#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_৪১
আফিফা আফরোজ এখান থেকে উঠে যাওয়ার পর সমুদ্র আরভীকে উদ্দেশ্য করে বলে,”কেন এমন প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছেন ললনা? কি পাবেন এই আগুনে জ্বলে?”
“ধ্বংস, বিনাশ অতঃপর শান্তি। আপনার কোনো সমস্যা আছে এতে? আর থাকলেও আমার কিছু করার নেই। তাই প্লিজ লিভ নাও।”
সমুদ্র হাসলো আরভীর কথায়। যুবক বয়সে বেশ কয়েকবার আরশাদ রায়হানের সমাবেশে উপস্থিত ছিলো বন্ধুদের সাথে। তখন উনার কিছু কথা বেশ মনে ধরেছিলো সমুদ্রের। কিন্তু উনি কি জানতেন উনার মেয়ে উনার সে সব নীতি কথা এক পাশে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে প্রতিশোধে মাতোয়ারা হয়ে ধ্বংস খেলায় নামতে?”
“যে যাই করুক না কেন। সবসময় ভালোবাসা দিবে। দেখবে একসময় তোমার ক্ষতিসাধক নিজেই অনুতপ্ত হবে তোমার মহৎপ্রাণ দেখে।”
সমুদ্রের কথায় আরভী অবাক চোখে তাকায় সমুদ্রের দিকে। এ উক্তি আরশাদ রায়হানের। আরশাদ রায়হান প্রায়শই আরভীকে এ কথা বলতেন। এমনকি সমাবেশেও মাঝে মধ্যে এরকম কিছু নীতিবাক্য বলতেন উনি।
আরভীকে অবাক চোখে তাকাতে দেখে সমুদ্র দারুন মজা পেলো। যাক, আরভী তবে ভুলে নি সেসব কথা। তাই ভেবে সমুদ্র হেসে বললো,”যেই মেয়েটি বাবা হত্যার প্রতিশোধে মেতেছে সেই মেয়েটিই নিজের বাবার আদর্শ ভুলতে বসেছে। কথাটি দারুন হাস্যকর লাগছে না ললনা?”
“বাবার এই মহৎপ্রাণের জন্যই তো আপনার মামা সুযোগ পেয়েছেন। উনি তো বাবার বন্ধু ছিলেন। তবু কেন এরকম একটা জঘন্য কাজ করেছেন?”
“জঘন্য মানুষ জঘন্য কাজ করবে এটাই তো স্বাভাবিক। বরং জঘন্য মানুষ ভালো কাজ করলে আমরা অবাক হয়ে যাই। যেমন করে আরশাদ আংকেল হয়তো আপনার এসব কাজ দেখে অবাক হচ্ছেন!”
“মানে! কি বলতে চাইছেন আপনি?”
“আপনার বাবা আপনাকে সব সময় এই রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চেয়েছেন কেন? যেনো আপনি কখনো এই দূষিত রাজনীতির মধ্যে আটকা না পড়ে যান। উনি আপনাকে উনার আদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছেন কিন্তু আপনি তো প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়ে গেছেন ললনা। রাখুন সেসব, আমার কি দোষ বলুন তো? আমি আমার মামা ও ভাইকে বাৃচিয়েছি এটাই তো? কিন্তু আমি আপনার হয়ে যা কিছু করেছি সেসব?”
“কি করেছেন আপনি? শুধু কয়েকবার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আর এর জন্য আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। এখন কি প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রতিদান চাইবেন? যদি এরকম কিছু মনে করে থাকেন তবে আমি বলবো আপনি নিজের স্বার্থের জন্য আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন।” তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো আরভী।
আরভীর কথা শুনে সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আরভীকে দেখে মনে হচ্ছে আরভী পণ করেছে যাই হয়ে যাক না কেন সমুদ্রকে ভালোবাসবে না। কথাবার্তায় তো তাই মনে হচ্ছে।
সমুদ্র কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো। আরভীকে নিজের করতে হলে সব সত্যিটা আরভীকে জানাতে হবে। সব সত্যি জানলে হয়তো কিছুটা হলেও আরভীর মনে সমুদ্রের জন্য একটা জায়গা তৈরি হবে। তা ভাবেই সমুদ্র আরভীর উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,”আপনার মনে কি একবার ও প্রশ্ন জাগে নি নাহিদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে এতো প্রমাণ পুলিশের হাতে কিভাবে লেগেছে?”
সমুদ্রের এ প্রশ্নকে আরভী তেমন একটা গুরুত্ব দিলো না। উল্টো মজা নিতে জিজ্ঞেস করলো,”আপনি দিয়েছেন প্রমাণ?”
