#নিশীভাতি
#২৬তম_পর্ব
এবার দূরত্ব ঘোচালো রাশাদ। ইলহার খুব সন্নিকটে এসে শুধালো,
“আমি তাহলে কি করলে আপনার এই ভুল ধারণা ভাঙবে?”
রাশাদ ইলহার এতোটাই সন্নিকটে যেখানে নিশ্বাসের প্রগাঢ় ধ্বনিও কানে আসে। রাশাদের চোখে চোখ রাখতেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো ইলহা। রাশাদের দৃষ্টি আজ কেমন যেন লাগামহীন। এই দৃষ্টির ভাষা বুঝতে পারলো না ইলহা। বুকটা কাঁপছে দুরু দুরু। শিহরণ জাগছে অন্তস্থলে। চামেলী মেয়েটা বড্ড পাকা। শুধু অংসত, অশ্লীল কথা বলে। সুযোগ বুঝে ফিসফিসিয়ে ইলহাকে বললো,
“ভাবীসাব, আজ রাত সবচেয়ে বড়। আটঘাট বাঁইধে নিয়েন”
কথাটা শুনেই একেবারে লজ্জায় রক্ত জমে গেলো নরম গালে। কথাটা পুনরায় ধাওয়া দিলো স্মৃতিতে। রাশাদের সংযমহীন, বেপোরয়া নয়ন এখনো নিশ্চুপ, স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে পেলব মুখবিবরের পানে। অপেক্ষা রমনীর উত্তরের। কিন্তু তার নত নেত্রপল্লবে লজ্জা চুয়ে পড়ছে। যা আরোও বিবশ করছে যেনো পুরুষহৃদয়কে। এতোকাল ইলহার কাছে কখনোই নিজ ইচ্ছে, নিজ অনুভূতিপ্রকাশ করে নি রাশাদ। তার ব্যবহার, আচার বরাবরই ছিলো সংযত, সুশীল। মেয়েটি অতর্কিতে মন আঙ্গিনায় প্রবেশ করে তাকে ক্রমশ দূর্বল করে দিলেও সে দৃঢ়চিত্তে তা চেপে রেখেছে। কিন্তু আজ সকল সংযম যেনো হাটু ভেঙ্গে ফেলেছে। দৃঢ় সংকল্পও মুখ থুবড়ে পরেছে তীব্র বাসনার কাছে। অন্তর থেকে বার বার একটাই স্বীকারক্তি,
“ইলহা কেবল আমার, একান্ত আমার”
নির্জন ঘরে কেবল-ই নীরবতার লীলাখেলা। বাগানের ঝিঝিপোকার ডাকটাও শোনা যাচ্ছে। সেই সাথে শোনা যাচ্ছে ইলহার গাঢ় নিঃশ্বাস। রাশাদ আরেকটু কাছে এলো, সম্বোহনী কন্ঠে বললো,
“আপনার নতদৃষ্টি কতটা ভয়ংকর আপনি নিজেও জানেন না ইলহা, পুরুষের হৃদয়ে নিষিদ্ধ আকাঙ্খা তৈরি করার জন্য যথেষ্ট”
নিঃশ্বাস যেনো আরোও ভারী হলো ইলহার। লজ্জায় আরোও বিগলিত হলো যেনো। হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চলে গেলো। বহুদিন পর এমনটা হলো। রাশাদ একমনে দেখছিলো ইলহাকে। হুট করে তার একাগ্রতায় ব্যাঘাত ঘটলো। ঘরময় আধারীয়া দেবী বিরাজ করলেন। সেই সাথে কোথা থেকে ফুলেল গন্ধ ভেসে এলো। পূর্ণ চন্দ্রমা তখন নিজেকে উজার করলো মেঘের আড়াল থেকে। জানালার গ্রিল গলে প্রবেশ করলো জ্যোৎস্না। সেই অকৃত্রিম আলো এসে ভিড়লো ইলহার লাজুক মুখে। ঠোঁটখানা আলতো কাঁপছে শীতের সমীরে। আজ অনুমতি নিলো না রাশাদ। আলতো করে ছুলো নরম গাল। আঙ্গুলের ডগার আলতো উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে উঠলো ইলহা। চোখ তুললো সামান্য। রাশাদের মুখখানা আধারে স্পষ্ট নয়। ফলে লজ্জাটা একটু কমলো। রাশাদ এবার তাকে অবাক করে কপালে উষ্ণ চুমু আঁকলো। রাশাদের স্পর্শে শরীরময় শিহরণ বয়ে গেলো যেনো। স্নিগ্ধ স্বরে তখন কানে এলো,
