#চন্দ্রাণী(১৩)
পুরো উঠানের সব পাতা,ময়লা সব কিছু তুলে ফেললো টগর। শ্যাওলা ধরা উঠানের চেহারা বদলে গেলো আস্তে আস্তে। টগর গোসল করে বের হয়ে এলো।পরনে একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট শুধু। কলিং বেল বাজতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো টগরের।এই ভর দুপুরে কে এলো আবার!
দরজা খুলে দেখে ৩২ দাঁত বের করে নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে। টগরের দিকে তাকিয়ে নির্ঝর বললো, “সারপ্রাইজ দিতে চলে এলাম।”
টগর রাগান্বিত হয়ে বললো, “আপনার কি আর কোনো কাজ নেই?সারাক্ষণ আমার পেছনে লেগে থাকেন কেনো?”
নির্ঝর হেসে বললো, “আমার কাজই এটা টগর। তোমার পেছনে লেগে থাকাও আমার কাজ।আর আমার কাজ আমি ভালো করেই বুঝি।”
টগর বিরক্ত হয়ে ভেতরে সরে দাঁড়ায়। নির্ঝর কথা না বাড়িয়ে ভেতরে চলে আসে।
চন্দ্র চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে।টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “আপনাকে কি ইনভাইটেশন কার্ড পাঠাতে হবে ভেতরে আসার জন্য? ”
চন্দ্র মুচকি হাসলো।
নির্ঝর টগরের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি আসার সময় এই ম্যাডাম ও চলে এলেন।ওনার ইচ্ছে তদন্ত করা দেখার।”
টগর বললো, “আপনার যা বলার আছে প্লিজ তাড়াতাড়ি বলুন,আমার প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে।”
নির্ঝর হেসে বললো, “একেবারে কাজের কথা মনে করেছো।ক্ষিধে তো আমার ও পেয়েছে। ”
টগর বিরক্ত প্রচন্ড এই ইন্সপেক্টর তার সাথে হেয়ালি করতে চাইছে।
টগর কড়া গলায় বললো, “আপনি নিশ্চয় আমার সাথে লাঞ্চ করতে চাচ্ছেন না।”
নির্ঝর আহত স্বরে বললো, “কে বললো চাই না?আমি অবশ্যই চাই তোমার সাথে লাঞ্চ করতে। ”
টগর হতাশ হয়ে সোফায় বসে পড়লো। তার ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে।
নির্ঝর সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসলো। টগরকে সে সর্বোচ্চ বিরক্ত করবে।
টগর নিজেকে সামলে বললো, “গরম ভাত আর ডিম ভাজি,চলবে?”
নির্ঝর হেসে বললো, “দৌড়াবে।”
চন্দ্র আচমকা জিজ্ঞেস করলো, “কে রান্না করবে?রান্নার কেউ আছে?”
টগর বিড়বিড় করে বললো, “আমাকে কি চোখে লাগে না?অণুবীক্ষণযন্ত্র এনে দিতে হবে?”
চন্দ্র আমতাআমতা করে বললো, “না মানে,আপনি রান্না পারেন?”
টগর চিল মুড নিয়ে বললো, “যতটা রান্না জানলে ভাত আর ডিম ভাজি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা যায় ততটা জানি।বসুন,একবার খেয়ে দেখুন,নরমাল ডিম ভাজি না হলেও বারবিকিউ ডিম ভাজি খাবেন না হয় আমার বাড়িতে।”
চন্দ্রর ভীষণ খারাপ লাগলো। এই লোকটাকে সে যতোই অপছন্দ করুক এখন কেনো জানি খারাপ লাগছে। পুরুষ মানুষ যতোই ভালো শেফ হোক,তবুও চন্দ্রর মনে হয় বাড়ির রান্না মেয়েদেরই মানায়।
মেয়েদের হাতের রান্না মানে কেমন একটা মায়া মমতায় মাখা একটা ব্যাপার থাকে।পুরুষের রান্নায় থাকে শুধু মাত্র পেট জামিন দেওয়ার ব্যাপার।
ইতস্তত করে বললো,”কিছু মনে না করলে আমি রান্না করি?”
টগর চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার আগে নির্ঝর হেসে বললো, “না না,মনে করার কিছু নেই।আপনি নিশ্চিন্তে রান্না করুন।”
চন্দ্র জিজ্ঞেস করলো, “কিচেন কোন দিকে?”
