দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ২৬ #আদওয়া_ইবশার

0
434

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৬
#আদওয়া_ইবশার

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এসেছে। এবার শুধু কিছু মুহূর্তের অপেক্ষা। এরপরই দুজন ভালোবাসার মানুষ বাঁধা পরবে পবিত্র বন্ধনে। দুটানা অনুভূতিতে ঠাসা দুরু দুরু বুকে লাল টুকটুকে বউ সেজে প্রণয় পুরুষের অপেক্ষায় ইতি। ভালোবাসার মানুষটাকে চিরসঙ্গী হিসেবে আপন করে পাবে ভেবে যেমন আনন্দের বন্যা বইছে মনে, ঠিক তেমনই ভবিষ্যৎ চিন্তায় বক্ষমাঝে অজানা কিছু ভয় দানা বেঁধেছে আনন্দের পাশাপাশি। কতক্ষণ পরেই বাইরে শোরগোল শোনা যায় ‘বর এসেছে’। কথাটা শোনা মাত্রই অস্থিরতা বেড়ে যায় ইতির। বুকের ধুকপুক শব্দটা দ্বিগুণ হয়। হাজার অনুভূতির মিশেলে পৃষ্ট হৃদয়ে স্বাদ জাগে প্রিয় মানুষটাকে বর বেসে এক নজর দেখে চোখের তৃষ্ণা মিটাতে। নব বধূর লজ্জার আস্তরণে হৃদয়ের চাওয়া টুকু হেরে যায়। চুপচাপ অশান্ত হৃদয়ে প্রহর গুণে যায়, কখন দুজনার তীব্র অপেক্ষার অবসান ঘটবে? কখন দুজন দুজনকে সকলের সম্মতিতে কবুল পড়ে আপন করে নিবে। পরক্ষনে আবার ভাবনারা বদলে গিয়ে বুকে জমে বিষাদ। জন্ম থেকে পাওয়া আপন মানুষ,আপন ভিটে সমস্ত কিছু পর করে চলে যেতে হবে এ বাড়ির মায়া ছেড়ে। এমন ভাবনায় খুশী গুলো মলিন হয়ে তীব্র কষ্টে ছেয়ে যায় নব বধূর মন।

নতুন বরকে দেখার আশায় ইতির পাশে বসে থাকা সকলেই ছুটে যায়। থেকে যায় শুধু দৃষ্টি। চারিদিকে সকলের মনের মাঝে বিয়ে উপলক্ষে আনন্দ উচ্ছ্বাসের ছড়াছড়ি থাকলেও মনের কোণে মেঘ জমেছে দৃষ্টির। সকলের আনন্দ উল্লাস যেন তার কাছে বিষের মতো ঠেকছে। রক্তিমের কথায় দেহে আঘাতের চিহ্ন না হলেও মনে বিশাল আচড় কেটেছে। আঘাতে জর্জরিত মন ভিষণ বাজে ভাবে অসুখে ভোগছে। এমন অসুস্থ মন নিয়ে কি আর আনন্দে মেতে থাকা যায়? তবুও মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে মুখ বোঝে সমস্ত কিছু সহ্য করে যাচ্ছে দৃষ্টি। তবে ভুল করেও গতকালের পর আর রক্তিমের চোখের সামনে পরেনি। পাষাণ পুরুষের প্রেমে পাগল প্রায় দৃষ্টি এবার দাঁতে দাঁত চেপে মনকে শাসিয়েছে। প্রতিজ্ঞা করেছে আর অপমানিত হতে যাবেনা ঐ মানুষটার সামনে। যতদিন পযর্ন্ত পাষাণটা নিজে থেকে দৃষ্টিকে কাছে না ডাকবে ঠিক ততদিন পযর্ন্ত প্রয়োজনে বেহায়া মনকে শিকল পরিয়ে হলেও ঐ পাষান্ডটার থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। এমন একটা শক্ত প্রতিজ্ঞা করার মাঝেও দৃষ্টির বেলাজ,বেহায়া মনটা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে প্রশ্ন করে বসে, “ঐ পাষাণ শিকদার যদি কখনো তোকে নিজ থেকে কাছে না ডাকে! তবে কি তাকে ছেড়ে যাবি?” বিপরীতে দৃষ্টি নিজেই নিজেকে শাসিয়ে মনের ভাবনা গুলোকে পাত্তা না দেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে বিরবিরিয়ে বলে,
“যদি ঐ পাষাণটা তাকে কখনো না ডাকে,তবে সে বুঝে নিবে ঐ মানুষটা সত্যিকার অর্থেই হৃদয়হীন। হৃদয় নেই দেখেই দৃষ্টি নামক আস্ত এক ভালোবাসার খনিকে সে উপেক্ষা করতে পেরেছে। দৃষ্টিও মস্ত বড় পাপ করেছে এমন হৃদয়হীন পুরুষকে নিজের কোমল মন দিয়ে। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবেই ধরে নিবে ভালোবাসার মানুষের অবহেলা।সবাই ভালোবেসে সুখ পায়। সে না হয় দুঃখই পেল। এক জনম হাসি মুখে বুকে দুঃখ লুকিয়ে পাড় করে দিল ভালোবাসা নামক পাপের শাস্তি ভোগ করে।”

বর বেশে মেহেদী শিকদার মঞ্জিলে পা রাখার পর কিছু নিয়ম পালন শেষেই ধুম পরে যায় খাওয়া-দাওয়ার। বাড়ির সবথেকে ছোট সদস্যের বিয়ে। এই বিয়েতে কি কোনো আয়োজনের কমতি রাখা যায়? একপ্রকার বলা চলে এটাই শিকদার বাড়ির শেষ বিয়ে। নিজের ছেলের প্রতি আজীজ শিকদারের খুব একটা ভরসা নেই। ঐ অনুভূতিহীন রোবট মানব আদও কখনো বাবা ডাক শুনবে কি না কে জানে। সেখানে তার ভবিষ্যৎ ছানাপোনার বিয়ের খাবার আশা করাটা একপ্রকার বিলাশীতা। সেই চিন্তা করেই মনের সবটুকু শখ-আহ্লাদ ঢেলে পুরো শহর জানিয়ে ধুমধাম আয়োজন করেছে ছোট মেয়ের বিয়েতে। ঐ পাথুরে মনের রোবট মানব ছেলেটা যা কির্তী শুরু করেছে, নাতি-নাতনির বিয়ে দূরের কথা, দাদা ডাক শোনার আশায় মনে হয় বাদ দিতে হবে খুব শিগ্রই। মাঝে মাঝে আজীজ শিকদার নিজেকে অপরাধী ভাবতে বাধ্য হয় এই ভেবে, দৃষ্টি নামক মিষ্টি ফুলটাকে তার অনুভূতিহীন ছেলের সাথে জড়িয়ে দিয়ে মেয়েটার জীবনটাই না নষ্ট করে দিল। কিন্তু ওনারই বা আর কি করার আছে? দৃষ্টির বাবা-মায়ের সাথে সৈন্যসমেত একপ্রকার যুদ্ধ করে ছেলেটাকে বিয়ে করিয়ে এনেছিল। ভেবেছিল মেয়েটার সাথে থাকতে থাকতে নিশ্চয়ই ঐ পাষাণের মন গলবে। কিন্তু হচ্ছে তার বিপরীত। তবুও কিছুই করার নেই। বাবা হয়ে তো আর ছেলের বৈবাহিক জীবনে নাক গলাতে পারেনা সর্বক্ষণ।

খাওয়া-দাওয়া শেষে কতক্ষণ খোশগল্পে বিয়ে বাড়ি মাতিয়ে রাখে মুরুব্বিরা। কথায় কথায় জানা যায় আগেভাগে আজীজ শিকদার দেনমোহরের বিষয়টা পরিষ্কার করেননি। বিয়ের মুহূর্তে এসে তিনি বলছেন ছেলে খুশি হয়ে যা দিবেন তাই তারা মেনে নিবে। পরক্ষনেই মেহেদীর বাবা-বড় ভাই জানায় দশ লক্ষ টাকা দেনমোহর দিবেন তারা। কথাটা রক্তিমের কানে পৌঁছাতেই প্রতিবাদ করে ওঠে। সরাসরি মেহেদীর সামনে গিয়ে জানতে চায়,

” স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করা স্বামীর ফরজ কাজ। তোর যত টাকা পরিশোধ করার সামর্থ্য আছে তত টাকায় দেনমোহর ধার্য করবি। এর বেশি এক টাকাও না।”

