নিশীভাতি #৯ম_পর্ব

0
773

#নিশীভাতি
#৯ম_পর্ব

“কি চাই আমান ভাই?”
শক্ত কন্ঠে শুধালো হুমায়রা। তখন আমান কাতর স্বরে বললো,
“ফাইজানকে বিয়ে করো না হুমায়রা। ওকে বিয়ে করলে তোমার ই বিপদ”

আমানের কথাটা বোধগম্য হলো না হুমায়রার। চোখ কুচকে এলো। সন্দিহান, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্ষতবিক্ষত করলো সে আমানকে। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললো,
“কিসের বিপদ?”

হুমায়রার কণ্ঠে নিজের প্রতি অবিশ্বাস লক্ষ করলো আমান। ম্লান হেসে বললো,
“অবিশ্বাস করছো আমায় হুমায়রা? আমি কিন্তু তোমার ক্ষতি চাই না।“

হুমায়রা অপ্রস্তুত হলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো সাথে সাথেই। অশৃঙ্খল কপালে আসা চুলগুলো কানের পেছনে গুজলো। মানুষটি বেপরোয়া দৃষ্টি তাকে খুতিয়ে দেখতে ব্যস্ত। না তাকালেও বোঝা যায় সেটা। আমান তখন বললো,
“এই বিয়েতে মানা করে দাও হুমায়রা। তুমি কি জানো ফাইজানের আগে একবার বিয়ে হবার কথা ছিলো? কিন্তু বিয়ের আগের দিন তার হবু স্ত্রী কিডন্যাপ হয়৷ প্রায় ৭২ ঘন্টা তল্লাশির পর তাকে পাওয়া যায় কিন্তু মৃত। একটা জলজ্যান্ত মেয়েকে গলা কেটে নালায় ফেলে দিলো অথচ কেউ টের ও পেলো না। আর এসব কিছুতে ফাইজান ছিলো মৌন। যেন তার কিছু যায় ই আসে না। তাই বলছি। এই বিয়েটা করো না। ফাইজান একটা প্রহেলিকা। তাকে সমাধান করতে গেলে নিজেই আওলে যেতে হবে। তাই তোমাকে সাবধান করতে চাই”

হুমায়রার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেল সে। আতংকের ছাপ স্পষ্ট মুখে। অপ্রতীভ, ভীত স্বরে বললো,
“মে/রে ফেললো?”
“হ্যা, মে/রে ফেলেছে।“
“কারা আর কেনো?”
“কারা জানা যায় নি, বলতে পারো ফাইজানের জানার ইচ্ছে হয় নি। কারণটা হয়তো ব্যক্তিগত শত্রুতা। বুঝোই তো নেতা মানুষ। নেতাদের শত্রু না হলেও হাজারটা শত্রু। অবাককর ব্যাপার, ফাইজান পরদিন এমন আচারণ করেছে যেন কিছুই হয় নি। সে তিনদিন পর তার মত ঢাকা চলে গিয়েছিলো, শপথ গ্রহণ করতে। তাই বলছি, বিয়েটা করো না”

হুমায়রা কিছুসময় চুপ রইলো। অন্তস্থল থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। স্মিত স্বরে বললো,
“আমার হাতে কিছু নেই আমান ভাই, আমার নসীবের চাবিকাঠি আমার হাতে নেই। আল্লাহ যা করবেন, নিশ্চয়ই ভালোই হবে”

অষ্টাদশীর মলিন কন্ঠে আহত হলো হৃদয়। ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চাইলো জমাট কষ্টগুলো। কিন্তু পুরুষের কাঁদতে নেই, দূর্বলতা দেখাতে নেই____

******

দোকানে আজ বেশ ভিড়, মনে হচ্ছে সবার ঘরেই কিছু না কিছু নষ্ট হয়েছে। সকাল থেকে মোট সাতটা চার্জার ই বিক্রি হয়েছে। মিঠু হাপিয়ে উঠেছে। অথচ রাশাদের মাঝে কোনো ক্লান্তি নেই। মিঠুর মাঝে মাঝে মনে হয় রাশাদ একটা মেশিন, একটি মানুষ ক্লান্ত হয় না কেন। মধ্যাহ্নের এখন শেষ ভাগ, খাবারের জন্য পেটে অমানুষের মতো প্রবৃত্তির সঞ্চালন করছে। অথচ এই মানুষটি তাকে নামাযের পনেরো মিনিটি ছাড়া কোনো ছুটি দেয় নি। সেই ফাকে অবশ্য সে একটি কলা পাউরুটি খেয়ে এসেছে। কিন্তু তবুও ক্ষিদে কমে নি। যতই হোক বাড়তি বয়সের ছেলে সে। আর সহ্য না করতে পেরে অসন্তোষ স্বরে রাশাদকে বলে উঠলো,
“ভাইজান ছুটি দেন, খামু”
“পাউরুটি, কলা খেয়েও পেট ভরে নি?”

স্বাভাবিক গলায় কথাখানা বললো রাশাদ। সে হিসেব মিলাতে ব্যস্ত। মাসের শেষ, বাকির হিসেবটা এখন দেখাটা প্রয়োজন। শফির টাকা পরিশোধের জন্য এ মাসে ধার করতে হয়েছে তার। সেই ধারের অংকটাও মিলিয়ে নিচ্ছে। মিঠু মুখ ফুলিয়ে বললো,
“ওইতো দশ টেহার একটা ছুডু রুটি, ঐতে এক কোনাও ভরে না”

রাশাদ নিঃশব্দে হাসলো, প্রশ্রয়ের হাসি। নরম স্বরে বলল,
“বেশ, এবার পেট ভরিয়ে খেয়ে আয়। কিন্তু দশ মিনিট। এক মিনিট এদিক ওদিক যেনো না হয়। এযে কাসেম ভাইকে ফোন দিবি। মাল দিয়ে যায় নি এখনো। আর কয়টা চার্জার আছে গুনে রাখবি। আমি একটু সদরে যাবো”

মিঠুকে আর পায় কে! ছুটে খেতে বেরিয়ে গেলো সে। রাশাদ তখন হিসেবে মগ্ন। গ্রামের প্রবীণ রহমত আসলেন। প্রথমে দোকানের বাহিরে বেশ কিছু সময় ডাকলো। সাড়া শব্দ না পেয়ে ভেতরে আসলেন তিনি। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,
“ও শামসুর নাতী, ওই নাতীসাহেব, হুনো না কে রে?”

ধ্যানমগ্ন রাশাদের ধ্যান ভাঙলো। নাতীসাহেব নামটি মস্তিষ্কের বহুদিন পুরোনো কিছু স্মৃতিকে তাজা করে তুললো। সেই সাথে মানসপটে ভেসে উঠলো, স্নিগ্ধ হাস্যোজ্জ্বল একটি মুখ। যার সাথে মাত্র দুবার মোলাকাত হয়েছে রাশাদের। ক্ষণপরিচিত নারীর স্মৃতিতে অবাক হলো রাশাদ। আনমনেই হাসলো। মেয়েটির সাথে আরেকবার দেখা হলে কি খুব মন্দ হত! কে জানে, হয়তো তাদের গল্পটা সেখানেই শেষ। রহমত অধৈর্য্য স্বরে বললো,
“ওই শামসুর নাতী, হাসতেছো কে রে? আমি কি মশকরা করলাম নি?”
“বলেন দাদা কি জন্য আসা?”
“আমার তেইশ হাজার টেহা হইছে”

রাশাদের চোখ কুচকে এলো। তীক্ষ্ণ হলো দৃষ্টি। উবে গেলো সরল হাসি। বিদ্বেষী স্বরে শুধালো,
“কিসের টাকা রহমত দাদা?”
“ও মা, বোনের বিয়ার খানা। টেহা দিবা না। আমারে ডাকছিলো শামসু। রান্নার ভার আমারেই দেছে। আমিও কইছি এমপি সাহেবের মন এক্কেরে পটায়ে দিমু আমার রান্নায়। আঙ্গুল চাটবো”
“দাদা ডাকছে আপনাকে?”
“হ, কই এই মাসের শেষ বিয়া। তোমার থেইক্যা টেহা নিতি। আমি তাই আইছি”

রাশাদের চোখে মুখে বিরক্তি পরিস্ফুটিত হলো। বুঝলো এবার হয়তো দাদার সাথে আরেকচোট ঝামেলা হবে। এতবার বলার পর সে এই বিয়ের জন্য উতলা হয়েছে।

