#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৭
#আদওয়া_ইবশার
মানুষের জীবন কখন কোন দিকে মোড় নেয় কেউ বলতে পারেনা। সুখ, দুঃখ এই দুটো জিনিস মনে হয় একে অপরের পরিপূরক। না হয় কি সুখের মুহূর্ত গুলো শেষ হতে না হতেই মানব জীবনে দুঃখ এসে হাজির হতো? শিকদার মঞ্জিলের বিয়ের সাজ এখনো মুছেনি। চারিদিকে এখনো উৎসবমোখর আমেজ। সেই আনন্দঘন মুহূর্ত শেষ হবার আগেই ঝুমঝুমিয়ে ঝরে পরল দুঃখের বর্ষণ। যেই কালো অতীত মা-ছেলের মাঝে দূরত্বের দেয়াল সৃষ্টি করেছিল। আজ সেই দেয়াল ভাঙ্গতে না ভাঙ্গতেই সেই কালো অতীত আবারও হানা দিল। সুখের সানাই শেষ হবার আগেই বেজে ওঠল দুঃখের সানাই।
আজীজ শিকদার কোনো যুক্তি, তর্ক দেখিয়েও ছেলেকে আটকে রাখতে পারেননি। বিভীষিকাময় ঘুমিয়ে থাকা সেই অতীত জাগ্রত হয়ে নিয়ে গেল চৌদ্দ শাকের ভিতর। বিবশ চোখে চেয়ে দৃষ্টি শুধু দেখে গেল তার প্রণয় পুরুষ, যে পুরুষের প্রেমে মজে পরিবার ছেড়ে এতোদূর এসেছে, হাজার লাঞ্চনা সহ্য করছে সেই পুরুষের হাতে হায়কড়া পরিয়ে পুলিশ খুনের আসামী হিসেবে নিয়ে গেল। রেহানা বেগম ছেলের এমন বিপদে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। ছেলের শোকে কান্নায় মূর্ছা যাবার অবস্থা। একদিকে পুরোনো কেসের সূত্র ধরে ছেলেকে নিয়ে গেল পুলিশ, অন্যদিকে পুত্রবধূর থমকানো চেহারা, স্ত্রীর কান্না, সব মিলে আজীজ শিকদার দিশাহারা। কি রেখে কি করবে, কাকে সামলাবে মস্তিষ্ক ঘেটে গিয়ে কিছুই ঠাহর করতে পারছেনা। প্রায় আড়াই বছর পর কেনই বা শেষ হয়ে যাওয়া কেস আবার শুরু হলো সেটাও ভেবে পাচ্ছেনা। জেরিনের বাবার বাড়ির লোক বলতে তো একমাত্র জেরিনের মা, মামারা আছেন। ওনারা যদি আড়াই বছর আগের রায়ে সন্তুষ্ট না থাকতেন তবে কি আরও আগেই এই কেস নতুন করে শুরু করার কথা ছিলনা?বছরের পর বছর চলে যাবার পর তারা কেন এটা নিয়ে পরবে? এর পিছনে কি অন্য কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে?পেছন থেকে কি অন্য কেউ কলকাঠি নাড়ছে?একের পর এক ভাবনায় মস্তিষ্ক অসাঢ় আজীজ শিকদারের। তবুও কোনো সুরাহা করতে পারছেনা।
“বাবা! ওনি কি সত্যিই খুন করেছিল?”
ভাবনার অতলে ডুবে থাকা আজীজ শিকদার হুট করে পুত্রবধূর মুখে এমন একটা প্রশ্নে থমকে যায়। শীতল চোখে কতক্ষণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করে মেয়েটার মনে কি চলছে। কিন্তু ব্যর্থ হয় আজীজ শিকদার। কেমন যেন প্রাণহীন হয়ে গেছে মেয়েটা। চোখের সামনে স্বামীকে এভাবে ধরে নিয়ে যেতে দেখেও কান্না দূরের কথা, কোনো নড়চড় পযর্ন্ত করেনি। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে আজীজ শিকদার প্রবল আত্মবিশ্বাসী স্বরে বললেন,
“যে হাত দেশের জন্য অস্ত্র ধরেছে, অসহায় মানুষের দুঃখ মুছে দিয়েছে,অনাহারীর মুখে খাবার তুলে দিয়েছে,সেই হাত কখনো খুন করতে পারেনা। আমার ছেলে খুনি না।”
“তবে কেন সবাই বলে নিজের স্ত্রী,ভাইকে খুন করেছে রক্তিম শিকদার? কেন খুনি বলে মানুষজন তাকে?খুনের দায়ে আজ কেনই বা পুলিশ ধরে নিয়ে গেল? এতো ধোয়াশার মাঝে আমাকে কেন রাখছেন আপনারা? আমার স্বামীর সম্পর্কে জানার অধিকার কি আমার নেই? কি সেই অতীত, যে অতীতের সূত্র ধরে আজ আমার স্বামী খুনি? সে যদি খুন না করেই থাকে তবে আপনার ছেলে সংগ্রাম কিভাবে মারা গেছে? আর আপনার বড় ছেলের প্রথম স্ত্রী! ওনিই বা কিভাবে মারা গেছে? দয়া করে আমাকে আর ধোয়াশার মাঝে রাখবেন না। আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”
