#নিশীভাতি
#১৯তম_পর্ব
শরীফা ভীষণ ব্যাস্ত। বৌভাতের সকল কিছু সে নিজেই দেখরেখ করছে, একমাত্র ছেলের বৌভাত। তাই কোনো ভুলত্রুটি কাম্য নয়। হুমায়রাকে ডেকে এনেছে শাড়ী পছন্দের জন্য। হুমায়রার একটি নীল শাড়ি বেশ পছন্দ হলো। শরীফাও তার পছন্দকেই প্রাধান্য দিলো। এর মাঝেই ঘরে প্রবেশ করলো ফাইজান। শান্ত স্বরে বলল,
“মা আমরা কাল বাড়ি ফিরছি”
ফাইজানের কথাটি ফ্যানবন্ধ, বদ্ধ ঘরে আন্দোলিত হলো। ছন্দপতন হলো যেনো শরীফার সকল পরিকল্পনার মাঝে। হতবাক নয়নে চাইলো সে। কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বললো,
“ফাইজলামির একটা সীমা থাকা উচিত”
“আমি ফাজলামি কোনোদিন করেছি বলে মনে পড়ছে না। তাই এই অভিযোগটা খারিজ করো”
“রাখো তোমার ঢং, বৌভাতের আগে কোথাও নড়ছি না আমি”
“মা, নির্বাচনের ডেট দিয়েছে। আমাকে যেতে হবে। সামনেই মনোনয়নের ঘোষণা হবে। তাই এখানে বসে থাকার মানে নেই”
“আর তোমার বৌভাত সেটা কি প্রয়োজনীয় নয় তোমার কাছে?”
ফাইজান এবার অধৈর্য্য হলো। শরীফা চিরটাকাল এমন ই জেদী। প্রায় ই ধৈর্য্যচ্যুত হয় ফাইজান অহেতুক তর্কে। কিন্তু শরীফার স্বভাব বদলাবার নয় যেন। কথায় আছে, “যার হয় না নয়ে, তার হবে না নব্বই এ”— কথাটা যেনো খেটে গেছে শরীফার জন্য। এবার ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে ফাইজান বললো,
“বৌভাত হবে না সেটা আমি কখন বলেছি? এতোটা চার ইঞ্চি বেশি বোঝো কেনো তুমি? আমি শুধু বলেছি আমরা এখানে আর থাকবো না। বৌভাত আমাদের বাসায় যেয়ে হবে”
“তোমাকে আমার এক রত্তি বিশ্বাস নেই, ভালো জানি বাড়ি ফিরতেই তুমি কাজ নিয়ে ব্যস্ত হবে। মনোনয়নের সময় তো ঢাকাই চলে যাবে”
ফাইজান কপাল চেপে নিজেকে শান্ত করলো। বিরক্তি দমালো। ধীর স্বরে মোলায়েমভাবে বললো,
“বৌভাত হলেই খুশি তো তুমি?”
“শুধু বৌভাত না, আমার তো আরোও অনেক দাবি। পুরো এগারো দফা”
“আপাতত একদফায় খুশি থাকো, ভুলে যেও না তোমার বৌমা একটা বাচ্চা”
শরীফা মুখ ফুলালেন। অপ্রসন্ন স্বরে বললেন,
“বেশ, বৌভাতেই হবে”
“মনোনয়ন প্রার্থীর ঘোষণার পর ই বৌভাত করবো। কথা দিলাম”
“সে তো অনেক দূর”
“মাত্র চারদিন মা”
“কিন্তু”
“এবার কিন্তু তুমি আমার সহ্যের বাঁধ ভাঙ্গছো। আমাকে চেনো কিন্তু তুমি, আমি ছাড়া বৌভাত পুষাবে? বৌভাতে বর থাকবে না— মানতে রাজী?”
কঠিন স্বরে কথাটা বললো। ফাইজানের চোয়াল শক্ত, দৃষ্টিতে কাঠিন্য উঁকি দিলো। শরীফা বিপাকে পড়লো। ছেলের জেদ ভালো করেই জানা। সে সত্যি সত্যি এমন কিছু করতে পারে। অসহায় চোখে তাকালো বিছানার দক্ষিন কোনে বসা নীরব অষ্টাদশীর দিকে। মেয়েটি নিলীন চোখে তখন দেখছিলো নিজের পছন্দের শাড়িটি। মুখখানায় মলিনতা। কিন্তু কিছু বলার অধিকার আছে কি না জানা নেই। শাড়ির কোনাটা শুধু দলিত হচ্ছে নরম হাতের ফাঁকে। শরীফা বেশ ইতস্তত স্বরে বলল,
“হুমায়রা, তোমার কি মত?”
“উনাকে জিজ্ঞেস করছো কেনো?”
সাথে সাথেই প্রশ্ন ছুড়লো ফাইজান। শরীফা রোষমিশ্রিত স্বরে বললেন,
“অদ্ভুত ওর মত আছে না?”
ফাইজান উত্তর দিলো না। শুধু ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ, শানিত নয়নে চাইলো হুমায়রার দিকে। হুমায়রা কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। একবার চাইলো ফাইজানের পানে। তারপর মলিন স্বরে বললো,
“আমার কোনো সমস্যা নেই মা, শুধু একটা আবদার আছে”
“বলো মা”
“আমি একটু বাড়ি যেতে চাই, যেহেতু কালই চলে যাচ্ছি। আমি সকালেই ওখানে যাবো। যাবো?”
“যাবে না কেনো মা, আমাদের ফিরতে তো দেরি হবে। অন্তত ভোটের আগে আসবো না”
হুমায়রা হাসলো। ফাইজানের মুখশ্রী ভাবলেশহীন। সে তার বক্তব্য শেষ হতেই বেরিয়ে পড়লো। হুমায়রা তার যাবার পানে চেয়ে রইলো। ছাদ থেকে ফেরার পর হুমায়রা ভেবেছিলো নানা প্রশ্নে তাকে জর্জরিত করবে ফাইজান। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। মানুষটি ভাবলেশহীন ভাবে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, যেনো কিছুই হয় নি। অথচ এখন তাকে একেবারে ভিন্ন একজন মানুষ লাগছে। একটা মানুষের কতগুলো রুপ থাকে, মাঝে মাঝে হুমায়রার মনে হয় সে মানুষটিকে বুঝে, আবার মনে হয়……
“তুমি কিছু মনে করো না কিন্তু মা”
শরীফার লজ্জিত স্বরে ভাবনার মেঘে ছেদ পড়লো। হুমায়রা সাথে সাথেই বলল,
“এভাবে বলছেন কেনো মা?”
“আসলে ফাইজান, মাঝে মাঝে ও এমন করে না। ও তোমাকে ওভাবে বলে নি, আসলে আমি ই এতো জেদ করছিলাম যে ও বিরক্ত হয়েছে”
“মা রা তো থাকেই জেদ করার জন্য। এটা তো তাদের জন্মগত অধিকার মা”
হুমায়রার মিষ্টি কথাটা শরীফার ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটলো। প্রসন্ন স্বরে বলল,
“ভাগ্যিস তুমি আমার বউ মা হলে, নয়তো কাঁচের ভিড়ে হিরে হারিয়ে ফেলতাম”
শরীফার এমন আহ্লাদগুলো লুফে নিতে ইচ্ছে হয় হুমায়রার। নিজ মায়ের কাছ থেকে এমন ভালোবাসা পাওয়া যেনো আমাবস্যার চাঁদ ছিলো হুমায়রার কাছে। আচ্ছা মাতৃভালোবাসার সংজ্ঞা কি? শরীফা নাকি জুবাইদা?
******
বড় জানালাটি খোলা। হিমশীতল বাতাস হু হু করে প্রবেশ করছে ঘরে। ছুয়ে যাচ্ছে ফাইজানের শরীর, মুখ। ফাইজানের গায়ে কোনো সোয়েটার নেই। কালো রঙ্গের হাফ হাতা একটি টি শার্ট কেবল। তবুও অনুভূতিহীন মানুষের মতো কাজ করে যাচ্ছে সে। বিছানা করতে ব্যাস্ত হুমায়রা একবার চাইলো ফাইজানের দিকে। মানুষটির চোখে চশমা, দৃষ্টিতে একাগ্রতা। অনেক জড়তা, দ্বিধা কাটিয়েই শুধালো হুমায়রা,
“আমরা কেনো এতোটা দ্রুত যাচ্ছি?”
“কাজ আছে”
ভাবাবেগশূন্য স্বরে উত্তর দিলো ফাইজান। চোখ তুললো না, সে তার কাজে ব্যাস্ত। হুমায়রা একটু সময় নিলো। নিঃসংকোচ কন্ঠে বলল,
“হুট করেই কাজ চলে আসে? এতোদিন তো ছিলো না”
এবার একটু থামলো ফাইজান। চোখ তুললো। হুমায়রার বুদ্ধিদীপ্ত চোখজোড়া উত্তরের প্রতীক্ষায় আছে। ফাইজান একটু থেমে স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“আমার ভালো লাগছে না এখানে?”
“সেটার কারণ কি আমান ভাই?”
“আপনার কি মনে হয় সেটা আপনার আমান ভাই?”
পালটা প্রশ্ন ছুড়লো ফাইজান। এবার সে কাগজগুলো ছোট টেবিলে রেখে বুকে হাত বাধলো। শানিত হলো দৃষ্টি। হুমায়রা হতচকিত হলো প্রথমে। তারপর নিষ্প্রভ স্বরে বললো,
“আপনি জানতেন, আমান ভাই আমাকে পছন্দ করে?”
“আমি আপনার সম্পর্কে জানি না এমন কিছু নেই হুমায়রা, আগেও একবার বলেছিলাম। বিশ্বাস করেন নি হয়তো”
হুমায়রা থমকালো। অষ্টাদশীর মনে জাগলো হাজারো প্রশ্ন। তার মধ্যে যেটা মস্তিষ্কে ছেয়ে গেলো সেটাই ঠোঁটে আওড়ালো,
“আমাকে কি আপনি কোনো কারণে সন্দেহ করছেন?”
“না, কখনোই না। আমি আপনাকে অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু অপর মানুষটিকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কারণ সে হিন্টস বুঝে না”
বিনা সংকোচে কথাটি বলল ফাইজান। হুমায়রা পরক্ষণেই প্রশ্ন ছুড়লো,
“কিসের হিন্টস?”
ফাইজান এবার কিছুটা বিভ্রান্ত হলো। চুপ করে রইলো কিছুসময়। কিশোরীর গতরাতে ফাইজানের কথাটি স্বরণ হলো হুট করেই,
“কালকে খোঁপা করে রাখবেন, যাতে এই দাগটি সবাই দেখতে পারে। আর বুঝতে পারে আপনি আমার সকলভাবে বৈধ স্ত্রী”—- সাথে সাথেই হাত চলে গেলো গলার নিচের লালচে অংশটায়। অভিমান ধরা গলায় শুধালো,
“এটা কি তবে শুধুই আমান ভাইকে দেখানোর জন্য?”
প্রশ্নটা যেনো ঘরের নিস্তব্ধতার সাথেই মিশে গেলো। ফাইজান এবারোও চুপ রইল। তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হলো। হুমায়রা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। আর কথা বাড়ালো না সে, মৌনতা তো সম্মতির লক্ষণ। তাই আর কোনো উত্তরের অপেক্ষা করলো না হুমায়রা। শুধু নিস্তব্ধতায় চির ধরলো কিশোরীর সদ্য পরিস্ফুটিত কিছু স্বপ্নের। সে বিছানা গুছালো। দু বালিশের মধ্যখানে বালিশের বিশাল দেওয়াল দেখে কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়লো ফাইজানের। ভরাট স্বরে বললো,
“আজ আমাদের মাঝে এই দেওয়াল কেনো? গতকাল তো ছিলো না”
“গতকাল আপনাকে এতোটা জটিল এবং ধোঁয়াশা লাগে নি তাই”
হুমায়রার কন্ঠ যেনো চুরমার করলো নীরবতা। সে শুয়ে পড়লো ফাইজানের অপেক্ষা না করেই। ফাইজান নিষ্পলক চোখে অষ্টাদশীকে দেখতে লাগলো। কপালের ভাঁজের সাথে বিরক্তিও যেনো পরিলক্ষিত হলো।
*******
এপাশ ওপাশ শুধু পাশ ফিরলো ফাইজান। ঘুম আসছে না। মাথা ব্যাথাটা বেড়েছে। পাশের মানুষটি অচিরেই ঘুমোচ্ছে। ফাইজানের শীত কম তাই জানালাটি এখনো খোলা। হিমশীতল সমীরের দোলা খাচ্ছে ঘর। সে সাথে গুটিয়ে বেড়ালের বাচ্চার মতো ঘুমিয়ে আছে হুমায়রা। ফাইজানের ইচ্ছে বালিশগুলো ছুড়ে ফেলতে। আর বুকের মধ্যিখানে টেনে নিতে এই রুপবতীকে। কিন্তু সে নিজের কথায় নিজেই আটকে গেছে। হুমায়রার অমতে কিছুই করবে না। বিরক্তিতে মুখ থেকে চ সূচক শব্দ বের হলো। মেয়েটি খুবই মোহনীয়। প্রথমে বিশ্বাস না হলেও এখন বিশ্বাস হচ্ছে মেয়েটি বাদে তার ঘুম আসবে না। হাফসার মৃত্যুর পর থেকে নির্ঘুম রাত কাটানো যেনো অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। চোখ বুঝলেই বিভীষিকার মতো চোখের সামনে ভাসতো অপ্রীতিকর কিছু দৃশ্য। কত শত রাত নির্ঘুম কেটেছে নিজেও জানে না। হয়তো গুরুত্ব দেয় নি সে। কাজে মগ্ন থেকেছে। ভুলতে চেয়েছে। কিন্তু গতকাল যখন দীর্ঘকাল বাদে নির্বিঘ্নে ঘুমিয়েছে তখন বেশ অবাক হলো ফাইজান। ঘুমের ঔষধহীন, এন্টি ডিপ্রেশনহীন তার ঘুম এসেছে। প্রথমে যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলো, অনেক ক্লান্ত সে তাই ঘুমিয়েছে। কিন্তু আজও সে ক্লান্ত। কই ঘুম তো আসছে না। তাই নিশ্চিত হলো তার ঘুমের কারণটি পাশে নিদ্রারত এই কিশোরী। জীবন্ত ঘুমের ঔষধ সে। ফাইজান উঠে বসলো। টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটি পুরলো পকেটে। কম্বল টেনে দিলো হুমায়রার গলা অবধি। খুব আস্তে বললো,
“আপনি কেবল ই আমার ঘুমের মাধ্যম, আর কিছুই নন হুমায়রা”
******
নিগূঢ় রাত। নিশ্বাসের সাথে ধলা পাকানো সাদা হাওয়া বাতাসে মিলাচ্ছে। ঠান্ডা ভালোই পড়েছে। রাশাদ হাত ঘষছে। ইলহার ঘরে সেদিন গুইশাপ ঢুকেছে। তাই রাতে একটু ব্যাবস্থা করতে ইলহার ঘরের কাছে এসেছে সে। হঠাৎ ই কানে এলো মিহি ক্রন্দনের আওয়াজ, ইলহা কাঁদছে কি……………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি