দৃষ্টির_আলাপন #পর্বঃ২৮ #আদওয়া_ইবশার

0
428

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ২৮
#আদওয়া_ইবশার

পুরো দেশ জুড়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিষয়বস্তু একটাই। সাভারের নব নির্বাচিত এমপি আজীজ শিকদারের বড় ছেলে একজন খুনি। নিজের ছোট ভাই এবং সহধর্মিণীকে নিজ হাতে নিষ্ঠুর ভাবে খুন করেছিল আড়াই বছর আগে। সেই খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সয়ং এমপি আজীজ শিকদার। সবটা জানার পরও মেয়র থাকা কালীন সময়েই ক্ষমতা আর টাকার জোড়ে সত্যকে মিথ্যে প্রমাণ করে খুনি ছেলের দোষ ঢেকেছে। একজন খুনিকে ইন্ধন দিয়ে সে নিজেও সমান অপরাধী। এমন একজন মানুষ কিছুতেই এমপি হতে পারেনা। যে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় সে কিভাবে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করবে? ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন থেকে নোটিশ চলে এসেছে,ঘটনা যদি সত্য প্রমাণিত হয় এবং ছেলের বিরুদ্ধে যদি আজীজ শিকদার সাক্ষী না দেয়, তবে এমপি পদ থেকে বাতিল করা হবে। চারদিক থেকে সকল চাপ একসাথে আসতে শুরু করেছে। আর প্রেস মিডিয়া তো আছেই। মিডিয়ার লোকজন যেন শিকদার বাড়ির আশেপাশে প্রতি মুহূর্ত উত পেতে থাকে। এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখে পরে আজীজ শিকদার হতাশায় জর্জরিত। ছেলেকে বাঁচাবে না নিজে বাঁচবে না কি মিডিয়ার সামনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে জনগণের মুখ বন্ধ করবে? সর্বদা নিরব, শান্ত থেকে নিজের বুদ্ধিমত্বা কাজে লাগিয়ে যেকোনো অনুকূল পরিস্থিতি সামলে নেওয়া আজীজ শিকদার আজ কোনো কূল খোঁজে পাচ্ছেনা। একের পর এক ঘটনায় মস্তিষ্ক জট পাকিয়ে নিস্তেজ হয়ে আছে। শুধু আজীজ শিকদার একা না। রক্তিমের সাথে চলা প্রতিটা ছেলে বর্তমান পরিস্থিতির জাতাকলে বুদ্ধিহীন। তবুও কেউ থেমে নেয়। মেহেদী, রাকিব, জাবির, শান্ত প্রত্যেকে নিজেদের মতো সমাধান খোজার চেষ্টায় মত্ত।ভাইয়ের খবর শোনার সাথে সাথেই ইতি নিজের নতুন সংসার ছেড়ে ছুটে আসে শিকদার বাড়ি। এখন পযর্ন্ত মেহেদী নিজেও শিকদার বাড়িতে পরে আছে। প্রাণ প্রিয় বন্ধুর এমন একটা অবস্থায় কিছুতেই স্থির থাকতে পারেনি।

নিস্তেজ হয়ে স্টাডি রুমে বসে আছে আজীজ শিকদার। উত্তরে জানালার থাই গ্লাস সড়ানো। পৌষের সকালের হীম হাওয়া এসে শরীর কাঁপিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে কোনো হুঁশ নেই আজীজ শিকদারের। এক ধ্যানে জানালা গলিয়ে দৃষ্টি যতদূর যাচ্ছে স্থির তাকিয়ে নিজ ভাবনায় মত্ত।শান্ত রুমটাতে অশান্ত হাওয়া নিয়ে একসময় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পরে মেহেদী। সাথে জাবির। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ডেকে ওঠে আজীজ শিকদারকে,

“বাবা!” ভাবনাচ্যুৎ হয় আজীজ শিকদার। নির্বাক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় মেহেদীর দিকে। শীতল স্বরে জানতে চায়,

“কিছু জানতে পেরেছো?”

মেহেদীর চোখের দৃষ্টি চঞ্চল। অত্যধিক উত্তেজনায় বুকের ভিতরটাও ধরফর করছে। বার কয়েক ঢোক গিলে শুকনো গলাটা ভিজানোর প্রয়াস চালিয়ে বলে,

“যা ভেবেছিলাম তাই।”

কথাটা শুনে কিছুটা ধাতস্থ হয় আজীজ শিকদার। বসা থেকে ওঠে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে জানতে চায়,

“কিভাবে বুঝলে? সন্দেহজনক কিছু পেয়েছো?”

“থানায় যে কনস্টেবলটাকে টাকা খাইয়ে হাত করেছিলাম! খবরটা ওনিই জানিয়েছে। কাল রাতে লিয়াকত বিল্লা থানায় গিয়েছিল। তাছাড়া রাকিবকে যে পাঠিয়েছিলাম জেরিনের মামার বাড়ির দিকে লক্ষ রাখতে। রাকিব নিজেও আজ সকালে লিয়াকত বিল্লাকে জেরিনের মামার সাথে দেখেছে।”

চিন্তায় ভাজ হয়ে থাকা কপালদ্বয় মসৃণ হয় আজীজ শিকদারের। ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠে বক্র হাসির রেখা। মাথা ঝাকিয়ে বললেন,

“জানতাম। সাবেক এমপি সাহেব ছাড়া এতো ধূর্ত বুদ্ধি আর কার হবে!”

“আজকে রক্তিমের সাথে একবার দেখা করতে চাচ্ছিলাম বাবা। এখন মনে হচ্ছে থানায় যাওয়াটা অতি আবশ্যক। শু য়ো র টা না জানি কাল রাতে কোন কু-মতলবে থানায় গিয়েছিল।”

মেহেদীর মুখে গালি শুনে যথেষ্ট বিরক্ত হয় আজীজ শিকদার। মুখে ‘চ’ বর্গীয় উচ্চারণ করে বিরক্তিভাব প্রকাশ করে বলে,

“আহ্! যাবে ভালো কথা। কিন্তু মুখ খারাপ করো কেন? আর কার সামনে কি বলতে হয় সব খেয়ে বসে আছো না কি? আমি তোমার শশুর কথাটা মনে হয় ভুলে গেছো!”

অত্যাধিক উত্তেজনায় মেহেদী সত্যিই ভুলে গিয়েছিল তার সামনে অন্য কেউ না,সয়ং নিজের শশুর দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণ একটা গালির বিপরীতে এমন মুখে ঝামা ঘষে দেওয়ার মতো অপমানে কাঁচুমাচু মুখ লজ্জায় মাথা নত করে রাখে মেহেদী। তখনই শুনতে পায় আজীজ শিকদারের আদেশ,

“বউমাকে সাথে নিয়ে যেয়ো। দুদিন থেকে মেয়েটা বারবার অনুরোধ করছে একবার তাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। একবার দেখা করতে পারলে হয়তো একটু সামলাতে পারবে নিজেকে।”

তৎক্ষণাৎ মুখ উঁচিয়ে বিরোধীতা করে ওঠে মেহেদী,

“অসম্ভব বাবা। ভাবিকে সাথে নিয়ে গেলে আপনার খ্যাঁপা ছেলে লকআপের ভিতর থেকেই আমার গলা টিপে ধরবে।”

“কিছুই করবেনা। সবসময় সবার মন-মানসিকতা এক রকম থাকেনা। তাছাড়া মেয়েটার কথাও একবার আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ।খাওয়া,ঘুম সব ভুলে ঘরবন্দি করে রেখেছে নিজেকে। এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পরবে।”

শশুরের সাথে কথায় না পেরে হার মেনে নেয় মেহেদী। রাজি হয় দৃষ্টিকে সাথে নিতে। নিয়ে তো যাবে। তবে আদও রক্তিমের সাথে দেখা করাতে পারবে কি না কে জানে!

****
আধ ঘন্টার মাঝেই মেহেদীর সাথে থানায় উপস্থিত হয় দৃষ্টি। চোখ দুটো তার তৃষ্ণার্ত। বুকের ভিতরটা অস্থিরতায় ভরপুর। যখন থেকে শুনেছে রক্তিমের সাথে দেখা করার সুযোগ পাবে তখন থেকেই প্রচণ্ড অস্থিরতা, ছটফটানিতে মনের অবস্থা বেগতিক।সাভার মডেল থানার সামনে গাড়ি থামতেই দৃষ্টি মেহেদীকে রেখেই এক প্রকার দৌড়ে ভিতরে ঢুকে পরে। পিছন পিছন ছুটে যায় মেহেদী।কয়েক জায়গায় ঘুষ আবার কয়েক জায়গায় বিভিন্ন ফরমালিটিস পূরণ করতে করতে আরও আধ ঘন্টা সময় চলে যায়। দৃষ্টির যেন এবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। এতোটুকু দেরীও তার সহ্য হচ্ছেনা। অত্যধিক উত্তেজনায় শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো। অনুমতি পেতেই মেহেদীকে পিছনে ফেলে দৌড় লাগায় দৃষ্টি। দৃষ্টির এমন পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় মেহেদী। কোনোমতে বুঝিয়ে কিছুটা শান্ত করে ধীরস্থির ভাবে এগিয়ে যায় রক্তিমকে রাখা সেলের দিকে। নির্দিষ্ট সেলের সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরের চিত্র দেখে থমকে যায় দুজনেই। দৃষ্টির এতোক্ষনের এলোমেলো শ্বাস-প্রশ্বাস টুকু এবার বন্ধ হবার জোগাড়। অস্থিরতা কাটিয়ে বুকের ভিতর শুরু হয় ঝড়ের তান্ডব। নির্বাক মেহেদীও একই ভাবে অত্যধিক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেলের ভিতর এক হাঁটু ভাজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে থাকা রক্তিমের দিকে। মাত্র ছয়দিন হয়েছে রক্তিম জেলে। এই ছয় দিনেই নিষ্ঠুর গুলো কিভাবে অত্যাচার চালিয়েছে তার উপর! ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্তের দাগটা দূর থেকে দেখেও মনে হচ্ছে এখনো তাজা হয়ে আছে। কেমন নিস্তেজ শক্তিহীনের মতো চোখ দুটো বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে প্রাণহীন এক শরীর। মেহেদীর নির্বাক দৃষ্টি ওক সময় ঝাপসা হয়। মানতে কষ্ট হয় বন্ধুর এমন পরিণতি। কতটা নির্দয়ের মতো অত্যাচার চালিয়েছে অমানুষ গুলো! ভাবতেই ভিতরটা কেঁপে ওঠে। দৃষ্টির ফোঁপানোর শব্দে মেহেদীর ঘোর কাটে। তটস্থ ভঙ্গিতে একবার আশেপাশে তাকিয়ে মৃদু স্বরে ডেকে ওঠে রক্তিমকে। কে ডাকছে কন্ঠটা ধরতে পারেনা রক্তিমের বেদনায় পৃষ্ঠ মস্তিষ্ক। শরীরের পীড়ার কাছে সব কিছুই ঝাপসা আজ। বহু কষ্টে বন্ধ চোখের পাপড়ি দ্বয় আলগা করে মাথা অল্প সোজা করে রক্তিম।নিভু নিভু দৃষ্টিতে ভাসে দুজন মানুষের প্রতিবিম্ব। কিন্তু মানুষ দুজন কে, তা ঝাপসা দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়না। রক্তিমের এমন বেহাল দশায় মেহেদীর চোখে অশ্রু বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পরে। সাথে সাথেই আবার শার্টের হাতায় চোখ দুটো মুছে নেয়। একবার কান্নারত দৃষ্টিকে দেখে নিয়ে আবারও ডাকে রক্তিমকে। এতোক্ষন পর এবার রক্তিমের অসাঢ় মস্তিষ্ক মেহেদীর কন্ঠ চিনতে পারে। চোখের দৃষ্টিও অল্প পরিষ্কার হয়। ভেসে ওঠে পরিচিত দুটো মুখ। দৃষ্টিকে এখানে দেখে খানিক উত্তেজিত হয় রক্তিম। বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে কোনোমতে টলতে টলতে এগিয়ে আসে লোহার শিকল দিয়ে তৈরি দেয়ালের নিকট। ডান হাতে একটা শিক ধরে নিজের ব্যালেন্স টুকু বজায় রাখার চেষ্টা করে ব্যথাতুর কন্ঠে নিচু স্বরে বলে ওঠে,

“ওকে কেন নিয়ে এনেছিস?”

