সম্মান, প্রতিপত্তির মোহে চোখে পর্দা দেওয়া সে কি ক্ষেপবেন না? তুই বিয়ের রাতে পালিয়ে তার মুখে কালিমা এঁকেছিস। আমিতো এটাও শুনেছি, যে ছেলেটির সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো, সে অনেক কথা শুনিয়েছে। তার ভাষ্য তুই তোর প্রেমিকের সাথে পালিয়েছিস। এমন কিছু কি?”

আদিবার প্রশ্নে তাচ্ছিল্যভরা স্বরে ইলহা বলল,
“তোর কি তাই মনে হয়? ছোট বেলা থেকে কখনো কি আমি নিজের জন্য সময় পেয়েছি? পড়াশোনা আর বাড়ি এটাই ছিলো আমার গন্ডি। বাড়ির দমবন্ধ, জঞ্জালময় পরিধি থেকে মুক্তি পেতে আমি পড়াশোনাকে বেঁছে নিয়েছি। একমাত্র সেই স্থানেই আমাকে কেউ খবরদারিতা দেখাবে না। সেখানে অন্য কারোর জীবনে কাল হবার ইচ্ছে আমার কোনোকালেই নেই”

আদিবা চুপ করে রইলো। ইলহাকে ছোটবেলা থেকে চেনে সে। তাদের বন্ধুত্বের বয়স প্রায় তের বছর। সে খুব ভালো করে জানে ইলহা কোন পরিবেশে বড় হয়েছে। আকিব শাহরিয়ার শহরের বেশ পয়সাওয়ালা মানুষের মাঝে একজন। প্রতিপত্তি, যশ কিছুতেই বিধাতা তার কমতি নেই, শুধু অনুভূতি গুলো পাথর। তার কাছে তার বহিঃজগতের প্রাচুর্য্যই প্রধান। আত্মপ্রেমে মগ্ন সে। নিজের ব্যতীত বাকি মানুষগুলোকে সে কেবল জড়বস্তুই মনে করেন। কখনো পরিবার নামক বন্ধনগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছেন বলে জানা নেই। ইলহা তার কাছে মেয়ে নয়, কেবল একটি সিড়ি যা তার সম্মান বাড়াবে। তাই তো নতুন এক বড় নেতার ছেলের সাথে ইলহার অমতে তার বিয়ে ঠিক করেছে সে। যেনো তার ব্যাবসায়িক জীবন মসৃণ হয়। ইলহা অনেক বিরোধিতা করে, প্রতিবাদ করে। কিন্তু সেই প্রতিবাদের ধ্বনিগুলো আকিব সাহেবের কান অবধিও যায় নি, তার পূর্বেই শিকলে দম আটকে আত্মহুতি দিয়েছিলো। আর সহ্য না করতে পেরে, পালানোর পথ ই বেঁছে নিয়েছিলো ইলহা। এখনো তাই করছে, বিগত দশ দিনে সে কারোর সাথেই যোগাযোগ করে নি। নিজের সিম ও ফেলে দিয়েছে। ম্রিয়মান স্বরে শুধালো,
“মা কেমন আছে রে?”
“ভালো নেই, আংকেল তাকে দোষ দিচ্ছেন। সে কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে এসেছিল তোর খোঁজ জানি কি না। হাতে পায়ে ধরা বাকি ছিলো কেবল”

ইলহা কিছুসময় চুপ করে রইলো। অন্তস্থল থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো কেবল। ক্ষীন স্বরে বললো,
“রাখছি, নিজের খেয়াল রাখিস”

ইলহার বিষন্ন মুখশ্রী নজর এড়ালো না রাশাদের। কৌতুহল নিয়ে শুধালো,
“কি হয়েছে আপনার? কোনো খারাপ খবর?”

স্মিত হাসলো ইলহা। মলিন স্বরে বললো,
“আমার যাবার কোনো স্থান নেই নাতীসাহেব। আমি ওই কারাগারে ফিরতে চাই না, অথচ কারাগার ব্যাতীত আমার যাবার কোনো জায়গা নেই”

রাশাদের অনেক প্রশ্ন ছিলো বটে কিন্তু ইলহাকে এখন প্রশ্নগুলো করাটা কতটুকু সমীচিন হবে বুঝতে পারলো না। একবার চাইলো কমলাটে নীলাম্বরে। সূর্য অস্ত যাবে এখন ই। পশ্চিমপ্রান্তে লাল রং গাঢ় হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ লাল রঙ্গ ঢেলে দিয়েছে সাদা ক্যানভাসে। রাশাদ মৃদু হেসে বলল,
“আপনার ঝালমুড়ি ভালোলাগে?”
“কেনো?”
“এখানে ভালো চুইঝালের ঝালমুড়ি পাওয়া যায়, খাবেন?”

