নিশীভাতি #২০তম_পর্ব

0
770

#নিশীভাতি
#২০তম_পর্ব

নিগূঢ় রাত। নিশ্বাসের সাথে দলা পাকানো সাদা হাওয়া বাতাসে মিলাচ্ছে। ঠান্ডা ভালোই পড়েছে। রাশাদ হাত ঘষছে। ইলহার ঘরে সেদিন গুইশাপ ঢুকেছে। তাই রাতে একটু ব্যাবস্থা করতে ইলহার ঘরের কাছে এসেছে সে। হঠাৎ ই কানে এলো মিহি ক্রন্দনের আওয়াজ, ইলহা কাঁদছে কি! হঠাৎ এই ছোট্ট প্রশ্নটি মানসপটে স্থান পেতেই ব্যস্তিব্যস্ত হলো হৃদয়। পানসে এক অনুভূতি ছেয়ে গেলো কঠিন অন্তঃস্থলে। দ্বিধা জন্মালো। তার কি একবার যাওয়া উচিত, পর্যবেক্ষণ করা উচিত! পরক্ষণেই দ্বিধার পরিধি বাড়লো। এতো গহীন রাতে একজন নারীর ঘরে প্রবেশ করাটা কি সংযত? প্রশ্নগুলো কুহেলিকায় ছেদ পড়লো, যখন নিস্তব্ধ পরিবেশে আলোড়ণ তুললো কম্পিত ক্রন্দন। সাথে সাথেই দ্বিধাদ্বন্দের জ্বলাঞ্জলি দিয়ে দরজায় টোকা দিলো রাশাদ। খুব মোলায়েম স্বরে বললো,
“ইলহা? ঠিক আছেন?”

সারাহীন ওপাশ। শীতল, নিস্তব্ধ পরিবেশে শুধু ক্ষণে ক্ষণে ক্রন্দনের স্বর কানে আসছে। রাশাদ আবার টোকা দিতে দরজা ফাঁক হলো। মেয়েটি ডোর দেয় নি। এতোটা কেনো অসতর্ক। কপালে ভাঁজ পড়লো রাশাদে। তখন দৃষ্টি গেলো ঝাপসা হলদেটে মোমের আলোর নিচে চোখ বুজে থাকা রমনীর দিকে। এলোমেলো চুলগুলো বিছিয়ে আছে বালিশে। কিছু পিঠের নিচে। চোখে চিকচিক করছে নোনাজল। ক্ষুদ্র, জীর্ণ শরীরখানা কাঁপছে কিছু সময় অন্তর অন্তর। রাশাদ একটু কাছে আসলো। খুব আলগাভাবে স্পর্শ করলো তার কপাল৷ রুক্ষ্ণ হাত তাপমাত্রা অনুভব করার চেষ্টা করলো। না জ্বর নেই। তবে কেনো কাঁদছেন উনি! চোখ থেকে নির্গত চকচকে এই তরলকে হাতের উলটো পাশ থেকে মুছে দিলো রাশাদ। সেই সাথে মোটা কাঁথাটা গলা অবধি টেনে দিলো। কিছুপল তাকিয়ে রইলো নিষ্প্রাণ মুখশ্রীর পানে। সেদিনে বান্ধবীর সাথে কথা বলার পর থেকেই সে বিষন্ন হয়ে আছে। ভয় পাচ্ছে, গুটিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারগুলো না চাইতেও দৃষ্টি এড়াচ্ছে না। কেমন অদ্ভুতাকার মায়া জন্মেছে। শুধু মায়া অবধি থাকাটাই শ্রেয়। রাশাদ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই খপ করে দুটো জীর্ণ সরু হাত তার বাহু চেপে ধরলো। শক্ত করে ধরলো যেনো ঢিল দিলেই হারিয়ে যাবে। রাশাদ বিভ্রান্ত হলো। এর মাঝে কানে ভেসে এলো ক্ষীণ স্বর,
“আমাদের মেরো না প্লিজ, মেরো না প্লিজ”

