#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-২৩,২৪♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🍂
.
কপালে এক হাত দিয়ে জ্বীবের এক সাইডে কামড় দিয়ে চোখ বড়বড় করে সামনে তাকিয়ে আছে নিত্য। তার ঠিক সামনেই চকলেট ক্রিমে মাখামাখি অবস্থায় রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে অগ্নি।
.
একটু আগেই কেক বানানোর জন্য চকলেট ক্রিম বানাচ্ছিলো নিত্য। সেই মুহূর্তে নিত্য কিচেনে একা থাকায় অগ্নি চুপিচুপি নিঃশব্দে কিচেনে ঢুকে পড়ে। তার উদ্দেশ্য ছিল নিত্যকে চমকে দেওয়া। কিন্তু তার এই চমকে দেওয়া যে তাকে চকলেটে গোসল করিয়ে ছাড়বে তা সে কল্পানাতেও ভাবতে পারেনি কোনোকালেই। তার মতে একজন মেডিকেলে পড়ুয়া ছাত্রি নিতান্ত্যই সাহসী হবে। কিন্তু নিত্য যে সবার থেকে ব্যতিক্রম তা সে এখন বেশ বুঝতে পারছে।
.
অগ্নি নিত্যকে সারপ্রাইজ দেবে বলে পা টিপেটিপে নিত্যর পেছনে গিয়ে “ভাউউউ” করে চেঁচিয়ে উঠেছিলো। সেই সময় নিত্য চকলেট ক্রিম বানাচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে কারো ভাউউ করে উঠায় হাতে চকলেটের বোলটা নিয়ে চিৎকার করে ঘুরে দাঁড়ায় সে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ক্রিমগুলো ছিটকে অগ্নির ওপর পড়ে যায়, যার ফলস্বরূপ অগ্নি এখন চকলেটের ভূতে পরিণত হয়েছে!
.
– আ…আ…আম সো সরি! আ…আসলে আমি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ কারো চেঁচানোর আওয়াজে ভয় পেয়ে ঘুরতে গিয়ে…ইয়ে মানে ওই চকলেটগুলো আরকি….! হেহে! (জোড়পূর্বক দাঁত বের করে হেসে দিয়ে)
.
নিত্যর এখন ঠিক কি করা উচিৎ তা সে বুঝে উঠতে পারছেনা। বারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে যাচ্ছে সে। তার মতে অগ্নি এখনই অগ্নিমূর্তি রূপ ধারণ করবে। আগের ফ্লেবারে কনভার্ট হয়ে দু চারটে থাপ্পড়ও বসিয়ে দিতে পারে সেই ভয়ে আগে থেকেই দুগালে দুহাত চেপে ধরে রেখেছে নিত্য।
কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে অগ্নি নিজের গালে লেগে থাকা চকলেট এক আঙুলে স্লাইড করে নিয়ে, আঙুলটি মুখে ঢুকিয়ে দেয়। অগ্নির কান্ড দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা নিত্য। বোকার মতো হা করে অগ্নিকে দেখে বোঝার চেষ্টা করছে যে এক্সাক্টলি ঠিক কি করতে চাইছে সে। অগ্নি ঠোঁট পাউট টাইপ করে নাড়িয়ে চাড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে চোখ দুটো এদিক ওদিক ঘুরিয়ে আনমনেই বলে উঠলো,
.
– সবই ঠিকঠাক তবে একটু সল্ট দিতে হবে। না হলে কেমন যেন বিদঘুটে টাইপ টেস্ট আসছে।
.
বলেই উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটা ধরলো অগ্নি। যা দেখে নিত্যর মুখের “হা” আগের তুলনায় আরোও দ্বিগুণ আকার ধারণ করলো। আনমনেই বলে উঠলো সে ,” হা! এটা কি হলো!”
.
🌼
.
