#নিশীভাতি
#১৭তম_পর্ব (বর্ধিতাংশ)
হুমায়রার ঘুম ভাঙ্গলো আযানের সাথে সাথেই। চোখ মেলে পিটপিট করে চাইতেই হৃদযন্ত্রের স্পন্দন বাড়লো। উন্মুক্ত বুকে নিজেকে লেপ্টে থাকা পাবে এ যেনো অকল্পনীয়। বিস্ফারিত হলো নয়ন। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো উষ্ণ রক্তস্রোত। শুভ্রগাল হলো রক্তিম। ফাইজান গভীর ঘুমে। তার শান্ত চেহারাটি তার দিকে ফেরানো। মানুষটির নগ্ন বুকে এতোটা সময় লেপ্টে ছিলো ভাবতেই কিশোরীর শরীর কেঁপে উঠলো। তড়িৎ গতিতে সরতে গেলে টের পেলো মানুষটির শক্ত হাতের আঙ্গুলগুলো চেপে বসে রয়েছে তার কোমড়ের হাড়ে। হুমায়রার লজ্জা গাঢ় হলো। ফাইজানের শান্ত ঘুমন্ত মুখশ্রীর পানে স্থির হলো দৃষ্টি। মানুষটি কি জানে তাকে ঘুমের মাঝে কতোটা নিষ্পাপ লাগে! দাম্ভিকতার ছোঁয়া নেই, রাগের বালাই নেই। গাম্ভীর্যটুকুও কোথায় হারিয়ে গেছে। হুমায়রা বেশ খানেকসময় তাকে দেখলো। কোথাও যেনো একটি নতুন মানুষকে যেন আবিষ্কার করলো সে। গম্ভীর, লাটসাহেবের বা/চ্চার সাথে বৈবাহিক জীবনটা খুব একটা মন্দ কাটবে বলে মনে হচ্ছে না।
নামায পড়ে বাঁধা চুলগুলো ছেড়ে দিলো হুমায়রা। চুল আঁছড়াতে আঁছড়াতে নজর গেলো গলার কন্ঠাস্থির পাশের সেই লালচে দাগটির দিকে। না চাইতেই গালজোড়া উষ্ণ হয়ে উঠলো। আয়না দিয়েই একনজর দেখল ঘুমন্ত ফাইজানকে। সে এখনো ঘুমে বিভোর। লোকটি আসলেই নির্লজ্জ, নয়তো কেউ বলে এই দাগ সকলকে দেখিয়ে বেড়াতে! হুমায়রা চুল দিয়ে ঢেকে দিলো দাগটি। তারপর বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। নেতাসাহেবের সব কথা শুনতে হবে জরুরি তো নয়।
*****
ধোঁয়াতোলা চায়ে ক্ষণ সময় পর পর চুমুক দিচ্ছে ফাইজান। চোখের সামনে কিছু কাগজ। যা উলটে পালটে একাগ্রতার সাথে দেখছে সে। এর মাঝেই ঝড়ের গতিতে প্রবেশ করলো ফরিদ। সামনে থাকা ছোট্ট টেবিলটাকে ছুরে মারলো হাতে থাকা পত্রিকা। হিনহিনে স্বরে শুধালো,
“এই জন্য বিয়ে করেছো তুমি অসহায় মেয়েটিকে?”
ফরিদের কথায় দৃষ্টি তুললো ফাইজান। তীক্ষ্ণ, বরফের ন্যায় শান্ত দৃষ্টি। চোখে মুখে সুপ্ত বিরক্তি। গম্ভীর স্বরে শুধালো,
“সকাল সকাল চেঁচাচ্ছো কেনো?”
“নিজেই পড়ে দেখো কি লেখা এতে”
ফাইজান তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে পত্রিকাটি হাতে নিল। তার ভ্রু কুঞ্চিত হলো ঈষৎ। চতুর্থ পেজের হেডলাইন, “নিরহংকারী এম.পি বিয়ে করলেন এক অজপাড়াগাঁয়ের মেয়েকে, পাশে দাঁড়ালেন তার দরিদ্র অসহায় পরিবারের”। ফাইজানের ভাবমূর্তির খুব একটা পরিবর্তন লক্ষ হলো না। প্রচন্ড স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“কি হয়েছে এতে?”
“কি হয়েছে মানে?”
“এটা কি ভালো নয়? আমাদের ক্যাম্পেইনের জন্য এমন পজেটিভ নিউজ ই তো চাই”
“মানেটা কি? তুমি নিজের স্বার্থে হুমায়রাকে ব্যাবহার করবে? এটাই তোমার উদ্দেশ্য ছিলো?”
“ভুল বলছো তুমি, আমি হুমায়রাকে নয় আমার বিয়েকে ব্যাবহার করছি”
“পার্থক্য আছে বুঝি?”
ফাইজান ঈষৎ হাসলো। মৃদু স্বরে বললো,
“অবশ্যই। এই পুরো প্রতিবেদনে কোথাও কিন্তু হুমায়রা বা তার পরিবারের কারোর নাম নেই। এবং কখনো আসবেও না। তাই অহেতুক চিন্তা ছাড়ো। সামনে মনোনয়নের ডিকলিয়ারেশন হবে। এটা নিয়ে চিন্তা করাটাই মনে হয় বেশি বুদ্ধিমানের হবে”
“তুমি এতোটা পাষাণ কেনো ফাইজান। একটা বাচ্চা মেয়ের জীবন নিয়ে…”
“বাচ্চা মেয়েটি আমার স্ত্রী ফরিদ ভাই। তার চিন্তাটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আর তুমি আমার মনোনয়ন নিয়ে চিন্তা করো”
কঠিন স্বরে কথাটা বললো ফাইজান। তার মুখের কাঠিন্য নজরে পড়তেই চুপ করে গেলো ফরিদ। ফাইজানের এমন রুপের সাথে ভালো করেই পরিচিত সে। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“কেতাব চৌধুরী বার বার চেষ্টা করছে তোমার আসনে যেনো সে মনোনয়ন পায়”
“তাহলে তার চেষ্টাকে দমন করার চেষ্টা করো”
“আচ্ছা”
“আর একটা কথা”
“ক…কি?”
“হুমায়রা নয়, এখন থেকে আমার সামনেও তাকে ভাবী বলে সম্বোধন করবে”
ফাইজানের শীতল স্বর শিরদাঁড়ায় একটা শীতল ত্রাসের স্রোত বয়ে গেলো ফরিদের। মাথা নাড়িয়ে ছোট করে “হু” বলেই বেরিয়ে গেলো সে। ফাইজানের নজর আবার গেলো পত্রিকাটির দিকে। কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়লো।
*****
অল্প আঁচে জ্বলছে চুলো। তার উপরে চাপানো কড়াই। সরষের তীক্ষ্ণ গন্ধ নাকে আসছে। আজ প্রথম রান্না করতে এসেছে হুমায়রা। নিজের বাড়িতে রাজকন্যা সে ছিলো না। তাই রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সব কিছুতেই সে পারদর্শী। নিজ হাতেই মাছ কেঁটেছে সে। মামা শ্বশুর সাহেব সকাল সকাল বড় একখানা ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছেন। তাই সরষে ইলিশ রাধছে সে। হেসেলের উনুনের উষ্ণতায় ঘাড় বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পরছে। একটু পর পর চুল সরাচ্ছে হুমায়রা। তখন ঘরের কাজের খালা পারুল বললো,
“হুমায়রা চুল আটকায়ে ল, তাইলে গরম কম লাগবো। দে আমি বাইন্দে দি”
বলেই চুলগুলো খোঁপায় বাঁধায় তৎপর হলো। চুল সরাতেই গলার লালচে দাগটি উন্মোচিত হলো। হুমায়রা সাথে সাথেই বাধা দিলো,
“থাক না খালা, লাগবে না”
“ওরে হুমায়রা, তাই তো কই তোরে আজকেরা এত্তো হুন্দর কেন লাগতাছে। আমাদের বাবাজি আদর করিছে তোরে। তা স্বামীর সোহাগ পাতি কিরাম লাগলো”
পারুল খালার কথায় লজ্জায় জমে যাবার যোগাঢ়। লজ্জামাখা স্বরে বলল,
“খালা, কি যে বলো”
“মুই কি কলাম, এতো তোর বর ই পরমান দিয়ে রাখিছে”
“ধ্যাত, তোমার মুখে কিচ্ছু আটকায় না”
পারুল খালা হাসতে হাসতে আরোও কিছু কথা বললেন, যা শুনে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবার যোগাঢ় হুমায়রার। কথাগুলো শুধু হেসেল অবধিই সীমাবদ্ধ রইলো না। দৃষ্টির অগোচরে কারোর কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো তা। সেই সাথে হলো রক্তক্ষরণ যা কেবল অনুভব করা যায়, দেখানো যায় না___
*****
সেদিন কথা দিলেও বাজারে নিয়ে আসতে পারে নি রাশাদ। ইলহা তাকে জোরও করে নি। তবে নাতিসাহেবের জন্য সে তৈরি হয়ে ছিলো। অজান্তেই মনে বেঁধেছিলো কিছু আকাঙ্খা। আজ দুপুরের পর রাশাদ দোকানে গেলো না। বরং ভারী স্বরে বলল,
“আমরা একটু বের হবো তৈরি হয়ে নিন”
“জি?”
“বললাম, আপনাকে নিয়ে বের হবো। তৈরি হয়ে নিন”
মানুষটি দাঁড়ালো না। সোজা উঠে নিজ ঘরে চলে গেলো। ইলহা কিছু সময় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো তার যাবার পানে। যখন ধাতস্থ হল, ঠোঁটের কোনায় দখল নিলো মিষ্টি হাসি।
উঠোনে নিজের বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো রাশাদ। বারবার দেখছিলো ঘড়ির কাঁটা। শীতের বেলা, এখন না বের হলে মাগরিব গড়িয়ে যাবে অকালেই। ঠিক তখন ই চোখ আটকে গেলো তার। মিষ্টি রঙ্গের শাড়ী পরিহিত নারীটি যখন তার সামনে এসে দাঁড়ালো হৃদয় কম্পিত হলো শতবার যেন। চশমার আড়ালে কাজলকালো স্বচ্ছ চোখগুলো দীপ্তি যেনো তীরের মতো আক্রমণ করলো শান্ত চিত্তে। গোধুলীর শেষ লগ্নের সোনালী আলোতে স্নিগ্ধ ছোট্ট মুখখানায় হামলে পড়ল মোদির নয়ন। শুকনো ঢোক গিললো রাশাদ। নির্নিমেষ অসংযত নয়নকে লাগাম ছাড়া হতে দেখে দ্বিধাগ্রস্থ হলো। ইলহা মিহি স্বরে বলল,
“যাবেন না, নাতীসাহেব?”
রাশাদ দৃষ্টি সরিয়ে দিলো। হৃদয় এখনো স্পন্দিত হচ্ছে তীব্র আন্দোলনে। মনে হলো অলিখ মায়ায় জড়িয়েছে সে। সে মায়া থেকে নিস্তার নেই।
বাজারের একটি সার্ভারের দোকানে এলো ইলহা। কিন্তু মেইল চেক করলো। তারপর সেখান থেকেই ফোন দিলো নিজের বান্ধবীকে। নিজের ফোন দিয়ে ফোন দিবে না। তাহলে বাবা ট্রাক করে ফেললে পারেন। যদিও সিম পালটে ফেলেছে বহু পূর্বেই। কিন্তু বিশ্বাস নেই। প্রথমে কিছু সময় বান্ধবী ফোন ধরলো না। অবশেষে চারবারের মাথায় ফোন ধরল সে,
“হ্যালো”
“আদিবা?”
“কে?”
“আমি, ইলহা”
“দোস্ত তুই কোথা থেকে ফোন দিচ্ছিস?”
“আছি একটা নিরাপদ জায়গায়”
“দোস্ত সেখানেই থাক। ভুলেও শহরে আসার কথা ভাবিস ও না………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি