#নন্দিনী_শুধু_আমার
পর্ব:১
খুব সকালে ঘুম ভেঙেছে আজ নন্দিনীর। সত্যি কথা বলতে সারারাতই তার ঘুম হয়নি উত্তেজনায়। ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে আসায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। কিন্তু সকাল হতে না হতেই আবার উঠে যায়। আজ সে বাড়ি থেকে পালাবে। তার সাত বছরের ভালোবাসা মীরনের হাত ধরে চলে যাবে আজ অনেকদূর। সে পালাতে চায়নি। এমন দিন তার জীবনে কোনোদিন আসতে পারে সে ভাবতেও পারেনি। কিন্তু তার কাছে আর কোনো উপায় ছিলো না। বাবাকে অনেকবার বুঝিয়েছে সে। মীরনকে ছাড়া কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া অসম্ভব তার পক্ষে। কিন্তু বাবা কিছুই শোনেনি। নন্দিনীর বাবা রাজীব শাহ বিশাল ব্যবসায়ী। বাজারে তার সবজির আড়ৎ আছে কয়েকটা, কাপড়ের দোকান আছে প্রায় আঠারোটা। তার একমাত্র মেয়ে এই নন্দিনী। আর মীরনের আছে টা কি? কোনোমতে বিএ টা পাশ করে এখন হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে বাবা মা সহ আরো ছয় ভাইবোন। মীরন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। সবাই ওর দিকে চেয়ে আছে ও কবে চাকরি পেয়ে তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাবে। স্বভাবতই রাজীব শাহ রাজি হয়না তার একমাত্র রাজকন্যাকে এমন ভবঘুরে একটা ছেলের হাতে তুলে দিতে। কারণ সে বিশ্বাস করে অভাব ঘরে ঢুকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালাবে। তার মেয়ে ছোটবেলা থেকে যেমন রাজকীয়ভাবে বড় হয়েছে, সে কীভাবে অমন একটা ছোটলোক ঘরে যেয়ে নিজেকে মানিয়ে নেবে? তাই সে দেরি না করে নন্দিনীর বিয়ে ঠিক করেছে তারই মতো একজন ব্যবসায়ীর সাথে। যদিও তার বয়স কিছুটা বেশি। আগে একটা বিয়েও হয়েছিলো কিন্তু সংসার টেকেনি। এতে অবশ্য লোকটার দোষ দেওয়া যায়না। বউটা ভালো ছিলো না। বিয়ের কয়দিন পরেই পূর্ব প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়েছিলো। রাজীব শাহ এখানে ছেলেটার দোষের কিছু দেখেনা। বনেদী ঘরের একমাত্র ছেলে নির্ঝর, দুই হাতে টাকা কামায়। চেহারাছবিও নেহাৎ মন্দ নয়। যেমন লম্বাচওড়া তেমনি পেটানো শরীর। রাজীব শাহ নিজের মেয়ের জন্য এরচেয়ে ভালো আর কেউ হতে পারে না এমনটাই মনে করে।
আজ নির্ঝরের বাড়ি থেকে নন্দিনীকে দেখতে আসবে। রাজীব শাহ গোপনে জেনেছে যে, মেয়ে পছন্দ হলে আজই নাকি তারা আংটি পরিয়ে যাবে আর পাকা কথা বলে যাবে। খুব তাড়াতাড়ি হয়তো বিয়ের তারিখও ধার্য করা হবে। তার একটাই কারণ, প্রথম বিয়ের পর নির্ঝরের সব মেয়েদের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছে। সে কোনোভাবেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে রাজি নয়। এরকম করতে করতে বয়সটাও বেশ বেড়ে গেলো। বাবা মায়ের চিন্তার শেষ নেই। নন্দিনীকে দেখতে আসায় কিছুটা নিমরাজি হওয়ায় তারা খুবই খুশি। পারলে আজই বিয়েটা দিয়ে দেয়।