“হ্যাঁ, আমি তন্ময়কে কাজে লাগিয়ে অনেক আগেই কিছু প্রমাণ জোগাড় করে রেখেছিলাম। বাকি গুলো এই কয়েকদিনের মাঝে করেছি। তন্ময় আমার বন্ধু এই সুবাধে কেউ তন্ময়কে সন্দেহ করে নি। আর আমাকে সন্দেহ করবে তা অসম্ভব। আমি বুকে পাথর চেপে মামাকে কারাগার পর্যন্ত পৌছে দিয়েছি। আর সেই কারনেই মামা নিজের ক্ষমতা, সম্রাজ্য সব হারিয়েছে। আর আপনি ভাবছেন আমি আমার মামার পক্ষ নিচ্ছি? হ্যাঁ, মানছি তারপর আমি মামাকে সাহায্য করেছি। কারন আমার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিলো না মামার এই অবস্থা দেখা। মনের কোনে কোথাও ভালোবাসা রয়ে গেছে মামার জন্য। মামাকে বা মিনহাজকে চোখের সামনে আমি মরতে দিবো এ কথা আমি কস্মিনকালেও ভাবতে পারি না।”
সমুদ্রের কথা শেষ হলে আরভী সমুদ্রের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালো,”তো আমাকে এসব বলছেন কেন আপনি? সহানুভূতি অর্জন করতে?”
“আপনি এমন অনুভূতি হীন হলেন কিভাবে ললনা? আমার অবস্থা দেখে কি আপনার বিন্দু পরিমাণ খারাপ লাগে না? একটা ছেলে আপনার জন্য এতো বছর ধরে অপেক্ষা করে যাচ্ছে তা জানতে পেরেও কি আপনার মনে তার জন্য মায়া জন্মায় না? সামান্য একটু দুঃখ প্রকাশ করে না?”
“না করে না।”
আরভীর কথায় সমুদ্র চুপ করে আরভীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর আরভী সমুদ্রের চোখের দিকে। মূলত দুজনেই ব্যাস্ত একে অপরের চোখের ভাষা পড়তে।
সমুদ্র এই আশায় আরভীর চোখ পড়তে চাইছে হয়তো সামান্য হলেও আরভীর চোখে নিজের জন্য মায়া-মোহ দেখবে। অপরদিকে আরভী সমুদ্রের চোখে চোখ রেখে সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে সমুদ্রের চোখ যুগল পড়ার চেষ্টা করছে।
——-
নাহিদ চৌধুরী নিজের সামনে মিনহাজের লাশ নিয়ে মিনহাজের মাথার ধারে বসে আছেন। উনি বর্তমানে বাংলাদেশে উনার নিজ বাড়ি চৌধুরী ম্যানশনে অবস্থান করছেন। একটু আগেই এসেছেন এখানে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তবেই এসেছেন।
তন্ময় গোপন সূত্রে খোজ পেয়েছে নাহিদ চৌধুরীর বাড়ি ফেরার কথা। তাই নিজের টিম নিয়ে বের হয়ে গেছে গাড়ি নিয়ে। উদ্দেশ্য নাহিদ চৌধুরীকে হাতেনাতে ধরা। এবার এমন ব্যবস্থা করতে হবে যে কোনো ক্রমেই আর কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন না উনি। জীবনের অন্তিম মূহুর্ত পর্যন্ত থাকতে হবে অন্ধকার কারাগারে।
নাহিদ চৌধুরী অনেকক্ষণ যাবত নিজের ছেলের মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে আছে। কত নিষ্পাপ লাগছে ছেলেটাকে। কত্ত সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে ছেলেটা। আর জাগবে না কখনো। ভালোই হয়েছে জাগবে না। এখন যেরকম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে জেগে থাকলে সেরকম শান্তি হয়তো কোনোকালেই পেতো না। আরভীকে ঠকানোর আফসোস, অনুতাপ চিরকাল থেকে যেতো ছেলেটার মনে।
এখানে আসার আগে হিমেলকে জানিয়েছিলেন উনি ফিরবেন। কিন্তু এটা বলেন নি মিনহাজের মৃতদেহ সাথে নিয়ে ফিরবেন। হিমেল নাহিদ চৌধুরীর অবস্থা ও মিনহাজের মৃতদেহ দেখে অবাক না হয়ে পারলো না। নাহিদ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো উনার অবস্থা কতটা দূর্বিষহ হয়ে আছে।
অনেকক্ষণ এক কোণে দাঁড়িয়ে থেকে বুকের মাঝে কিছুটা সাহস জুগিয়ে হিমেল জিজ্ঞেস করলো,”ভাই, মিনহাজ বাবারে মাটি দিবেন না?
