নিশীভাতি #৮ম_পর্ব

0
836

#নিশীভাতি
#৮ম_পর্ব

হুমায়রা নিজেকে সামলাতেও পারলো না তার আগেই তাকে বগলদাবা করে ঘরে নিয়ে গেলেন আতিয়া খাতুন। ঘরে যেতেই দেখলো চেয়ারে চেয়ারম্যান পত্নী সালমা এবং শরীফা বসে আছে। শরীফা তাকে দেখেই বললো,
“আমার তো মেয়ে পছন্দই চাচী। এখন আমার পুত্রবধুকে ঘরে তোলার অপেক্ষা”

শরীফার কথাটি মস্তিষ্কে ঝঙ্কার তুলল হুমায়রার। বিমূঢ় নয়নে তাকিয়ে রইলো সে বেশ কিছুসময়। ওদিকে শামসু মিঞার খুশি দেখে কি! সে গদগদ কণ্ঠে বলল,
“আপনের মাইয়্যা যখন ইচ্ছে ঘরে তুলবেন মোগোর আপত্তি নাই, শুধু একটু সময় নিবো। যতই হোক নাতনীর বিয়া। এক কাপড়ে তো পাঠাইতে পারি না”

শরীফা শামসুর কথা শুনে হাসল। মিষ্টি করে বলল,
“চাচা, মেয়ে আমি এক কাপড়েই নিব। আমার কিচ্ছু চাই না। শুধু আমার ছেলেটাকে সামলাবে এমন বুদ্ধিমতী মেয়ে চাই। বুঝেনই তো, ছেলের পেশা।“
“না না আমগোর মাইয়্যা এক্কেরে সব সামলায়ে লইব। একটু শিখায়ে পরায়ে লইবেন। নিজের মনে করেই শিখায়ে লইয়েন। গেরামে মানুষ, বয়স কম। আপনাদের মত করে গড়ায়ে নিবেন”

আতিয়া খাতুনের কথা আশ্বাস দিল শরীফা। একটিবার ও শুধানো হলো না হুমায়্রার মতবাদ। তার পূর্বেই শরীফা একটা সোনার আংটি পড়িয়ে দিলেন হুমায়রাকে। হুমায়রার সব কিছু দুঃস্বপ্নের মত লাগছে। পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে। নিজের জীবনের উপর নিজের ই কোনো আধিপত্য নেই। ভাইজান থাকলে হয়তো কখনই এমন কিছু হতো না। সে এই বিয়ের জিন্য কখনোই রাজী হতো না। এবং সে হুমায়রার মতবিহীন কিছুই করতো না। কিন্তু আফসোস ভাইজান এখন নেই। সে আসবে এশার নামাযের পর। হুমায়রার ঘটনার গতিতে সামাল দিতে বলেই ফেললো,
“ভাইজান তো আসে নি”

হুমায়রার কথায় কিঞ্চিত বিরক্ত হলেন শামসু মিঞা। শরীফা তখন বললো,
“রাশাদ কি অমত করবে?”
“না না কি যে বলেন, এত্তো বড় ঘর, এত্তো ভালো সম্বন্ধে ও অমত করবে কেনো?”

খানিকটা অপ্রস্তুত স্বরে কথাখানা বললেন শামসু মিঞা। শরীফা নিশ্চিন্ত হলো। রাশাদ অমত করলে তার পছন্দের কন্যা হাতছাড়া হয়ে যাবার সম্ভাবনা হয়েছে। হুমায়রা দাঁত কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলো। যে মানুষটিকে তার পছন্দ ই না, সেই মানুষটির সাথে সারাজীবন কি করে কাটাবে সে। সবথেকে বড় কথা, সে এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। গতবার বিয়েটা ভাঙ্গার পর থেকে মনোস্থির করেছিলো সে মন দিয়ে পড়াশোনা করবে, প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই স্বপ্ন, ইচ্ছে, অভিলাষাগুলো মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। কিশোরীর চিত্ত দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। চাপা আর্তনাদ করে উঠলো হৃদয়। অন্তস্থল থেকে বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করলো প্রবলভাবে। কিন্তু অসুস্থ দাদা সুখে আচ্ছাদিত মুখখানা দেখে কিছুই বলতে পারলো না সে। এদিকে বিয়ের পাকা কথা বলেই শরীফা এবং সালমা প্রস্থান করলো। বিয়ে হবে এই মাসের শেষ সপ্তাহে। যতই হোক তার একমাত্র পুত্রের বিবাহ। একটু আড়ম্বড়তা করা জায়েজ।

