#নিশীভাতি
#১৭তম_পর্ব
নিজের কাজ থামিয়ে পাশে গিয়ে বসলো ফাইজান। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো শুভ্র মুখখানার দিকে। স্থির সেই চাহনী। বাতাসের ঝাপসায় এলোমেলো চুলগুলো খুব সন্তর্পনে কানের পেছনে গুজলো। ঠিক সেই সময়েই চোখ মেললো হুমায়রা। বিস্মিত নয়নজোড়া ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়েছে ফাইজানের দিকে। নিজেকে ধাতস্থ করার পূর্বেই পুরু পুরুষালী আঙ্গুল বিচরণ শুরু করলো তার ঠোঁট। ফাইজানের পুরুষালী কন্ঠ ধ্বনিত হলো ঘরে,
“যেহেতু সেদিন রাতে আমি ছিলাম না, তাই নিয়মমাফিক আজ আমাদের বাসর রাত। আর আপনি কি না ঘুমোচ্ছেন?”
ঘরময় নিগূঢ় নৈঃশব্দতা। একটা কম ওয়াটের বেগুনী লাইট জ্বলছে ঠিক হুমায়রার মাথার উপর। সেই বেগুনী রঙ্গে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ফাইজানের মুখশ্রী। তার স্থির, মোহগ্রস্থ চাহনী তার বিভ্রান্ত করলো। সাথে সাথে একটা তিতকুটে অনুভূতি জাগলো, তিনদিন যে পুরুষটি তার খোঁজ নেয় নি তার কাছে নিজেকে সপে দিতে হবে? বিয়ে মানেই কি শুধু দেহের চাহিদা। অবসন্ন কণ্ঠে শুধালো,
“তাহলে আমার কি করা উচিত?”
“এই প্রশ্নের উত্তর ভেবে দেখি নি, তবে ঘুমানো তো মোটেই উচিত নয়”
হুমায়রা চোখ মেলে চাইলো। ফাইজান তার খুব কাছে, এতটা কাছে যেখানে নিঃশ্বাসের শব্দও কানে আসে। সেই সাথে নাকে এলো তীব্র, কড়া মিষ্টি একটি গন্ধ, এই গন্ধটা আগেও পেয়েছিলো সে যখন ফাইজানের খুব সন্নিকটে এসেছিলো। ফাইজানের এই সুগন্ধিটা কড়া কিন্তু নাকে ঝাঁঝালো লাগে না। অনেকটা ফুলের মতো। কন্টকের কাছে ফুলের গন্ধ। বিষয়টা অবাক লাগলো, হাসিও পেলো হুমায়রার। যে মানুষের ফুলে এলার্জি সে কি ফুলেল সুগন্ধি পরিধান করে। হুমায়রার ঠোঁটে মিষ্টি হাসির প্রলেপ দেখে ফাইজানের ঠোঁটও এক চিলতে হাসি দখল করলো। ঈষৎ বিস্মিত ভাব এনে বললো,
“আজ ধার দেখাবেন না?”
“ধার দেখালে আপনি মানবেন? যদি বলি আমাকে ছুঁবেন না মানবেন?”
“আমাকে কি খুব দর্জাল মনে হয় আপনার?”
“হ্যা হয়, যেভাবে তাকান যেনো আমি আপনার কোনো মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছি”
“নেন নি বলছেন?”
“কি নিয়েছি?”
“আমার মাকে। তাকে বশ করে আমার বিরুদ্ধে করেন নি?”
হুমায়রা চোখ ছোট ছোট করে চাইলো। হতাশ গলায় বললো,
“আমি তাকে বশ করেছি”
“করেছেন, অবশ্যই করেছেন। নয়তো আমার সমাবেশে সে ফোন করে আমাকে গাধা বলে সম্বোধন করতো না”
ফাইজানের অভিযোগে হেসে উঠলো হুমায়রা। খিলখিল হাসি ধ্বনিত হলো নিস্তব্ধ ঘরে। ফলে চুরমার হলো সেই নিস্তব্ধতা। ফাইজান মুগ্ধ হয়ে দেখলো সেই হাসি। খুব আস্তে বললো,
“আপনি সত্যি খুব সুন্দর হুমায়রা”
ফাইজানের কথাটার মাঝে কিছু একটা ছিলো। হাসি উবে গেলো হুমায়রার, নেত্রপল্লব ঝুকলো লজ্জায়। গালখানা ঈষৎ উষ্ণ হলো। ফাইজান কিছুটা ঝুকলো। দূরত্ব গুছলো বেশখানিকটা। হুমায়রার গলার কাছে ঠোঁটখানা ছোঁয়ালো আলতো ভাবে। হুমায়রা কেঁপে উঠলো সাথে সাথে। শিহরণ বয়ে গেলো শিরদাঁড়া বেয়ে। ঈষৎ ব্যাথায় শব্দ করে উঠলো সে। সাথে সাথেই ফাইজান তাকে ছেড়ে দিলো। আহ্লাদী ছোঁয়ায় হাত বুলালো মাথায়। মৃদু হেসে বললো,
“আজকের জন্য এটুকুই থাকুক। আপাতত স্ট্যাম্প করে রাখলাম, দখলখানা সময় বুঝে করবো। কালকে খোঁপা করে রাখবেন, যাতে এই দাগটি সবাই দেখতে পারে। আর বুঝতে পারে আপনি আমার সকলভাবে বৈধ স্ত্রী”
হুমায়রা বিমূঢ় চাইলো। অবসন্ন হৃদয়ে শুধালো,
“আমি আপনার একচ্ছত্র সম্পত্তি বুঝি?”
“ভুল বললেন, আপনি আমার একচ্ছত্র সম্পদ”
“আলাদা নাকি?”
“অবশ্যই। সম্পত্তি তো নির্জীব বস্তু, যা সহজেই হস্তান্তর হয়। আপনি হস্তান্তর অযোগ্য, অমূল্য। যাকে খুব কষ্টে তার ভাইজানকে রাজি করে নিয়ে এসেছি। তাহলে এক কি করে হয়?”
হুমায়রা ফ্যালফ্যাল করে চাইলো ফাইজানের দিকে। দ্বিধাগ্রস্থ স্বরে বলল,
“আপনি অনেক হেয়ালী করেন”
“যান, আর করবো না”
“একটা প্রশ্ন করি?”
“করুন”
“আপনি এই বিয়েটা কেনো করেছেন? এখন বলবেন না আপনি আমাকে ভালোবাসেন”
হুমায়রার সহসা প্রশ্নে অবাক হলো ফাইজান। দৃষ্টি সজাগ হলো। মেয়েটির বুদ্ধিদীপ্ততা তাকে বিস্মিত করলো আরোও একবার। আলতো হাতে তার নরম গাল ছুঁলো সে। খুব মোলায়েম স্বরে বলল,
“মিথ্যে বলবো না, আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি না হুমায়রা। আপনাকে বিয়ে কেবলমাত্র মায়ের জন্যই আমি করেছি”
হুমায়রা উত্তরটা জানতো তবুও কেনো যেনো মিয়ে গেলো ভেতরটা। এক দমবন্ধ অনুভূতি হলো। সে কি অন্য কিছু আশা করছিলো? হয়তো। ধীর গলায় শুধাতে ইচ্ছে হলো,
“তবে কি হাফসাকে এখনো আপনার মনে পড়ে?
কিন্তু প্রশ্নটা বিয়ের তিনদিনের মাথায় কথাটা অসংযত। তাই প্রশ্নটা গিলে নিল হুমায়রা। ফাইজান নিজ থেকেই বললো,
“আমার থেকে অন্য কোনো উত্তর আশা করছিলেন?”
“নাহ”
“তাহলে চোখমুখে এমন আষাঢ়িয়া মেঘ জমলো কেন আপনার?”
“ভাবছি, তাহলে বিয়ের থেকে আপনার দাবি কি?”
“কিছুই না, যতটুকু আপনি আশকারা দিবেন ততটুকুই”
“তাহলে এই দাগ কেন? আমিতো আশকারা দেই নি”
“বাধাও দেন নি”
হুমায়রা চুপ করে গেলো, লজ্জায় মুখ থেকে কথা বের হতে চাইলো না। দৃষ্টি নেমে গেলো আপনাআপনি। সেই সাথে চিবুক খানাও। ফাইজান আলতো হাতে চিবুকখানা ধরে তার দৃষ্টি নিজের দিকে ফেরালো, খুব নম্র, কোমল স্বরে বলল,
“আমার বাবা একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। বাড়ির সকলের অমতে মা তাকে বিয়ে করে। খুব সুন্দর প্রেমকাহিনী তাই না? কিন্তু প্রেমকাহিনী খুব বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী ছিলো না। কিছু দুর্ষ্কৃতকারীরা তাকে মে’রে ফেলে। আমি তখন চৌদ্দ বছর, মা আমাকে নিজ হাতে বড় করেছেন। তাই তার সব চাওয়া পাওয়াগুলো আমার কাছে বিধির বিধান। কিন্তু এবার আমি তার ইচ্ছের বিরোধিতা করেছিলাম। কারণ আমার অনির্দেশ্য জীবনের কাছে একজন আঠারো বছরের মেয়েকে জড়ানোর ইচ্ছে আমার কোনো কালেই ছিলো না”
“তাহলে বিয়েটা করলেন কেনো?”
“কারণটি আপনি হুমায়রা। ওই যে বললাম আমার মাকে আপনি বশ করে ফেলেছেন। এখন আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত জানেন। আমার যদি কিছু হয়েও যায় মা একা হবে না”
হুমায়রা উদ্বিগ্ন হলো ঈষৎ, ব্যকুল স্বরে বললো,
“আপনার কি হবে?”
“কতকিছু হতে পারে। ওই যে বললাম, আমার জীবনটা অনির্দেশ্য”
হুমায়রা চুপ করে রইল। ফাইজান আলতো চুমু আঁকলো তার কপালে। উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে কেঁপে উঠলো সারা শরীর। অদ্ভুত শিহরণে আবেশিত হল কিশোরী। ফাইজান তার মাথায় আলত করে হাত বুলিয়ে বলল,
“আপনি ঘুমিয়ে যান হুমায়রা, রাত হয়েছে”
“আপনি ঘুমাবেন না?”
“ঘুমাবো, একটু হাতের কাজ বাকি”
বলেই উঠে গেলো ফাইজান। আলমারী থেকে টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করে বাথরুমে চলে গেলো। হুমায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গলার কাছে কামড়ের জায়গাটা জ্বলছে। লোকটাকে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না। সত্যি এক অদ্ভুত প্রহেলিকা সে।
******
সাদা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো ফাইজান। তার ভেজা চুলগুলো পড়ে আছে কপালের উপর। চশমাটা ভাপে ঘোলা হয়ে গিয়েছে। চশমাখানা মুছে একদফা নজর দিলো হুমায়রার দিকে। একটু কাছে গেলো নিভৃত দৃষ্টিতে আবার দেখলো মেয়েটিকে। শ্বাস প্রশ্বাস ক্ষীণ। বোঝা যাচ্ছে নিদ্রায় ডুবন্ত সে। বেগুনী আলোয় এই শুভ্রখানায় এক অলিখ মায়া জড়ানো। চোখের দৃষ্টি একটু নামতেই ফর্সা গলায় লালচে দাগটায় নজর আটকালো। নিজের কাজে নিজেই অবাক হলো ফাইজান। পোঁড়া ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে কুসুম প্রভার ন্যায় হাসি জমলো। প্রতিনিয়ত মেয়েটি তাকে ইন্দ্রজালে জড়াচ্ছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে সেই ইন্দ্রজালে সে জড়াচ্ছেও। অদ্ভুত আসক্তি তাকে ক্ষণে ক্ষণে পরাজিত করছে। ফাইজান ধীর পায়ে হেটে বারান্দায় দাঁড়ালো। পকেট থেকে একটা বেনসন বের করলো, ক্ষণিকের ধপ করে আগুনে তা জ্বালালো। ঠোঁটের ফাকে সেই জ্বলন্ত নিকোটিনের ধোঁয়া নিবৃত্ত মনে ছাড়লো। এরপর পকেটের মানিব্যাগটা বের করলো। সেখানের একটি গোপন কোটর থেকে বের করলো একটি ছবি। হাস্যজ্জ্বল প্রাণবন্ত মেয়ের ছবি। সিগারেটটা ঠোঁটে চেপে দু হাতে ছিড়ে ফেলল ছবিটা। এরপর উড়িয়ে দিলো হিনহিনে হাড়কাঁপানো উত্তরীয়া বাতাসে। এক হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে দলিত হলো সিগারেটটি। অপর হাত গুজলো পকেটে। মনে মনে আওড়ালো,
“এবার সত্যি আমি তোমাকে বিদায় দিলাম হাফসা, আমার জীবনে কিংবা হৃদয়ে তোমার স্থান অবশেষ রইলো না”
*****
হুমায়রার ঘুম ভাঙ্গলো আযানের সাথে সাথেই। চোখ মেলে পিটপিট করে চাইতেই হৃদযন্ত্রের স্পন্দন বাড়লো। উন্মুক্ত বুকে নিজেকে লেপ্টে থাকা পাবে এ যেনো অকল্পনীয়………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি