#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৮
মাথা নিচু করে আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নয়নতারা। মৃদুলের কান্ডে সে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেছে। নয়নতারা বুঝতে পারে নি সামান্য একটু মজা করার জন্য পাত্র এভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। শুঁকনো ঢোক গিললো নয়নতারা। নীলিমা দৌড়ে রুমে আসলো তখন। তার বাবা মাও এলো। নীলিমা নয়নতারার কাচুমাচু মুখখানা দেখে বললো,“কি করেছিস?”
নয়ন মিনমিনিয়ে নিজের চোখের চশমাটা ঠিক করে বললো,“আমি কিছু করি নি। খালি বলেছি আমি নীলিমা ব্যাস তাতেই অজ্ঞান হয়ে গেছে।”
মৃদুল দেখছে আশরাফকে। বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে। রনির চোখে মুখে বিস্ময়। ছ্যাড়াডা কামডা করলো কি? আশরাফ পানি আনতে বললো। নয়নতারা দৌড়ে পানি আনতে গেল। আদ্রিতারা অবাক চোখে তার যাওয়ার পানে তাকালো। এই বুড়ো মহিলা এভাবে দৌড়ে গেল কিভাবে। একটু আগেও তো কাঁপতে কাঁপতে আসছিল। নয়নতারা দৌড়ে এসে আশরাফের হাতে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“নিন।”
আশরাফ একঝলক তাকালো মহিলাটির দিকে। কণ্ঠটা কেমন ইয়াং মেয়েদের মতো ঠেকলো। আশরাফ বেশি ভাবলো না দ্রুত পানির গ্লাসটা নিয়ে পানি ছিটালো মৃদুলের চোখে মুখে। সঙ্গে সঙ্গে লাফ মেরে উঠে বসলো মৃদুল। থমথমে কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললো,“আব্বা আমি বিয়া করতাম না।”
আশরাফ ওরা নিরাশ হলো মৃদুলের কান্ডে। নিজেদের মুখে চাপড় মারলো সবাই। এমনিতেই লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে তারা। তারওপর মৃদুলের এমন উদঘাট কান্ড। নীলিমার বাবা এতক্ষণ পর খেয়াল করলো তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক সাদা চুলওয়ালা মহিলাকে। তাকে চিনতে না পেরে বললো,“আপনি কে?”
নয়নতারা কাচুমাচু হলো এবার। নীলিমা বললো,“বাবা ও নয়ন।”
সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় করে বললো,“ও নয়নতারা।”
সবাই চাইলো নয়নতারার দিকে। নয়নতারা মাথা নাড়ালো নীলিমার বাবার কথায়। নীলিমার বাবা বললেন,“তার মানে এসবের পিছনে তোর হাত আছে।”
নয়নতারা এগিয়ে আসলো। মাথার ঘোমটা তার অনেক আগেই পড়ে গেছে। নয়নতারা তার মাথায় লাগানো আলগা সাদা চুলের গোচা খুলে ফেললো। চোখের চশমাও খুললো। গালে লাগানো আলগা ফেস মাস্ক আর মেকাপ উঠাতেই তার ঝকঝকে ফর্সা মুখখানা আর ঘনকালো চুলগুলো দেখা গেল। আশরাফের নজর কাড়লো সেই মুখশ্রী। নয়নতারা থমথমে কণ্ঠে বললো,“বিশ্বাস করুন আঙ্কেল আমি একটু মজা করছিলাম কিন্তু উনি যে অজ্ঞান হয়ে যাবেন বুঝতে পারি নি। আমি খুব দুঃখিত আঙ্কেল।”
উপস্থিত সবাই এতক্ষণে পুরো ঘটনা ঠাহর করতে পারলো। নীলিমা এগিয়ে গেল মৃদুলের দিকে। বসলো ওর পাশ দিয়ে। মৃদু কণ্ঠে আওড়ালো,“আপনি ঠিক আছেন তো। ও আমার ফ্রেন্ড নয়নতারা। আপনাদের সাথে একটু মজা করার জন্য ওমন সেজে এসেছিল। ও নীলিমা না আমি নীলিমা।”
মৃদুল এবার চাইলো নীলিমার দিকে। মুগ্ধ হলো। না বাবার চয়েস খারাপ না। নীলিমার বাবা কি বলবেন বুঝতে পারছে না। নীলিমার মাও চুপ। অতঃপর নীলিমার বাবাই লজ্জিত স্বরে বললো,“তোমরা কিছু মনে করো না ও একটু ওমনই ফাজিল টাইপের মেয়ে।”
সবার দারুণ হাসি পাচ্ছে বিষয়টায়। কিন্তু তারা হাসতে পারছে না। আশরাফ অনেকটা নিজেকে সামলে বললো,“আমরা কিছু মনে করি নি।”
নয়নতারা সরাসরি চাইলো আশরাফের দিকে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,“আমি খুবই দুঃখিত বিষয়টায়। কিন্তু আমি সত্যি বুঝতে পারি নি উনি এই সামান্য বিষয়টায় অজ্ঞান হয়ে যাবেন।”
মৃদুলের এবার লজ্জা লাগছে। ইস! এটা কি করে ফেললো। মৃদুল মিটমিট করে তাকালো তার বন্ধুদের দিকে। চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে সবাই। সে বুঝতে পেরেছে আজ চরম লেভেলের লজ্জাজনক একখানা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। যা তার বন্ধুমহলের সদস্যদের দারুণ লজ্জায় ফেলেছে।’
—-
রাত তখন বেশ গভীর। কনকনে শীতের আভাস বইছে চারিপাশে। আজ হসপিটাল থেকে বের হতে রাত প্রায় তিনটে বেজে গেল আদ্রিতার। ক্ষিদে আর ক্লান্তিতে শরীর অবশ প্রায়। আদ্রিতা বরাবরের মতো সোহেলকে ডাকলো। সোহেল এলো। দ্রুত জবাব দিলো,“ম্যাডাম হয়েছে।”
আদ্রিতার ক্লান্তমাখা শরীরে উত্তর,
“হুম। চল দ্রুত।”
“আচ্ছা ম্যাডাম আসেন।”
আদ্রিতা হেঁটে গিয়ে বসলো গাড়িতে। সোহেলও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্ট্যার্ট দিলো। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো গাড়ি স্ট্যার্ট হচ্ছে না। সোহেল বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরও গাড়ি স্ট্যার্ট না হওয়ায় বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হলো আদ্রিতা। থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“কি হয়েছে সোহেল?”
সোহেলের নিরাশ চাহনি। হতাশায় ঘেরা মুখ। সে বললো,
“বুঝচ্ছি না ম্যাডাম।”
“রাত হলে এটার কি হয় সোহেল?”
“আমিও জানি না দিনে তো ঠিকই থাকে রাতে কি হয় বুঝি না।”
সোহেল গাড়ি থেকে নামল। গাড়িটা অনেকক্ষণ চেক করে বললো“ম্যাডাম গাড়িতে তেল নেই।”
আদ্রিতার ইচ্ছে করছিল সোহেলকে অনেক্ক্ষণ পেটাতে কিন্তু পারলো না। সে গাড়ি থেকে বের হলো। বিরক্ত নিয়ে বললো,
“এটা আরো আগে দেখো নি কেন সোহেল?”
সোহেল মাথা নুইয়ে বললো,“বিশ্বাস করুন ম্যাডাম সকালেও ফুল ছিল হঠাৎ কি করে খালি হয়ে গেল বুঝচ্ছি না।”
আদ্রিতা আর কথা বাড়ালো না। সোহেল বললো,“গাড়ি এনে দিবো ম্যাডাম।”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আদ্রিতা। বললো,“আগে এটাকে ঠিক করো সোহেল। কাল থেকে এমন হলে আমি তোমায় দেখে নিবো।”
কথাটা বলে হনহন করে হেঁটে গেল আদ্রিতা। সোহেল মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে। রাগে ফুঁসলো আদ্রিতা। সে বুঝতে পারছে না রোজ রাতে গাড়িটার হয় কি। আদ্রিতা তার মায়ের নাম্বারে কল করলো। সঙ্গে সঙ্গেই ধরলো তার মা। যেন তার কলেরই অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। আদ্রিতার মা চিন্তিত স্বরে বললো,
“কখন ফিরবি আদ্রিতা?”
“আমার একটু লেট হবে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো মা।”
কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিল। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। এত রাতে খাওয়ার মতো কিছু নেই আশেপাশে। পুরো রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি টাড়ি কিছুই দেখা যাচ্ছে না তেমন। আদ্রিতার ইচ্ছে করছে সোহেলের কানটা ছিঁড়ে ফেলতে। ছেলেটা আগের চেয়ে বড্ড বেখেয়ালি হয়ে গেছে। এমন চলতে থাকলে সে সোহেলকে বাদ দিয়ে নতুন ড্রাইভার রাখবে। কথাগুলো একা মনে বলছে আর হাঁটছে আদ্রিতা। হঠাৎই পিছন থেকে গাড়ির হর্ণ বাজার আওয়াজ শোনা গেল। আদ্রিতা আরো বিরক্ত হলো এতে। পিছন ঘুরে বিরক্ত নিয়েই চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“সমস্যা কি এভাবে মাঝরাতে শুধু শুধু হর্ণ বাজাচ্ছেন কেন?”
ফারিশের কণ্ঠ শোনা গেল। সে বললো,“সমস্যাটা হচ্ছেন আপনি।”
আদ্রিতার টনক নড়লো। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ফারিশের মুখের দিকে। বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন বললো,“আপনি এখানে?”
ফারিশ গাড়ির দরজা খুলে দিলো। আদ্রিতা ছুটে গিয়ে বসলো গাড়িতে। সিটব্লেট লাগিয়ে বললো,“এত রাতে এখানে কি করছিলেন?”
ফারিশের এক বাক্যের জবাব,“অপেক্ষা।”
আদ্রিতা চোখ বড় বড় করে চাইলো ফারিশের দিকে। ক্লান্তি ভাবটা আচমকাই উবে গেল কোথাও। সে বললো,“আপনি কখন থেকে আমার অপেক্ষা করছিলেন?”
ফারিশের আবারও এক বাক্যের উত্তর,“অনেকক্ষণ।”
আদ্রিতা জোরে নিশ্বাস ফেলে তার মাথাটা এলিয়ে দিলো গাড়ির সিটে। চোখ বন্ধ করে বললো,
“খুব ভালো করেছেন আমার অপেক্ষায় ছিলেন নয়তো এতরাতে কতদূর আমার হাঁটা লাগতো কে জানে।”
“কেন আপনার গাড়ি কই?”
“আর বলবেন না ওটায় কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। রোজ রাতে সমস্যা করছে। পরশু টায়ার ফেটে গেছিল। কাল ঠিক ছিল। কিন্তু আজ আবার তেল নেই।”
ফারিশ ছোট করে বললো,“ওহ।”
আদ্রিতা চাইলো ফারিশের দিকে মাঝে একদিন তার সাথে ফারিশের দেখা হয় নি। তবে রাতে কথা হয়েছিল। আদ্রিতা বললো,
“কাল এলেন না কেন?”
“রোজ তো গাড়ি নষ্ট করা যায় না। তাই ভেবেছি একদিন পর পর করবো।”
মুহুর্তের মধ্যে চোখ চড়ুই গাছ আদ্রিতার। বিস্ময়কর এক চেহারা নিয়ে বললো,
“তার মানে এই দুইদিন।”
“হা আমি করেছি।”
“কিন্তু কেন?”
“এভাবে একসাথে বাড়ি ফেরার জন্য।”
“আমায় বললে কি আমি আসতাম না।”
“চমকানো তো যেত না।”
আদ্রিতা হেঁসে ফেলে। বলে,
“আপনি আসলেই একজন অদ্ভুত মানুষ।”
ফারিশের তড়িৎ উত্তর,
“জানি তো।”
“কাল থেকে আর গাড়ি নষ্ট করবেন না। এই দূরে অপেক্ষা করবেন আমি আসবো।”
ফারিশ রাস্তার পানে তাকিয়েই বলে,“আচ্ছা।”
আদ্রিতার পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। দ্বিধাহীন কণ্ঠে বললো,
“আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।”
ফারিশ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আমাকে কি বিশ্বাস করা যায় ডাক্তার ম্যাডাম?”
আদ্রিতা চমকালো,ভড়কালো, অবাক হলো খুব। বললো,
“কেন যাবে না।”
“তাহলে আমার সাথে যাবেন দূরে।”
আদ্রিতার মিনমিনিয়ে বললো,
“কোথায়?”
“আছে এক জায়গা যাবেন।”
“আমার যে ক্ষিদে পেয়েছে।”
“তার জন্যই তো যাবো। আপনাকে খাওয়াবো। যাবেন?”
আদ্রিতা বেশি ভাবলো না। বললো,“ঠিক আছে।”
ফারিশ দ্রুত গাড়ি ঘোরালো। গাড়ির স্পিড দিল বাড়িয়ে। আদিবকে কল করে বললো,“আদিব আজ রাতে আমি ফিরছি না। তুমি চিড়ামুড়ি কিছু একটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
অপরপাশের কিছু শোনা গেল না তার আগেই ফারিশ ফোন কেটে দিয়েছে। আদ্রিতা তার দিকে তাকিয়ে। ফারিশ বিনা কথায় পুরো এক ঘন্টার রাস্তা আধঘন্টায় এসে থামালো গাড়ি। আতঙ্কিত আদ্রিতার তখন থমকানো মুখ। সে ডান পাশে চাইলো। বনজঙ্গলে ঘেরা একটা জায়গা। আদ্রিতা সরু চোখে তাকালো ফারিশের দিকে। বললো,
“আমরা কি এখানেই নামবো?”
ফারিশ জবাব দিলো না। সরল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। করুন স্বরে বললো,
“আমার যদি হঠাৎ প্রেম প্রেম পায় তবে কি আপনি খুব রাগ করবেন ডাক্তার ম্যাডাম?”
আদ্রিতার বিস্মিত চেহারা। চোখ মুখ কুঁচকালো। শরীর অবশ হলো প্রায়। সে বললো,“এসব কি বলছেন?”
ফারিশের দুষ্ট মার্কা হাসি,
“আমি জানি বিয়ের আগে প্রেম প্রেম পাওয়াটা একটা দণ্ডনীয় অপরাধ। তবুও হঠাৎ পেয়ে বসলে আপনি কি রাগ করবেন?”
আদ্রিতার দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টালো। কিছু বুঝলো। হাসলো। সুরেলা সুরে আওড়ালো,“আমি আপনায় খুন করবো ফারিশ।”
ফারিশের মুখ হাসি হাসি। দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। সে নরম কণ্ঠে শুধালো,
“পারলে মারুন। আপনি মারলে আমি বেঁচে যাই।”
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]
#TanjiL_Mim♥️
গল্পের পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের গ্ৰুপে জয়েন হয়ে পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।
https://www.facebook.com/groups/1129904368415371/?ref=share_group_link