রক্তিমের এমন ব্যথাতুর নিস্তেজ কন্ঠ এবার যেন দৃষ্টিকে একেবারে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। নিঃশব্দের কান্নাটা রূপ নেয় উচ্চ রুলে। তৎক্ষণাৎ পাশে থাকা কনস্টেবল হালকা ধমকের সাথে বলে ওঠে,

“এটা জেলখানা। আপনাদের রঙ্গতামাশা করার জায়গা না। আলগা পিরিতি দেখাইতে আসলে ঐটার সাথে সব কয়টারে ভরে রাখব।”

কনস্টেবলের কথা সবার কানে গেলেও কোনো প্রত্যুত্তর করেনি কেউ। কারণ পরিস্থিতি এখন তাদের অনুকূলে। এমন শত অপমান মুখ বুজেই সহ্য করতে হবে। দৃষ্টি ঠোঁট কামড়ে কান্নার শব্দ আটকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সেলের ফাঁক গলিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রক্তিমের ঠোঁটের কোণের রক্ত টুকু ছুঁয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ হালকা ব্যথা সেই সাথে দৃষ্টির হঠাৎ এমন একটা কাজে বিস্ময়ে কেঁপে ওঠে রক্তিম। চোখ তুলে কান্নারত দৃষ্টির মুখের দিকে তাকায়। রক্তিমের ঠোঁটের কোণের রক্ত টুকু হাতের কনিষ্ঠ আঙুলে লাগিয়ে আবারও হাতটা বাইরে নিয়ে আসে দৃষ্টি। টকটকে লাল রক্ত কতক্ষণ অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে দেখে জানতে চায়,

“এতোটা নির্দয়ের মতো কিভাবে মেরেছে ওরা আপনাকে? খুব কষ্ট হয়েছে আপনার, তাইনা!”

শরীরের যন্ত্রণা থেকেও মনের যন্ত্রণা তীব্র রক্তিমের। দৃষ্টির এমন প্রশ্নে নির্বাক তাকিয়ে থাকে কতক্ষণ। রক্তাক্ত ঠোঁটের কোণে যন্ত্রণামিশ্রীত হাসি ফুটিয়ে বিরবিরিয়ে বলে,

“এক নারী জাতি আর কত রূপ দেখাবে? একজন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ সৃষ্টি করে আনন্দ পায়। আরেকজন শরীরে অল্প আঘাতের সন্ধান পেয়ে তীব্র বেদনায় ছটফটানি প্রকাশ করে।”

বুকের ভিতরে থাকা যন্ত্রণাটা যেন এবার শরীরের যন্ত্রণা ম্লান করে দিয়েছে। তীব্র এক দহনে বুকের ভিতরটা চৌচির। জ্বিভের ডগায় রক্তাক্ত ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে বেদনার ঢোক গিলে রক্তিম। কন্ঠে দৃঢ়তা আনার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে বলে,

“আর কখনো এখানে আসবেনা। আমার চিন্তা তোমাকে করতে হবেনা। আমি ভালো আছি। বাড়ি যাও। পড়াই মন দাও। মাত্র দুদিন পর এডমিশন টেস্ট। এবার যদি চান্স হারিয়ে নিজের মা-বাবার কাছে আমাকে দোষী করেছো তবে খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি। আমি যেন জেলের ভিতর থেকেও শুনতে পায় চান্স হয়ে গেছে।”

এই প্রথম! বিয়ের এতোদিনে এই প্রথম রক্তিম কন্ঠে অধিকার খাটিয়ে দৃষ্টিকে শাসনের সুরে কিছু বলেছে। তাও এমন একটা মুহূর্তে এসে, যে মুহূর্তে দৃষ্টি পারছেনা রক্তিমের এমন আচরণে খুশী হতে, পারছেনা চোখের সামনে দেখা রক্তিমের করুণ পরিণতি ঘুচিয়ে দিতে। বুকের ভিতরটা যে কি অসহ্য যন্ত্রণায় নিঃশেষ হচ্ছে!মনে হচ্ছে বিষাক্ত কোনো এক পোকার বাস এই বুকে। যে পোকা কামড়ে ধরে বুকের মাঝে নিজের সমস্ত বিষ উগলে দিচ্ছে। সেই বিষে নীল হচ্ছে হৃৎপিন্ড। চোখের সামনে শখের পুরুষের এমন নির্মম পরিণতি সহ্য হচ্ছেনা কিছুতেই। ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে পুরো বিশ্বকে জানান দিতে, তার ভালোবাসার মানুষের শরীরের প্রতিটা আঘাত তার হৃদয়ে এক একটা অগ্নিপাতের সৃষ্টি করছে। যে অগ্নিপাতে দগ্ধ হচ্ছে মন জমিন। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এ মন জমিনে কি আর কখনো বসন্তের কোকিল উড়বে? ভালোবাসার গান গাইবে? না কি সারাজীবন ডাহুকের আর্তনাদ ভেসে আসবে!

জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে বহু কষ্টে সামলায় দৃষ্টি। তবে কান্নারা কি আর এতো সহজে বিদায় নিতে চায়! দৃষ্টি পারেনা কান্না আটকাতে। সেভাবেই কান্নায় রোধ হয়ে আসা কন্ঠে বলে,

“এবার আমি ঠিক চান্স পেয়ে যাব। আমার স্বামী এই প্রথম আমার থেকে কিছু একটা আশা করছে। আমি কিভাবে সেটা অপূর্ণ রাখি! বাড়ি গিয়ে সব ভুলে মন দিয়ে পড়ব। তবে আমি চাই আমার এই খুশির সংবাদটা আপনি জেলের ভিতরে থেকে না, মুক্ত আকাশের নিচে থেকে শুনবেন। রেজাল্ট পাবলিশড হবার আগে আপনার জামিন না হলে লাগবেনা আমার চান্স। কিসের পড়ালেখা কিসের কি? যে জীবনে আপনি নেই সেই জীবনের থেকে আমার মৃত্যু শ্রেয়। আচ্ছা! একটা কথা বলুন তো। মানুষ বলে মন থেকে কাওকে ভালোবাসলে না কি তাকে পাওয়া যায়। আমিও পেয়েছি আপনাকে। মন থেকে ভালোবেসেছি দেখেই পেয়েছি। কিন্তু যে পাওয়ায় বারবার হারানোর ভয় তাড়া করে বেড়ায়, সেই পাওয়ার কি কোনো মূল্য আছে! আমি কেন আপনাকে পেয়েও পেলাম না এখনো? আল্লাহ কিসের শাস্তি দিচ্ছে আমাকে? আমার যে আর সহ্য হচ্ছেনা এই যন্ত্রণা। যখনই মনে হয় আপনাকে আমি পেয়েও হারিয়ে ফেলছি তখনই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আমার। মনে হয় পুরো পৃথিবীটা থমকে গেছে। ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন?”

কথা গুলো বলতে বলতেই মুখ ঢেকে আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পরে দৃষ্টি। রক্তিম নির্বিকার। শরীরে অজস্র আঘাতের চিহ্ন নিয়েও নির্বাক তাকিয়ে সামনের দিকে। একদিকে বন্ধুর নির্মম পরিণতি অপরদিকে দৃষ্টির পাগলপ্রায় দশা। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মেহেদীর। এই এক দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া বর্তমানে হয়তো তাদের আর কিচ্ছু নেই। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে দৃষ্টিকে বুঝিয়ে থানার বাইরে গাড়িতে রেখে মেহেদী আবারও রক্তিমের কাছে আসে। দেখা করার জন্য যি সময় টুকু পেয়েছিল তার মধ্যে হাতে আরও পাঁচ মিনিন অবশিষ্ট আছে। এর মাঝেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা সেড়ে ফেলতে হবে। দ্রুত কদমে আবারও রক্তিমকে রাখা সেলের কাছে এসে নিচু স্বরে রক্তিমকে উদ্দেশ্য করে জানতে চায়,

“ঐ স্কাউন্ড্রেলটা কাল রাতে না কি থানায় এসেছিল!”

“হু” ছোট্ট করে জবাব দেয় রক্তিম। রাগে চিড়বিড়িয়ে ওঠে মেহেদী। চোয়াল শক্ত করে জানতে চায়,

“শু য়ো র টা আসার পরই কি তোর উপর এভাবে অত্যাচার চালিয়েছে? কোনো রিমান্ড ছাড়া কিভাবে এমন টর্চার করে তারা? সালার সব কয়টা বা*** দালাল। একবার শুধু তোকে বের করে নেই। প্রত্যেককে দেখে নিব। একটাকেও ছাড়বনা।”

শ্লেষাত্মক হাসে রক্তিম। নিজের প্রতি নিজেই বিদ্রোপ করে বলে,

“দুটো খুনের আসামি হয়েও দীর্ঘ আড়াই বছর আরামছে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরেছি। তোর কি মনে হয় ওরা উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কেস রি-ওপেন করেছে? আলরেডি এমপি সাহেবের উপর চাপ আসতে শুরু করে দিয়েছে। এই খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সয়ং এমপি সাহেব। বাতাসের গতিতে এটা সবার কাছেই পৌঁছে গেছে। তাছাড়া লিয়াকত বিল্লার মতো ক্রিমিনাল যেখানে হাত লাগিয়েছে সেখানে আমার মুক্তির আশা কিভাবে করিস? ছেড়ে দে আমার আশা। শুধু শুধু মরিচিকার পিছনে ঘুরে নিজেদের জীবনটা নষ্ট করিস না। মৃত্যুর ভয় আমার নেই। যদি থাকতোই তবে হয়তো এতো সহজে এই হাতে দুটো শরীর থেকে প্রাণ আলাদা করতে পারতাম না। আমার মৃত্যুতেই আমার মুক্তি। আমিও এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি চাই। শান্তির ঘুম ঘুমাতে চাই।”

রক্তিমের নির্লিপ্ত কন্ঠের এমন ভয়াবহ কথায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে মেহেদীর। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দিনের মতোই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়। বুকের ভিতর সৃষ্টি হয় নাম না জানা এক তোলপাড়। শিক ধরে রাখা রক্তিমের হাতটা এক হাতে শক্ত করে ধরে মেহেদী। শক্ত মনোবলে দৃঢ় কন্ঠে বলে,

“একদম ঘাবড়াবিনা। ভুলে যাবিনা তুই আজীজ শিকদারের ছেলে রক্তিম শিকদার। এতো সহজে তোর পতন হতে পারেনা। আরও অনেক বছর বাঁচতে হবে তোকে। তোর মনে নেই, আমরা দুজন যে প্ল্যান করেছি ব্যবসা শুরু করব! ছন্নছাড়া জীবনটাকে বিদায় দিয়ে আট-দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচব আমরা। নিজেদের পাশাপাশি এলাকার প্রতিটা বেকার ছেলের কর্মসংস্থান গড়ব। তুই ছাড়া এগুলো কিভাবে হবে? আমাকে প্লিজ মাঝ পথে ফেলে চলে যাস না। তোকে বাঁচতে হবে। আমাদের দুজনের একসাথে দেখা এখনো কত কত স্বপ্ন অপূর্ণ! সেগুলোর পূর্ণতা দিতে হবে। দৃষ্টি মেয়েটা শুধু তোকে ভালোবেসে নিজের পরিবার ছেড়েছে। তোকে যেদিন পুলিশ ধরে নিয়ে আসে, ঐদিনই দৃষ্টির মা-বাবা এসেছিল তাকে নিয়ে যেতে। মেয়েটা যায়নি। কি বলেছিল জানিস! তুই নাকি ওর মানসিক শান্তি। ছন্নছাড়া,গুন্ডা রক্তিম শিকদারকে ভালোবেসে সে নিজের পরিবার ছাড়তে পেরেছে যেহেতু।এখন খুনি রক্তিম শিকদারকেও ভালোবেসে দুঃখ গুলোকেই সুখ ভেবে একটা জীবন পাড় করে দিতে পারবে। একবার ঐ মেয়েটার কথা ভাব। পৃথিবীতে সব মেয়ে খারাপ হয় না। সবাই ছলনা করেনা। যদি কতরোই, তবে তোর আমার মা-বাবা এখনো একসাথে এক ছাঁদের নিচে থাকতনা। তাদের সংসারটা এমন সুন্দর পরিপূর্ণ হতনা। পৃথিবীতে দৃষ্টির মতো মেয়েরা আছে বলেই ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে।ঐ খাঁটি হিরেকে আর কাঁচ ভেবে পায়ে ঠেলে দিস না। ঐ মেয়েটার ভালোবাসার মূল্য চুকানোর জন্য হলেও তোকে এই চৌদ্দশিকের ভিতর থেকে বের হতে হবে। আর তোর বাবা-মা! তাদের একমাত্র ছেলে এখন তুই। তুই ছাড়া ওদের আর কেউ নেই। ঐ দুটো মানুষের বুড়ো বয়সের হাতের লাঠি তুই। নিজের পরিবারের কথা ভেবে হলেও হার মেনে নিস না। মনে বিশ্বাস রাখ। ইন শা আল্লাহ তোর মুক্তি হবেই।”

চলবে…….

(পাঠক, কিছুদিন যাবৎ প্রচুর ব্যস্ততায় আমার দিন কাটছে। একদম লেখার সময় পাচ্ছিনা। কাল রাতে আর এখন মিলিয়ে এই একটা মোটামুটি বড় পর্ব লিখেছি। প্রতিদিন যদি গল্প দেই তবে বড় পর্ব দিতে পারবনা। একদিন পর পর দিলে হয়তো বড় পর্ব দেওয়া সম্ভব হবে। এখন আপনারা বলুন গল্প কি প্রতিদিন চান? না কি একদিন পর পর বড় পর্ব!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here