চন্দ্রাণী (০৫)

0
290

চন্দ্রাণী (০৫)

রান্নাঘরে সকালের নাশতা বানানোর কাজে ব্যস্ত চন্দ্র।ঝড়ের গতিতে পরোটা বানাচ্ছে সে।
বাড়িতে বানানো ঘি দিয়ে আজ পরোটা ভাজা হচ্ছে। ঘি’য়ের ঘ্রাণে চারপাশ ভরে গেছে।
রেহানা একটা পাতিলে করে আলু,বেগুন, গাজর,চিচিঙ্গা দিয়ে সবজি রান্না করছে পরোটার সাথে খাওয়ার জন্য আর সাথে আছে গরুর দুধের চা।

আজ আর শর্মীর কোনো কাজ নেই।আপা এলে শর্মীর ছুটি রান্নাঘর থেকে। আপা সুনিপুণভাবে সব সামলে নেয়।

শর্মী রান্নাঘর থেকে দূরে বসে আছে। ঘিয়ের ঘ্রাণ তার সহ্য হচ্ছে না। কি অদ্ভুত ব্যাপার, ঘিয়ে ভাজা পরোটা যার প্রিয় সে কি-না এখন ঘি সহ্য করতে পারছে না।
ওড়নার এক কোণ নাকে চেপে বসে আছে শর্মী।পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান আপাতত ক্যান্সেল। ভাগ্য তাকে নিয়ে যা করতে চায় করুক।
ভালোবেসে,বিশ্বাস করে যখন সে ভুল করেছে তখন শাস্তি তো পেতেই হবে।
ভুল মানুষকে বিশ্বাস করার খেসারত দিবে না হয়।

চন্দ্র শর্মীর দিকে তাকাচ্ছে আর পরোটা বানাচ্ছে। শর্মী কেমন আনমনা হয়ে আছে।
লজ্জায় চন্দ্র নিজে থেকে শর্মীকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ও পারছে না।
শুভ্র একটা গরম পরোটা শর্মীর কাছে নিয়ে যেতেই শর্মী নাক আরো জোরে চেপে ধরলো।একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চন্দ্র শর্মীর জন্য আটার রুটি বানালো আলাদা করে।

সবাই যখন নাশতার টেবিলে বসে নাশতা করছে শর্মী তখন নিজের রুমে বসে রুটি খাচ্ছে। চন্দ্রর মন ও অস্থির হয়ে আছে।

নাশতা শেষ করে সবাই যখন দুপুরের রান্নার আয়োজন করছে তখনই খবর এলো শর্মী বান্ধবী নীলিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাতে মা’য়ের সাথে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলো,ফেরার সময় মা মেয়ে দুজনেই রিকশা করে ফিরছিলো,তার মধ্যে পথে কারা যেনো রিকশা থেকে মা’কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে।

সকাল সকাল এরকম একটা খবর পেয়ে শর্মী যারপরনাই হতবাক। সবসময় এরকম ঘটনা আশেপাশের গ্রামে শুনেছে, কিন্তু নিজেদের গ্রামেই এরকম হবে কখনো ভাবতেই পারে নি।

বর্ষাকালের দিন,আকাশ এই হাসে এই কাঁদে অবস্থা। এতোক্ষণ ঝলমলে রোদ ছিলো, এখন আবার আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে।
শর্মী হতভম্ব হয়ে বসে আছে। নীলি কি তবে শফিকের সাথে পালিয়ে গেছে?

নীলি আর শর্মী দু’জনে এক সাথে কলেজে আসা যাওয়া করে, নীলির থেকেই শর্মী জেনেছে শফিকের কথা।
কয়েকদিন ধরে নীলি বলছিলো বাসায় বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, শফিককে ছাড়া নীলি কাউকে বিয়ে করবে না।

চন্দ্র এসে বললো, “শর্মী চল,নীলিদের বাড়ি যাই।চাচীকে দেখে আসি।”

শর্মীর হাত পা কাঁপতে লাগলো। ওই বাড়িতে গেলে যদি চাচী জিজ্ঞেস করে নীলির সাথে তো শর্মী আসা যাওয়া করতো, শর্মী আমতাআমতা করে বললো, “আপা,আমার খুব ভয় করছে।”

চন্দ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কেনো?তুই কি কিছু জানিস?”