আতিয়া খাতুন নাতীনের কপালে চুমু আঁকলেন। আনন্দের অশ্রু দু আঁখিতে টলমল করছে। কাঁপা স্বরে বললেন,
“বড় ভাগ্য লইয়ে আইছো বুবু। কি ভালা পরিবার, কি ভালা শাশুড়ী। সব জাইন্যা তোমারে ঘরে লইতাছে। তুমি অমত কইরো না”
“ভাইজান কি রাজী হবে?”
“রাশাদরে মুই বুঝাইয়া কমু। কেবল তুমি অমত কইরো না।”

দাদীর কথার ভাবার্থ না বোঝার মত অবুঝ নয় হুমায়রা। এখন সে দ্বিমত পোষণ করলেই রাশাদ বিরোধীতা করবে। এবং হলো ও তাই। রাশাদ যখন জানতে পারলো তার একমাত্র বোনের বিয়ে এমপি ফাইজান ইকবালের সাথে ঠিক হয়েছে সে সরাসরি কঠিন স্বরে বলে দিলো,
“এই বিয়ে হবে না”

রাশাদের কথায় ক্ষেপে গেলেন শামসু। বৃদ্ধ কন্ঠ বজ্রস্বরে বললো,
“ফাইজলামি করস? বিয়ে হইবো না কে রে! আলবত হইবো। কিডা ঠেকাইবো?”
“আমি”

দাদার চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে উত্তর দিলো রাশাদ। ফলে রাগ আরোও বাড়লো শামসু মিঞার। রগ ফুলিয়ে বললেন,
“তুই আমার অবাধ্য হইবি?”
“অবাধ্য হবার কিছু নেই। আমি নেতাগোতার সাথে বোনের বিয়ে দিবো না। আর হুমায়রা এখন বাচ্চা। ওর পড়াশোনার প্রয়োজন। আপনি জিদ ছাড়েন। এই বিয়ে হবে না। ওদের মানা করে দিবো আমি”
“খবরদার, এই খবরদার। যদি এরাম কিছু সপনেও ভাবস, তোরে লাত্থি দিয়া ঘর থেইক্যা বাইর করাম। মাইয়্যা হইছে বিয়া করবে, কিসের এতো পড়াশোনা। ঐদিন তোর মায়ের জন্য মুখে কালি লেপছিলো বইল্যা ভালা পোলা বিয়া ভাইঙ্গা দেছেলো। আহারে! রাজরানীর মতো থাকতো মাইয়্যাডা। এখন নিজ থ্যাইকা আল্লাহ পাকে এতো হুন্দর একটা হম্বন্ধ আনলো আর তুই আইছোস বিয়া ভাঙ্গতি? জানোস তুই, তোর বোনের নামে কি কি ছড়ায় মানুষ? জানোস? তোর মা বাপের কিত্তির পরে একটা পরিবার আয় নাই। চেয়ারম্যানের বোন এই গেরামের না, তাই তার মন উদার। এই বিয়া ভাঙলে কই বিয়া দিবি? মাইয়্যা মানুষ কি ঘরে রাখোনের জিনিস? জিদ দেখাবি না! সারাজীবন কি ওরে তুই পালবি?”
“হ্যা, আমি সারাজীবন আমার বোনকে পালবো। আমার আপত্তি নেই”

রাশাদ এখনো শান্ত। তার মুখোভাব অমলিন, দৃঢ়। হুমায়রা বারান্দার কাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। শামসু মিঞা রাগে কাঁপছেন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঝাটা হাতে নিয়েই বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভূত হলো তার। আহ করে বসে পড়লেন ধপ করে মাটিতে। এদিকে আতিয়া খাতুন স্বামী, নাতীর দ্বন্দে মধ্যস্থা করতে চিৎকার করে উঠলেন,
“রাশাদ, অসুস্থ মানুষটারে কেন চেতাইতাছোস। পাগল হইছিস নি?”
“সেটা দাদাকে বল, আমি তো শান্ত আছি”
“চুপ কর। তোর এতো জিজ্ঞাসা জিগা বুবুরে। ও বিয়া করতে রাজী কি না”

রাশাদ এবার তাকালো হুমায়রার দিকে। হুমায়রা চোখ নামিয়ে নিলো। রাশাদ বোনের উদ্দেশ্যে বললো,
“হুমায়রা, তুই এই বিয়েতে রাজী?”