সকাল সকাল রান্নার তোরজোর শুরু হয়েছে শাহ বাড়ি। রাজীব শাহ ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। তার ধারণা নির্ঝরের পরিবার নন্দিনীকে খুবই পছন্দ করবে। রূপে-লাবন্যে মেয়েটার জুড়ি মেলা ভার। পছন্দ না হয়ে যাবে কোথায়? যদিও মেয়েকে নিয়ে তার ভয় হচ্ছে। মেয়ের এতো নির্লিপ্ততা তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। মীরনের ব্যাপারে সে কঠোরভাবে ঘটনা সামলে নেওয়ায় মেয়ে তার উপর রেগে আছে সে ঠিক বুঝতে পারে। সেদিনের পর থেকে মেয়ে একদম চুপচাপ হয়ে আছে। কারো সাথেই ঠিকমতো কথা বলেনা সে। একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে রাজীব বলে,’একদিন ঠিক বুঝবি মা রে, বাবা তোর খারাপ চায়নি।’
সারা ঘরময় পায়চারি করছে নন্দিনী। যতোই সময় যাচ্ছে ততই ভিতর ভিতর অস্থির হয়ে যাচ্ছে সে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ছেলেবাড়ির লোকেরা চলে আসবে তাদের বাড়ি। এরপর কোনোভাবেই বাড়ি থেকে পালানো যাবেনা। সে অপেক্ষা করছে তার ভাবী নিশিতার জন্য। নিশিতা সব জানে নন্দিনী আর মীরনের কথা। নন্দিনী যে বাড়ি থেকে আজ পালিয়ে যাবে এটাও নিশিতা জানে। সে নন্দিনীকে কথা দিয়েছে সে পালাতে সর্বোচ্চ সাহায্য করবে।
খুট করে দরজা খোলার শব্দ হয়। নন্দিনী ভয়ে জড়সড় হয়ে যায়। তাহলে কি তার মা এলো সে তৈরি হয়েছে কিনা দেখতে? ছেলে বাড়ির সবাই কি ইতোমধ্যে চলে এসেছে?
দরজা থেকে নিশিতাকে ঢুকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নন্দিনী।
ভ্রু কুঁচকে কিছুটা রাগ করে সে বললো,”এই আপনার আসার সময় হলো ভাবী? কখন পালাবো আমি বাড়ি থেকে? ছেলে বাড়ির লোক চলে আসার পর?”
নিশিতা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,”তোমার ভাইজানকে তুমি চিনো না নন্দিনী? নিশ্চয়ই কিছু সন্দেহ করেছে। সকাল থেকে আমার উপর কড়া নজরদারি রেখেছে। আমি তোমার ঘরের দিকে পা বাড়ালেই আমাকে কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত করে রেখেছে। অনেক কষ্টে তার চোখ ফাঁকি দিয়ে এলাম।”
নন্দিনী কিছুটা দমে যেয়ে বললো,”সবই বুঝলাম, এখন ওদিকের খবর বলুন। বাবা আর ভাইজান কোথায়?”
নিশিতা ফিসফিস করে বললো,”উনারা জুম্মাহর নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছেন। এটাই সুযোগ নন্দিনী। মা ওদিকে রান্নাবান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। এই সুযোগ হাতছাড়া করোনা। নামাজের পরেই বাবা আর তোমার ভাইজান উনাদের নিয়ে ফিরবে।”
নন্দিনীর বুকটা কেঁপে ওঠে। সে জানেনা সে ভুল করছে নাকি ঠিক করছে। সে শুধু জানে সে মীরনকে তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। ভালোবাসা একবার হারিয়ে ফেললে আর ফিরে পাবেনা সে।
“কিন্তু কীভাবে বের হবো ভাবী? গেটে দারোয়ানকে বাবা কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। আমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত যেনো আমাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া না হয়।”
নিশিতা এবার নিজের কোলের মধ্যে লুকানো একটা কালো বোরকা বের করে নন্দিনীর সামনে তুলে ধরে। নন্দিনী অবাক হয়ে বললো,”এটা কি ভাবী?”