ইলহা বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বুকটা হুহু করে উঠলো। এক অব্যক্ত খুশি ধরা দিলো যেনো হৃদয়ে। মাথাখান তীব্র ভাবে দোলালো। সে খাবে ঝালমুড়ি। রাশাদ হাতখানা বাড়িয়ে দিলো। প্রগাঢ় স্বরে বলল,
“চলুন”

*****

ছাদের কর্ণিশ ঘেষে মুক্ত আকাশে চেয়ে থাকা যেনো অভ্যাসে পরিনত হয়েছে হুমায়রার। বিকেলের চায়ের কাপটি নিয়েই ধীর পায়ে ছাদে চলে এসেছে সে। ফাইজান তার কাগজের ভাণ্ডারে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। সামান্য শব্দেও বিরক্তি নিয়ে চোখ তুলছিলো। সামনে মনোনয়ন প্রার্থী ঘোষণা হবে। সেজন্য ফাইজান ব্যাস্ত। এসব কিছু বুঝে না হুমায়রা। ভালোও লাগে না। সে শুধু দুদন্ড নিজের স্বাধীনতায় বিচরণ চায়। কিন্তু ফাইজানের জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না। শরীফার ঘরে বসেছিলো বেশ খানিকক্ষণ, তার অনেক গল্প রপ্ত করেছে। আজগুবি কিছু গল্পও আজ শুনেছে। শরীফা গদগদ স্বরে বললো,
“জানো আমি যখন তোমার বয়সে ছিলাম ফাইজান তখন আমার পেটে। একদিন ওর বাবার সাথে বেড়িয়েছিলাম। হুট করেই দাঙ্গা লাগলো। আমি সেই পেট আকড়ে কি দৌড়টাই না দিয়েছি। তারপর একজনকে দুর্বৃত্তকে দেখলাম ভাঙচুর করতে, আমি নির্ভীক হয়ে ব্যাটাকে পেটালাম”

মহিলা নিজের বড়াই করতে বেশ পছন্দ করে। যদিও হুমায়রার বিশ্বাস হলো না। সে মানুষ ছোট্ট তেলাপোকায় ঘর মাথায় করে সে আস্তো মানুষকে পেটাবে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আজ অবশ্য হুমায়রার মন ভালো। বাড়ির প্রতিটা প্রাণী তার খাবারের প্রশংসা করেছে। এমনকি ফাইজান নামক অহংকারী ব্যক্তিটিও দুবার তরকারি নিয়েছে। যেখানে সে সর্ষের গন্ধ সইতে পারে না। হুমায়রা বুঝলো না মানুষটি কেনো খেলো, তার সত্যি ভালো লেগেছে নাকি কেবল ই দেখানোর জন্য। নেতা মানুষরা যতটুকু নয় তার চেয়ে অধিক প্রদর্শনে ভালোবাসে। ফাইজান ও তেমন! জানে না হুমায়রা। মৃদু বাতাসে হালকা উড়লো খোলা চুল। ঠান্ডা লাগছে একটা শাল আনলে ভালো হতো। ভেবেই চুমুক দিলো চায়ের কাপে। চা টাও ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। ঠান্ডা চায়ের থেকে বিস্বাদ কিছু হতে পারে বলে জানা নেই হুমায়রার। তাই মুখখানা সাথে সাথেই বিকৃত হলো। এখন ফেরা উচিত আযান দিয়ে দিবে ক্ষণিকক্ষণের মাঝেই। পেছন ফিরতেই থমকে গেলো। ঠিক তার পেছনে আমান দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ অবসন্ন, ঠোঁট শুষ্ক। দৃষ্টি কেমন ছন্নছাড়া। হুমায়রার তার প্রতি সমবেদনা হয় মাঝে মাঝে। পাশ কেটে যেতে নিলে আমান হালকা ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,
“তুমি ভুল করলে হুমায়রা। একদিন আফসোস হবে দেখো”
“যদি আফসোসের অনলে জ্বলিও, মনে করবো সেই আগুন আমি জ্বালিয়েছি”

কঠিন গলায় উত্তর দিলো হুমায়রা। আমান কাতর স্বরে বলে উঠলো,
“তাই বলে নিজেকে এভাবে সপে দিলে ওই ধান্দাবাজের কাছে?”
“আমান ভাই, একটা অনুরোধ করি। দাবি তো করেন আমাকে ভালোবাসেন, সেই ভালোবাসার খাতিরেই অনুরোধ, আমাকে ভুলে যান। নিজেও কষ্ট পাচ্ছেন, আমাকেও বিব্রত করছেন”
“তোমাকে ভুলতে হলে যে নিজেকে ভুলতে হবে হুমায়রা। তুমি তো ভালোবাসো নি, তাই এই ভালোবাসার যন্ত্রণা কখনো অনুভব করো নি। যেদিন কাউকে অন্তঃস্থল দিয়ে ভালোবাসবে, তখন বুঝবে এই বিচ্ছেদের কি অসহণীয় যন্ত্রণা”

হুমায়রা স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইলো। ঠিক তখন ই ছাদের দরজায় বেশ জোরে শব্দ হল। আৎকে উঠলো হুমায়রা। পেছনে ফিরতেই দেখলো ফাইজান দাঁড়িয়ে আছে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে, দৃষ্টি স্থির, শীতল। হুমায়ার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতেই সে ঠান্ডা গলায় বললো,
“হুমায়রা, ঘরে আসুন। আযান দিবে”

*****

বিশাল শালুক দিঘীর সামনে বসে রয়েছে ইলহা এবং রাশাদ। হাতে ঠোঙ্গা মুড়ি মাখার। ইলহা বায়না করেছিলো সে পাড়ে পা ঝুলিয়ে বসবে কিন্তু রাশাদ ই বারণ করলো। তাই অন্য বটগাছের নিচে তাদের বসতে হলো। দিঘীর ঠিক বিপরীতে সূর্য অস্তযানে যাত্রারত। ইলহা খোলা ঢেউ খেলানো চুল উড়ছে। চশমার আড়ালে কাজলনয়ন অপলক চেয়ে আছে ঘাসফুলের দিকে। কিছু হাতের মুঠোতে নিয়ে রাশাদের সামনেও ধরলো। রাশাদ শুধালো,
“মন ভালো হয়েছে?”
“আমার মন খারাপ কে বলেছে আপনাকে?”
“মন খারাপ ছিলো না?”

ইলহা মলিন হেসে বললো,
“জানি না, পাথর হয়ে গেছি, নাকি সইতে সইতে দুঃখ আর এখন আমাকে কাবু করে না”
“আচ্ছা, আপনার বান্ধবী কি বললেন? কবে যাবেন আপনি?”
“তাড়িয়ে দিচ্ছেন?”

বিদ্রুপের স্বরে শুধালো ইলহা। রাশাদ সাথে সাথেই উত্তর দিলো,
“না তো, সেটা কখন বললাম?”
“বলেন নি, কিন্তু একটা অপরিচিত মানুষকে নিজের বাসায় আশ্রয় দেওয়াটাও তো সহজ নয়। বোঝাই বলা যায়। আসলে আমার বান্ধবী আমাকে ওর বাসায় আশ্রয় দিবে না জানিয়েছে। কারণ আমার বাবা তাকে হুমকি দিয়েছেন। আমি জানি না নাতীসাহেব আমার জন্য কি ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে। কিছু বেসরকারী হাসপাতালে সিভি দিয়েছি, কিন্তু কোনো উত্তর আসে নি। তাই আপনার ঘাড় থেকে কবে নামবো বুঝছি না। চিন্তা করবেন না, একটা ব্যাবস্থা করে নিবো”
“আপনি আমার ঘাড়ে বসে আছেন, এই কথাটি কে বলেছে আপনাকে?”

কঠিন স্বরে শুধালো রাশাদ। ইলহা হেসে বললো,
“রাগ করলেন নাতীসাহেব?”
“একটা কথা মাথায় রাখবেন ইলহা, আমার কাছে আপনি কখনোই বোঝা নন। আমি কখনোই আপনাকে তাড়িয়ে দিবো না”

রাশাদ খুব শান্ত ভাবে কথাটা বললো, কিন্তু ইলহার পৃথিবীটা যেনো থমকে গেলো। প্রথম মনে হলো, সেও একজন মানুষ, যাকে কেউ অন্তত বোঝা ভাবে না। হৃদযন্ত্রের স্পন্দন বাড়লো খানিকটা। অস্তগামী সূর্যের লালচে আভায় মূহুর্তটি যেনো আরোও মুগ্ধকর মনে হলো, না মুহূর্তটি নয় মানুষটি। শুধু এই সামনে বসা মানুষটি ই মনোমুগ্ধকর। ইলহা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলো রাশাদের পানে। ঠোঁটের কোনে জমলো মিষ্টি হাসি____

****

শরীফা ভীষণ ব্যাস্ত। বৌভাতের সকল কিছু সে নিজেই দেখরেখ করছে, একমাত্র ছেলের বৌভাত। তাই কোনো ভুলত্রুটি কাম্য নয়। হুমায়রাকে ডেকে এনেছে শাড়ী পছন্দের জন্য। হুমায়রার একটি নীল শাড়ি বেশ পছন্দ হলো। শরীফাও তার পছন্দকেই প্রাধান্য দিলো। এর মাঝেই ঘরে প্রবেশ করলো ফাইজান। শান্ত স্বরে বলল,
“মা আমরা কাল বাড়ি ফিরছি”…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here