গত আড়াই ঘন্টা যাবৎ আমি মাত্র দুটো বিক্রিয়া মুখস্থ করেছি। তাও মাঝে মাঝে সংকেতগুলো গুলিয়ে ফেলছি। যদি বইয়ের পাতাগুলো খেয়ে ফেললেও পড়াগুলো মুখস্থ হতো তবে আমি ছাগলের মতো গাছের পাতার বদলে বইয়ের পাতাগুলোই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতাম নির্ঘাত।
কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। বইয়ের পাতা গুলো পানিতে গুলিয়ে জুস বানিয়ে খেলেও তা আমার ছোটখাটো মাথায় ঢুকবে না।
সামনেই জল্লাদের মতো কোপ বসানোর জন্য বসে আছে সাদা বিলাই। উনাকে দেখেই আমার রুহু কেঁপে উঠছে। একটু পর পর একটা করে পানির গ্লাস শেষ করে চলেছি আমি।
গলাটা এবার আগের থেকে আরোও বেশিই শুকিয়ে এলো যখন নীবিড় ভাইয়া কড়া গলায় বলে উঠলেন
“দেখি এতোক্ষণ ধরে কতোটুকু পড়লে, বই রাখো নোট বুক বের করো।”
উনার কথাটা শুনা মাত্রই বুলের বামপাশে একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এই বুঝি বুক ফেটে কান্না করে পুরো বন্যা বইয়ে দেবো আমি। গলা আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল আবারও। তাই উনার দিকে আবারোও অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে করুণ স্বরে বলে উঠলাম,
.
– নী..নীবিড় ভা…ভাইয়া…! আর..এক গ্লাস পানি প্লিজ….!
.
নীবিড় ভাইয়া বিনিময়ে মাথা ঘুরিয়ে বেড টেবিলে থাকা পানির জগ টা নিচ থেকে উপরে চোখ বুলিয়ে আবারোও আমার দিকে মাথা ঘুরিয়ে শান্ত সুরে বলে উঠলেন,
– এই পর্যন্ত ঠিক কয় গ্লাস পানি খেয়েছো বলতে পারো?
.
আমি প্রথম থেকে মনে করে করে একটা করে আঙুল বের করতে করতে শেষে হাতের পাঁচটা আঙুলই বের করে দেখিয়ে ঠোঁট উল্টালাম।
সাথেসাথেই উনার হাই ভোল্টেজ ওয়ালা এক ধমক খেয়ে জমে গেলাম আমি।
.
– ৫ গ্লাস পানি খেয়ে পুরো জগ খালি করে ফেলোছো। এরপরেও তোমার গলা শুকায় কিভাবে? ওটা তোমার পেট নাকি কূয়া! সব পানি দিয়েই ভর্তি করে ফেললে ডিনার কোন পেটে ঢুকাবে? স্টুপিড!
.
– কেনো? আপনার পেটে! 😁
.
বলেই নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরলাম আমি। এতোক্ষণ মনে মনে উনাকে অনেক কথা শুনালেও এবারেরটা এভাবে মুখ ফোসকে বের হবে কে জানতো?
কিন্তু অবাক করা বিষয় উনি মুখে কিছুই না বলে বসা থেকে উঠে গেলেন। উঠেই আমার দিকে এগোতে লাগলেন। যা দেখে আমার প্রাণপাখি যেনো যায় যায়!
.
– আমার পেটে ঢুকাবে তাইনা? তা কিভাবে শুনি?
– আ..আ..আমি তো ওটা..ভ..ভুলে বুলে ফেলেছি ভা…ভাইয়া! সুরি!
– হোয়াট? ওই সুরি টা আবার কি?
– হেহে! “সরি” এর তোতলা ভার্সন! (দাঁত বের করে)
– শা….ট আ….প! সাচ আ স্টুপিড গার্ল! চুপচাপ পড়ো।
.
বলেই জগ টা নিয়ে রুম থেকে ধরাম করে দরজাটা লাগিয়ে চলে গেলেন। আর আমি এক লাফ মেরে উঠে পড়লাম। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতে লাগলাম। এই সুযোগ আমাকে পালাতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সাদা বিলাই আমার সুযোগের মাথা কেটে দরজাটা বাইরে থেকে লক করে চলে গেছেন।
.
মেজাজটা পুরোপুরি বিগড়ে গেলো আমার। দিনে দুপুরে এতো অত্যাচার আর সহ্য করা যাচ্ছে না।
মনের ক্ষোভ মেটাতে জোড়ে একটা চিৎকার দিয়ে বসলাম আমি।
– ” সাদা বিলাইয়ের বাচ্চা….! তোর কপালে বউ জুটবে না দেখে নিস। শাঁকচুন্নি তোর ঘাড় মটকাবে। একসাথে ১০০ টা কুত্তার তাড়া খাবি তুই….!”
.
বলেই দরজায় জোড়েসড়ে একটা লাথি মেরে আবারোও অগত্যা টেবিলে বসে বইয়ে মুখ গুঁজলাম আমি।
.
🌹
.
– আরে ওইদিকটায় দেখুন। বেলুনগুলো তো খুলে যাচ্ছে!
.
– হেই জাস্ট ডোন্ট ওয়ারি এটম বোম্ব! (রাত্রি চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই) উপপস! আই মিন মিস. হোয়াট?
.
– রাত্রি…! (দাঁতে দাঁত চেঁপে)
.
– ওহ ইয়েস..! রাত্রি, রাইট? ওকে ওকে আমি ঠিক করে দিচ্ছি!
.
বলেই টুলের ওপর উঠে গেল রুশো! ব্যানারের পাশে বেলুনগুলো ঠিক মতো লাগিয়ে যেই না নিচে নামতে যাবে ওমনি টুল থেকে পা স্লিপ কেটে সোজা রাত্রির ওপর গিয়ে পড়লো সে। রাত্রি এমন আকস্মিক ঘটনায় টাল সামলাতে না পেরে নিজেও পড়ে যায় ফ্লোরে!
.
রুশো রাত্রির ওপরে আর রাত্রি রুশোর নিচে। রুশো এক দৃষ্টিতে রাত্রির দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো কোনো যাদুঘরের ভাস্কর্য পর্যবেক্ষণ করছে সে। এদিকে রাত্রি রুশো কে ধাক্কিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাতে কোনো লাভই হচ্ছে না তার! রুশো আগের মতোই ঘোর লাগানো দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।
.
– ওই ব্যাটা ধলা ইন্দুর! উঠ বলতেছি!
.
নাহ চেঁচিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। রুশো আগের মতোই রিয়াকশন ছাড়া ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে তার দিকে। রাত্রির শরীরে এতোটা শক্তিও নেই যে রুশো ধাক্কিয়ে ওপর থেকে ফেলে দেবে। শেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে নিজের মাথা দিয়ে রুশোর মাথায় “”ঢিশুম”” করে একটা বারি মেরে দিলো রাত্রি। রুশো “আউউউচ” করে মাথা চেপে ধরে সরে যেতেই রাত্রি চট করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কপালে হাত বুলাতে থাকে। সে নিজে থেকে মারলেও অনেকটা ব্যথা লেগেছে নিজেরই। নিউটনের বলের তৃতীয় সুত্র মোতাবেক যেমন বলা হয়েছে “প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত মূখি প্রতিক্রিয়া রয়েছে!” ঠিক তেমনই আঘাত দিতে যেতে উলটে আঘাত লেগেছে রাত্রিরোও।
.
– ওরে আমার বিউটিফুল কপালে পটেটো বানিয়ে ফেললো রে…….! (কপাল চেপে ধরে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলে উঠলো রুশো)
.
রাত্রি কপাল ঘষতে ঘষতেই চোখ বড়বড় করে বলে উঠলো,
– মানে? কপালে পটেটো?
.
– আরে আলু আলু! আলু বানিয়ে ফেললে তুমি আমার কপালে। আউউউচ! উহুহুহু!
.
রুশোর কথা শুনে না চাইতেও হাসি পেলো রাত্রির। তাও হাসি উপেক্ষা করে রাগি ফেইস নিয়ে আবারোও কপালে হাত বুলাতে লাগলো নিজের।
রুশো উঠে দাঁড়িয়ে রাত্রিকে নিজের কপালে হাত বোলাতে দেখে চিন্তিত হয়ে বলে উঠলো,
.