******

ফাইজানের সাথে কথা কাটাকাটি চলছে শরীফার। মা-ছেলের মধ্যে এখন নীরব যুদ্ধ চলছে। ফাইজান বিয়ে করবে না, আর শরীফা বিয়ে দিবে। শরীফা তাই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে কথা বন্ধ করে দিবে ছেলের সাথে। ছেলেকে চেনা আছে তার, সুরসুর করে লাইনে চলে আসবে। কিন্তু এবার তেমন হলো না, প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা মা-ছেলের মধ্যে কথা হলো না। অথচ ফাইজান একটিবার ও তাকে ফোন দেয় নি। সে চলে গিয়েছে ঢাকা। শরীফা তখন বারবার দেখতে লাগলো ফোন। কিন্তু হতাশা ছাড়া কিছুই পেলো না। অবশেষে না পেরে ফোন দিলো ফরিদকে। ফরিদ তিনবারের মাথায় ফোন ধরলো,
“আম্মা বলেন”
“ওই গাধাটা কই?”
“পার্টির লোকদের সাথে আছে। কথা বলতেছে। আসলে আপনারে ফোন দিতে বলতেছি”
“লাগবে না, মনে হচ্ছে আমি মরে যাচ্ছি কথা বলতে। লাটসাহেবের বাচ্চাটাকে বলিস, বিয়ে হবে। ও চাইলেও হবে না চাইলেও হবে। নয়তো আমি অনশনে বসবো। ধর্মঘট”

ফরিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফাইজান তখন নিজের কাজে ব্যস্ত। হতাশ স্বরে বললো,
“আম্মা, কাজ দিবে না। কেন জেদ করতেছেন”
“শোন ফরিদ্দা, ওইটা তোর স্যার হইলে আমি ওর মা। জেদের দেখছোস কি! এবার আমি সংজ্ঞাসহ উদাহরণ দিবো। এই বলে দিলাম”

বলেই খট করে ফোন কেটে দিলো শরীফা। ফরিদ ফাইজানকে সবটা জানালো। কিন্তু সে নির্বিকার। খুব শান্তভাবে বললো,
“এইসব ভাউতাবাজি ফরিদ, কান দিও না। মাকে আমি চিনি, সে আর যাই হোক অনশনে বসবেন না”

******

ঘরের পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। ভাইজান এবং দাদার কোন্দল ভয়ংকর রুপ নিচ্ছে। হুমায়রার ভয় হচ্ছে, কোনো অনর্থ না ঘটে। অশান্তি লাগছে সবকিছু। পড়াশোনায় মন বসছে না। সব ছেড়েছুড়ে কোথাও পালিয়ে যেতে মন চাইছে। তাই ঘর ছেড়ে দীঘির পাড়ে এলো হুমায়রা। শীতল হাওয়া বইছে তখন বাতাবরণে। আকাশে কমলা রঙের লীলাখেলা। অগোছালো চুল উড়ছে। দীঘির পাড়ে বসেই ছিলো খেয়াল করলো, দূরে জটলা বেঁধেছে। কৌতুহলে সেখানে ছুটে গেলো কিশোরী। ভিড় ঠেলে ভেতরে যেতেই চোখ বিস্ফারিত হলো। মাটিতে অজ্ঞান, মূর্ছিত পড়ে রয়েছে শরীফা…………………

চলবে

[মুসলিম পাড়ার দুটি বাড়ি, নাম শান্তিকানন এবং সুখনীড়। কিন্তু সেখানে অশান্তির বাস আর সুখের ছিটেফুটেও নেই। আছে শুধু ঝগড়া কলহ, বিদ্বেষ। বড়রা তো বড়রা, ছোটরাও এই কোন্দলে ঝাঝড়া। সকালবেলায় বল এসে ভেঙ্গে ফেললো আয়াতের শখের চুড়ি। ক্রোধ বর্ষণ হলো এই পাশ থেকে। কিন্তু ওপাশের সৌম্য পুরুষ, সাফওয়ান কেবল ই হাসলো। ফলে আরেকদফা ঝগড়া লাগলোই। আর দর্শক হলো মুসলিম পাড়া। এই বিদ্বেষ, কলহের বাতাসে প্রেমপুষ্প ফোটাবার দুঃসাহস পোষন করেছে এক জোড়া কপোত-কপোতী, প্রভা-ইশতিয়াক। আঠারো বছর ধরে সঞ্চিত প্রণয় পরিণয়ে পৌছাবে তো? নাকি তার পূর্বেই দু-বাড়ির কোন্দল পিষিয়ে দিবে প্রেম? সাফওয়ান-আয়াতের ঝগড়া কি কখনো শেষ হবে? নাকি চাঁদ কখনো বলবে হাতটি ধরতে?

ই-বই : চাঁদ বলে হাতটি ধরো (অংশ বিশেষ)

পুরো গল্পটা পাবেন শুধুমাত্র বইটই এপে। দাম মাত্র ৬০ টাকা!বইটি পড়তে হলে অবশ্যই গুগল প্লে স্টোর থেকে বইটই এপ ডাউনলোড করে নিজের একাউন্ট রেজিস্টার করতে হবে]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here