হুমায়রা জবাব দিলো না। পা গুটিয়ে মাটি আকড়ে দাঁড়িয়ে রইলো কেবল। দ্বিতীয়বারের মতো শুধালো রাশাদ,
“হুমায়রা, কথা কস না কেরে? তুই রাজী?”
“তোমরা যা ভালো বুঝবে”

হ্যা না কিছু না বলেই উত্তর টা দিলো হুমায়রা। রাশাদ বাঁকা হাসলো। বোনের মন বুঝতে খুব একটা কষ্ট হলো না তার। দাদাকে কাঁধ দিলো উঠার জন্য। তার ঘরে নিয়ে বসিয়ে দিলো খাটে। তারপর শান্ত স্বরে বললো,
“যতদিন হুমায়রা কলেজ পাশ না করবে আমি ওর বিয়ে দিব না। তাতে লোক যা ইচ্ছে বলুক আমার শুনে কাজ নেই”

শামসু মিঞা ক্ষেপলেন। কিন্তু শরীরের জোর মনকে সাহায্য করলো না। আতিয়া খাতুন তাকে ইশারা দিয়ে বললেন,
“এখন আর নয়, পরেরটা পরে দেখা যাবে”

******

চেয়ারম্যানবাড়িতে বিয়ের কথা শুনে দুদফা তুলকালাম বাঁধলো। প্রথম দফায় বাধালো আমান। নিজের অন্তস্থলে নিভৃত যতনে লালিত নারীকে অন্য কারোর স্ত্রী রুপে দেখার মতো স্পৃহা কোনো পুরুষের ই থাকে না। আমানের ও নেই। উপরন্তু সেই মানুষটি যদি হয় নিজের ই ফুফাতো ভাই তবে সেই হৃদয়ের দহণের মাত্রা লাগাম ছাড়ায়। দেলওয়ার সাহেব তখন চুরুট টানছিলেন। আমান বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলো রুমে। ভনীতাহীন স্বরে বললো,
“এই বিয়ে আটকান”

আমানের কথায় চোখ তুলে চাইলেন দেলওয়ার সাহেব। কিন্তু উত্তর দিলেন না। তিনি তার মত করেই চুরুট টানতে ব্যস্ত। বাবার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আমান আবার বললো,
“আব্বা, এই বিয়া থামান। হুমায়রার বিয়া ফাইজানের ভাইয়ের সাথে হবে আর আমি তা চুপ করে বসে দেখবো তা হবে না। আমি ঘরে আগুন ধরাবো আব্বা”

দেলওয়ার এখনো নির্বিকার। তার ভ্রুক্ষেপ নেই। আমান ধৈর্য্যচ্যুত হলো। অভিমান, কষ্ট ফুটে উঠলো কন্ঠস্বরে,
“এমন কেন করলেন আব্বা, কেন হুমায়রা আমার বউ হইলো না? কেন আব্বা, আমার সাথে বিয়ে দিলেন না আপনি? আমি ওকে ভালোবাসি আব্বা। ফুপু সব জাইনেও বিয়ে দিচ্ছে কই সে তো একটিবারও ভাবলো না”
“শরীফা আগুনে ঝাপ দিলে আমি দিবো না। ভুলে যেও না তুমি আমার একমাত্র সন্তান। তোমার বিয়ে আমি কোনো নষ্টা পরিবারের মেয়ের সাথে দিবো না”
“আব্বা”
“চিৎকার কইরো না আমান। ভুলে যাইও না এটা আমার ঘর। একটু পর যে গলা ভিজাবা সেটাও আমার পয়সা দিয়ে”

আমান দমে গেলো। পরনির্ভরশীলতা গুনের মতো, ধীরে ধীরে সেটা ভেতরের আত্মমর্যাদাটুকু খেয়ে ফেলে। বিনিময়ে থেকে যায় কেবল ই খোলশ।