– ইশশ তোমারও লেগে গেলো! প্লিজ, আমায় হার্ট করবে সে ঠিক আছে। বাট নিজেকে হার্ট করে আমায় মেরোনা।
.
রাত্রি রুশোর এমন কথায় কিছুটা অবাক হয়। পর মুহূর্তে আবারো ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো,
– একটা কাজও কি ঠিক মতো করতে পারেন না আপনি? আর মেয়ে মানুষের মতো পড়ে গেলেন কেনো। ইভেন এতোবার বলার পরই বা সরছিলেন না কেনো আমার ওপর থেকে?
.
– আরে আরে কাম অন! জাস্ট রিল্যাক্স না! এতো হাইপার হলে ডেকোরেশন করবে কি করে? হাও? সো জাস্ট চিল। ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো জাস্ট। নাথিং এলস! এন্ড সরি ওনাস এগেইন ফর…..
.
বলেই টুপ করে নিজের কপালের সাথে রাত্রির কপালে আরেকবার আস্তে করে বারি মেরে উলটো দিকে ফিরেই দৌড়ে যেতে যেতে বলে উঠলো,
– ছোটবেলায় মাম্মা বলতো, কারো সাথে মাথায় একবার বাড়ি খেলে শিং গজায়। দুবার খেলে আর গজায় না। আমার সুইট কিউট ফেইসে শিংটা খুবই বাজে লাগবে, সো আরেক টা বারি দিলাম। সরি এটম বোম্ব…….!(জোড়ে টান দিয়ে)
.
রুশো আর রাত্রির দিকে ফিরে তাকায় নি। এক ছুটে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেছে সে। একবার যদি ফিরে তাকাতো তাহলে রেগেমেগে বোম্বাই মরিচ হয়ে যাওয়া রাত্রিকে ঠিকই দেখতে পেতো!
.
🍁
.
– খেতে এসো ডিনারের টাইম হয়ে গেছে! তোমার দ্বারা পড়াশুনা হবে না তা বোঝা হয়ে গিয়েছে আমার। তাড়াতাড়ি এসো। কুইক।
.
বলেই চলে গেলেন নীবিড় ভাইয়া। উনি যেতেই আমি উনাকে হাজারটা গালি বিড়বিড় করে দিতে দিতে ডাইনিং টেবলে এসে বসলাম। সবার আগে থেকেই এসে বসে গল্প জুড়ে দিয়েছে। আমার সাথে কেউ কথাই বলছে না। সবাই একে ওপরের সাথে কথা বলতেই ব্যস্ত। এমনকি রাত্রি পেত্নিটাও আমাকে ভুলে গিয়েছে। নিত্য আপুর সাথে কি সুন্দর হেসে হেসে গল্প করছে। আর এই তিন বান্দরের দল তো গল্পের ঝুলি খুলে বসেছে যেনো। আমি শুধু মুখ ফুলিয়ে দেখে যাচ্ছি সব কিছু। বড্ড অভিমান হচ্ছে আমার। ঠিক আছে ওরা কথা বলবে না তো আমিও বলবো না। আমার কি ঠেকা! যত্তসব!
আম্মুও তেমন কথা বললো না। আব্বু নাকি আজ ঘরেই খাবে। অফিস থেকে টায়ার্ড হয়ে ফিরেছে। তাই আম্মু আমাদের খেতে দিয়ে নিজের জন্য আর আব্বুর জন্য খাবার বেড়ে নিয়ে চলে গেলো।
.
কোনোরকমে রাগে গজগজ করতে একটু খেয়েই উঠে পড়ি আমি। উঠেই বড়বড় পায়ে ঘরের দিকে হাটা ধরি। আজ খেতেও ভালো লাগছেনা। তাছাড়া অর্ধেক পেট তো তখন পানি খেয়েই ভরিয়ে ফেলেছি। কে জানে আজ বাথরুম যেতে যেতে ঘুম হবে কিনা।
আমি কিছুদূর আসতেই পেছন থেকে সবার চাপা হাসির আওয়াজ ভেসে আসছিলো। তাতে আমার কি? হাসুক। হাসতে হাসতে শহীদ হয়ে যাক সবাই, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না হুম।
.
