#এই_মন_তোমারি
#পর্ব_৩৯
#লেখনীতে_নুজাইফা_নূন
-” শাফায়াত ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি ছিটা দিয়ে এসে দেখলো অপারেশন থিয়েটার থেকে একজন মহিলা ডক্টর বের হচ্ছে।যার মুখে মাস্ক পরা রয়েছে। কিন্তু শাফায়াতের যেন ডক্টর কে চেনা চেনা মনে হলো। ডক্টর সামনে এগিয়ে আসতে’ই শাফায়াতের সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেল। শাফায়াত অনেক টা অবাক হয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো, আমার লজ্জাবতী ললিতা! শাফায়াতের বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয়।সে বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বললো, না না ! এটা কিভাবে সম্ভব? সূরা তো দশ বছর আগেই মা’রা গিয়েছিলো।মৃত মানুষ কিভাবে জীবিত হতে পারে? কিন্তু এই ডক্টর কে দেখে আমার এমন অসুখ করছে কেনো?এই দশ বছরের অনেক মেয়ের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে, কথা হয়েছে। কিন্তু কখনো এমন ফিল করি না।আজ যেমন টা ফিল হচ্ছে। শাফায়াত শার্টের উপরের দিকের দুটো বোতাম খুলে দিয়ে বললো, বড্ড হাঁসফাঁস লাগছে আমার।এ কোন রোগে ধরলো আমায়? মেয়েটা কে দেখার পর থেকে এই রোগের উৎপত্তি শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন মেয়েটার চোখে হাজার বছরের না বলা লুকিয়ে আছে। এমন ও তো হতে পারে এই ডক্টর’ই আমার সূরা। সূরা সেদিন মা’রা যায় নি। যেহেতু আমরা কেউ’ই সূরার লাশ দেখেছিলাম না। শাফায়াতের আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝে মেয়েটা মুখের মাস্ক খুলে বললো,
-” ডোন্ট টেক এ টেনশন। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।হি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার। ডক্টর মুখের মাস্ক খোলার সাথে সাথে নাজমা মঞ্জিলের প্রত্যেকে যেনো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। শাফায়াত তাল সামলাতে না পেরে হসপিটালের করিডোরে রাখা বেঞ্চিতে বসে পড়লো।নাইমার তার মেয়েকে চিনতে একটু ও অসুবিধা হলো না। মেয়েটা একদম সেই পরীর মতোই আছে। পার্থক্য শুধুমাত্র আগে সে ছোট ছিলো আর এখন সে পরিপূর্ণ নারী।নাইমা ছটফট করতে লাগলো মেয়েটা কে একবার বুকে জড়িয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার সাহস হলো না।সূরার হয়তো তার চেহারা মনেও নেই।মনে থাকবে’ই বা কিভাবে? তিনি মনে মনে বললেন, সেই ছয় বছর বয়সে মেয়েটাকে ফেলে আমি চলে এসেছিলাম।এখন আমি কোন অধিকার নিয়ে তার সামনে যাবো? আমার মেয়েটা যে বেঁচে আছে এটাই অনেক। আমি না হয় তাকে দূর থেকে ভালোবেসে যাবো বলে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলেন নাইমা।নাজমা দেওয়ান যেনো চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছেন।তিনি চোখে থাকা চশমাটা খুলে চোখের পানি মুছে দৌড়ে গিয়ে সূরা কে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চোখে মুখে অজস্র চুমু দিয়ে বললেন, তুই বেঁচে আছিস মা? দশটা বছর পরে তোকে এইখানে এইভাবে দেখতে পারবো এমনটা কখনো ভাবিনি। তুই এতো গুলো বছর কোথায় ছিলি সূরা? জানিস তোকে আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।তোর জন্য আরো একটা ভালো খবর আছে সূরা।তোর মা বেঁচে আছে। তুই আমার ছোট বোন নাইমার মেয়ে। এজন্যই তোকে প্রথম যখন আমি দেখেছিলাম , তোকে আমার আপন কেউ মনে হচ্ছিলো।কারণ তুই যে আমার মেয়ে।হোক সেটা বোনের মেয়ে।সবাই বলে মায়ের গন্ধ নাকি খালার গাঁয়ে পাওয়া যায়।সূরার মা বেঁচে আছে শুনে সূরার মধ্যে তেমন ভাবান্তর হলো না। মানুষ টার চেহারাও স্পষ্ট মনে নেই তার।সূরার নাজমা দেওয়ান এর জন্য মায়া হলো।তার খুব ইচ্ছে হলো নাজমা দেওয়ান কে বুকে জড়িয়ে নিতে। কিন্তু সূরা নাজমা দেওয়ান এর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
-” ম্যাম প্লিজ কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ।আ’ম শানজানা ।শানজানা চৌধুরী।নট ইউর সূরা বলে চোখের পানি আড়াল করতে চোখে সানগ্লাস পরে হসপিটাল থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়ানোর আগেই শাফায়াতের দিকে সূরার চোখ পড়লো। মানুষ টাকে দেখে সূরার বুক ধুক করে উঠলো। সূরা মনে মনে বললো, আমার পুলিশের কতো পরিবর্তন এসেছে। আগের সেই হ্যান্ডসাম লুক নেই তার মধ্যে। মাথায় কালো চুলের আড়ালে কিছু সাদা চুল উঁকি দিচ্ছে।আগে থেকে অনেক টা শুকিয়ে গিয়েছে। কেমন বিধ্বস্ত লাগছে মানুষ টাকে দেখে।কি অদ্ভুত নিয়তি! যাকে সুখে দেখবো বলে আমি বাংলাদেশে ছেড়ে কানাডা পাড়ি জমিয়েছিলাম আজ সেই মানুষটা সুখে নেই। এই মানুষ টাকে একটা নজর দেখার জন্য আমার কানাডা থেকে বাংলাদেশে ছুটে আসা।আজ থেকে দশ বছর আগে আমি সেদিন ফোনে তার কণ্ঠস্বর শুনে নিজেকে শান্ত করতে পারি নি। বারবার মনে হচ্ছিলো আমি তার কাছে ছুটে চলে আসি।তাকে তরী আপুর বুক থেকে ছিনিয়ে নেয়। অনেক কষ্ট করে সেদিন নিজেকে শক্ত করেছিলাম। আমি শফিকুল দেওয়ান এর মুখোমুখি হতে চেয়েছিলাম। বারবার আমার শ্বাশুড়ি মায়ের চেহারা টা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। আমি আমার সূরা কে শাফির যোগ্য করে তুলবো।পুরো পৃথিবী আমার সূরা কে চিনবে কথাটা কানে বাজতে লাগলো সূরার। সূরা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে শাহিন চৌধুরীর কাছে গিয়ে বললো,
-” বাবা আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।আমি একজন নামকরা ডক্টর হতে যায়। আমি এই পৃথিবীকে দেখিয়ে দিতে চাই যে মেয়েরা চায়লে সব পারে। শাহিন চৌধুরী সূরার কথা শুনে তাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে মা।আমি সব ব্যবস্থা করছি।এরপর সূরা ডাক্তারী পড়াশোনার জন্য কানাডা পাড়ি জমায়।যদিও সূরার কখনো বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু তার সুন্দর ব্যাডা মানুষ তাকে অনেক পীড়া দিতো। অনেক আজে বাজে স্বপ্ন দেখতো তাকে নিয়ে।এক পর্যায়ে সূরা নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারে না। পুরোনো রাগ অভিমান ভুলে বাংলাদেশে আসে তার প্রিয় মানুষগুলোর মুখ দেখতে। বাংলাদেশে আসার পর সূরা শফিকুল দেওয়ান এর ব্যাপারে সব জানতে পারে। শফিকুল দেওয়ান যে হসপিটালে এডমিট ছিলো সেখানকার ডক্টরের সাথে যোগাযোগ করে তাকে জানান সূরা নিজে তার অপারেশন করবে। ব্যাপার টা শুনে ডক্টর অনেক অবাক হয়ে গিয়েছিলো।কারণ তারা ডক্টর শানজানা চৌধুরীর ব্যাপারে জানে।তার মতো এমন নামকরা একজন ডক্টর নিজে তার পেশেন্টের ট্রিটমেন্ট করতে যাচ্ছে এটা যেন তার বিশ্বাসী হচ্ছিলো না।যদিও ডক্টর তাকে মোটা অংকের টাকা অফার করেছিলো। কিন্তু সূরা নিজের জন্য একটা টাকাও নেয় নি।সে নিজের সবটুকু দিয়ে শফিকুল দেওয়ান এর ট্রিটমেন্ট করেছে। মানুষ টার প্রতি যে সে কৃতজ্ঞ। সে তাকে মন থেকে ক্ষমা করে দিয়েছে।সে তাকে আঘাত দিয়েছিলো বলেই সূরা পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনায় পরিনত হয়েছে। নিজেকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে তাকে আজ সবাই এক নামে চিনতে পারে ডক্টর শানজানা চৌধুরী।সূরা সবার আড়ালে চোখের পানি মুছে সামনের দিকে আগানোর আগেই একটা বাচ্চা ছেলে এসে শাফায়াতের গলা জড়িয়ে ধরে বাবা বলে কপালে চুমু দিলো।সূরা বাচ্চাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।তরীর চেহারার সাথে বাচ্চাটার চেহারার অনেক মিল পেলো সূরা।আর সূরার ধারণা কে সত্যি করে দিয়ে তরীর ও বাচ্চাটার পিছু পিছু এসে শাফায়াতের থেকে বাচ্চাটা কে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, তোমার বাবার শরীর ঠিক নেই সোনা। তুমি বাবা কে বিরক্ত করো না সোনা।তরী কে দেখে যেনো সূরার পুরোনো ক্ষত টা তাজা হয়ে গেলো।সে মনে মনে বললো বাহ্ ! আমাকে ছেড়ে তাহলে ভালোই আছে পুলিশ।বাচ্চা ও পয়দা হয়ে গিয়েছে।আপনার মনে যে তরী ছিলো। এজন্যই আমি যখন বাচ্চা চেয়েছি তখন আমার নিজেকেই বাচ্চার উপাধি দিয়েছেন।কারণ আপনি শুধু মাত্র তরীর বাচ্চার বাবা হতে চেয়েছেন।আর হয়েছেন ও। শুধু মাত্র আমি আমিই পারলাম না আমার এই মন টা দ্বিতীয় কাউকে দিতে।আর কখনো বোধহয় এই মন অন্য কাউকে দিতে পারবো না পুলিশ।কারণ #এই_মন_তোমারি ছিলো আর আজীবন থাকবে।।
চলবে ইনশাআল্লাহ।।
আমার গ্ৰুপ : নূনের গল্প সাম্রাজ্য-Nuzaifa Nun ❤️