********

ফাইজান তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিলো। ফোনে জরুরি কথা বলছে সে। আগামী পরশু সংসদের অধিবেশনে যেতে হবে। কিন্তু মা যেতে চাইছে না বিধায় তাকে অধিবেশন শেষ ফেরত আসতে হবে। মন্ত্রনালয় থেকে ফোন এসেছিলো। এবার বিল পাশ হবে, তাই সবাইকে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। কথা শেষে পেছনে ফিরতেই দেখলো মা দাঁড়িয়ে আছে। মুখে স্বচ্ছ হাসির প্রলেপ। ফাইজান তাকে দেখে মুচকি হেসে বললো,
“কি হয়েছে মা, এতো খুশি আজ?”
“আমার মনের আশা পূরণ হতে যাচ্ছে”
“মানে?”
“একদম মনের মতো একটা মেয়ে পেয়েছি। পুরাই পুতুল। তোর সাথে কি দারুণ মানাবে। আহা, যেমন দেখতে তেমন ব্যবহার। তেজ ও আছে। কিন্তু সুপ্ত। একেবারে পার্ফেক্ট এমপি এর বউ”

শরীফা ছোট বাচ্চাদের মতো বিবরণে ব্যস্ত। তার খুশি ধরছে না। এদিকে মুখের রঙ পালটে গেলো ফাইজানের। তার কপালে ভাঁজ পড়লো। কঠিন স্বরে বললো,
“আমার বউ? এসবের মানে কি মা?”
“মানে হচ্ছে এই মাসের শেষ সপ্তাহে তোমার বিয়ে। এবার আমি কোনো কথা শুনবো না ফাইজান”
“আর আর অনুমতিতে আমার বিয়ে ঠিক করেছো তুমি?”

ভীষণ শীতল কণ্ঠে কথাটা বললো ফাইজান। ফাইজানের রাগ কখনোই মাত্রা ছাড়ায় না। তবে ধারালো চাকুর ন্যায় শীতলতা যে কাউকে শিউরে দেয়। কিন্তু শরীফা দমলো না। জোর দিয়ে বললো,
“আমার ছেলের বিয়ে দিতে আমার অনুমতি লাগবে? হাসালে। বিয়ে হবে ব্যাস। আর হুমায়রা খুব ভালো মেয়ে”

হুমায়রা নামটি শুনতেই ভ্রুজোড়া একত্রিত হলো ফাইজানের। কঠিন স্বরে বললো,
“মেয়েটিকে নিয়ে অতিরিক্ত মাখামাখি করছো না তুমি? আমি তোমার কথায় তাকে ফ্রি পড়ার ব্যবস্থা করেছি। এখন তাকে বিয়ে করতে হবে? হাসালে মা। এবার তোমার পাগলামিতে আমি নেই। এটাই আমার শেষ কথা”
“ফাইজান, আমি তোমার কাছে অনুমতি নিচ্ছি না। ভুলে যেও না, আমি তোমার মা। আর তুমি বিয়ে না করলে আমি ভুলে যাবো আমার একটি ছেলে আছে”
“আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে কারোর জীবন নষ্ট হোক আমি তা চাই না। সব জেনে বুঝেও এমন একটা বিবেকহীন চিন্তা আমি প্রশ্রয় দিতে পারি না। তাই আমি তোমার পাগলামীকেও প্রশ্রয় দিবো না। এটাই আমার শেষ কথা”
“আমিও দেখবো বিয়ে কি করে না হয়”

রাগে ফুসতে ফুসতে ঘর ছাড়লেন শরীফা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফাইজান। তার মা কেনো এমন পাগলামী করছে বুঝে উঠতে পারছে না। সব জেনে শুনে একটি মেয়ের জীবন সে নষ্ট করতে পারে না। অতীতের সেই কালো স্মৃতি এখনো যে মস্তিষ্কে ভেসে উঠে।

******

কলেজ যাবার সময় হুমায়রার পথ আটকালো আমান। আমানের এমন কাজে ঘাবড়ে গেলো হুমায়রা। তার ভীত চোখ দেখে আশ্বাস দিয়ে বললো,
“ভয় পেও না। আমি তোমাকে উত্ত্যক্ত করতে আসি নি”
“কি চাই আমান ভাই?”

শক্ত কন্ঠে শুধালো হুমায়রা। তখন আমান কাতর স্বরে বললো,
“ফাইজানকে বিয়ে করো না হুমায়রা। ওকে বিয়ে করলে তোমার ই বিপদ….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here