কথাটি কর্ণকুহরে আসতেই ভয়াবহ রকমের উত্তেজিত হলো মস্তিষ্ক। রক্তকণিকার বেগ দ্রুত হলো। নিস্তব্ধ শীতল ঘরে মিলিয়ে গেলো স্বর। রাশাদের দৃষ্টি নরম হলো। ইলহার চোখের কোনে আবার উঁকি দেওয়া জল হৃদয়ে কাঁটার মতো বিধলো। সন্তর্পণে হাতখানা ছাড়ালো। মাথায় আলতো করে আদুরে স্পর্শ দিতেই মেয়েটি আবার ঘুমিয়ে গেলো। রাশাদ তার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো আর মনে মনে আওড়ালো,
“ক্রমশ আপনি আমার দূর্বলতা হয়ে যাচ্ছেন”

*******

ভোরের মিষ্টি রোদের স্পর্শে নীহারিকার ঘোর কাটলো। কুহেলিকার চাঁদরে আগলে আদুরে সকালের স্নিগ্ধতা ছুঁয়ে যাচ্ছে হুমায়রার ভেজা চুলে। গামছা দিয়ে সে ভেজা চুলগুলো শুকাতে ব্যাস্ত। বিছানা শীতল। বালিশের দেওয়ালের ওপাশের মানুষটি নেই। গতরাতে শীতল যুদ্ধ করেছিলো সে। নিজের এমন আচারণে নিজেই খানিকটা অবাক হলো সে। হুমায়রা কখনোই রাগ বা জেদ দেখানো মেয়ে নয়, সর্বদাই সে মানিয়ে নেওয়ার তত্ত্বে বিশ্বাসী। যতই প্রতিকূলতা থাকুন সে কখনো অভিমান করে না, অভিযোগ করে না। ছেলেবেলা থেকে নিজের বাড়ির ভঙ্গুর মানসিকতা থেকে সে এটাই শিখেছে। তবে গতরাতে যেনো কিছু একটা হলো। খুব রাগ হলো, খুব কষ্ট হলো। হুমায়রা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। ভেজা চুলগুলো আলগোছে খোঁপা করলো। শাড়ির আঁচলটা ঠিক করলো। তখন-ই দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো ফাইজান। চশমার আড়ালে লাল টকটকে চোখগুলো জানান দিচ্ছে নির্ঘুম রাত্রীর। হুমায়রা আয়না দিয়েই দেখলো একপলক ফাইজানকে। ফাইজান এসেই ঘরের দক্ষিণের আরামকেদারায়। হুমায়রা বেড়িয়ে যেতে নিলে ভরাট গলায় বললো,
“আমরা বিকেল চারটের সময় বের হবো। আপনাকে ওখান থেকেই পিক করে নিবো”

হুমায়রা মাথা কাত করে সম্মতি প্রকাশ করলো। কিন্তু কথা বললো না। যা বিরক্ত লাগলো ফাইজানের। ফলে গম্ভীর গলায় শুধিয়েই বসলো,
“আপনি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার সাথে কথা বলবেন না?”
“আমাদের সম্পর্কটি খোশগল্প করার মতো নয় নিশ্চয়ই। আর অহেতুক কথা তো আপনার অপছন্দ। আমার ও কথা হাতরাতে ভালো লাগছে না। তাই চুপ থাকাই ভালো। আমার তো অভিযোগ নেই”

ফাইজানের কপালের ভাঁজ প্রগাঢ় হলো। মেয়েটি যুক্তিদিয়ে কথা বলছে। এটাই তো সত্যি। কিন্তু তার কেনো বিরক্ত লাগছে! সে কি চাইছে যেনো মেয়েটি অভিযোগ করে! নিজের এমন চিন্তায় নিজেই অবাক হলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো। আড়াল করে নিলো অহেতুক প্রশ্ন। ভরাট গলায় বললো,
“যেটা ভালো বুঝেন”

বলেই চোখ বুঝলো সে। মুখ ছেয়ে আছে ক্লান্তি। হুমায়রার একবার শুধাতে ইচ্ছে হলো,
“রাতে ঘুমান নি?”