“এটা আমাদের বাড়িতে যে খালাটা কাজ করে হালিমা নাম করে, তার বোরকা। উনি কাজে ব্যস্ত, তাই উনার ট্রাংক থেকে চুরি করে নিয়ে এসেছি। এটা ঝটপট পরে নাও নন্দিনী। দারোয়ান তোমাকে চিনতে পারবে না।”
নন্দিনী অবাক হয়ে ভাবীর দিকে তাকায়। এরপর আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।
“আরে এই মেয়ে কি করছো তুমি? এখন এসবের সময় নয়। যদি সত্যিই বাড়ি থেকে পালাতে চাও এখনই যা করার করো। এরপর আর সময় পাবেনা।”
নন্দিনী কাঁদতে কাঁদতে বললো,”ভাবী আপনার এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবোনা। আজ আপনি আমার ভালোবাসাকে জিতিয়ে দিয়েছেন।”
“এখন এসব বলার সময় নয় নন্দিনী। নাও এটা পরে নাও খুব তাড়াতাড়ি।”
নন্দিনী কাঁপা কাঁপা হাতে বোরকাটা তুলে নেয়। এরপর নিশিতার দিকে একবার তাকিয়ে ঝটপট ওটা গায়ে পরে নেয় সে।
“মুখটা বেঁধে নাও নন্দিনী। দারোয়ান জিজ্ঞেস করলে বলবে তুমি হালিমা। দোকানে যাচ্ছো কিছু জিনিস কিনতে।”
নন্দিনী নিশিতার হাত চেপে ধরে বললো,”আমার খুব ভয় করছে ভাবী। বাবা বা ভাইজান যদি কোনোভাবে ধরে ফেলেন আমাকে তো মেরে ফেলবেই সেই সাথে মীরনকেও শেষ করে দিবে।”
নন্দিনীর হাত বরফের মতো ঠান্ডা। নিশিতা তার হাতের উপর হাত রেখে বললো,”আরেকবার কি ভেবে দেখতে চাও নন্দিনী?”
“না ভাবী, আমার যা ভাবার ভাবা হয়ে গিয়েছে। আমি মীরনকে ছাড়া বাঁচবো না। আমি সারাজীবন কষ্টে কাটাতে পারবো না ওকে হারিয়ে।”
নিশিতা নিজের হাত থেকে দু’টো বালা খুলে নন্দিনীর হাতে দিয়ে বললো,”এটা রাখো নন্দিনী।”
নন্দিনী ছলছল চোখে নিশিতার দিকে তাকায়।
“এটা তোমার কাছে রাখো। দরকার হলে কাজে লাগবে। তেমন কিছুই তো নিজের সাথে নিতে পারছো না। এটা রেখে দাও।”
“ভাবী আপনি আমাকে আরো ঋণী করে দিচ্ছেন। যদি কখনো সুযোগ হয় আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও আপনার ঋণ শোধ করবো।”
নিশিতা ম্লান হেসে বললো,”কোনো ঋণ শোধ করতে হবে না। আমি চাই তোমরা সুখী হও। আর দেরি করোনা নন্দিনী। ওদের ফেরার সময় হয়ে গেলো।”
নন্দিনী ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে, তার পা কাঁপছে। মা কে একনজর দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে তার। কিন্তু এই অবস্থায় আর যাওয়া যাবে না এখন মায়ের কাছে।
“কিচ্ছু ভেবো না নন্দিনী। আমি এদিকটা সামলে নিবো। আমাকে যতো যাই হুমকি দেওয়া হোক, আমি কোনোভাবেই কিছু জানাবো না।”
নন্দিনী শেষবারের মতো নিশিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এরপর নিজের ঘরের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। এখন আর পিছনে তাকানোর সময় নেই তার।
দোতলার বারান্দা থেকে একদৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে আছে নিশিতা। কিছুক্ষণ আগেই নন্দিনী দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে গেট ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। সেদিকে তাকিয়েই ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো নিশিতার। মনে মনে বললো,’মেয়ে নিয়ে খুব অহংকার ছিলো তাইনা রাজীব শাহ? আমিও যে কোনো বাড়ির আদরের মেয়ে এটাই ভুলে গিয়েছিলেন আপনি। এখন দেখুন, মেয়ে কীভাবে মুখে চুনকালি মাখায় আপনার। মেয়েকে তো হারালেন, সেই সাথে বাজারে সকল ব্যবসায়ীদের সামনে মানসম্মানও হারাবেন এখন। মাথা তুলে আর তাকাতে পারবেন না যে কয়টা দিন বেঁচে থাকবেন। এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। আমার বাবাকে যতো অপমান আপনি করেছেন, আজ আপনি তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি অপমানিত হবেন।’
নিশিতার এসব ভাবনার মধ্যে হঠাৎ মর্জিনা বেগমের চিৎকার শুনতে পেলো সে। “বউমা বউমা” বলে তারস্বরে ডেকে যাচ্ছে সে।
“আসছি মা।” নিশিতা আঁচলটা মাথায় তুলেই চলে যায় সেখান থেকে।
“বলুন মা, ডাকছিলেন?”