শর্মী ঢোক গিলে বললো, “নীলির একজনের সাথে সম্পর্ক আছে আপা।শফিক নাম ওর।বাজারে যেই সুবর্ণা কসমেটিকস এর দোকান আছে, ওই দোকানে ছেলেটা চাকরি করে। নীলির বাড়িতে না-কি বিয়ের কথা হচ্ছে, নীলি বলছিলো শফিক নাকি ওকে বলেছে পালিয়ে যেতে।”

চন্দ্র শুনে বোনের হাত ধরে বললো, “চল আমার সাথে, চাচী যদি জিজ্ঞেস করে তবে যা জানিস তা বলে দিবি।”

শর্মী আর চন্দ্র দুজনেই গেলো নীলিদের বাড়িতে। শর্মীর বুক কাঁপছে দুরুদুরু করে। নীলির সম্পর্কের কথা শর্মী জানলেও শর্মীর ব্যাপার নীলি জানতো না।নিয়াজই বলেছিলো কাউকে যাতে না বলে শর্মী।নয়তো লোক জানাজানি হলে দুজনের বাবা রেগে যেতে পারে।

তখন নিয়াজের সব কথা ঠিক মনে হতো শর্মীর,সব কথাই যৌক্তিক লাগতো। এখন অবশ্য বুঝতে পারে।
এখন বুঝেছে নিয়াজ ওসব বলত নিজেকে সবার ধরাছোঁয়ার বাহিরে রাখার জন্য। এই যেমন এখন কেউ বলতে পারবে না কখনো নিয়জ আর শর্মীর সম্পর্ক ছিলো।
এতো বোকা কবে হলো শর্মী নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, কিন্তু উত্তর পায় না।

নীলির মা বুক চাপড়ে কান্না করছে। আশেপাশে বাড়ির মেয়ে বউয়েরা সবাই এসে ভীড় করেছে।
কেউ কেউ কানাঘুষা করছে কোনো ছেলের সাথে পালিয়েছে হয়তো। ছেলে আর নীলি দু’জন মিলেই এই নাটক সাজিয়েছে।
নীলির মা শর্মীর হাত চেপে ধরে বললো, “মা গো,আমার নীলু তো তোর লগেই আসা যাওয়া করতো, তুই কি কোনো দিন দেখছিলি ওরে কোনো পোলার লগে কথা কইতে?আমি তো জানি আমার মাইয়া কেমন, আমার মাইয়া এই রকম মাইয়া না।কোনো পোলার লগে এরকম আড্ডা নাই আমার মাইয়ার।”

শর্মী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। বাবা মায়েরা আমাদের কতটা ভরসা করে, বিশ্বাস করে। তারা মনে করে তাদের সন্তান ভীষণ নিষ্পাপ।
অথচ যেদিন জানতে পারে তাদের বিশ্বাস ভুল ছিলো, বিশ্বাসের ভীত যেদিন নড়ে যায় কেমন লাগে সেদিন তাদের?
শর্মী যদি এখন বলে দেয় যে নীলির সত্যি কারো সাথে সম্পর্ক আছে তাহলে কেমন লাগবে ওনার তাহলে!

চন্দ্র বোনের হাত চেপে ধরলো আলতো করে। শর্মী জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো, “না চাচী,এরকম কিছু তো আমি জানি না।”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “চাচী,এতো কান্নাকাটি কইরেন না।থানায় জিডি করছিলেন চাচী?”

নীলির মা কাঁদতে কাঁদতে বললো, “করছি গো মা,কিন্তু আমি জানি কোনো লাভ নাই।থানার ওরা কয় আমার মাইয়া কোনো পোলার লগে ভাগছে।”

চন্দ্র আর শর্মী নীলিদের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো।বাহিরে এসে চন্দ্র বললো, “শফিক কোন দোকানে কাজ করে তুই চিনিস?”

শর্মী মাথা নেড়ে বললো, “হ্যাঁ, চিনি আপা।”

চন্দ্র বললো, “চল তাহলে, শফিকের সাথে দেখা করতে যাই।তাহলেই সব কনফিউশান দূর হবে,চাচী অন্তত স্বস্তি পাবে মেয়েটা ভালো আছে এই ভেবে।”

শর্মী অবাক হয়ে বললো, “কেনো আপা?তুমি কেনো যাবে?”

চন্দ্র হাটতে হাটতে বললো, “আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে, চাচী মিথ্যা বলে নি। মায়ের পাশ থেকে এতো রাতে এভাবে পালিয়ে যেতে হলে অনেক বড় কলিজা লাগে শর্মী।দেখ,নীলি তো কলেজে রোজ যায়,ও যদি পালিয়ে যেতে চাইতো তবে তো কলেজে গেলে ওভাবেই যেতে পারতো।
এভাবে মায়ের পাশ থেকে কেনো যাবে এভাবে রাতের বেলা?”

চন্দ্র আর শর্মী রিকশায় উঠে বাজারে গেলো।স্বর্ণকার গলিতে ঢুকে তিন চার দোকান পার হতেই শর্মী বললো, “এই দোকান আপা।”

দু’জনে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালো। শফিক শর্মীকে দেখে মুচকি হেসে বললো, “আপু ভালো আছেন? ”

শর্মী মাথা নেড়ে বললো, “হ্যাঁ, ভালো। আপনি? ”

শফিক হেসে বললো, “ভালো আছি।”

শর্মী আবার জিজ্ঞেস করলো, “নীলি কেমন আছে? ”

শফিক লাজুক হেসে বললো, “আজ তো কথা হয় নি আপু,গতরাত থেকে কল দিচ্ছি ধরছে না।”

শর্মীর গলা শুকিয়ে গেলো, চন্দ্র নিজেও অবাক হলো। মনে মনে সে চেয়েছে তার ধারণা যাতে মিথ্যা হয়,তাহলে অন্তত চাচী এটুকু নিশ্চিত হবেন যে তার মেয়ে সুস্থ আছে, ভালো আছে।

শর্মীর ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে শফিক বললো, “আপু,কোনো সমস্যা? ”

চন্দ্র বললো, “না ভাই,আমরা আসছি।”

দুজনে মন খারাপ করে বের হলো, সেই মুহুর্তে বাড়ি থেকে কল এলো চন্দ্রর ফোনে।
শুভ্র অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কেমন ছটফট করছে না-কি সে।

দুই বোন হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি গেলো।শাহজাহান তালুকদার ছেলের হাত চেপে ধরে কাঁদছেন,তার মাথায় কিছু ঢুকছে না।কি হলো ছেলেটার হঠাৎ করে। চন্দ্র এসে সেই রিকশা করে ভাইকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটলো।

তার কিছুক্ষণ পর পরই শর্মী,চন্দ্রর মা,বাবা সবাই গিয়ে হাজির হল।

হাসপাতালের বাহিরে একটা সিড়ির উপর সিগারেট ধরিয়ে নিয়াজ টগরের কাঁধ চাপড়ে বললো, “শাহজালাল তালুকদারের ক্ষমতা আমি কেমনে শেষ করে দিই খালি দেখ,আমার বাপেরে বারবার নির্বাচনে হারানোর খেসারত তাকে দিতে হবে এবার সুদে আসলে।এবার আমি মারাত্মক প্ল্যান করেছি।”

টগর ভোঁসভোঁস করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো, “দূর ভাই,এসব ক্ষমতায় সুখ নাই,সুখ আছে মদের বোতলের প্রতি চুমুকে।”

নিয়াজ হাসলো মনে মনে। এই গাঁধাটাকে সাথে রাখার এই এক সুবিধা, এর ধ্যান সবসময় মদের বোতলে থাকে।এর এক কান দিয়ে কথা ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়।
একটু আগে নিয়াজ কি বলেছে এখন জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবে না।
নিয়াজের অনেক প্ল্যান আছে।আস্তে ধীরে এগুবে নিয়াজ,প্রয়োজনে টগরকে ফাঁসিয়ে দিবে সে।

ডাক্তার এসে জানালো কোনো ভাবে শুভ্রর পেটে ড্রাগ গিয়েছে, আর এই ড্রাগ এতোটাই কড়া যে অনভ্যস্ত কেউ প্রথম বার নিলে মারা যেতে পারে পর্যন্ত। ভাগ্যিস শুভ্রকে দ্রুত হসপিটাল নিয়ে আসা হয়েছে।

সবাই হতভম্ব হয়ে রইলো ডাক্তারের মুখের কথা শুনে। শুব্র আর ড্রাগ?
কিভাবে সম্ভব!

চলবে……

রাজিয়া রহমান

পোস্টে সবার রিয়েক্ট আশা করছি😒
জয়েন করুন আমার গ্রুপ রাজিয়ার গল্প কুটির এ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here