রক্তিমের কথাটা উপস্থিত অধিকাংশ মানুষের পছন্দ হয়নি। প্রায় অর্ধেকেই ভাবছে ছেলের বাবা-ভাই যখন চাচ্ছে তখন মেয়ের ভাই হিসেবে সে কেন বিরোধীতা করবে? মেয়ের ভাই হিসেবে তো তার আরও মোটামুটি বড় একটা অংকের দেনমোহর দাবী করে বোনের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার কথা। সেখানে কি না উল্টো সে আরও বাগরা দিচ্ছে। বিষয়টা মেহেদীর বাবা নিয়াজ সাহেবের পছন্দ হয়নি। মনে মনে ভাবেন সারা বছর গুন্ডা মাস্তানি করে নিজের সাথে ওনার ছেলেটার ভবিষ্যৎ ও নষ্ট করেছে। এখন আজ আবার সে নিজেই সামর্থ্য খোঁজতে আসছে। সে কি জানেনা মেহেদী বেকার! নিজেই এখনো বাপের-ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খায়।সেখানে বউয়ের দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করবে কিভাবে? রক্তিমের এটা ভাবা উচিৎ ছিল মেহেদীর বাবা-ভাই যখন বলছেন তখন তারাই পরিশোধ করবে দেনমোহরের টাকা। মনে মনে রুষ্ট হলেও মুখে প্রকাশ করেননা নিয়াজ সাহেব। মুখে মেঁকি হাসি ফুটিয়ে বললেন,

“দেখো বাবা! তুমি তো জানোই আমার ছেলে বেকার। সব জেনেই তোমরা আমার ছেলের সাথে তোমার বোনের বিয়ে দিতে চাইছো। আমার ছেলে বেকার হলেও কখনো তোমার বোনের কোনো চাহিদা অপূর্ণ থাকবেনা। আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট অর্থবিত্ত দান করেছেন। আমার ছেলে সারাজীবন পায়ের উপর পা তুলে খেলেও তা কমবেনা। তেমন দেনমোহরের টাকাও দশ লক্ষ কেন বিশ লক্ষ হলেও অপরিশোধ্য থাকবেনা। পুত্রবধূর ভরন-পোষনের দায়িত্ব যেমন আমি নিব। তেমন তার দেনমোহরের টাকাও আমি পরিশোধ করব।”

এমন একটা জবাবে মুহূর্তেই চটে যায় রক্তিম। তবে বোনের বিয়েতে কোনো ঝামেলা হোক চায়না বিধায় শান্ত ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টায় বলে,

“কিন্তু আমি চাই আমার বোনের দেনমোহর তত টাকায় হবে যত টাকা তার স্বামী নিজে পরিশোধ করতে পারবে। ছেলেটা আপনার হলেও তার সম্পর্কে জানার মাঝে অল্প ভুল করেছেন। আমার সাথে থেকে গুন্ডামি করেও ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারটা খুব ভালো করেই আয়ত্ব করে নিয়েছে আপনার ছেলে। যা আপনার অজানা। সুতরাং আমার মনে হয় স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করার মতো সামর্থ্য তার আছে। তাই আমি তার মুখ থেকেই শুনতে চাচ্ছি কত টাকা দিলে সে পরিশোধ করতে পারবে। আর একটা কথা। আমার বোনের ভরন-পোষনের দায়িত্বটাও আপনাকে নিতে হবেনা। এটাও আপনার ছেলে নিতে পারবে। বন্ধু হিসেবে এতোটুকু বিশ্বাস আমার তার উপর আছে।”

ছেলের যুক্তিতে সন্তুষ্ট হাসেন আজীজ শিকদার। নিয়াজ সাহেবকে মানাতে বিনয়ী স্বরে বলে,

“বিয়াই সাহেব!লোক দেখানো অল্প সু-নামের জন্য লাখ লাখ টাকা দেনমোহর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না। হাদীসেও এটাই বর্নিত। স্বামীর যতটা সামর্থ্য আছে সেই হিসেবেই দেনমোহর ধার্য্য করা। আপনার ছেলের যদি এক টাকা দেওয়ার সামর্থ্য হয় আমি তাতেও খুশী। ঐসব দেনমোহর বড় বিষয় না। বড় বিষয় হলো আমার মেয়ের সুখ। আপনার ছেলের সাথে আমার মেয়ে সুখে থাকলেই হবে। আর কিছুই চাইনা।”

এক কথা, দুই কথায় কখন না জানি বড় কোনো ঝামেলা বেঁধে যায়। সেই ঝামেলার জের ধরে না আবার পেয়ে গিয়েও প্রেয়সীকে হারিয়ে ফেলতে হয় ভয় হয় মেহেদীর। পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত বলে ওঠে,

