#এই_মন_তোমারি [ শেষ থেকে শুরু]
#পর্ব_৩২
#লেখনীতে_নুজাইফা_নূন
-“শফিকুল দেওয়ান চায়ে চুমুক দিতে দিতে দরজা খুলে দেন। কিন্তু দরজা খুলে তিনি যেন ভুত দেখার মতো চমকে উঠেন।তার হাত থেকে চায়ের কাপ আপনা আপনি ফ্লোরে পড়ে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায়। তিনি অনেক টা অবাক হওয়া কন্ঠে বলে উঠলো, তুই এইখানে?”
-” শফিকুল দেওয়ান এর কথায় শাফায়াত অবাক হয়ে বললো, বাবা তুমি মিলি আন্টি কে আগে থেকেই চিনো?তোমরা কি আগে থেকেই পরিচিত?”
-” চিনবো না মানে? খুব ভালো করে চিনি এই ছলনাময়ী নারী কে। কিন্তু তুই এই ছলনাময়ী কে কোথায় পেলি?”
-” কয়েক মাস আগে নদীর তীরে একটা লাশ পাওয়া যায়।সেই লাশের পরিবারের সদস্যদের খুঁজতে গিয়ে মিলি আন্টির খোঁজ পাই।তিনি হসপিটালে অসুস্থ্য অবস্থায় ছিলেন। আমি তার চিকিৎসার সমস্ত খরচ বহন করি।আন্টির এই দুনিয়ায় নিজের বলতে কেউ নেই।তাই আন্টিকে আমি আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছি। আন্টি আমাদের বাড়িতে , আমাদের সাথে থাকলে তোমার কি কোনো সমস্যা আছে বাবা?”
-” না না ! আমার সমস্যা থাকবে কেনো?”
-“কিন্তু মিলি আন্টি তোমার সাথে ছলনা করেছে মানে? তুমি ঠিক কি বলতে চায়ছো বাবা? একটু ক্লিয়ার করে বলো প্লিজ।”
-” কি তখন থেকে মিলি আন্টি মিলি আন্টি মিলি আন্টি করছিস? ও মিলি নয়।ও নাইমা ।নাইমা দেওয়ান।তোর আম্মির মায়ের পেটের আপন বোন। একসাথে বেড়ে উঠা আমাদের। নাইমা কে প্রচন্ড ভালোবাসতাম আমি। আমি ওকে নিজের ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলাম। বিনিময়ে মুচকি হাসি হেসেছিলো নাইমা। আমি ও বোকার মতো ভেবেছিলাম নাইমা ও হয়তো আমাকে ভালোবাসতো।নাইমা কে ভালোবাসার ব্যাপার টা কিভাবে জানি চাচা বুঝতে পারে। প্রথমে চাচা রাজি হয় নি। আমি চাচার হাতে পায়ে ধরে চাচা কে রাজি করিয়েছিলাম। চাচা আমাদের দুজনের বিয়ে ঠিক করেছিলো। সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু বিয়ের দিন নাইমা আমাকে ঠকিয়ে চাচার মানসম্মানের কথা চিন্তা না করে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে যায়।পরে চাচা নিজের মানসম্মান বাঁচানোর জন্য নাজমার সাথে আমার বিয়ে দেয়।”
-” ওহ্ এজন্যই তুমি আম্মি কে কখনো ভালোবাসতে পারো নি।কারণ তোমার মনে যে অন্য কেউ ছিলো।”
-” ভুল করেছিলাম এই ছলনাময়ী কে ভালোবেসে। দাঁড়া দাঁড়া এক মিনিট! তুই একটু আগে কি জানি বললি? ওর দুনিয়াতে আপন বলতে কেউ নেই মানে?ওর স্বামী , সন্তান কি ওকে ছেড়ে দিয়েছে? জানতাম এমনটায় হবে।কারণ অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজে সুখি হওয়া যায় না।প্রকৃতির বিচার বলে একটা কথা আছে।ওর মতো মেয়ের সাথে এমনটায় হওয়া উচিত।”
-” এতোক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা শুনে চোখের পানি ফেলছিলো নাইমা।সে জানে সে আবেগের বশে কতো বড়ো ভুল করেছে।যার জন্য সে অনুতপ্ত।সে এতোটায় অনুতপ্ত যে এই পরিবারের মুখোমুখি কখনো দাঁড়াতে চান নি। কিন্তু কে জানতো এতো গুলো বছর তার পর ভাগ্যে তাকে আবারো সেই পরিচিত মুখগুলোর সামনে দাঁড় করাবে।আবারো মুখোমুখি হতে হবে তাদের। শাফায়াত কে দেখে নাইমার আপন কেউ মনে হচ্ছিলো। কিন্তু নাইমা যদি ক্ষুণাক্ষরে ও টের পেতো শাফায়াত শফিকুল আর নাজমার ছেলে সে কখনো এই বাড়িতে আসতো না। নাইমা চোখের পানি মুছে শফিকুল দেওয়ানের পা জড়িয়ে ধরে বললো, আমি জানি আমি যা করেছি তার কোনো ক্ষমা হয় না। তবুও বলছি আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও শফিকুল। তোমাদের কষ্ট দিয়ে আমি নিজেও ভালো নেই। প্রতিনিয়ত ধুঁকে ধুঁকে মরছি। আজ পনেরো টা বছর ধরে আমি আমার পাপের শাস্তি ভোগ করছি। বেঁচে থেকেও যেন প্রতিদিন একটু একটু করে মরছি। এতো দিন হয়তো শরীরে পচন ধরতো আমার। রাস্তার শেয়াল কু’কু’রের খাদ্যে পরিনত হয়ে যেতাম।”
-” মরে যাওয়া উচিত ছিলো তোর।”
-” নাজমা দেওয়ান সূরার ছবি বুকে নিয়ে অঝোরে কান্না করছিলেন। হঠাৎ নিচ থেকে চিৎকার চেঁচামেচি কান্নার আওয়াজ শুনে তিনি বাইরে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু বাইরে এসে এতো গুলো বছর পর নিজের ছোট বোন কে দেখে যেন তার পা থমকে যায়। বোন কে যে বড্ড ভালোবাসাতো নাজমা। নিজের জন্য একটা ড্রেস কিনলে নাইমার জন্য ও কিনতো। নিজের ফ্রেন্ডদের সাথে কোনো পার্টিতে গেলেও নাইমা কে ছাড়া যেতো না। বোনের জন্য নিজের জীবন ও দিতে পারতো।তাই তো যখন নাজমা জানতে পেরেছিলো যে শফিকুল তাকে নয় বরং নাঈমা কে ভালোবাসে তখন তিনি হাসি মুখে সবটা মেনে নিয়েছিলেন। বোনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে নিজের ভালোবাসার মানুষ কে বোনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বোন সবার সাথে ছলনা করেছিলো। নাজমা দেওয়ান সেসব কথা ভুলে দৌড়ে গিয়ে বোন কে নিজের বুকে টেনে নিয়ে চোখে মুখে অজস্র চুমু দিয়ে বললেন, একি হাল হয়েছে তোর? এতো দিন কোথায় ছিলি তুই? জানিস বোন তোকে কতো জায়গায় খুঁজেছি। কিন্তু তোর কোনো খোঁজ পাই নি। হঠাৎ তুই কোথা থেকে এলি?”
-” বোনকে ধরে নাইমা কান্না করতে করতে তার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা খুলে বললো।সব শুনে নাজমা দেওয়ান বললো পাপ বাপকেও ছাড়ে না বোন।যাই হোক তুই তোর পাপের শাস্তি পেয়ে গিয়েছিস ।এখন আর কান্না নয়।বাকি জীবন টা তুই আমাদের বাড়িতে আমাদের সাথে হাসি খুশি তে কাটাবি ।”
-” ঠিক আছে আপু।তোমরা ছাড়া যে আমার আর আপন বলতে কেউ নেই। আমি তোমাদের ছেড়ে আর কোথাও যাবো না। আমার যে এখনো আমার স্বামী সন্তান কে খুঁজে পাওয়া বাকি।”
-” তুই চিন্তা করিস না নাইমা।আমরা সবাই মিলে তোর বর আর তোর মেয়েকে খুঁজবো।”
-” জানি না আমার মেয়েটা এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? যেখানেই থাকুক আল্লাহ যেনো আমার মেয়েটাকে ভালো রাখে , সুস্থ্য রাখে। আমার মেয়েটাকে যেন আমার বুকে ফিরিয়ে দেয়।একটা বারের জন্য হলেও আমার মেয়েটাকে যেন আমি মায়ের আদর ভালোবাসা দিতে পারি।”
___________________________________
-” হসপিটালের সাদা বেডের উপর আকাশী রঙের পোশাক পরে শুয়ে রয়েছে সূরা।লম্বা চুলগুলো দুপাশে বেনি করে রাখা হয়েছে। মাথায় ,হাতে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। চেহারা কেমন যেনো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গিয়েছে। সূরা কে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।সূরার ঘুম ভাঙ্গতে’ই নার্স বাইরে গিয়ে একটা দম্পতি কে জানান। মূহুর্তের মধ্যে যেন খুশিতে তাদের চোখে ছলছল করে উঠলো।তারা দৌড়ে সূরার কাছে এসে সূরার কপালে চুমু দিয়ে বললো , এখন কেমন লাগছে মা?”
-” মোটামুটি ভালো। কিন্তু আমি এইখানে কেনো? আর আপনারা কারা?”
-” সূরার কথায় ভদ্রলোক বললেন, আমি শাহিন চৌধুরী ।এই শহরের সবাই এক নামে চিনে আমাকে। শিল্পপতি শাহিন চৌধুরী। অতঃপর শাহিন চৌধুরী তার পাশে থাকা ভদ্রমহিলা কে দেখিয়ে বললেন ও আমার স্ত্রী মনিরা চৌধুরী।জানো মা আমার টাকা পয়সা ধন দৌলত কিছুর অভাব নেই। শুধু অভাব একটা সন্তানের।আজ পনেরো বছর ধরে আমরা নিঃসন্তান।কতো দেশ বিদেশের ডক্টর দেখিয়েছি কিন্তু ফলাফল শূন্য। এখন মনে হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা আমাদের ডাক শুনেছেন। তিনি তোমাকে আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন।তোমাকে দেখে আমরা বুঝতে পেরেছি তুমি হয়তো অসহায় একটা মেয়ে। দেখো মা তুমি কে বা তোমার পরিচয় কি সেটা আমরা জানতে চাই না। পুরোনো সব দুঃখের কথা তুমি ভুলে যাও।তোমাকে আর কোনো দুঃখ কষ্ট স্পর্শ করতে পারবে না।আজ থেকে তুমি শানজানা ।শানজানা চৌধুরী।ডটার অফ শিল্পপতি শাহিন চৌধুরী।।
চলবে ইনশাআল্লাহ।।
আমার গ্ৰুপ : নূনের গল্প সাম্রাজ্য-Nuzaifa Nun ❤️