.
.
চলবে…………………..💕
#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-২৪♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
ছাদে পা রাখা মাত্রই আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম যেনো। নড়বার শক্তিও হাড়িয়ে ফেলেছি আমি। শুধু মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রয়েছি।
.
ছাদের আনাচে কানাচে নীল সাদা মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো। পুরো ছাদের সাথে ফুলের টবগুলোও ঝকমক করছে। আমার দোলনাটায় এত্তোগুলো ফুল দিয়ে সাজানো। ছাদের মাঝ বরাবর একটা গোল টেবিল তার ওপরে আমার পছন্দের এত্তোবড় একটা কেক। তার ঠিক পেছনে খানিকটা উঁচুতে বড় একটা ঝুলানো ব্যানার টাঙানো। তার দুপাশে নীল সাদা রং এর বেলুন লাগানো। ছাদের প্রত্যেকটা পিলারে বেলুনের বাহাড়। এমনকি পুরো ছাদের ফ্লোরেই বেলুনের ছড়াছড়ি।
.
নিত্য আপু খুব মন দিয়ে কেক ডেকোরেশন করছে। রাত্রি ক্যান্ডেল হাতে টেবিলের দিকে যাচ্ছে। অগ্নি ভাইয়া দুহাতে দুটো টেডিবিয়ার নিয়ে দোলনায় রাখছে। ওদিকে রুশো ভাইয়া বেলুন ফোলাচ্ছে। বর্তমানে অর্ধেক ফুলিয়েছে। কিন্তু শুধু নীবিড় ভাইয়াকে কোথাও দেখতে পারছিনা।
.
হঠাৎ, আমাকে দেখে সবাই একদফা ভূত দেখার মতো চমকে গেল। সবাই যেনো স্টাচু হয়ে গিয়েছে। রুশো ভাইয়ার অর্ধেক ফোলানো বেলুন ফুসসসস….! করে চুপসে ভাইয়ার মুখ থেকে উড়ে গেলো।
পর মুহূর্তে সবাই ঘড়ির দিকে এক পলক চেয়েই একসাথে “Happy Birthday Anannya” বলে চেঁচিয়ে উঠলো। সাথে সাথেই এক বস্তা গোলাপ ফুলের পাপড়ি আমার ওপর এসে পড়তে শুরু করলো। আমি অবাক হয়ে ওপরে তাকাতেই দেখি এই ফুলের পাপড়ি গুলো এমনি এমনি নয় বরং আমার হ্যান্ডসাম সাদা বিলাই আমার ওপর ছড়াচ্ছেন। উনাকে এক পলক দেখেই আমার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। এত্তো সুন্দর সারপ্রাইজ দেখে খুশিতে আমার হাত পা অবশ হয়ে আসছে। চোখে পানি চিকচিক করছে। এ তো কোনো কষ্টের অশ্রু নয় এতো পরম সুখের অশ্রুকণা!
.
নীবিড় ভাইয়া ওপর থেকে ততক্ষণাত নেমে এলো। উনি বাদে বাকি সবাই দৌড়ে এসে আমার খুব টাইডলি হাগ করে বসলো,
.
– কি টাইমিং রে অনু! আমরা তো কাজে কাজে ভুলেই গিয়েছিলাম ১২ টা বেজে আসছে। একদম ঠিক টাইমে ছাদে এসেছিস। (অগ্নি)
.
– বার্থডে গার্ল, তো বলো কেমন লাগলো আমাদের দেওয়া সারপ্রাইজ? (নিত্য)
.
– স্পিচলেস! আমি বাকরুদ্ধ! (আনমনেই বলে উঠলাম)
.
সবাই আমার কথা শুনে হাসা শুরু করে দিলো। রাত্রি আমার মাথায় একটা চাটি মেরে বলে উঠলো,
– অনন্যা রে, তোর সবার বার্থডে মনে থাকে আর নিজেরটাই ভুলে গিয়েছিলি?
.
আমি মাথা চুলকে চুলকে বলে উঠলাম,
– সেই রে! তোর অত্যাচার দিন দিন বেরেই চলেছে। দেখ এখনই সব ভুলে যাচ্ছি। তোর চেঁচামেচিতে না নিজেকেই ভুলে যাই!
.
রাত্রি আমার কথা শুনে চোখ ছোটছোট করে কেবল বকতে যাবে তার আগেই রুশো ভাইয়া চোখমুখ ঢেকে বলে উঠলো,
– প্লিজ! ছুটকির বার্থডের দিন এটলিস্ট এটম বোম্ব ফাটিয়ো না।
.
ভাইয়ার কথায় হু হা করে হেসে উঠলাম আমরা। আর রাত্রি কটমট করে ভাইয়ার দিকে তাকিয়েও আমার জন্য কিছু বললো না।
.
– হ্যা রে ভাইয়া! আম্মু আব্বু কেও ডাকতি!
.
– নারে আম্মু আব্বু জানেই। আর আব্বুর তো রাত জাগা যাবেই না। আম্মুকে আসতে বলেছিলাম বাট বললো ছোটদের মধ্যে আসতে চাইলো না। বিকেলে তো আয়োজন করবেই তখন সবাই থাকবে। চিন্তা করিস না। এটা তো জাস্ট আমাদের প্লান ছিলো। (অগ্নি)
.
– হেই ব্রো সিস, তোমাদের হলে চলো, ছুটকিকে দিয়ে কেক কাটাই। আমি আর ওয়েট করতে পারছিনা ট্রাস্ট মি! ইশশ দেখতেই কি ইয়াম্মি লাগছে খেতে কেমন লাগবে ভাবলেই….! (রুশো)
.
রুশো ভাইয়ার কথায় হেসে উঠলাম আমরা সবাই। এমনি এমনি কি আর ওকে জোঁকার বলা হয়?
নিত্য আপু টেবিল থেকে কিছু একটা এনে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
.
– অনন্যা, এটা তোমার জন্য!
.
বলেই আমার মাথায় একটা সাদ পাথরের তাজ পড়িয়ে দিলো। তাজটা অসম্ভব সুন্দর! সিম্পলের মধ্যে। যেমনটা প্রিন্সেসরা পরে অনেকটা সেরকমই।
.
– থ্যাংকইউ সো মাচ আপুউউউউ!
.
– থ্যাংক ইউ আমায় না বলে ওই যে ভাইয়াকে বলো। ভাইয়া সারা মার্কেট ঘুরে বেছে বেছে এই তাজ টা নিয়ে এসেছে।
.
আপুর কথা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। বলে কি! নীবিড় ভাইয়া কিনেছে এটা? তাও আমার জন্য? উনার মতো বদমেজাজি, গোমড়া মুখো সাদা বিলাই কি না আমার জন্য কিনেছে? উনি তো আমায় সহ্যই করতে পারেন না। সবটাই কি তবে বেস্টফ্রেন্ডের বোন দেখেই?
হবে হয়তো! ভেবেই একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়লাম আমি। আসলেই উনার পছন্দ আছে বৈকি।
.
🍂
.
আজ থেকে উনিশ বছর পূর্ণ হলো আমার। সেই সুবাদেই কেকের ওপরে “1” এন্ড “9” ডিজিটের দুটো ক্যান্ডেল জ্বালানো।
নিত্য আপুর ট্যালেন্ট দেখে আমি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। এটা যে ঘরে বানানো কেক বোঝার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। ডেকোরেশন ও তাই। একটা স্মাইলি ফেইস আঁকানো তাতে। পাশে বড়বড় করে আমার নাম লেখা! ওরে ট্যালেন্ট রে। আর আমি চা পর্যন্ত বানাতে পারি না, ভেবেই নিজের গালে আস্তে করে একটা চড় বসিয়ে দিলাম।
.
– ওই ফুঁ দে। (অগ্নি)
– হ্যা! অনন্যা কি ভাবছো ফুঁ দাও। (নিত্য)
.
আমার এক পাশে অগ্নি ভাইয়া, আরেক পাশে রাত্রি। রাত্রির পাশে রুশো ভাইয়া, আবার রুশো ভাইয়ার পাশে নীবিড় ভাইয়া, আর উনার পাশে নিত্য আপু। আবার নিত্য আপুর পাশে অগ্নি ভাইয়া। বলতে গেলে সবাই আমাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ঠিক সামনে নীবিড় ভাইয়া।
অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপুর তাড়া দেওয়ায় আস্তে করে হেলে ফুঁ দিলাম। কিন্তু কপাল আমার একটা ক্যান্ডেল নিভলেও আরেক টা নিভে নি। তা দেখে সবাই হেসে দিলো আর অগ্নি ভাইয়া আমার মাথায় চাটি মেরে বলে উঠলো,
.
– ওরে আহাম্মক রে। সামান্য দুটো ক্যান্ডেলও ফুঁ দিয়ে নেভাতে পারে না।
.
ভাইয়ার হাতে একটা চিমটি কেটে দিয়ে ভেংচি কাটলাম আমি। এবার জোড়ে একটা ফুঁ দিয়ে দুটো ক্যান্ডেলই ফেলে দিলাম।
.
🌸
.
কেক কেটে পড়লাম মহাবিপদে। সবার আগে কাকে খাওয়াবো এই নিয়ে টেনশনে পড়ে গেলাম। শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ডান দিক থেকে যতদূর হাত যায় ততদূর যে যে থাকবে তাকে খাওয়াবো দেন বাম দিকে যারা থাকবে তাদের খাওয়াবো। সেই সিদ্ধান্তেই অটুট হয়ে ভাইয়াকে আগে কেক খাওয়ালাম। কেকের টুকরোটা ছোট করে কাটায় অগ্নি ভাইয়াকে খাইয়ে নিত্য আপুকে দিয়েই শেষ হয়ে গেল। তবে একটা জিনিস খেয়াল করলাম কেক খাওয়ানোর সময় দুজনই লজ্জা টাইপ মুচকি মুচকি হাসছিলো। হাসুক ঠিক আছে বাট লজ্জা লজ্জা ফিলিংস কেনো? ভাববার বিষয় হলেও ব্যাপারটা তেমন পাত্ত না দিয়ে আবারোও কেক কেটে এক পিস নিলাম রাত্রিকে খাইয়ে রুশো ভাইয়াকে দিবো তখনই দেখি ভাইয়া আগে থেকেই হা করে রয়েছে। আমি ফিক করে হেসে পুরো পিস টাই রুশো ভাইয়াকে দিয়ে দিলাম। রুশো ভাইয়াও মনের সুখে কেক খেতে লেগে পড়লো।
.
এবার আমার বুক ধুক ধুক করছে কারণ লাস্ট ওয়ান যিনি এখনোও কেক খান নি তিনি হলেন ওয়ান এন্ড ওনলি মুখসধারী সাদা বিলাই। উনাকে চেনা বড়ই মুশকিল। সবার সামনে আমার সাথে হেসে হেসে কথা বললেও, কেউ না থাকলে একেবারে সাবান ছাড়াই ধোলাই দিয়ে ছেড়ে দেন। হাহ!
আচ্ছা উনাকে খাওয়ানো টাকি খুব জরুরী? না খাওয়ালে হয় না? উনি তো তাকাচ্ছেন ও না। তাহলে বরং নাই খাওয়াই।
এসব আকাশ পাতাল ভাবছি তখনই ভাইয়ার গলা কানে এলো,
.
– কিরে? কি ভাবছিস? নীবিড় কে খাওয়া।
.
ভাইয়ার ভাবনার মাঝখানে সাইকেল চালানোর জন্য আমার সাজানো গোছানো পরিকল্পনাটা একদম মাঠে মারা গেল। আমি মুখ গোমড়া করে এক পিস কেক নিয়ে উনার সামনে গেলাম। উনি আমাকে দেখে কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকালেন, সাথে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুললেন। যা জানান দিচ্ছে তিনি মনে মনে কোনো ফন্দি আটছেন নিশ্চয়। আমি ভয়ে ভয়ে উনার মুখের কাছে কেকের টুকরোটা এগোতেই উনি আমার হাত ধরে কেকের সাথে আমার হাতের আঙুলও মুখে ঢুকিয়ে নিলেন। এমন আকস্মিক ঘটনায় আমি চোখ বড়বড় করে ফেললাম। সাথেসাথেই উনি আমার আঙুলে “কচ” করে কামড় বসিয়ে ছেড়ে দিলেন। আমি ব্যাথায় যেই না মুখ খুলে চেঁচাতে যাবো তার আগেই উনি কৌশলে কেকের বাকি অংশ আমার মুখে পুড়ে দিলেন। সবটা সবার অগোচরেই ঘটে গেল। কারণ সবাই তো মজা করতে ব্যস্ত।
নীবিড় ভাইয়া আমার দিকে বাম সাইডের ভ্রু উঁচু করে নিজের ঠোঁট বামদিকে বাঁকিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ভাইয়াদের কাছে চলে গেলেন।
আর আমি কেক নিয়েই মুখ ফুঁলিয়ে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছি। কেক টাকে চাবানোর কথাও মাথায় নেই আমার।
হঠাৎ মনে পড়ায় কোনোরকমে কেকটা গিলে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। কি হলো একটু আগে? ইয়া আল্লাহ! আমাকে বাঁচাও এই জল্লাদের কাছ থেকে। দিনে দুপুরে এতো অত্যাচার আর সহ্য করা যায় না।
ভাইরে তুই কি এই দুনিয়ায় আর বেস্টু পাইস নাই?
.
🌹
.
– মাম্মিইইইইইইইইইই……………..!
.
বলে চেঁচিয়েই ভয়ে কুঁকয়ে উঠে রাত্রিকে চেপে ধরে ওর পেছনে মুখ লুকালো রুশো ভাইয়া!
.
ভাইয়ার এহেন কান্ডে কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারছি না আমরা। আবার কি হলো? আগের বার নাহয় রাত্রির কথা বলায় ভয় পেয়ে ভাইয়ার কোলে উঠেছিলো রুশো ভাইয়া। কিন্তু এবার ভয় পেয়ে রাত্রিকেই চেপে ধরলো কেনো?
.
– একি কি করছেন? ছাড়ুন আমায়!
.
রুশো ভাইয়া রাত্রির কথায় কিঞ্চিত পরিমাণেও সরলো না। বরং ওকে ধরে রেখেই সামনে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠলো,
– ক…ক..ক..ককরোচ…..!
.
রুশো ভাইয়ার দেখানো আঙুল বরাবর তাকিয়ে দেখি একটা আরশোলা হেটে যাচ্ছে। হায় কপাল! আমি আরশোলা দেখে একটু ভয় পেলেও রুশো ভাইয়ার ভয় পাওয়া দেখে নিজেকে বড়ই সাহসী বলে মনে হচ্ছে আমার।
.
অগ্নি ভাইয়া হাসতে হাসতে আরশোলা টাকে সরিয়ে দিয়ে এসে আরোও মজা করে বলে উঠলো,
– রুশো…! এই দেখ আমার হাতের মুঠোয় আরশোলাটা আছে। তোকে হ্যালো, হায় বলার জন্য ছটফট করছে!
.
ওমনি রুশো ভাইয়া “নোওওওও….!!” বলে চোখ বন্ধ করে চেঁচিয়ে উঠে রাত্রিকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।
বর্তমানে রাত্রির অবস্থা একেবারেই দেখার মতো হয়েছে। না পারছে ভাইয়াকে ছাড়াতে আর না পারছে সইতে….!
ব্যাপারটায় কার কি মনে হচ্ছে তা জানি না তবে আমার ব্যাপক মজা লাগছে! হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে বোধহয় আমার!
.
.
.
চলবে………………..💕