“বলি তোমার আক্কেলজ্ঞান কি কোনোদিন হবে না বউমা? বাড়িতে অতিথি আসবেন, যারা কিনা আমাদের আত্মীয় হতে চলেছেন। বাড়িতে কতো কাজ। আর তুমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছো?”
নিশিতা ভিতরের চাপা রাগকে বের হতে দেয়না। জোর করে হেসে বললো,”কি করতে হবে দিন না মা। আমি খাবার টেবিল সাজিয়ে ফেলছি এক্ষুনি।”
“থাক মা জননী তোমার আর টেবিল সাজিয়ে কাজ নেই। আমি ইতোমধ্যেই করে ফেলেছি সে কাজ। তুমি যাও তোমার ননদকে একটু সাজিয়ে দাও। ওরা এসেই মেয়েকে দেখতে চাইবে। আর আমার হাত পরিষ্কার নেই, আমার আঁচল থেকে আলমারির চাবিটা নাও। আলমারির দ্বিতীয় তাকে দেখবে একটা সোনালী বাক্স আছে। ওখানে যতো গহনা পাবে সব দিয়ে নন্দিনীকে সাজাবে। কিছু যেনো বাদ না থাকে।”
নিশিতা কথা বাড়ায় না। কোনোভাবেই এখন কিছু প্রকাশ করা যাবেনা, শুধু অভিনয় করে যেতে হবে।
“দেখো কোনো গহনা আবার নিজের জন্য সরিয়ে রেখো না।”
নিশিতা হতবাক হয়ে বললো,”মা এসব কি বলছেন আপনি?”
“এতো অবাক হওয়ার তো কিছু নেই মা। তোমাকে আমরা কম গহনা দিয়েছি বলে তো তোমার আর তোমার বাপের রাগের শেষ নেই আমাদের উপর। আমরা নাকি সব আমাদের মেয়ের জন্য রেখেছি, তোমাকে কিছুই দিইনি।”
নিশিতা মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে। মর্জিনা বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে বললো,”দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সার্কাস না দেখিয়ে এখন যাও। বাড়িতে একটা শুভ দিন, চোখের পানি ফেলে দিনটা অপয়া করে দিও না।”
নিশিতা ঝড়ের বেগে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। মর্জিনা বেগম সেদিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে নন্দিনী। তার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে তার। তার মন বারবার বলছে এখনো সময় আছে, বাড়ি ফিরে যেতে। কিন্তু যতবার মীরনের মুখটা চোখে ভেসে উঠছে, ততবার সব ভাবনা দূরে হারিয়ে যাচ্ছে তার। কিছুক্ষণের মধ্যেই মীরনকে একদম নিজের করে পাবে সে, পৃথিবীর কোনো শক্তি পারবে না তার কাছ থেকে মীরনকে আলাদা করতে। বারবার হাত ঘড়িতে সময় দেখে নন্দিনী। এতোক্ষণে মীরনের পৌঁছে যাওয়ার কথা, কেনো এতো দেরি করছে সে? উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে তার। কপাল চুইয়ে ঘাম পড়ছে। অস্বস্তিতে কাঁদতে ইচ্ছা করে নন্দিনীর।
ইতোমধ্যে শাহ বাড়িতে গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে নন্দিনী বাড়িতে নেই। ছাদ, বাগান, বাড়ির আনাচে কানাচে সব জায়গায় খোঁজা হয়েছে, কোথাও নন্দিনী নেই।
রাজীব শাহ দারোয়ানের কলার চেপে রাগে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করলো,”তোকে বলেছিলাম না নন্দিনীকে বাইরে যেতে দিবি না? কীভাবে বাড়ির বাইরে গেলো ও?”