“দেড় লাখ টাকা দিতে পারব আমি। আব্বা প্লিজ! আর কোনো অমত করবেন না। আমিও চাই আমার স্ত্রীর দেনমোহর আমার নিজের টাকায় পরিশোধ করব।”

ছেলের সোজা জবাবে আধার ছেয়ে আসে নিয়াজ সাহেবের মুখে। ভাবে লোক-সমাজে কতটা অসম্মান হবে তার। পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বলবে লাখ লাখ টাকার মালিক হয়েও ফকিরের মতো সামান্য কয়টা টাকা দেনমোহর দিয়ে ছেলের বউ ঘরে তুলেছে। তবে এই মুহূর্তে কিছু বলাও যাবেনা। ছেলেই যেখানে ভরা মজলিসে সম্মতি দিয়ে দিয়েছে। সেখানে নিয়াজ সাহেব অমত পোষণ করলে বিষয়টা বিচ্ছিরি হয়ে যাবে। সেই ভেবেই সম্মতি দিয়ে দেয়।

বিয়ের আসল কার্যক্রম শুরু হয়। ইতিকে নিচে নিয়ে আসার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়। বিয়ের ভারী ল্যাহেঙ্গার কিছুটা ভার একপাশে উঁচিয়ে ধরে ননদিনীকে সার্পোট দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নিয়ে আসে দৃষ্টি। শিকদার বাড়ির ছোট রাজকন্যার নব রূপে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে উপস্থিত সকলেই।শিকদার বাড়ির মেয়ের পাশাপাশি তার পাশে থাকা বউয়ের রূপের প্রশংসার গুঞ্জন সৃষ্টি হয় গুটিকয়েক আত্মীয়র মাঝে। শত মানুষের ভীরের মাঝেও প্রয়সীর বধূ রূপে থমকায় মেহেদী। তাকে এভাবে মুগ্ধ হয়ে এক নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঠাট্টা-হাসির রোল পরে যায় মুহূর্তে। মেহেদীর সেদিকে কোনো ধ্যান জ্ঞান নেই। পাত্তা দেয়না কারো হাসি ঠাট্টা।তার এতো বছরের প্রেম সাধনা আজ পূর্ণতা পেতে চলেছে। তার প্রেয়সী তার জন্যই আজ নিজের সমস্ত রূপ উজাড় করে সেজেছে। তবে সে দেখবেনা তো কে দেখবে? মেহেদীর এমন নির্লজ্জ চাহনী চোখ তুলে একবার তাকিয়ে দেখেই লজ্জায় নতজানু হয় ইতি।নিচে নেমে রক্তিমকে দেখতে পেয়ে বর কনে দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে দূরে সরে যায় দৃষ্টি। মুহূর্তেই শান্ত হয়ে ওঠে পরিবেশ। সকলের মনযোগ কাজীর কথায়।বিয়ের কার্যক্রম শুরু করে কাজী। মেহেদীর উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বলে ওঠেন,

” দেড় লক্ষ টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া আপনি নিয়াজ উদ্দিন সাহেবের ছোট পুত্র মেহেদী হাসান, এমপি আজীজ শিকদারের ছোট কন্যা ইসরাত ইতিকে বিবাহ করিতে রাজি থাকলে বলুন ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’।

নিরব পরিবেশে উপস্থিত সকলেই উৎসুক দৃষ্টিতে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে। অপেক্ষায় তার মুখ থেকে কবুল শব্দটা শোনার। কারো দিকে না তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে এক পলক রক্তিমের দিকে তাকায় মেহেদী। রক্তিম নির্বাক। কাটকাট ভঙ্গিতে বুকে হাত গুজে বোনের পাশে দাঁড়িয়ে। মেহেদীকে তার দিকে তাকাতে দেখেও কোনো নড়চড় হয়না। বরং আগের থেকেও শাণিত হয় চোখের দৃষ্টি। মেহেদী নিজে থেকেই ভেবে নেয় রক্তিমের ঐ কঠোর দৃষ্টির মানে। চোখের চাহনীতেই গুন্ডা শিকদার তাকে জানিয়ে দিচ্ছে,

“আমার বোনের মুখে আজীবন হাসি ফোটানোর দায়িত্ব নিতে পারলেই কবুল বলবি। নইলে না। বিয়ের পর যদি কোনোদিন বোনকে কাঁদতে দেখি তবে সেদিনই হবে তোর শেষ দিন।”