“আল্লাহ তা’আলা আমার নসীবে আপনাকে রাখবে কখনো কল্পনাও করি নি। তবে, প্রতিটি মোনাজাতে আমি আপনাকে চেয়েছি হালালরুপে”
কি চমৎকার স্বীকারক্তি। এমন মানুষকে কি ভালো না বেসে থাকা যায়? ইলহার চোখের কোনে পানি চিকচিক করল। রাশাদের স্পর্শগুলো এবার সংযত থেকে লাগামছাড়া হলো। প্রথমে চুমু আঁকলো দু গালে্, নাকের কোনায়, দু চোখে। এরপর সেই ঠোঁটের সিক্ত ছোঁয়া স্পর্শ করলো ইলহার নরম পুস্পপল্লবের ন্যায় ঠোঁট। কি অকৃত্রিম মাদকতা। ইলহা বিগলিত হলো তার প্রণয়নের সাথে। গা ভাষালো তীব্র মাদকতায়। গাঢ় হলো স্পর্শ। নিঃশ্বাসের গতি বাড়লো। সিক্ত ছোঁয়ায় ক্রমশ কেঁপে উঠলো ইলহা। শক্ত দেহের মাঝে প্রবল সুখময় অনভূতিতে জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে মন। হাত খামছে ধরলো রাশাদের শক্ত পিঠ। রাশাদকে আজ সুশীল নাতীসাহেবটি মোটেই মনে হচ্ছে না। বরং বেসামাল পুরুষটি লাগছে যার তীব্র আকাঙ্খা এই নারী। একটা সময়ে রাত নিবিড় হলো। কিছু তীব্র আর্তনাদ চিরলো নিবিড় নীরবতাকে। কিন্তু সেই আর্তনাদ চরম সুখের।
*******
তীব্র শীতের মাঝেও গোসল সেরে বের হলো ফাইজান। চুলগুলো থেকে পানির কনা গড়িয়ে পড়ছে শান্ত মুখশ্রীতে। তোয়ালেটি গলাতে অথচ সে মুছছে না। তার দৃষ্টি একবার বিচরণ করলো ঘরময়। আঁধারে লিপ্ত ঘর। ধপ করে জ্বালালো মোম। মোমের আলো আলোকিত করলো গাঢ় আধার। আনাচে কানাচে দেখলো ঘরটা, হুমায়রা নেই। সতর্কচোখে আরোও একবার দেখে ভরাট গলায় উচ্চারণ করলো চার অক্ষরের নামটি, “হুমায়রা”
আলোআধারীতেই মিলিয়ে গেলো স্বর, সাড়া এলো না। ফলে নিরুপায় হয়ে আলমারীর পাশের দরজাটা ঠেললো। ছোট্ট ঘরটা তখন অন্ধকারে লিপ্ত। হঠাৎ ধিকধিক আলো শুষে নিলো সেই আঁধার। নজর গিয়ে স্থির হলো কাঁথা মোড়ানো তন্দ্রায় লিপ্ত স্থির শুভ্র মুখে। বই এর পাতা উদাম করে খোলা। কলমটা পড়ে আছে খুব অযত্নে। হেলান দিয়ে ঘুমে রুপবতীর সেদিকে খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো ফাইজান। তোয়ালে দিকে চুবচুবে চুলগুলো মুছে ফেললো। বড় অবহেলায় তারপর ফেলে দিলো তোয়ালেটি। তারপর খুব স্বযত্নে কোলে তুলে নিলো স্ত্রীকে। বরাবর ই লঘু ঘুম হবার দরুণ সাথে সাথেই চোখ মেললো কিশোরী। তন্দ্রালু চোখে চাইলো সুঠামদেহী পুরুষের দিকে। মুখশ্রী তার শান্ত, দৃষ্টি স্থির। নরম স্বর চিরলো নীরবতা,
“কি করছেন?”
মানুষটি উত্তর দিলো না। সোজা যেয়ে তাকে খাটে শোয়ালো। প্রথম প্রশ্ন,
“আপনি খেয়েছেন?”
