#চন্দ্রাণী (২৮)
বাহিরে ভীষণ হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। অনেক মানুষের চিৎকার, হৈহল্লা ভেসে আসছে।চন্দ্র টগরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে।তার এই ছোট্ট জীবনে এতটা ভয় সে পায় নি এর আগে।ঝুঁকি সে অনেক বারই নিয়েছে।কিন্তু কখনো এভাবে ভয় পায় নি।টগর চন্দ্রকে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো, “আপনার কোথাও লাগে নি তো?”
চন্দ্রর দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছিলো। টগর শক্ত করে চন্দ্রর হাত ধরে বললো, “একবার আপনাকে হারিয়েছি।এবার যখন ফিরে পেয়েছি তারপর আর হারাতে দিবো না।এই শূন্য সংসার আপনি ফিরে এলেই পরিপূর্ণ হবে। আমার এই অন্ধকার ঘরে আপনিই হবেন আলোকবর্তিকা।”
চন্দ্র কিছুই বুঝতে পারছে না। সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। দরজায় করাঘাত শুনে টগর চন্দ্রর হাত ধরে দরজা খুলতে গেলো। নির্ঝর বললো, “স্যার,ও পালিয়েছে। একজন মহিলা ছিলো মনে হয়, তার ওড়নার কিছুটা… ”
নির্ঝর কথা শেষ করতে পারলো না। চন্দ্রকে টগরের সাথে দেখে হুট করে চমকে উঠলো।
চন্দ্র বুঝতে পারছে না সে আর কতো অবাক হবে!
তাহলে ইন্সপেক্টর ও জানতো টগর যে সি আই ডি অফিসার?
অথচ এমন ভাবে অভিনয় করে গিয়েছে যেনো একে অন্যের শত্রু তারা!
টগর মুচকি হেসে বললো, “আপনার ভাবী,অবাক হচ্ছেন না-কি?”
নির্ঝর হেসে বললো, “উনি যে ভাবী হবে তা আমি অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু এতো শীঘ্রই ভাবী হবেন তা ধারণা করতে পারি নি।শুভ কাজটা সারলেন কবে?আমার রাস্তা তাহলে ক্লিয়ার করে দিলেন?”
চন্দ্রর মাথায় কারো কোনো কথা ঢুকছে না।তার চোখ নির্ঝরের হাতে থাকা ওড়নার অংশে নিবদ্ধ হয়ে আছে।
প্রদীপের নিচে কি অন্ধকার তাহলে!
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চন্দ্র বের হয়ে এলো। হনহনিয়ে বাড়ির দিকে যেতে লাগলো। পিছনে টগর ও এলো চন্দ্রর পিছু পিছু।
একবারের জন্য ও চন্দ্র পেছনে তাকালো না।তালুকদার বাড়ির সামনে আসতেই টগর থেমে গেলো।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে টগর বাড়ি ফিরে গেলো।
নির্ঝর বসে আছে সোফায়। টগর ফিরতেই নির্ঝর বললো, “স্যার…”
টগর বললো, “আপনি এখন আসুন অফিসার।আমার একটু ভাবনা চিন্তা করার সময় লাগবে।আগামীকাল কথা হবে।”
নির্ঝর আর টগরকে বিরক্ত না করে চলে গেলো সেখান থেকে। টগর বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। মাথা ব্যথা করছে তার।সব ব্যথা চাপিয়ে সবচেয়ে ভাবাচ্ছে চন্দ্রর ব্যাপারটা। চন্দ্র!
তার চন্দ্র?
এই সেই চন্দ্র যে কি-না তার বউ?
কখনো কি টগর ভেবেছিলো তাকে আবারও ফিরে পাবে?
ভাবে নি!
টগর ভেবেছিলো সে সারাজীবন তার কল্পনা হয়েই থেকে যাবে।মনে কতো আকাঙ্ক্ষা ছিলো টগরের একটা বার তাকে দেখার।একটা বার জানার যে কে ছিলো সে-ই মেয়ে!
অথচ জানতে পারে নি টগর সে কি-না তার সামনেই ছিলো।
আজ সব কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে।টগর চন্দ্রর ভাবনা ভাবতে গিয়ে সব ভুলে গেলো। তার মাথার উপর কি বিপদ তাও টগর ভুলে গেলো।
কানিজ ডাইনিং টেবিলের সামনে এলো।ভাইজান বসে আছেন গম্ভীর হয়ে। কানিজ বললো, “ভাইজান,আমি চলে যাবো।”
কাদের খাঁন নরম সুরে বললো, “আজকের দিনটা থেকে গেলে হয় না?
আজকেও ও কি তোর পুরনো রাগ ধরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে? ”
কানিজ বললো, “আমি শপথ করেছি ভাইজান। যে জাহান্নামে তোমরা আমাকে ফেলেছো সেই জাহান্নামে আমি আজীবন জ্বলে পুড়ে মরবো তবুও তোমাদের কাছে এসে থাকবো না।তোমাদের অহংকার যেমন তোমাদের কাছে সবার আগে আমার শপথ ও আমার কাছে।”
কাদের খাঁন একটা হতাশার নিশ্বাস ফেললো। সরকারি চাকরিজীবী জামাই পেয়ে খোঁজ খবর না নিয়ে কানিজকে বিয়ে দিয়েছিলো।
বিয়ের পর আস্তে আস্তে জানতে পারে মানুষ নামের পিশাচের কাছে বোনকে দিয়েছে।
পান থেকে চুন খসলেই কানিজের গায়ে হাত তুলতো ওরা।কতো বার গিয়েছিলেন কানিজকে ফিরিয়ে আনতে ওদের বাড়ি থেকে, পারেন নি।কানিজ প্রতিজ্ঞা করেছিলো মরে গেলে ওই বাড়িতে মরবে তবুও আর বাবার বাড়ি আসবে না।
তারপর?
একে একে তিনটা কন্যা সন্তানের জন্ম দিলো কানিজ। আর কানিজের শাশুড়ী কন্যা সন্তান হওয়ার অপরাধে তিনটা মেয়েকেই দত্তক দিয়ে দেয়।এরপর একটা ছেলে জন্ম নেয়,কিন্তু কানিজকে ছেলের কাছে যেতে দেয় নি ওরা।জন্মের ২ মাস পর ছেলেটাও মারা যায়।
শেষে আরেকটি মেয়ে জন্ম নিলে কানিজ মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায়।স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে মেয়ে নিয়ে আলাদা থাকে।
বাবা মারা যাবার পর বাবার একটু সম্পদ ও কানিজ নেয় নি।কাদের খাঁন বুঝতে পারেন নি এভাবে বোন অভিমান করবে।বুঝতে পারলে কোনো দিন বোনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে দিতেন না।
কতো বার বোনকে বুঝিয়েছেন ওদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য, কিছুতেই রাজি হয় নি।উল্টো বাবা ভাইয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। নিজেকে নিজে শাস্তি দিয়েই চলেছে কানিজ।একটা মাত্র বোনের মেয়ে তাকে কখনো এই বাড়িতে আনে নি কানিজ।
কাদের খাঁন হিসেব করে দেখলো তার জীবনে সব আসলে ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তি দিয়ে ভরপুর।
চন্দ্র বাড়িতে ফিরে দেখে রেহানা ঘরের সামনে সিড়িতে বসে আছে। মেয়েকে দেখে ছুটে এলেন মেয়ের কাছে।তারপর অস্থির হয়ে বললেন,”কই ছিলি তুই?কোথায় গিয়েছিলি আমাকে না বলে? আমাকে একবার বলে গেলি না কেনো তুই? এতো রাতে বোরকা পরে কোথা থেকে এলি?”
চন্দ্র জবাব না দিয়ে বললো, “শর্মী কই মা?”
রেহানা এক নজর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “শর্মী কই মানে?ও তো ওর রুমে মনে হয়। আমি দেখি নি তো ওকে।কেনো কি হয়েছে? ”
চন্দ্র বললো, “আমাকে শর্মীর কাছে যেতে হবে মা।”
চন্দ্র ছুটে শর্মীর কাছে গেলো।শর্মীর রুমের দরজা ভেজানো।চন্দ্র দরজা খুলে দেখে শর্মী রুমে নেই।চন্দ্র শর্মীকে খুঁজলো এদিক ওদিক। রেহানা ধড়ফড়িয়ে উঠে বললো, “কি হইছে রে মা?এরকম করতেছস কেনো তুই?শর্মী কই গেলো?তোর আব্বা ও তো ঘরে নাই।”
চন্দ্র কিছু বললো না। এই ওড়নাটা শর্মীর ওড়না। চন্দ্র এবার ঢাকা থেকে আসার সময় শর্মীর আর ওর জন্য একই রকম জামা এনেছিলো।শর্মীর গায়ে আজকে এই জামা দেখেছে চন্দ্র।
চলবে……
রাজিয়া রহমান