রক্তিমের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে নড়েচড়ে বসে মেহেদী নিজেও আত্মবিশ্বাসের সাথে তাকায় তার চোখে। বুক ফুলিয়ে একটা দম নিয়ে সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বলে ওঠে,

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

সাথে সাথে কেঁপে ওঠে ইতি। ভালো লাগার এক শীতল শিহরণ বয়ে যায় পুরো শরীরে। পরপর তিনবার মেহেদীর কবুল পড়া শেষে সকলেই উৎসুক নজরে তাকায় ইতির দিকে। সুখ-দুঃখের অদ্ভূত এক সংমিশ্রনে একটু সময় নিয়ে ইতি নিজেও তিনবার কবুল বলে প্রণয় পুরুষকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। হাসি ফোটে ওঠে সকলের মুখে। বিদাইয়ের সুর বাজতেই কান্নার রুল পরে শিকদার বাড়িতে। বাবার আদরের রাজকন্যা, মায়ের আদরের দস্যি মেয়ে, ভাইয়ের আদরের ছোট্ট বোনটা সমস্ত সম্পর্ক পিছনে ফেলে স্বামীর হাত ধরে পা বাড়ায় নতুন সংসারে। নিজের বাড়ি নিজের মানুষ গুলোকে ছেড়ে যেতে ফুট ফাঁটে ইতির। কান্নায় মুর্ছা যায়। তবুও সব বন্ধন ছিন্ন করে যেতে হয় নতুন জীবন সাজাতে।

****
বর যাত্রী বিদায় নিতেই খুব কাছের দুই-একজন আত্মীয় ছাড়া অন্যরাও একে একে বিদায় নেয়। মানুষে গমগম করা শিকদার মঞ্জিল আবারও নির্জীব হয়ে ওঠে। চারিদিকে অদ্ভূত নিরবতা গ্রাস করে নেয়। শিকদার বাড়ির প্রতিটা মানুষের জীবনে নেমে আসে মন খারাপের রাত্রি। খেয়েদেয়ে নিজের মতো করে নিশ্চুপ হয়ে ইতির রুমে শুয়ে পরে দৃষ্টি। মাত্র তিনদিনের পরিচয়েও আজ ইতির বিদায়ে অদ্ভূতভাবে মন খারাপ অনুভব করে দৃষ্টি। চোখের তারাই ভেসে ওঠে তার সেই বিদায় মুহূর্তের দৃশ্য। আজ যেভাবে ইতি বিদায় নিল বাড়ি ছেড়ে সেভাবেই তো তার বিদায় হয়েছিল। পরমুহূর্তে মনে পরে, উঁহু এভাবে না। ইতি বধূ বেসে সকলের সম্মতিতে ধুমধাম অনুষ্টানের মধ্য দিয়ে স্বামীর হাত ধরে বিদায় নিয়েছে। আর সে তো মা-বাবা’কে কষ্ট দিয়ে সাধারণ ঘরে পরা থ্রি-পিস পরে শশুরের হাত ধরে বিদায় নিয়েছিল। বউ সাজে স্বামীর হাত ধরে যেমন বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি আসার ভাগ্য হয়নি তার। তেমনই এখনো স্বামীর ভালোবাসা পাবার ভাগ্যটাও হয়নি। আদও হবে কি না সেটাও জানা নেই। অলস মস্তিষ্ক এমন হাজারটা ভাবনা চিন্তার উৎপাত ঘটিয়ে মন খারাপের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় দৃষ্টির। অর্ধরাত পর্যন্ত নির্ঘুম কাটে। আজানের আগ মুহূর্তে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে ভাবনা ঘর বন্ধ করে। ঘুম নামে দুই চোখে। মনে হয় সবেই চোখ দুটো লেগেছে। এর মাঝেই কানে ভাসে নিচে থেকে শোরগোল এর আওয়াজ আসছে। কিছুটা বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে দেয়ালে ঝুলানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা দশটা। হুড়মুড়িয়ে ওঠে বসে দৃষ্টি। শশুর বাড়িতে নতুন বউ হয়ে এতো বেলা অব্দি ঘুমাচ্ছে সে! না জানি উপস্থিত গুটিকয়েক আত্মীয় কত মন্দা রটাচ্ছে। কথাটা ভেবেই ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে উদ্যত হয়। সময় গড়ানোর সাথে সাথে নিচে থেকে আসা আওয়াজ তীব্র হয়। সাথে বাড়ে দৃষ্টির পায়ের গতি। সিঁড়ির কাছে গিয়ে নিচের দৃশ্য দৃষ্টিকোণ হতেই থমকে যায় দৃষ্টি। তিন-চারজন পুলিশ ঘিরে ধরেছে রক্তিমকে। নিশ্চল মস্তিষ্কে কতক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে আচমকায় ক্রস্ত পায়ে নিচে নামতে নামতে চেঁচিয়ে ওঠে,

“কি হয়েছে এখানে? পুলিশ কেন বাড়িতে?”