কিন্তু সেটা বলা হলো না। তবে পারুল খালাকে দিয়ে কড়া ব্লাক কফি পাঠাতে ভুললো না

******

সকাল সকাল তড়িৎ গতিতে ছোটাছুটি করছে রাশাদ। বোন এসেছে বিধায় তার কাজের শেষ নেই। বিনা খবরেই মেয়েটা সকালবেলা এসে উপস্থিত হলো। রাশাদ দোকানের জন্য বের হচ্ছিলো। বোনকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। চোখ ঝাপসা হলো। হৃদয় দূর্বল হলো। হুমায়রার কাছে যেয়ে তার মুখখানা ছুলো আলতো করে। খুব কাতর স্বরে শুধালো,
“কেমন আছিস বোন?”

ভাইজানের এমন ভারাক্রান্ত কন্ঠ হুমায়রার শক্ত চিত্ত গুড়িয়ে দিলো। কিশোরী চেপে থাকা আহ্লাদী স্বভাব ঠিকরে বের হলো। ভাইজানের মুখে চেয়ে শুধালো,
“তুমি কেমন আছো ভাইজান? খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছো? এতো রোগা লাগছে কেনো?”

বোনের মাথায় আদুরে পরশ দিতে দিতে বললো,
“তুই যে ছিলি না, কে খেয়াল রাখবে?”
“তাহলে কেনো আমাকে দূরে পাঠালে?”
“তোর ভালোর জন্য রে পাগলি”

ভাইবোনের এমন মান-অভিমানের পালায় অশ্রুসিক্ত হলো আতিয়া খাতুনের চোখ। মেয়েটিকে প্রথমে চিনতেই পারে নি সে। গায়ে দামী কাতানের শাড়ি, অন্তত তিনহাজার টাকার তো হবে। গলায় মোটা চেন। শুভ্র চামড়ায় যেনো জ্বলজ্বল করছে। মুখে অদ্ভুত লাবণ্য। সাজসজ্জাহীন মুখশ্রীটাও কি দীপ্তি ছড়াচ্ছে। এটাই হয়তো টাকার কামাল। শামসু মিঞা নাতনী আসায় হুকুম জারি করলেন, আজ রাশাদের দোকানে যাওয়া হবে না। রাশাদ বোনকে শুধালো,
“থাকছিস তো ক’দিন?”

তখন ই মিয়ে গেলো হুমায়রার আনন্দ। ম্রিয়মান স্বরে বললো,
“আজ চারটের সময় গ্রাম ছাড়ছি। তিনি নিজের বাড়ি যাবার জেদ করছেন”
“সে কি কতা, তালি পরে বৌভাত”

শামসুর মিঞার উদ্বিগ্ন প্রশ্নে আশ্বাস জুগিয়ে হুমায়রা বললো,
“আমাদের বৌভাত ওখানেই হবে। একবার উনার মনোনয়নটা হয়ে যাক, তারপর ঘটা করে করবেন বলেছেন”
“আসলে নেতা মানুষ, নির্বাচন তো তাদের পুলসিরাত”

তাচ্ছিল্যভরে কথাখানা বললো রাশাদ। কাওছার সবাইকে অবাক করে মেয়ের প্রতি কৃত্রিম ভালোবাসা দেখালো। কি চিন্তা তার মেয়ের প্রতি! হুমায়রা প্রথমে বিভ্রান্ত হলো বাবার এমন আচারণে, পরক্ষণেই শুধালো,
“আব্বা, আপনি তো একবার আমার খোঁজ নিলেন না। বিয়ের তো ছয়দিন আজ”

সাথে সাথেই থতমত খেলো কাওছার। রাশাদ ঠোঁট চেপে হাসলো। বাবার মতলব কেউ না বুঝলেও সে আয়ত্ত করতে সময় নিলো না।