“বিশ্বাস করুন বড় সাহেব, নন্দিনী আপা বের হয়নি বাড়ি থেকে। আমি কেনো মিথ্যা বলবো?”
রাজীব শাহ আরো জোরে চেপে ধরে তাকে।
“একদম চালাকি করবি না। তুই নন্দিনীকে বাড়ির বাইরে যেতে সাহায্য করেছিস।”
“আমি উনাকে আজ দেখিনি পর্যন্ত বড় সাহেব। আমার কথা বিশ্বাস করুন।”
নন্দিনীর বড় ভাই ফিরোজ শাহ, শান্ত কিন্তু ভীষণ রাগী।
বাবাকে টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে সে দারোয়ানের কাছ থেকে।
“বাবা শান্ত হও, আমাকে কথা বলতে দাও। এই এবার আমাকে বল আমরা নামাজে যাওয়ার পর আর কেউ বাড়ি থেকে বের হয়েছে?”
দারোয়ান কাঁদতে কাঁদতে বললো,”ছোট সাহেব আপনারা বের হওয়ার পর আপনাদের বাড়ির কাজের লোক হালিমা বের হয়েছে বোরকা পরে। তাকে নাকি দোকানে পাঠানো হয়েছে। আমি কিছু না ভেবেই তাকে বাইরে যেতে দিয়েছি। কিন্তু সে এখন পর্যন্ত বাড়ি ফেরেনি।”
আঁৎকে ওঠে ফিরোজ। হালিমা তো বাড়িতেই আছে। তাহলে কি নন্দিনী হালিমার বোরকা পরে বের হয়েছে? এতো সাহস ওর হবে? নাকি আর কেউ ওকে সাহায্য করেছে?
মর্জিনা বেগম ঘরে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। এ কি সর্বনাশ হয়ে গেলো তার? কোথায় গেলো তার মেয়েটা? এখন এতোগুলো মানুষের সামনে কি বলবে সে? পাশেই নিশিতা দাঁড়িয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে রেখেছে। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তার।
হঠাৎ করেই ফিরোজ এসে নিশিতার একবাহু টানতে টানতে তাকে নিজেদের ঘরে নিয়ে গেলো। এরপর দরজাটা আটকে দিলো ভিতর থেকে।
নিশিতা ভ্রু কুঁচকে বললো,”সমস্যা কি তোমার? এভাবে সবার মধ্য থেকে টেনে ঘরে নিয়ে এলে কেনো তুমি আমাকে?”
ফিরোজ হঠাৎ নিশিতাকে দেয়ালে চেপে ধরে বললো,”সত্যি করে বলো নন্দিনী কোথায়?”
নিশিতা জোরে ঠেলে ফিরোজকে দূরে সরিয়ে দেয়। এরপর ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,”তোমার বোন কোথায় আমি কীভাবে জানবো? আমাকে কি ও কিছু বলে গিয়েছে?”