টগর যন্ত্রচালিতের মতো দেখিয়ে দিয়ে বললো, “ফ্রিজে মাছ মাংস অনেক কিছু রাখা আছে, দরকার মতো নিয়েন।”
চন্দ্র মুচকি হেসে চলে গেলো।
টগর নির্ঝরের মুখোমুখি বসে বললো, “আপনার সমস্যা কি?”
নির্ঝর হেসে বললো, “সেদিন খুনটা কেনো করেছিলে?তোমার হাতের ব্যাগে কি ছিলো সেদিন?”
টগর বিরক্ত হয়ে বললো, “আমি জানি না কি ছিলো। আর আমি কাউকে খুন করি নি।”
নির্ঝর পায়ের উপর পা তুলে বললো, “যেই লোকটা খু/ন হয়েছে তার ফোন থেকে একটা মেসেজ পেয়েছি আমরা। মেসেজে লিখা ছিলো টগর যাতে বেঁচে ফিরতে না পারে। ”
টগর যেনো আকাশ থেকে পড়লো। হতভম্ব হয়ে বললো, “হোয়াট! ”
নির্ঝর হেসে বললো, “তবুও বলবেন আপনার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই এসবের?”
টগর বললো, “আমি বারবার, হাজার বার বলবো আমার সাথে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই।”
নির্ঝর বললো, “তুমি যে ওখানে যাবে তা কে কে জানতো?”
টগর ভেবে বললো, “নিয়াজ ছাড়া আর কেউ না।”
নির্ঝর চুপ করে ভাবতে লাগলো। নিয়াজকে তার কেমন সন্দেহ হচ্ছে। এই ছেলেটা ওভারস্মার্ট বেশ।ওকে নজরে রাখতে হবে।
চন্দ্র দ্রুত হাতে কাজ করা শুরু করে দিলো। পুরুষ মানুষকে হাত করার অন্যতম প্রধান একটা হাতিয়ার হলো ভালোমন্দ খাওয়ানো। আর টগরের এটা হতে পারে সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। যেহেতু নারীসঙ্গ বিবর্জিত মানুষ, নিজে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খায়।তাকে কাবু করা খুব একটা অসুবিধা হবে না।
ফ্রিজ থেকে মুরগির মাংস বের করে ভিজিয়ে রেখে দ্রুত হাতে পেঁয়াজ, মরিচ কেটে নিলো।তারপর আদা,রসুন,জিরা বেটে নিলো।
রাইস কুকারে ভাত আর এক চুলায় ডাল বসিয়ে দিলো।
মশলা বেটে আলু কেটে নিলো।মাংস ভালো করে বরফ ছাড়ে নি।তবুও আর দেরি করলো না চন্দ্র।
মশলা কষিয়ে নিয়ে মাংস দিয়ে দিলো।
রান্নাঘর থেকে মাংসের ঘ্রাণ এসে নাকে লাগতেই টগর চমকে উঠলো। কতো বছর পর আজ আবার এরকম ঘ্রাণ পাচ্ছে?
মা মারা যাওয়ার পর থেকেই নিজের রান্না নিজে করে। কোনো মতে পেটে দুই মুঠো গেলেই হয় তার,এতো কষিয়ে আয়োজন করে রান্না করতে যায় না। ভাত আর আলু ভর্তা করেই বেশির ভাগ দিন চালিয়ে নেয়।ফ্রিজে মাছ মাংস সবই রাখে তবুও।যেদিন আর ইচ্ছে করে না একই খাবার রিপিট করতে সেদিন রান্না করে। যতই ভালো রান্না করুক ইউটিউব দেখে, তবুও নিজের রান্না নিজের তেমন একটা ভালো লাগে না টগরের।
নির্ঝর উঠে বসে বললো, “তোমার সাথে আমার একটা মিল আছে জানো?”