রাশাদ আজ নিজে বাজার করেছে। ঘাম ছুতে গিয়েছে বাজার করতে। আজ মঙ্গলবার বিধায় বাজারে বেশ ভিড়। একেবারে তাজা একটা বোয়াল মাছ কিনেছে সে। বোন তার বোয়াল মাছ খুব পছন্দ করে, সেই সাথে শিং মাছ ও কিনতে ভুলে নি। লম্বা বেগুন কিনে এনেছে, ফুলকপি, শালগম সব-ই কিনেছে সে। দাদীকে বলবে লম্বা বেগুন দিয়ে শিং মাছ আর ফুলকপি নিয়ে বোয়াল মাছ রাধতে। এতো আড়ম্বরপূর্ণ বাজারে পকেট খানা শুন্য হয়ে গিয়েছে। মাসের এখন অনেক বাকি! সামনের মাসটা কি করে চলবে সেটা বেশ ভাবালো রাশাদকে। হাতের দুটো ব্যাগের মূল্য আড়াই হাজার টাকা। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। দাদীর হাতে বাজারগুলো দিতেই আতিয়া খাতুন অবাক স্বরে শুধালো,
“এত্তো বাজার? হ্যা রাশাদ, তুই ফাগল হলি?”
“থাক না দাদী, মেয়েটা আজ চলে যাবে”
“দাম কেমন নিছেরে? বাড়িছে নাকি মাছের দাম?”

রাশাদ মলিন হেসে উত্তর দিলো,
“মানুষ বাদে আজকের বাজারে সব কিছুর-ই দাম বাড়ে, শুধু মানুষ ই দাম খুইয়ে শুন্য হয়ে আছে”

*****

খাওয়া দাওয়া শেষে ইলহা এবং হুমায়রা বসলো একত্রে। যেনো দুই সখীর বহুকালের গল্প বাকি। ইলহা নানাবিধ প্রশ্ন করলো তাকে। এটা? সেটা? উত্তর দিতে দিতে হাপিয়ে গেলো হুমায়রা। পরে নিজেই শুধালো,
“তুমি কেমন আছো আপু? তোমার মুখখানা এতো শুকনো কেনো বলো তো?”
“আমার কি হবে? আমি ভালো আছি”
“সত্যি?”

ইলহা আর উত্তর দিতে পারলো না। ভারী দীর্ঘশ্বাস বের হলো অন্তঃস্থল থেকে। হুমায়রা তখন শুধালো,
“তোমার বাসায় কথা হয়েছে?”
“না, বান্ধবীকে ফোন দিয়েছিলাম। সে বারণ করলো শহরে যেতে”
“চাকরির কি ব্যাবস্থা হলো?”
“সেটাও এখনো দোদুল্যমান”
“আচ্ছা, তুমি একটু উপজেলার ক্লিনিকে চেষ্টা করো না। হ্যা, বেতন কম অবশ্য। জানি না তোমাকে নেবে কি না, তবুও ক্ষতি কি একবার চেষ্টা করতে?”

হুমায়রার কথা মনে ধরলো ইলহার। সত্যি তো এটা ভেবে দেখে নি সে। শহরের চাকরির চেয়ে বাবার আড়ালে থাকাটাই তার জন্য মঙ্গল।

এর মাঝেই আতিয়া খাতুনের ডাক পড়লো। পিঠে বানিয়েছে সে নাতীনের আসার খুশিতে। নাতিনের প্রিয় ভাপা পিঠে। বিকালের কোমল রোদে উঠানে মাদুর পেতে উত্তপ্ত ভাঁপা পিঠে সাথে ঝোলা নলেন গুড়। আহা! শৈশবের সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দগুলো যেনো ধরা দিলো হুমায়রার চোখ মুখে। ঠিকরে উঠলো অকৃত্রিম সুখ। সময়ের কাটা যে কতদ্রুত চলে সেটাই তার প্রমাণ। একদিন এ বাড়ি তার ছিলো। একান্ত তার, অথচ এখন সে এই বাড়ির মেহমান। যার আপ্প্যায়নে ব্যস্ত সকলে। ভাপা পিঠের এক টুকরোতে কামড় বসাতেই নারকেলের মিষ্টি স্বাদ পেলো সে। দাদী ভুলে নি, তার নাতনীর নারকেল পুরা ভাপা বেশি ভালো লাগে। ইলহা একটু ফুলকপির তরকারী নিলো। বেশ আয়েশ করেই খেলো। মেয়েটি আজ অনেকটা উৎফুল্ল লাগছে। রাশাদকে নিজের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে নিজের প্লেটটা এগিয়ে দিলো সে। মিষ্টি কন্ঠে শুধালো,
“খাবেন নাকি নাতীসাহেব? ফুলকপির সাথে ভাপা পিঠে মেখে খেতে কিন্তু বেশ লাগে”