“একদম চালাকি করার চেষ্টা করবে না নিশিতা। আমি জানি তুমিই ওকে বাড়ি থেকে পালাতে সাহায্য করেছো।”
নিশিতা হিসহিসিয়ে বললো,”তোমার বোন কি ছোট বাচ্চা? আমি তাকে পালাতে সাহায্য করলাম আর সে পালিয়ে গেলো? একদম আমার সাথে এভাবে কথা বলবে না তুমি। অতিথিদের সামনে কীভাবে নিজেদের মানসম্মান রক্ষা করবে তাই ভাবো। ঘরের ভিতরে এসে একটা নারীর উপর চোটপাট না করে, ওদের সামনে যাও।”
এই বলে নিশিতা দরজা খুলে হনহন করে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। ফিরোজ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।
উদ্ভ্রান্তের মতো দৃষ্টি ফেলে সোফায় বসে আছে রাজীব শাহ। তার সামনে ছেলেবাড়ির সবাই বসে আছে। নির্ঝর মাথা নিচু করে এক কোণায় বসা। নির্ঝরের বাবা মোতালিব খান হেসে বললো,”মেয়েকে তবে ডাকুন শাহ সাহেব। শুনেছি আপনাদের কন্যা নাকি সাক্ষাৎ পরী? আমরাও তবে পরী দেখি নিজের চোখে।”
রাজীব শাহ এর হাত-পা অবশ হয়ে যায়। কি বলবে এখন সে? নির্ঝর চোয়াল শক্ত করে বসে আছে, তার পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। চুলগুলো খুব সুন্দর করে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। দারুণ একটা আতরের সুঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে তার শরীর থেকে। বোঝাই যাচ্ছে তার চলাফেরা বনেদী বাড়ির ছেলের মতোই। এমন রাজপুত্রের সাথে তার মেয়ের বিয়েটা হবে না?
ফিরোজ কাচুমাচু হয়ে বললো,”চলুন না আগে খেয়ে নিবেন। বেলা তো কম হলো না। নির্ঝর ভাই, আপনি কি বলেন?”
নির্ঝর উত্তর দেয়না, আগের মতোই গম্ভীর হয়ে বসে থাকে।
মোতালিব খান কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”মেয়ে দেখার আগেই খেয়ে নিবো?”
“আসলে ও তৈরি হচ্ছে তো, এখনো আপনাদের সামনে আসার উপযুক্ত হয়নি ও। হলেই চলে আসবে।”
নিশিতা পর্দার ফাঁকা দিয়ে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
নন্দিনী হাউমাউ করে কাঁদছে মাটিতে বসে। প্রায় দুই ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে মীরন এখনো আসেনি। তাহলে কি মীরন ওকে ঠকালো? না না, এটা কোনোদিনও সম্ভব নয়। ও যেমন মীরনকে ভালোবাসে, মীরনও ওকে তারচেয়ে বেশি ভালোবাসে। এখানেই তো আসার কথা ওর। চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছিলো সে নিজেই এই জায়গার কথা। এখন নন্দিনী কি করবে? ফিরে যাওয়ারও তো মুখ নেই ওই বাড়িতে আর। নন্দিনী চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। মীরন যে মেসে থেকে, সে চিনে। এর আগে অনেকবার মীরন ওকে নিয়ে এসেছে এখানে। ফাঁকা মেসে মাঝে মাঝেই দুইজন অনেক সময় কাটিয়েছে। মীরনের বন্ধুরা তখন ওদের জন্য ঘর খালি করে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতো। নন্দিনী ঠিক করে সে মেসে যাবে। তারপর ওকে জিজ্ঞেস করবে কেনো তাকে এভাবে অপেক্ষা করালো সে?
“কেউ আছেন?”
জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে থাকে নন্দিনী। বেশ অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও কেউ দরজা খোলেনা। নন্দিনী আরো জোরে দরজা ধাক্কাতে থাকে আর চিৎকার করতে থাকে।
“দয়া করে দরজাটা খুলুন। মীরন তুমি শুনতে পারছো না আমার কথা?”
তারও বেশ কিছুক্ষণ পর একটা কালোমতো ছেলে এসে দরজা খোলে। ছেলেটাকে নন্দিনী চিনেনা। মীরনের সব বন্ধুকে সে চিনলেও এই ছেলেটা নতুন।
“কে আপনি? দুপুরের সময় এভাবে চিৎকার করছেন কেনো মেসের সামনে এসে?”
