#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৯
কনকনে শীতে থর থর করে কাঁপছে শরীর। আদ্রিতা তার গায়ে জড়ানো কালো চাঁদরটা আর একটু শক্ত করে চেপে ধরলো। আশপাশ পুরো নির্জীব। বনজঙ্গলের ঘেরা পুরো জায়গাটা। নিশি রাতের শিশিরে ভেজা মৃদু ঘাসের ওপর মোড়া পেতে বসে আছে আদ্রিতা। তার সামনেই ডালপালা পুড়িয়ে আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত ফারিশ। আদ্রিতার সামনে একটা থমথমে বাড়ি দেখা যায়। বাড়িটা অনেক পুরোনো আর ভুতূরে টাইপ। ফারিশ সেই বাড়ির ভিতর ঢুকেই ডালপালা নিয়ে এসে এই মৃদু ভেজা ঘাসের উঠোনে আগুন জ্বালাচ্ছে। আদ্রিতা প্রশ্ন করলো,“আমরা কি বাড়ির ভিতর যাবো না?”
ফারিশ একঝলক চাইলো আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। পরমুহুর্তেই দ্রুত জবাব দিলো,“আমরা না শুধু আপনি।”
আদ্রিতা হতাশ হলো। মুখভঙ্গি বদলালো। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এমনটা কেন?”
“আমার ইচ্ছে তাই।”
“এমন অদ্ভুত ইচ্ছে কি বেমানান নয়।”
“হয়তো বেমানান তবে আমার কাছে সুন্দর।”
আদ্রিতা চুপ হয়ে গেল। ফারিশ আগুন জ্বালিয়ে ফেললো কিছুক্ষণেই। একটা ডাল আগুনে পেতে তাড়া দিয়ে বললো,
“এবার বলুন কি খাবেন?”
“আপনি যা খাওয়াবেন। আর তাছাড়া আপনার কাছে এই মুহূর্তে খাওয়ানোর মতো কি কি আছে তা আমি কি করে জানবো?”
“ডিম রুটি খাবেন। আমি শুধু অমলেট বানাতে পারি।”
আদ্রিতা মৃদু হাসলো। বললো,
“করুন। তবে জলদি করবেন। আমার কিন্তু দারুণ ক্ষিদে পেয়েছে।”
ফারিশ দেরি করলো না। সে চলে গেল বাড়ির ভিতর। আদ্রিতা চুপচাপ বসে আগুন পোয়ালো। ফারিশ ফিরে এলো মিনিট পনের পরে। হাতে কিছু গরম করা পাউরুটি আর দুটো ডিমের অমলেট।’
আগুনের তাপে ঘাসের জমির কিছু অংশ গেছে বেশ শুকিয়ে। ফারিশ সেই শুঁকনো ঘাসের উপর বসলো। আদ্রিতার দিকে অমলেটের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“ভয় পেয়েছিলেন?”
আদ্রিতা তড়িঘড়ি করে বললো,“অল্পস্বল্প।”
ফারিশ হাসে। আদ্রিতা চেয়ে রয় শ্যামবর্নের সেই পুরুষটির দিকে। মানুষটা হাসলে এত কেন সুন্দর লাগে কে জানে। আদ্রিতা প্লেট ছুঁইলো। মোড়া ছেড়ে ফারিশের মুখোমুখি একটু দূরত্ব নিয়ে বসলো। বললো,
“আপনি খাবেন না?”
“না। আপনি খান।”
“কেন?”
“আমার ক্ষিদে পায় নি।”
আদ্রিতা কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো। খুব জলদি জলদিই করলো। ফারিশ তার পানে তাকিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটার বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। আদ্রিতার বেনুনী করা চুলগুলো বেশ এলেমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে সামনে। গায়ে জড়ানো সবুজ রঙা চুড়িদার। বুকে জড়ানো কালো চাদর। খুবই সাদামাটা। তবুও অসাধারণ দেখাচ্ছে। চোখে পলক ফেলছে বার বার। ক্লান্তি ভাবটা আগের চেয়ে বেশ কমেছে। ফারিশ আদ্রিতার থেকে দৃষ্টিতে সরিয়ে আগুনের দিকে চাইলো। পাশে জমিয়ে রাখা শুঁকনো ডাল দিলো। ডালের ছোঁয়া পেতেই তড়তড় করে বেড়ে উঠলো আগুন। গরম গরম উষ্ণতা আরো বাড়লো। শীত কমিয়ে দিলো আর একটু। আদ্রিতা খেতে খেতেই প্রশ্ন করলো,“এখানে কে থাকে?”
ফারিশের তড়িৎ উত্তর, “কেউ না।”
আদ্রিতার বিস্মিত নজর। বার পলক ফেলা পাপড়িযুগল। ফারিশ নিজেই বললো,
“এককালে এই বাড়িতে আমি আর আদিব থাকতাম। এখন আর থাকি না। তবে মাঝে মাঝে আসা হয়।”
আদ্রিতাকে শান্ত দেখালো। উত্তেজিত ভাব কমলো। নরম করে বললো,“ওহ আচ্ছা।”
এরপর নীরবতা চললো অনেকক্ষণ। আদ্রিতা তার খাওয়া শেষ করলো। বেশ ভালো লাগছে এখন। ফারিশ তার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। আদ্রিতা নিলো। একটু সময় নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা শেষ করলো। জোরে নিশ্বাস ফেলে বললো,“অবশেষে নিজেকে শান্ত লাগছে।”
ফারিশ পানির গ্লাসটা পুনরায় হাতে নিয়ে পাশে রাখলো। বললো,“অমলেট কেমন লাগলো?”
আদ্রিতা তৃপ্তির ঢেঁকুর দিয়ে বললো,“দারুণ।”
ফারিশ খুশি হলো। আদ্রিতা এবার আয়েশ করে আগুনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। বললো,
“জায়গাটা সুন্দর তবে ভয় ভয় লাগে।”
“ভয় কিসের আমি তো আছি।”
“তাই তো চুপচাপ আছি নয়তো কখন দৌড়ে পালাতাম।”
ফারিশ এবার উচ্চ শব্দে হাসলো। আদ্রিতাও হাসলো। ফারিশ আকাশ পানে চাইলো। খোলা আকাশের মাঝে অনেকগুলো তাঁরা দেখা যাচ্ছে। এত রাতে আকাশ ভর্তি তাঁরা এ যেন প্রথম লক্ষ্য করলো ফারিশ। ফারিশ মৃদু স্বরে বললো,“আকাশটা আজ খুব সুন্দর তাই না।”
আদ্রিতাও তাকালো আকাশের দিকে। বললো,“হুম।”
আবারও নীরবতা ভর করলো দুজনের মাঝে। কথা বলার মতো কোনো কথাই যেন পাচ্ছে না। সময়ের চাকা টিকটিক করে বাড়ছিল শুধু। হঠাৎই ফারিশ নিঃসংকোচে আবদারের স্বরে বললো,“আমি আপনার কোলে মাথা রাখি ডাক্তার ম্যাডাম?”
আদ্রিতার অদ্ভুত চোখ। ফারিশের শীতল দৃষ্টি। কণ্ঠস্বর বেশ নরম। আদ্রিতা বেশি সময় নিলো না। মাথা নাড়িয়ে মিষ্টি হেঁসে বললো,“আচ্ছা রাখুন।”
ফারিশ খুশি হলো। বিনা দ্বিধায় সে শুয়ে পড়লো নিচে মাথা রাখলো আদ্রিতার কোলে। আদ্রিতার হাত আপনাআপনি চলে গেল ফারিশের চুলে। হাত বুলাতে লাগলো ধীরে ধীরে। ফারিশ চোখ বন্ধ করলো। বললো,
“জানেন আমি না কখনো এভাবে কারো কোলে মাথা রাখি নি। আপনাকে কেন যেন আমার বড্ড আপন মনে হয়। কি যাদু করলেন বলুন তো?”
আদ্রিতা উত্তর দেয় না। ফারিশ আবারও বলে,
“আমার বয়স যখন পাঁচ তখন প্রথম রংপুরের সেই ইমাম আমায় নিয়ে ঢাকা আসেন। আমাকে বলে এখন থেকে নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। আমি তখন বেশ অবাক হই তার কথায়। আমাকে তিনি রেখে গেলেন এক এতিম খানায়। সেখানেই পরিচয় হয় আমার আদিবের সাথে। কিছু ছেলেরা ওকে ধরে মারছিল আমি আটকায়। তাদের থামাই। সেই থেকেই নাকি ওর জীবন বদলে যায়। এতিম খানায় থেকে ছিলাম দু’বছর। হঠাৎ শুনি যিনি এতিম খানা করেছিলেন তার ছেলে নাকি এতিম খানা বিক্রি করে দেয়। আমাদের এক নিমিষেই সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কে কোথায় গিয়েছিল জানা নেই। তবে আদিব আমার সঙ্গেই ছিল। ক্ষুধার জ্বালা ভয়ংকর জ্বালা আমি বুঝি। এমনও দিন গেছে আমাদের শুধু পানি খেয়ে কেটেছে পুরো চব্বিশ ঘন্টা। আদিব আমার চেয়ে এক বছরের ছোট ছিল। ক্ষুধার জ্বালা সইতে পারতো কম। কাঁদতো আমায় ধরে। আমি শুধু হাত বুলিয়ে দিতাম মাথায়। কি করতাম? কিছু তো করার নেই। জুতা পালিশ করে যা ইনকাম হতো তা দিয়ে মোটামুটি একবেলা চলে যেত কিন্তু রাত হলে সেই আবার জ্বালা। ধীরে ধীরে সয়ে গেল সব। শীতের এই কনকনে রাতে শুধু পলিথিন চাপিয়ে শুয়ে কাটিয়েছি কতরাত ঠিক নেই। পুলিশের হাতের মারও কম খাওয়া হয় নি মোদের। তবুও জীবন সুন্দর। তাই না।”
আদ্রিতা কি বলবে বুঝে না। ফারিশ চুপ হয়ে গেল। আর কিছু বললো না। তার খুব ঘুম পাচ্ছে। গভীর ঘুম। শান্তির ঘুম। আদ্রিতা ঘুমন্ত ফারিশের দিকে চাইলো। সে বুঝলো ফারিশ আর কিছু বলবে না। আদ্রিতা জোর করলো না। প্রশ্ন করলো না কোনো। চুপচাপ বসে চেয়ে রইলো ফারিশের মুখের দিকে। সামনেই জ্বলজ্বল করে জ্বলছে আগুন। আদ্রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে বুঝলো। সবার ছেলেবেলা সুন্দর হয় না। তারটা সুন্দর ছিল কিন্তু ফারিশের ছিল না। বুকচাপা এক আর্তনাদ বেরিয়ে আসলো আদ্রিতার।’
সময়ের কাটা সুড়সুড় করে বাড়ছে। ফারিশ গভীর ঘুমে মগ্ন তখন। আগুন প্রায় নিভে যাওয়ার মুহূর্তে। শুঁকনো ডাল আর নেই। আদ্রিতা এবার ডাকলো ফারিশকে। বললো,“শুনছেন,উঠুন। বাড়ি যাবেন না?”
ফারিশ হাল্কা নড়লো। আদ্রিতাকে আর একটু শক্ত করে চেপে ধরলো। আদ্রিতা অনুভব করলো তার শরীর মৃদু কাঁপছে। হয়তো ফারিশের সংস্পর্শে। আদ্রিতা আবারও ডাকলো। জোরেশোরে বললো এবার,“ফারিশ উঠুন না প্লিজ।”
ফারিশ এবার উঠলো। আশপাশ দেখলো। আচমকাই শোয়া থেকে উঠে বসলো। অদ্ভুত এক প্রশ্ন করলো,“আপনি যান নি?”
আদ্রিতা চোখ মুখ কুঁচকালো। বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো,“আমার কি একা একা যাওয়ার কথা ছিল।”
ফারিশ চুপ করে রইলো। তার মনে হচ্ছে সে বহুকাল পর একটু আরামে ঘুমিয়ে ছিল। এই আরাম সে বিগত বহুবছর পায় নি। ফারিশের নিজেকে গোছাতে সময় লাগলো দু’মিনিট। সে বললো,“চলুন যাই। ক’টা বাজে?”
আদ্রিতা তার হাত ঘড়িটা দেখলো। বিনয়ের সাথে বললো,
“সাড়ে চারটা।”
“আমি কি অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম?”
“না। খুব জোর পনের মিনিট।”
ফারিশের এবার বেশ অবাক লাগলো। মাত্র পনের মিনিট ঘুমিয়েছে অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে বহুক্ষণ ঘুমিয়েছে অনেক ঘন্টাও ছাড়িয়ে গেছে বোধহয়। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আদ্রিতাও উঠলো। আগুন ততক্ষণে পুরো দমে নিভে গিয়ে লাল লাল ফুলকি দেখাচ্ছিল শুধু। ফারিশ তাড়া দিয়ে বললো,“দ্রুত চলুন আপনায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”
আদ্রিতা শুনলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,“ঠিক আছে।”
—-
নীরবে গাড়ি চালাচ্ছে ফারিশ। মুখে কোনো কথা নেই। আদ্রিতাই বললো আগে,
“আপনি সেই বাড়ির ভিতর না নিয়েই পারলেন আমায়।”
“বাড়ির ভিতর নেয়ার কি কোনো কথা ছিল?”
“বাড়ির ভিতর কি রহস্য লুকিয়ে রেখেছেন তা বলুন।”
ফারিশের নিবিড় উত্তর,“একটা খাট আর একটা আলমারি। ওহ রান্নাঘরের বাহিরে একটা ফ্রিজ আছে। আর রান্নাঘরের ভিতরে রান্নার সরঞ্জাম। হাড়ি পাতিল। এই রহস্য।”
আদ্রিতার সন্দিহান দৃষ্টি,
“তাহলে ভিতরে নিলেন না কেন?”
“আসলে বদ্ধ করে আমার ভীষণ ভয় লাগে।”
আদ্রিতা অবাক হয়ে বললো,“মানে। আপনি তো একাই বাড়ির ভিতর থাকলেন আমায় নিলেন না তখন ভয় করলো না।”
ফারিশের এলেমেলো দৃষ্টি। বিষণ্নভরা চাহনি। সে বললো,“একা নয় আপনায় নিয়ে বদ্ধ করে থাকতে আমার ভয় লাগে।”
আদ্রিতার চোখমুখ ভয়ংকরভাবে কুঁচকে গেল। অদ্ভুত স্বরে আওড়ালো,“কি বলতে চাচ্ছেন একটু পরিষ্কার করে বলুন তো?”
ফারিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল,
“আমি আগে প্রচুর ধৈর্য্যশীল পুরুষ ছিলাম। কিন্তু ইদানীং আপনি আশেপাশে থাকলে আমার নিজেকে বড্ড অধৈর্য্যশীল পুরুষ মনে হয়। এমনিতেই নিশিরাত কনকনে ঠান্ডা। তারওপর যদি হয় বদ্ধ ঘর। আমি তো বেসামাল হয়ে উঠবো। বদ্ধ ঘরে আমার যদি প্রেম প্রেম পায় তখন। দেখুন আমি যথেষ্ট সতর্কবান মানুষ। বিয়ের আগে নো বদ্ধঘর।”
আদ্রিতার আচমকাই প্রচন্ড হাসি পেল। কি অদ্ভুত লজিকে তাকে বাড়ির ভিতরে নিলো না। আদ্রিতা হেঁসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,“আপনি এক বদ্ধ উন্মাদ ফারিশ।”
ফারিশের সহজ সরল উত্তর,“জানি তো।”
আদ্রিতা হাসতে থাকলো। তার ফারিশের কথায় দারুণ মজা লেগেছে। প্রকৃতি তখন একটু একটু করে জানা দিচ্ছিল রাতের আঁধার ছাড়িয়ে দিন আলো আসছে। আশেপাশে মসজিদ নেই। যার দরুন তারা টের পাচ্ছে না দূর আকাশে ফরজের আজান দিচ্ছে। ফারিশ একটুখানি গাড়ির জানালা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে এক শীতল হাওয়া তাকে নাড়িয়ে দিলো। আদ্রিতার তখনও মুখ ভরা হাসি। ফারিশের সেই হাসিতে চোখ আটকালো ক্ষণে ক্ষণে বহুবার। ফারিশ বুকে হাত দিলো। মনে মনে আওড়ালো,
“এভাবে হাসবেন না ডাক্তার ম্যাডাম,আপনি হাসলে আমার যে বড্ড ব্যাথা লাগে।”
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। গল্পের মোড় খুব শীঘ্রই ঘুরে যাবে তোমরা অপেক্ষায় থেকো।]
#TanjiL_Mim♥️
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/