দৃষ্টির উপস্থিতি টের পেয়ে শিকদার মঞ্জিলের সকলেই তটস্থ হয়। রেহানা বেগম দ্রুত দৃষ্টির কাছে এসে তাকে ফের উপরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে বলে,

“কিছুই হয়নি। বাড়ির নতুন বউ তুমি। এসব ঝামেলা দেখতে হবেনা। তোমার শশুর আছেন, ওনি সবটা সামলে নিবে। আমার সাথে রুমে চলো তুমি।”

শাশুড়িকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে জোর খাটিয়ে নিচে নেমে আসে দৃষ্টি। রক্তিমের সামনে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করে,

“কি হয়েছে বলুন আমাকে। পুলিশ কেন এসেছে? আর আপনাকেই বা এভাবে ঘেরাও করে রেখেছে কেন? কি করেছেন আপনি? আবার কোথাও মারামারি করেছেন?”

দৃষ্টির অস্থিরতা দেখে একজন পুলিশ অফিসার আজীজ শিকদারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “ওনি কে?” উত্তরে চিন্তিত আজীজ শিকদার গম্ভীর স্বরে জানায়,

“আমার ছেলের স্ত্রী।”

একটু থেমে আবারও উদগ্রীব হয়ে বলে,

“দেখুন অফিসার, কেইস রি-ওপেন হয়েছে এর কোনো নোটিশ আমরা পাইনি। এভাবে হুট করে এসে সেই মান্দাতার আমলের ডিসমিস হয়ে যাওয়া কেসের সূত্র ধরে আমার ছেলেকে নিয়ে যেতে পারেন না। কেস যদি রি-ওপেন হয়েও থাকে তবে আমরা কেন নোটিশ পাইনি? এর জবাব আগে দিন আমাদের।”

“তা তো আমরা জানিনা স্যার। উপর মহল থেকে আমরা অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট পেয়েই এসেছি। আমাদের কাজ আমাদের করতে হবে। আপনি যদি বাঁধা দিতে আসেন তবে হয়তো বিষয়টা আরও জটিল হবে। বুঝতেই পারছেন আপনার ছেলে মার্ডার কেসের আসামি। এই মুহূর্তে আপনি বাঁধা দিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। উল্টো আপনি নিজেও একজন খুনিকে সাপোর্ট করার অপরাধে এমপি পদ হারাতে পারেন।”

অফিসারের কথা গুলো শোনা মাত্রই যেন দৃষ্টির মাথায় মস্ত বড় আকাশটা ভেঙ্গে পরে। অনুভূতি শূণ্য নিস্তেজ কন্ঠে জানতে চায়,

“কিসের মার্ডার কেস?”

“প্রায় আড়াই বছর আগে আপনার স্বামী ওনার প্রথম স্ত্রী জেরিন এবং ভাই সংগ্রাম শিকদারকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। সেই কেসে তখন আপনার শশুর মিথ্যে প্রমাণ দিয়ে ছেলেকে নির্দোষ প্রমাণ করে ছাড়িয়ে এনেছিল। কিন্তু সেটা জেরিনের পরিবার মেনে নেয়নি। ওনারা আবার নতুন করে কেস ওপেন করেছে।”

চলবে…..

(লেবু অতি কচলালে তেতো হয়ে জানি, কথাটা আমিও জানি। কিন্তু কি করব বলুন? মাঝে ভেবে রাখা প্লাট এলোমেলো করার ফল এটা। ছোট্ট একটা গল্পকে এখন কচলাতে কচলাতে এতো দূর টেনে আনতে হবে। তবে আপনাদের আর বেশিদিন বিরক্ত করবনা। ঝামেপূর্ণ আর একটা কি দুইটা পর্ব হবে। এরপর রক্তিম-দৃষ্টির সংসার আপনাদের এক নজর দেখিয়ে গল্পের ইতি টানব। সেই পযর্ন্ত একটু সহ্য করে নিন আমার এই বস্তাপচা গল্পটা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here