টগর কিছু বললো না। নির্ঝর নিজেই বললো, “তোমার ও মা নেই আমার ও মা নেই।যদিও আমার বাবা আছেন তবে মা মারা যাবার পর থেকেই তিনি আমার তালুই হয়ে গেছেন।আমার ১০ বছর বয়সে মা মারা যান।
তোমার মতো আমি ও নিজের রান্না নিজে করে খাই।”
টগরের হঠাৎ করে নির্ঝরের জন্য কেমন মায়া হলো। সে তো মা’কে অনেক দিন পেয়েছে কাছে এই লোকটা তো তাও পায় নি।
লোকটাকে এতো দিন যতটা খারাপ ভেবেছিলো আজ মনে হচ্ছে ততটাও খারাপ না।
চন্দ্র তরকারি নামিয়ে প্লেটে ভাত বেড়ে নিয়ে একটু ঠান্ডা হতে রাখলো।সেই ফাঁকে শসা,টমেটো, পেঁয়াজ,কাচা মরিচ কুচো করে সরিষার তেল দিয়ে হাতে মেখে সালাদ করে নিলো।
সালাদ বানাতে বানাতে চন্দ্রর মনে হলো, “যদিও এই বাড়িতে কোনো মহিলা নেই তবুও এই লোকটা বাড়িঘর গুছিয়ে রাখে বেশ।ঠিকই বলেছে সেদিন,জাতে মাতাল হলেও,তালে ঠিক আছে। এই জাতে মাতাল লোকটার থেকে নিয়াজদের সব প্ল্যান বের করতে হবে চন্দ্রর।”
খাবার সার্ভ করার পর টগর কিছুটা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চন্দ্রর দিকে তাকালো। মেয়েটাকে দেখে মনে হয় ননীর পুতুল অথচ কাজেকর্মে বেশ গোছানো। ওর ভাবভঙ্গি, চলাফেরা দেখে একটুও মনে হচ্ছে না এই বাড়িতে প্রথম এসেছে বরং এমন দক্ষ হাতে সব করছে যেনো এই বাড়িটি তারই।
নির্ঝর খেতে বসে বললো, “বাহ,আপনার হাতে তো দেখছি জাদু আছে ম্যাডাম। খুব দ্রুতই সব আয়োজন করে ফেললেন দেখছি।”
চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “নিন আপনারা খেয়ে নিন।”
টগরের হঠাৎ করেই কেমন যেনো লজ্জা লাগছে খেতে বসতে এই মেয়েটার সামনে। যেনো এই বাড়িতে সে অতিথি এমন লাগছে।
চন্দ্র সাবলীলভাবে প্লেটে ভাত বেড়ে দিলো। তারপর মুরগির মাংস তুলে দিলো টগরের প্লেটে।
টগর ইতস্তত করে বললো, “আপনি ও বসুন না।”
চন্দ্র হেসে বললো, “না,ধন্যবাদ। আমি বাড়িতে গিয়ে খাবো।আব্বা মা অপেক্ষা করে থাকবে আমার জন্য। ”
টগর বললো, “আপনি এতো কষ্ট করে রান্না করেছেন,আর না খেয়ে যাবেন?প্লিজ বসুন।নয়তো আমার নিজেরই খারাপ লাগবে।”
চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “প্লিজ,আমার সাথে এতো ফর্মালিটি করবেন না।আমরা একই গ্রামের মানুষ। চেনাজানা থাকলে, কথাবার্তা থাকলে হয়তো আমরা বন্ধুও হতাম।তাই আমার সাথে এভাবে ফর্মাল ব্যবহার করবেন না।অন্য কোনো দিন খাবো।আজকে আপনারা খান।আপনার তো দেখছি বেড়ে খাওয়ানোর মতো কেউ নেই,আজ না হয় আমি আপনাকে বেড়ে খাওয়াই।”
নির্ঝর মিটিমিটি হাসতে লাগলো চন্দ্রর কথা শুনে। মেয়েটার হাবেভাবে বলছে সে টগরের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।
টগর আর কথা বাড়ালো না।খাবার মুখে তুলতেই টগর দ্বিতীয় বার মুগ্ধ হলো। ভীষণ ভালো রান্না করেছে মেয়েটা।আলু দিয়ে মুরগির মাংসের ঘন ঝোল সেই সাথে মুসুরি ডাল।ডালের মধ্যে আস্ত কিছু কাঁচামরিচ দিয়েছে।ভাতের সাথে চটকে খেতে অসাধারণ লাগছে।
সালাদের পাশে লম্বালম্বি করে কেটে রাখা লেবুও আছে।মাংসের বাটির উপর কিছুটা ভাজা জিরার গুড়ো ছিটিয়ে দেওয়া।এভাবেই তো মা ও দিতো।
কত বছর পর টগর আজ পেট ভরে ভাত খেলো!
জানে না টগর। খাবার পাতে তার ভিজে উঠা চোখ চন্দ্রর নজর এড়ালো না।
নির্ঝর খেতে খেতে বললো, “ফার্স্ট ক্লাস রান্না হয়েছে ম্যাডাম। বহুদিন পর পেট ভরে ভাত খাচ্ছি।”
টগর ফোঁড়ন কেটে বললো, “আপনি প্লিজ এরকম কথা বলবেন না।আপনাদের পুলিশ অফিসারদের জানা আছে আমার। নিজেদের গ্রামেই তো কতো দেখেছি অন্য কোথাও না,এই যে উনি,ওনাদের বাড়িতেও তো কতো পুলিশ অফিসার কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছেন।”
নির্ঝর হেসে বললো, “ভুল বলো নি তুমি। তবে সবাই এক রকম হয় না।আমি তোমার সাথে খেতে নিজে থেকে চেয়েছি বলে তুমি ভেবো না আমি সবসময়ই এরকম সবার সাথে। ”
টগর কিছু বললো না আর।সে তার বাসায় খেতে চেয়েছে বলে কথাটা বলে নি। অন্যান্য অফিসারদের দেখেছে এরকম সেটা বুঝাতে চেয়েছে। এখন কথা বাড়ালে মানুষটা খেতে আনইজি ফিল করবে ভেবে টগর আর কিছু বললো না।
খাওয়ার পর চন্দ্র সব কিছু ধুয়ে মুছে রান্নাঘর ও মুছে ফেললো। বাকি খাবার বক্সে ভরে ফ্রিজে রেখে দিলো।
তারপর ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে বললো, “ফ্রিজে সব রেখে দিয়েছি।রাতে খাবার আগে ওভেনে গরম করে নিবেন।”
টগর কি বলবে ভেবে পেলো না। চেয়ারম্যান লোকটাকেই টগরের পছন্দ না।সেখানে তার মেয়ে এতো কিছু করলো তার জন্য। কেমন লজ্জা অস্বস্তি হচ্ছে টগরের।
চন্দ্র বুঝতে পেরে বললো, “আপনি মনে হয় লজ্জা পাচ্ছেন এখনো। লজ্জা পাবেন না প্লিজ।আমার খুব ভালো লেগেছে আপনাদের খাওয়াতে পেরে।আসলে আমার মায়ের থেকে মনে হয় আমরা দুই বোন এই স্বভাব পেয়েছি। কাউকে নিজ হাতে কিছু করে খাওয়াতে পারলে কেমন যেনো মানসিক শান্তি পাই। আমি আমার মানসিক শান্তির জন্যই এটুকু করেছি।”
টগর আর কিছু বললো না। আসলে কি বলবে তাই ভেবে পাচ্ছিলো না।
নির্ঝর আর চন্দ্র চলে যেতেই টগর ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসলো তাকে কে খুন করতে চায়?
খেলা শেষ করার সময় হয়ে গেছে তাহলে!
নির্ঝর হাঁটতে হাঁটতে বললো, “আপনি কি টগরকে ভালোবাসেন?”
আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে চন্দ্র হতভম্ব হয়ে গেলো।
নির্ঝর হেসে বললো, “না আপনার হাবভাব তেমনই মনে হচ্ছে। আর আমার মন বলছে টগরের প্রতি আপনার একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়েছে, আপনি এর পরে ও অনেক বার যাবেন টগরের কাছে। ওকে রান্না করে খাওয়াতে। ”
চন্দ্র হতবাক হয়ে বললো, “আপনি কিভাবে বুঝলেন?”
নির্ঝর হেসে বললো, “কিছু ব্যাপার বুঝা যায় এমনিতেই। টগর খাওয়ার সময় আপনার দুই চোখ দিয়ে মায়া ঝরে পড়ছিলো। দেখে মনে হচ্ছিলো আপনার ভীষণ খারাপ লাগছে ওর জন্য। আসলে মেয়ে মানুষের মন একটু নরম বেশি তো।”
চন্দ্র কিছু বললো না। যেতে তো তাকে হবেই।টগরের থেকে তথ্য আদায় করতে হলে তাকে যেতেই হবে।
মনকে চন্দ্র প্রশ্ন করলো, “শুধু কি ইনফরমেশন পেতেই যাবো?তাহলে মনটা এমন বিষন্ন হয়ে গেলো কেনো?”
চলবে……!
রাজিয়া রহমান
আজকে অনেক বড় করে দিয়েছি,সবার লাইক,কমেন্ট আশা করছি।