নিস্তেজ কন্ঠস্বর একসময় চওড়া হয় দৃষ্টির। প্রতিটা কথায় তার অতীত জানার প্রবল জেদ। যে অতীতের জন্য রক্তিম শিকদারকে স্বামী হিসেবে পেয়েও পেলনা সেই অতীত আজ যেকোন মূল্যে সে জানবেই। পুত্রবধূর এমন দৃঢ় স্বরের প্রশ্নে একটাও ঘাবড়ায়না আজীজ শিকদার। কন্ঠস্বর আগের থেকেও নরম করে বলে,
“ঠিক সময়ে সব জানতে পারবে মা। একটু ভরসা রাখো এই বাবার উপর। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে, খুব বেশিদিন আমার ছেলেকে আমি জেল খাটতে দিবনা। সঠিক সময়ে সবার সামনেই সব সত্য প্রকাশ পাবে।”
“কোন সত্য?” জানতে চায় দৃষ্টি। আজীজ শিকদার দৃষ্টির মেঝের দিকে রেখে গম্ভীরভাবে বলে ওঠে,
“যে সত্য এতোদিন নিজের মাঝে চেপে রেখেছি। সেই সত্য।”
****
কোনো ঘটনা ঘটতে দেরি হলেও রটতে দেরি হয়না। ঝড়ের গতিতে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পরেছে পুরোনো কেসের দায়ে রক্তিম শিকদারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কথাটা পুরো এলাকায় জানাননি হতে হতে একসময় পৌঁছে দৃষ্টির খালা শিউলি বেগমের কানে। সেখান থেকে ময়মনসিংহ খবর পৌঁছাতে খুব একটা সময় লাগেনা। সাদেক সাহেব, দিলশান আরা দুজনেই এমন একটা খবর শুনে স্থির থাকতে পারেনি। সেদিনই ছুটে আসে সাভার মেয়ের কাছে। বাবা-মায়ের দেখা পেয়ে এবার যেন দৃষ্টির ভিতরে চলা ভাংচুর প্রকাশ পায় চোখের জলে। মায়ের পায়ের কাছে বসে করুণ আর্তনাদের সাথে বলতে থাকে,
“তোমার অমতে সেদিন ওনাকে বিয়ে করাই তুমি আমাকে অভিশাপ দিয়েছিলে মা? তোমাকে কাঁদিয়ে আমি একটুও ভালো নেই মা। বিয়ের পর থেকে একটা রাতও আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারিনি। তুমি তো মা! আমি না হয় একটা ভুল করেই ফেললাম। ক্ষমা করে দাওনা আমাকে! আমি আর নিতে পারছিনা এসব। এই অভিশপ্ত জীবনের বোঝা আর বইতে পারবনা। ঐ মানুষটাকে আমি আমার জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। কখন কিভাবে এতোটা ভালোবাসলাম জানিনা আমি। শুধু এটুকুই জানি ঐ মানুষটা ছাড়া আমি নিজেকে কল্পনা করতে পারিনা। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। আমার স্বামী খুনের দায়ে জেলে। কথাটা ভাবতেই আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মা। ভিতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।মেনে নাও না মা! ক্ষমা করে দাও আমাদের। তুমি ক্ষমা না করলে আমি কখনো শান্তিতে সংসার করতে পারবনা।”
মেয়ের করুণ আর্তনাদে দিলশান আরা’র কঠোর হৃদয় কেঁপে ওঠে। কেঁদে ওঠে মাতৃমন। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় কান্নারত মেয়ের মুখের দিকে।মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানেই মেয়েটা শুকিয়ে কি অবস্থা হয়েছে! চোখের নিচের কালো দাগেই প্রমাণ করছে নির্ঘুম রাত কাটানোর। চেহারায় সেই আগের লাবন্যতা আর নেই। আঠারো বছর বয়সেই মনে হয় পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের কোনো এক সংসার সামলানো ক্লান্ত নারী। যার দিন শুরু হয় সংসার নামক জাতাকলে পৃষ্ঠ হতে। একমাত্র আদরের মেয়ের এমন করুণ পরিণতি মানতে পারেনা দিলশান আরা। বিয়ে থেকে শুরু করে এখন পযর্ন্ত জমে থাকা সমস্ত রাগ, ক্ষুব বেরিয়ে আসে ঝাঝালো কথার তোরে। দৃষ্টিকে মেঝে থেকে টেনে তুলে দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে বললেন,