“ভাই দয়া করে মীরনকে ডেকে দাও। বলো যে নন্দিনী এসেছে তার সাথে দেখা করতে।”
ছেলেটা নন্দিনীর আপাদমস্তক একবার ভালো করে দেখে নেয়। এরপর ভ্রু কুঁচকে বলে,”মীরন ভাইয়ের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”
নন্দিনী কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,”ওকে যেয়ে বললেই ও চিনবে। তুমি আমার নামটা যেয়ে বলো ওকে।”
“মীরন ভাইকে বলা যাবে না কিছু। উনি এখন মেসে নেই।”
নন্দিনী কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”কখন বেরিয়েছে ও?”
“সে তো তিনদিন আগেই। গ্রামে গিয়েছে মীরন ভাই তার পরিবারের কাছে। মীরন ভাইয়ের স্ত্রীর শরীর ভালো না, সন্তানসম্ভবা। তার সাথেই দেখা করতে গিয়েছে।”
নন্দিনী চিৎকার করে উঠলো। তার পায়ের নিচ থেকে মনে হচ্ছে মাটি সরে যাচ্ছে। পৃথিবীটা দুলে উঠলো তার সামনে।
“একদম মিথ্যা কথা বলবে না। মীরন আমাকে ভালোবাসে। আজ আমাদের বিয়ে করার কথা। তুমি ওর নামে এতো বড় মিথ্যা বলছো?”
ছেলেটা বিরক্ত হয়ে বললো,”আপনি কে যে আপনার সামনে মিথ্যা বলতে যাবো আমি? আর কে আপনাকে ভালোবাসে, আজ বিয়ে করার কথা? মাথা ঠিক আছে আপনার? মীরন ভাই আরো দেড় বছর আগেই বিয়ে করেছেন গ্রামে। মীরন ভাই চাকরি পেলেই স্ত্রীকে শহরে নিয়ে আসবে।”
নন্দিনী মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গেলে কোনোরকমে দরজা ধরে নিজেকে সামলায়।
হঠাৎ পাশ থেকে আরেকটা ছেলে এসে বললো,”এই কি হয়েছে সে মজনু? দুপুরে একটু শান্তি করে ঘুমাতেও দিবি না? এতো চিৎকার চেচামেচি কিসের?”
“আরে দেখেন না মতি ভাই, এই আপা কোথা থেকে এসে বলতেছে মীরন ভাই নাকি উনাকে ভালোবাসে, আজ উনাদের বিয়ে করার কথা। আমি বললাম উনার স্ত্রী আছে, তার সাথেই দেখা করতে গ্রামে গিয়েছে মীরন ভাই। এখন আপা বলছে আমি নাকি মিথ্যা বলছি।”
মতি নামের ছেলেটা অবাক হয়ে নন্দিনীকে দেখে। বোরকার মধ্যে থাকা মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা। কিন্তু চোখ দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা অসম্ভব রূপবতী।
“আপা আমার কথাটা শুনেন, মীরন নামের এখানে একজনই থাকেন। উনার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, উনার স্ত্রীর কিছুদিন পরের সন্তান হবে। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”
নন্দিনী কথা বলতেও যেনো ভুলে গিয়েছে। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে তার। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাবে সে।
“বাবা আমার কিছু কাজ আছে। যদি এখানের কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে আমার জন্য ভালো হতো।”
নির্ঝর এখানে আসার পর প্রথম মুখ খুললো। তার গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ শুনে কিছুটা চমকে ওঠে রাজীব শাহ। এখন সে কি বলবে এদের?
মোতালিব খান হেসে রাজীব শাহের দিকে তাকিয়ে বললো,”আমিও তাই চাচ্ছি শাহ সাহেব। খাওয়া দাওয়াও তো হয়ে গেলো। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই নন্দিনী মা তৈরি হয়ে গিয়েছে।”
ফিরোজ আর তার বাবা দুইজন দুইজনের দিকে তাকায়। মর্জিনা বেগম ঘরে বসে সব শুনছে আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নিশিতা মুখ টিপে হাসছে। আজ সব অপমানের শোধ নেওয়া হবে।
(চলবে….)