#নিশীভাতি
#২১তম_পর্ব
এর মাঝেই খুব বিভ্রান্তভাবে প্রবেশ করলো ফরিদ। তাকে চিন্তিত ঠেকলো ফাইজানের কাছে। কিছু শুধাবার আগেই সে কানে কানে বললো,
“ফুপু ফোন দিছে, হুমায়রা নাকি হাসপাতালে”
ফরিদের কথায় স্থির নয়নে চাইলো ফাইজান। খুব শান্ত, গম্ভীর গলায় শুধালো,
“কি হয়েছে?”
“ও দিকে আজ দাঙ্গা হয়েছে। ফুপু আর হুমায়রা বেরিয়েছিলো কিছু সময়ের জন্য। ওরা জানতো না ঝামেলাতে পড়তে হবে। গাড়ি ভাঙচুর করেছে তাদের। একটা সময় পুলিশ ও আসে। ভিড়, হৈহল্লা; এর মাঝে হুমায়রা সেখানে পড়ে যায়। তখন মানুষের ছোটাছুটি আর হাঙ্গামার মধ্যে পদলিত হয়ে হুমায়রা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। শোল্ডার ডিসলোকেট হয়ে গেছে নাকি”
ফাইজান এখন স্থির। তার মুখবিবরে খুব একটা পরিবর্তন দেখা গেলো না। নির্লিপ্ত, আবগেহীন, অনুসক্ত মুখশ্রী। ফরিদ জানতো এমনই হবে। ফাইজান এই সংবাদে থাকবে নিষ্ক্রিয়। তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষিত হবে না। যে পুরুষ তার প্রেয়সীর জানাযা পড়েই কার্যালয়ে যেতে পারে সমাবেশের জন্য তার কাছে কিছু আশা করাটাও খানিকটা বোকামি। তবুও এই বোকামিটা জেনে বুঝেই করলো ফরিদ। ভেবেছিলো, মানুষতো বদলায়। হয়তো ফাইজান ইকবাল ও বদলাবে। ফরিদ কয়েক পল অপেক্ষা করলো। ফাইজানে উত্তর না পেলে সে বেরিয়ে যেতে নিলে ফাইজান গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো,
“এখন থেকে আধা ঘন্টায় রওনা দিলে কখনের মধ্যে পৌছাবো?”
“সন্ধ্যার আগে আমি পৌছে দিতে পারবো”
“ঠিক আছে তুমি গাড়ি রেডি করো”
ফরিদ যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। অবাক স্বরে শুধালো,
“হ্যা?”
“এক কথা বার বার বলা আমার অপছন্দ ফরিদভাই, বললাম, গাড়ি রেডি করতে”
ফরিদ এখনো পরিস্থিতিতে ধাতস্থ হতে পারলো না। কিন্তু মূর্খের মতো দাঁড়িয়ে রইলো না। ছুটে বেরিয়ে গেলো। ফাইজানের উত্তরটি যদি এমন হতো, “তো আমি কি করবো? আমি তো ডাক্তার নই”— হলেও হয়তো এতোটা অবাক হতো না ফরিদ। মনে মনে দুটো গালি দিয়ে নিজের কাজে চলে যেত। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। এদিকে কেতাব চৌধুরী, পায়ের উপর পা তুলে রাশভারী শ্লেষ্মাজড়িত স্বরে শুধালেন,
“যে মানুষের নিজের পদের মূল্য নাই, সে পদ পাবার যোগ্য ও না”
ফাইজান মৃদু হাসলো। কথাটা তাকে ইঙ্গিত করেই করা হয়েছে। ফাইজান ধারালো স্বরে উত্তর দিলো,
“সেটা না হয়, মান্য ব্যাক্তিরাই সিদ্ধান্ত নিক”
দশ মিনিটের অন্তরে প্রেসের শত ক্যামেরা আর মাইকের সামনে প্রার্থীদের নাম ডিকলিয়ারেশন শুরু হলো। পঞ্চগড় -১ , পঞ্চগড়- ২ ……… একে একে সকলের নাম উচ্চারণ করা শুরু হলো। নিজ জেলার নাম আসতেই কেতাব চৌধুরী যেনো একটু নড়ে চলে বসলেন, একটু ঝুকে এলেন যেনো তার নামটি শুনতে পারেন। কিন্তু সব মিথ্যে করে দ্বিতীয় বারের মতো আসন- ৩ এর প্রার্থী হল “ফাইজান ইকবাল”। নিজের নাম শোনা মাত্র পোঁড়া ঠোঁটে বিজয়ী হাসি উন্মোচিত হলো। এক মুহূর্ত বসলো না সে। উঠে দাঁড়ালো সে। কেতাব চৌধুরী তার হার যেন সইতে পারলো না। অনেকটা ফাইজানকে ধাক্কা দিয়েই সে বেরিয়ে গেলো। ফাইজান বুঝলো বুড়ো ঘোড়া আবার ক্ষেপেছে।
পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম.এ ভুঁইয়ার কাছে গেলো ফাইজান। বাবার আন্তরিক বন্ধু থাকার বদৌলতে তিনি ফাইজানকে দেখলেই মিষ্টি হাসি দিয়ে কুশল বিনিময় করলো,
“কংগ্রেচুলেশন ইয়াং ম্যান। দ্বিতীয়বারের মত সংসদ আসন পাচ্ছো”
“থ্যাংক ইউ স্যার। আপনারা ছাড়া তো সম্ভব হতো না”
“নো নো, আসলে এবার ইয়াং মানুষদের ই আমরা ফর্মে আনতে চাচ্ছি। ইউ আর ভেরি ক্যাপেবল। তাই তোমাকে বাঁছবে এটাই স্বাভাবিক। যদি কেতাব পার্টির উপর বেশ ক্ষেপে আছে। বাট তারও বুঝতে হবে। ওর যে স্ক্যান্ডালগুলো আছে তার পর পার্টি রিস্ক নিবে না। তাই তোমার সিট কেউ নিচ্ছে না আগামী ভোট অবধি”
ফাইজান শুধু মাথা নাড়ালো। ভুঁইয়া সাহেবের কথা শেষ হবার অপেক্ষা করছে শুধু। ভুঁইয়া সাহেব বললেন,
“কাল মিটিং এ থাকছো তো?”
“স্যার, বোধ হয় আমি থাকতে পারবো না”
“হোয়াই?”
ভুঁইয়া সাহেবের কপালে ভাঁজ পড়লো। ফাইজান শান্ত স্বরে বললো,
“আমার ওয়াইফ হাসপাতালে স্যার, ও ইনজিউরড”
“কিভাবে?”
“পুরো ডিটেইলস আমিও জানি না, তবে এটা প্লানড মনে হচ্ছে। সো আই হ্যাভ টু গো”
“ফাইজান, আই নো। তোমার স্ত্রী হাসপাতালে। কিন্তু এই মিটিং এ না থাকলে একটা খারাপ ইম্প্রেশন পড়তে পারে”
“আই নো স্যার। বাট, আই হ্যাভ টু গো নাও।“
“ওয়েল তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, বুঝে শুনে আগাও”
ফাইজান স্মিত হাসলো। ভুঁইয়া সাহেব কি বুঝাতে চাইলো বুঝতে বাকি রইলো না তার। কিন্তু সে একটিবারের জন্য দাঁড়ালো না। দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে গেলো। অফিস থেকে বের হয়েই গাড়িতে উঠলো সে। ফরিদ গাড়িতেই অপেক্ষা করছিলো। ফাইজান বসতেই সে গাড়িতে স্টার্ট দিলো। পিচঢালা রাজপথ চিরে গাড়ি চলতে লাগলো ১০০ কিলো মিটার স্পিডে। রোদ এসে ভিড়লো শ্যাম মুখে। চশমার আড়ালে চোখজোড়ায় অবর্ণনীয় অস্থিরতা যেন। গম্ভীর স্বরে শুধু বলল,
“আমার ডিটেইলস চাই ফরিদ ভাই”
“পেয়ে যাবে”
******
হুমায়রার জ্ঞান ফিরলো যখন, আকাশ তখন কালচে রঙ্গে ঢাকা। ঝিরিঝিরি বর্ষার মাতাল ধ্বনি কানে আসছে। হাত বাধা বুকের সাথে। কাঁধে অসামান্য ব্যাথা। যে ব্যাথায় তার ফর্সা মুখখানা নীল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। চোখজোড়াও সাক্ষী দিচ্ছে যন্ত্রণার। ঘুমের ঔষধের রেশ এখনো কাটে নি। নিজের অবস্থান মস্তিষ্ক ধাতস্থ করতেই নাকে এলো বিশ্রী ফিনাইলের গন্ধ। নাক, মুখ কুচকে হুমায়রা পাশ ফিরতেই চোখ বুজে থাকা পুরুষের দর্শন পেলো। মানুষটি ঢাকায় ছিলো না? তাহলে এখানে কিভাবে? একটু নড়তে নিলেই ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠলো সে। সাথে সাথেই চোখ মেললো ফাইজান। ধীর স্বরে বললো,
“কিছু লাগবে?”
“ক’টা বাজে?”
“রাত এগারোটা”
আশপাশ দেখে মোটেই মনে হয় নি এখন এতো গভীর রাত। হুমায়রা একবার চাইলো বারিসিক্ত থাই গ্লাসের দিকে। মনে হচ্ছে কেবল সন্ধ্যার সূচনা। শ্বাশুড়ির কথা মনে পড়তেই ফাইজানের দিকে চাইলো, কিন্তু কিছু বলার পূর্বেই সে উত্তর দিলো,
“মাকে বাড়ি পাঠিয়েছি। মানুষটা ক্লান্ত ছিলো”
“আপনিও তো ক্লান্ত”
“মিথ্যে বলবো না, ক্লান্তি আছে। কিন্তু তার বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। এখন দুশ্চিন্তাটা নেই। তাই ক্লান্তিটা গায়ে লাগছে না”
“আপনি আমার জন্যই ছুটে এসেছেন?”
ফাইজান উত্তর দিলো না। শুধু হাসলো নিঃশব্দে। সে নিজেও জানে না সে কেনো এতোটা জোরে গাড়ি হাকিয়ে এসেছে, সে নিজেও জানে না আজ সে তার স্বভাবের ব্যতিক্রম কাজ কেনো করলো। কিন্তু ওই মুহূর্তে তার মস্তিষ্কে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। অদৃশ্য একটা ভয় তাকে কাবু করছিলো। যা নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো যখন হুমায়রা মেয়েটির শান্ত মুখশ্রী দেখলো। নিজের এমন অদ্ভুত আচারণে সে হতবাক হলো। কোনো যুক্তি দাঁড় করাতে অক্ষম হলো। পরমুহূর্তে হুমায়রার পরিবার এবং মাকে যুক্তি রুপে দাঁড় করালো। ফাইজান উঠে দাঁড়ালো। একটু খুলে দিলো বেডের পাশের জানালাটি, আদ্র বায়ু এসে ঝাপটে পড়লো তার শ্যামমুখে। মিহি স্বরে শুধালো,
“আজ আপনাকে স্যুপ খেতে বলেছে। আমি আনিয়ে রেখেছি”
“আমার অই পানি ভালো লাগে না”
তারপর হুমায়রা অস্থির স্বরে বলল,
“আপনি উত্তর দিলেন না”
“যদি বলি আমি আপনার জন্য এসেছি, বিশ্বাস করবেন?”
হুমায়রা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। মিথ্যে বলবে না, তার বিশ্বাস হয় নি। কিন্তু অজানা শিহরণে হৃদয় কাঁপছে। ফাইজান হুমায়রার লজ্জামিশ্রিত মুখশ্রী একপলক দেখলো। তারপর কাছে যেয়ে বসলো ঠিক তার পাশে। এলোমেলো অবিন্যস্ত চুলগুলো সযত্নে খোঁপায় বাঁধলো সে। হুমায়রা তার দিকে চাইলো বিমূঢ় দৃষ্টিতে। ফাইজান তখন মোলায়েম স্বরে বলল,
“আমি নিজেও জানি না, কেনো এসেছি। তবে আমার ভয় হচ্ছিলো। হয়তো আপনার জন্যই ভয় হচ্ছিলো”
“আপনি এতো জটিল কেন বলুন তো? আমি বারবার আপনাকে বুঝতে যেয়েও হতাশ হই”
হুমায়রা নতদৃষ্টিতে কথাটা বলল। ফাইজান আলতো করে তাকে উষ্ণ গাল ছুঁলো। চুলে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
“আমি জটিল নই হুমায়রা। হয়তো আমি অনুভূতি প্রকাশে খুব কাঁচা কিন্তু খুব জটিল নই। তাই এই চিন্তা ছেড়ে খেয়ে নিন”
“দিন”
“আপনার ডান হাত বাঁধা, আমি খাইয়ে দিচ্ছি”
“অহেতুক কেন কষ্ট করবেন?”
“আপনি আমার স্ত্রী হুমায়রা, আপনার যত্ন করা আমার দায়িত্ব। যেমনটা আমি না চাইতেও আমাকে কফি করে খাওয়ান”
ব্যতিক্রমধর্মী ফাইজানকে আবিষ্কার করলো যেনো হুমায়রা। মানুষটিকে সে সত্যি বুঝে না। মাঝে মাঝে ভাবলেশহীন, মাঝে মাঝে খুব যত্নশীল। কোনটা তার আসল রুপ! সত্যি বুঝতে পারছে না হুমায়রা। চিন্তার পরদে আদ্র বাতাসে চোখ বুজে এলো হুমায়রার। কাঁধের ব্যাথা কম লাগছে। এখন তীক্ষ্ণ ব্যাথাটা হচ্ছে না। কখন যে ঘুমে তলিয়ে গেলো টের পেলো না।
*****
নিন্মচাপ, সাথে শ্বৈত্যপ্রবাহ। তাপমাত্রা ক্রমশ কমছে। সেই সাথে উত্তরীয়া শীতের প্রকোপ বাড়ছে। কম্বলের ওমের ভেতর হাত ঘষছে ইলহা। প্রকৃতি আজ আদ্র। মাটির ঘরে ঠান্ডা বেশি লাগে। মেঝেও মনে হয় ভিজে আছে। মোটা একটা শাল জড়িয়ে বের হলো ইলহা। কুয়াশার পরদে ভোরের আলোকেও তুচ্ছ লাগছে। এর মাঝেই বুটের শব্দ কানে এলো। সেই সাথে তীক্ষ্ণ স্বর,
“রাশাদ সাহেব বাড়ি আসেন? রাশাদ সাহেব?”
মোটা শাল পেঁচিয়ে বের হলো রাশাদ। সিভিল ড্রেসের অপরিচিত মানুষগুলোকে চিনতে কষ্ট হলো। সন্দিহান স্বরে শুধালো,
“কে আপনারা?”
“আমাদের চিনবেন না, কিন্তু আমাদের কাছে আপনার বিরুদ্ধে রিপোর্ট এসেছে। ব্যাবসায়ী আকিব শাহরিয়ারের একমাত্র মেয়েকে অর্থলোভে জিম্মি করে রেখেছেন। সত্যি কি?”………………
চলবে
(বইটই তে আমার সকল ই-বুক এবং বইয়ে যাচ্ছেন ৪০% ছাড়ে। “MOITHI40” প্রমোকোড ব্যাবহার করলেই ২৪ টাকায় পেয়ে যাবেন “অনুরক্ত ক্যানভাস”, ৩৬ টাকায় “চাঁদ বলে হাতটি ধরো” এবং ৫১ টাকায় “তন্দ্রাবিলাসী” বইটি পেয়ে যাবেন। তাই দেরি না করে লুফে নিন সুযোগ)
মুশফিকা রহমান মৈথি