“জ্বী”
কিন্তু কথাটা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। আজকে খাওয়ায় খুব অবহেলা হয়েছে। শ্বাশুড়ী খুব একটা তাগিদা দেবার সুযোগ পান নি। বিধায় নিজের ইচ্ছেমত অনিয়ম করেছে হুমায়রা। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো তো করেই নি সে ঔষধ ও খায় নি। মিথ্যেটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললেও বিচক্ষণ মানুষটি বিশ্বাস করলো না। বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে ফিরলো হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে। হুমায়রা অবাধ্য হয়ে বলল,
“আমি খাবো না”
“আমি তো আপনার মত জানতে চাই নি”
ফলে আর কথা বলার সুযোগ হলো না। বাধ্য হয়েই খেতে হলো সবটা খাবার। খাওয়া শেষ ঔষধ বুঝিয়ে দিলো ফাইজান। তারপর মিহি স্বরে বললো,
“খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন”
“আপনি?”
“আমি বাহিরে আছি”
“অহেতুক কেনো নিজের ঘুম নষ্ট করবেন”
“আমার ঘুমের জন্য আপনাকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হচ্ছে না”
“আপনি এখানেই ঘুমাতে পারেন, আমার পাশে। আমার আপত্তি নেই”
ফাইজান নিষ্পলক চেয়ে রইলো। অবাক হলো কিন্তু কারণ জানতে চাইলো না। রাত এখন গভীর, ক্লান্ত নেত্রে ঘুমরা হামলা করছে। তাই কিছু না বলে হুমায়রার পাশেই শুয়ে পড়লো ফাইজান। হুমায়রা সরলো না, মাঝে কোলবালিশের প্রাচীরও দিলো না। চোখ বুজে ফেললো বিনাসংকোচে।
*****
রাশাদের উন্মুক্ত বুকে লেপ্টে আছে বিবস্ত্র ইলহা। বুকটা ক্ষণে উঠা নামা করছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। মেয়েটি ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না। রাশাদ তাকে যত্ন করে বুকে আগলে রেখেছে। অপলক একাগ্র দৃষ্টি তাকে দেখছে। মায়া মুখশ্রী একদিন এভাবেই তাকে লেপ্টে ছিলো, কিন্তু সেদিন শত দ্বিধা ছিলো তাদের ভেতরের বাঁধা। আজ বাঁধাহীন মেয়েটি তার মাঝে লেপ্টে আছে। এখন থেকে আরোও একজন তার জীবনে প্রাধান্য পাবে। সকল চিন্তায় তার নামটি স্মরণ হবে। এযেনো এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। নিঃশব্দে হাসলো। ললাটে গাঢ় চুমু এঁকে মনে মনে বললো,
“কখনো আপনাকে কাঁদতে দিবো না ইলহা। আপনার সকল অভিলাষার ঝুড়ি এখন আমার একান্ত। কারণ আপনি ই পুরোটাই কেবল আমার একান্ত”
*****
গাঢ় তিমির। বাতাসের আনাগোনা ক্ষীন। এরমাঝে কারোর মৃদু কুহানী কানে এলো। তন্দ্রায় আঘাত হানলো তা। সাথে সাথে চোখ মেললো হুমায়রা। শব্দটি পাশ থেকেই আসছে। শক্ত হয়ে খামচে ধরে আছে তার হাত। সবল পুরুষালী দেহ ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে। তীব্র শীতেও তার মুখশ্রী ঘেমে একাকার। ফাইজানকে এমন দেখে কিঞ্চিত চিন্তিত হলো হুমায়রা। পরক্ষণেই মৃদু ধাক্কা দিয়ে শুধালো,
“ফাইজান, আপনি ঠিক আছেন?”
কিন্তু মানুষটি সাড়া দিলো না। বরং চোখ খিচে দাঁত চেপে শুয়ে রইলো। নিশ্চিত দুঃস্বপ্ন দেখছে। হুমায়রা আর স্থির থাকলো না। দূরত্ব গুছিয়ে আসে এলো সে। দ্বিধাহীন চিত্তে জড়িয়ে ধরলো তাকে। পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে মৃদু স্বরে বললো,
“কিচ্ছু হয় নি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি”
মানুষটি তার কথা শুনলো কি না কে জানে, তবে শক্ত করে আবদ্ধ করলো বাহুবন্ধনে। নিঃশ্বাস চিরলো হুমায়রার চামড়া। মুখখানা লুকালো হুমায়রার বুকে। আহত স্বরে গোঙ্গালো,
“আমি কিছু করি নি, আমি সত্যি ই কিছু করি নি”…………
চলবে
(ভালো লাগলে রেসপন্স করবেন)
মুশফিকা রহমান মৈথি