“ভালোবাসার মানুষের কাছে সুখে থাকতে এসে এখন কেন এমন দশা তোমার? স্বাস্থ্যের অবনতি, চোখের নিচে কালি, চেহারায় বয়সের ছাপ এসব কেন? কেন চেহারা থেকে সুখ উপচে পরার বদলে দুঃখ ঝড়ছে অশ্রু হয়ে? কিসের কমতি রেখেছিলাম তোমার? টাকা-পয়সা, খাবার-পোশাক, ভালোবাসা কিসের অভাব ছিল আমার ঘরে তোমার? কোন সুখের আশায় এই জীবন বেছে নিয়েছো?একটু খুনির কাছ থেকে কি সুখ আশা করো তুমি যা আমরা দিতে ব্যর্থ! উত্তর দাও। উত্তর দাও আমার প্রশ্নের।”
কোনো প্রতিত্তোর করতে পারেনা দৃষ্টি। চুপচাপ মাথা নত করে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। কান্না ছাড়া যেন এই মুহূর্তে তার মাঝে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মেয়ের নিরবতায় ক্ষেপে যায় দিলশান আরা। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে দৃষ্টির বাহুতে চাপ প্রয়োগ করে আবারও চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
“কথা বলছোনা কেন? উত্তর দাও আমার প্রশ্নের। আর যদি উত্তর না থাকে তোমার কাছে, তবে আজ এই মুহূর্তে ঐ খুনির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমার সাথে যেতে হবে তোমার। হয় আমাকে তোমার সুখ দেখাও না হয় সম্পর্ক চুকিয়ে নাও।”
সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা শুনে দৃষ্টি সহ আজীজ শিকদার, রেহানা বেগম সকলেই চমকে ওঠে। প্রতিবাদ করে ওঠে আজীজ শিকদার,
“এসব কি ধরনের কথা আপা! সম্পর্ক ছিন্ন করবে মানে কি? বিয়ে কি কোনো ছেলে খেলা, যে ইচ্ছে হলো খেলল আবার ইচ্ছে হলো খেলা শেষ করে দিল? সেই প্রথম দিন থেকে আপনি বারবার আপনার কথায় নিজেকে ভুল প্রমাণ করে আসছেন। একজন সম্মানিত কলেজের প্রভাষক হিসেবে এমন কথা-কাজ আপনার মানায়না।”
“সাধারণ জনতা ভেবে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পরিবারের অমতে একটা মেয়েকে জোর করে নিজের খুনি ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়াটা কি একজন এমপি হিসেবে আপনার মানায়? অন্য কারো দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিকটা ভেবে নিবেন। না হয় নিজের জালে নিজেই ফাঁসবেন। ভাববেন না আমার সাথে অন্যায় করে পাড় পেয়ে গেছেন দেখে সব জায়গায় পাড় পেয়ে যাবেন।”
চোখ বুজে সবটা হজম করে নেয় আজীজ শিকদার। ভুল সত্যিই আজীজ শিকদার নিজেও করেছে। আসলেই দিলশান আরা’কে প্রশ্নবিদ্ধ করার আগে নিজের দিকে তাকানো উচিৎ ছিল। খুব বড় মুখ করে তো দাপট দেখিয়ে মেয়েটাকে ছেলের বউ করে এনেছিল। কিন্তু দুঃখ ছাড়া কিছুই দিতে পারলনা আজ পযর্ন্ত মেয়েটাকে। অথচ জীবনে প্রথম ক্ষমতার অপব্যবহার করে দাপট দেখিয়ে মেয়েটার ভালোবাসার পূর্ণতা দেবার জন্যই নিজের ছেলের সাথে জড়িয়েছিল। ভেবেছিল মেয়েটাও সুখী হবে পাশাপাশি ছেলেটাও হয়তো এবার বদলে যাবে।
“মনের সুখ সবথেকে বড় সুখ মা। আমার রূপ লাবন্যতা দিয়ে কি হবে, যদি আমার মনেই শান্তি না থাকে? ঐ মানুষটার সাথে আমি সুখে আছি। ভালো আছি। মনের দিক থেকে আমি তৃপ্ত। আত্মতৃপ্তি ছাড়া আমি আর কিছুই চাইনা মা। তুমি দয়া করে আর কখনো এসব কথা বলবেনা। খুনি হোক আর যায় হোক। ঐ খুনি রক্তিম শিকদারটাকেই আমি ভালোবাসি। যেখানে পুরো মানুষটাকেই আমি ভালোবাসি, সেখানে তার খুনের অপবাদে কিভাবে আমার ভালোবাসা বদলে যাবে? একমাত্র মৃত্যু ছাড়া ঐ মানুষটার জীবন থেকে আমি কখনো সরবনা মা। তুমিও দয়া করে আমাদের আলাদা করার বৃথা চেষ্টা করোনা। আমাকে ক্ষমা করতে না পারো, সুখী হবার দোয়া করতে না পারো, কোনো অভিযোগ তলবনা তোমার প্রতি। তবুও দয়া করে দুজনকে আলাদা করার বৃথা চেষ্টা করোনা।”
চলবে…..