রাশাদ প্রত্যুত্তরে শুধু হাসলো। অকৃত্রিম, মনোমুগ্ধকর হাসি।

*****

রাত তখন দশটা। কালো জিপের মতো গাড়িটা জোরে ব্রেক কষলো একতালা বাড়ির সামনে। হুমায়রা তখন ঘুমে। শরীফা আলতো করে তাকে ডাকলো। দুডাকে চমকে উঠলো অষ্টাদশী। লুকিং গ্লাসে আড়চোখে তাকে দেখলো ফাইজান। মানুষটি চলে একেবারে ঘড়ির কাঁটায়। ঠিক চারটের সময় সে এবং শরীফা এলো রাশাদদের বাড়ি। তখন কিশোরী আরাম করে ভাপা পিঠে খাচ্ছিলো। ঠোঁট, চোখ আনন্দে চকচক করছিলো তার। কে বলবে এই সে সকালের বিষন্ন কিশোরী। রাশাদের সাথে সালাম বিনিময় ছাড়া আর কোনো কথা হলো না। তবে আতিয়া খাতুন রাস্তার জন্য পিঠে, গুড় দিয়ে দিলেন। আর শামসু মিঞা তার হাত ধরে খুব আন্তরিক ভাবে অনুরোধ করলেন,
“আমার নাতীনরে দেইখ্যা রাইখেন জামাই”
“আপনি বলবেন না, আমি ছোট আপনার”
“এইডা কলি হয়, এইডা আমগোর দেশের নিয়ম। জামাই মানেই আপনি”

মানুষগুলো বেশ ভরসা করে নিজের জিনিস সপলো ফাইজান এবং শরীফার কাছে। এবার রাশাদ আড়ালে গেলো না। বোনের হাতজোড়া নিজের মুঠোবন্দি করে বললো,
“সাবধানে যাস, আর সামনের মাসে একটা ফোন কিনে পাঠিয়ে দিবো। খারাপ লাগলেই আমাকে ফোন করবি”
“আমার বউ কে আমি ফোন কিনে দিতে পারবো”
“সেটা আপনার ব্যাপার। আমার বোনের প্রতি আমার দায়িত্ব আমি ছাড়ছি না”

দু জনের মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য কঠিন দৃষ্টি বিনিময় হলো। ফাইজান কঠিন দৃষ্টি নামিয়ে গাড়ির ফ্রন্ট সিটে গিয়ে বসলো তখন। তারপর যাত্রা শুরু হলো অজানা গন্তব্যের।

একতালা বাড়িটিকে দেখলে ছবির বাড়ির মতো লাগে। কেমন মায়া মায়া ধরণের। গেট পার হলে ইটের রাস্তা, দুপাশে ফুলের বাগান। বাড়ির পেছনেও অনেক গাছ-গাছলা। এমনকি বাড়ির বারান্দাতেও ঝুলছে ছোট ছোট টব। একটা পাখির খাঁচাও নজরে পড়লো হুমায়রার কিন্তু সেখানে পাখি দেখা গেলো না। কেবল বাহির দরজার উপরের হলদে লাইটখানাই জ্বলছে। শরীফা নিজে প্রবেশ করলেও হুমায়রা এবং ফাইজানকে বারণ করলেন প্রবেশ করতে। একটা প্লেটে পিঠে এবং গুড় দিয়ে মিষ্টিমুখ করিয়েই প্রবেশ করালেন তাদের। ফাইজান প্রথমে আপত্তি জানালো। কিন্তু মায়ের জেদের সামনে হার মানলো। লাগেজগুলো ফরিদ ঘরে নিয়ে আসলো। শরীফা তখন বললো,
“বৌমাকে ঘরে নিয়ে যা ফাইজান”

ফাইজান হেসে বললো,
“এখন তুমি নিজ ঘরে যাও”

শরীফা নিজ ঘরের জন্য প্রস্থান করতেই ফাইজান তার স্ত্রী হাত নিজের হাতের ফাঁকে নিলো। নিজের ঘরের ভেতরে একটি দরজার সামনে দাঁড়ালো তারা। খুব নরম স্বরে বললো,
“দরজাটা খুলুন”

হুমায়রা নিজ হাতে দরজা খুললো। একটা ছোট ঘর। যাতে একটি খাট, একটি বিশালাকার বই এর আলমারী, একটি পড়ার টেবিল আর খাটের পাশেই বিশাল জানালা। ঘরটি খুব সিমসাম কিন্তু গোছানো। খাটের সাথে লাগোয়া দেওয়ালটিতে নেমে এসেছে নীল অপরাজিতার মেলা। যদিও তা আঁকানো কিন্তু মনে হচ্ছে একেবারেই অকৃত্রিম। বিছানার চাঁদর থেকে শুরু করে সব ই খুব স্বযত্নে বাছাই করা। হুমায়রাকে অবাক করে তার কাঁধে দুহাত রাখলো ফাইজান। কানের কাছে মুখ নামিয়ে মোলায়েম স্বরে বললো,
“কেমন লাগলো ঘর?”
“এটা আমার?”

বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো হুমায়রা। ফাইজান মৃদু হেসে বললো,
“এটা আমাদের বিয়ে উপলক্ষে আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্য প্রথম উপহার”

হুমায়রা ফ্যালফ্যাল করে চাইলো মানুষটার দিকে। এই মানুষটিকে সে সত্যি বুঝে না। ফাইজান বললো,
“যেহেতু আমার সাথে আপনার থাকতে আপত্তি, তাই এই ঘরটা বানিয়েছি। আগে আমার রিডিং রুম ছিলো। এখন এটা আপনার ঘর। সুতরাং এখন অন্তত বালিশের দেওয়াল টেনে ঘুমাতে হবে না আপনার”

মানুষটির কথায় কি অভিমান প্রকাশ পেলো! বুঝতে পারলো না হুমায়রা।

******

আজকে মনোনয়ন প্রার্থীদের নাম ঘোষণা হবে। সকাল থেকে কেন্দ্র অফিসে বেশ হৈ-হল্লা। সেই হৈ-হল্লার মাঝে ভয়াবহ শান্ত চিত্তে বসে আছে ফাইজান। তার চোখে মুখে অকৃত্রিম গাম্ভীর্য। দলীয় নেতাদের বেশ রমরমা আজ। কেতাব চৌধুরী ও এসেছে। গত পাঁচবছর যাবৎ সে ফাইজানের সাথে আসনের লড়াই এ আছেন। গতবার হুট করেই তার এতোকালের এমপি আসন একটা সাতাশ বছরের ছোকরা কেঁড়ে নিলো। তিনি বুঝতেও পাড়লেন না হলো টা কি। আজও তিনি এসেছেন। বেশ কোমড় কেঁচেই এসেছেন যেনো এবার কোনো ভুল না হয়। একটা বত্রিশ বছরের চুনোপুটির কাছে তার পয়তাল্লিশ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হতে পারে না। তখন এমপি হলে মন্ত্রীত্ব শিউর ছিলো। কিন্তু এখন এমপি হতে পারা নিয়েই দ্বিধার। কেতাব এসে বসলো ঠিক ফাইজানের পাশ। ফাইজান সালাম দিলেও উত্তর দিলো না। তার অবস্থা বুড়ো ঘোড়ার মতো তার রশিতে বল নেই, কিন্তু তেজ দেখাতে সে ভুলে না। এর মাঝেই খুব বিভ্রান্তভাবে প্রবেশ করলো ফরিদ। তাকে চিন্তিত ঠেকলো ফাইজানের কাছে। কিছু শুধাবার আগেই সে কানে কানে বললো,
“ফুপু ফোন দিছে, হুমায়রা নাকি হাসপাতালে”………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here