এতোক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেও হিমেলের উক্ত কথায় আর চুপচাপ থাকতে পারলেন না। চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। উনার কান্নার স্বর সমগ্র চৌধুরী ম্যানশন জুড়ে শোনা গেলো। দলের লোকেরা বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে পাষাণ এক মানুষকে নিজ ছেলের জন্য কাঁদতে। যেই লোক এতোকাল নিজ হাতে মানুষ খুন করে এসেছে আজ সেই লোকই নিজের ছেলের মৃতদেহ সামনে নিয়ে আহাজারি করে কাঁদছে।
কিছুক্ষণ কেঁদে নিজেকে শান্ত করলেন নাহিদ চৌধুরী। তারপর সমুদ্রের নম্বরে কল করলেন।
সমুদ্র সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। চোখ থেকে ঘুমের রেশ এখনো পুরোপুরি কাটে নি। তাই বসে বসে ঝিমোচ্ছিলো। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলে নিভু নিভু চোখে মোবাইল হাতে নেয়। কে ফোন করেছে দেখতে স্ক্রিনে তাকাতেই দেখতে পায় “মামা” নামটি ভাসছে। মুহূর্তের মাঝে সমুদ্রের চোখ থেকে সমস্ত ঘুম বিলীন হয়ে যায়। বড় বড় চোখ করে স্ক্রিনের নম্বরের দিকে তাকায়। এটা তো নাহিদ চৌধুরীর বাংলাদেশের নম্বর। তবে কি নাহিদ চৌধুরী বাংলাদেশে এসেছেন? কিন্তু কেন এসেছেন? নাকি এটা নাহিদ চৌধুরী নয়, নাহিদ চৌধুরীর নম্বর থেকে অন্য কেউ কল করেছে?
সব প্রশ্নের উত্তর জানতে সমুদ্র কলটি রিসিভড করে কানে ধরতেই ভেসে আছে নাহিদ চৌধুরীর ক্রন্দিত কন্ঠস্বরে উচ্চারিত একটা বাক্য।
“মিনহাজ আর বেঁচে নেই রে ভাগ্নে।”
সমুদ্র স্তম্ভিত হয়ে যায় নাহিদ চৌধুরীর উক্ত বাক্যে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। হয়তো ভুল শুনেছ সমুদ্র। তা ভেবেই প্রশ্ন করে,”মামা তুমি কি বলছো বুঝতে পারছি না। আরেকবার বলো তো।”
“আমাদের মিনহাজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে ভাগ্নে। পাড়ি জমিয়েছে অন্য এক জগতে।” বলে হুহু করে কেঁদে উঠেন নাহিদ চৌধুরী।
সমুদ্র এবারও যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কি করে সম্ভব? মিনহাজ এভাবে চলে।যেতে পারে না।
সমুদ্রের চোখ ভিজে উঠে। দিকবিদিকশুন্য হয়ে সমুদ্র ছুটে যায় চৌধুরী ম্যানশনে।
সমুদ্র চৌধুরী ম্যানশনে পৌছে দেখলো বাড়িটি চারপাশ থেকে র্যাব ঘিরে রয়েছে। সমুদ্র ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে র্যাব দের মাঝ থেকে একজন পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললো,”ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই কারো।”
সমুদ্র মানলো না লোকটির কথা। ধাক্কা দিয়ে লোকটিকে ফেলে ভেতরে দৌড় লাগালো।
সমুদ্রকে এভাবে ভেতরে যেতে দেখে দুজন র্যাব সমুদ্রের পিছু ছুটলো সমুদ্রকে ধরতে। কিন্তু তারা সমুদ্রকে আটক করার আগেই সমুদ্র বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। দেখতে পায় একটা মৃতদেহ পড়ে আছে ফ্লোরে। শরীর তার সাদা কাপড়ে আবৃত। তার মাথার ধারেই নাহিদ চৌধুরী বসে হাউমাউ করে কেঁদে চলেছেন। আর তন্ময় নাহিদ চৌধুরীর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে এক দৃষ্টিতে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আছে।
সমুদ্র আস্তেধীরে মৃতদেহের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে দুজন র্যাব সমুদ্রের পথ আটকে দাঁড়ায়। যে দুজন র্যাব তখন সমুদ্রকে ধরতে সমুদ্রের পিছু পিছু ছুটেছিলো তারাই সমুদ্রকে থামিয়েছে। সমুদ্রের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে বলে,”বাহিরে চলুন আমাদের সাথে।”
এবার সবার দৃষ্টি যায় সমুদ্রের দিকে। তন্ময় সমুদ্রকে দেখে র্যাবদের ইশারা করে সমুদ্রকে ছেড়ে দিয়ে এখান থেকে বের হয়ে যেতে।
তন্ময়ের ইশারা পেয়ে তারা বেড়িয়ে যায়। আর তারা বেড়িয়ে যেতেই নাহিদ চৌধুরী উঠে দাঁড়ান। সমুদ্র ধীরপায়ে মৃতদেহের সামনে এসে দাঁড়ালে সমুদ্রের হাত ধরে কান্নারত স্বরে বলেন,”দেখ না ভাগ্নে, আমার ছেলেটা আমাকে একা ফেলে চলে গেছে। আমি বাপ হয়ে নিজের ছেলের লাশ কাধে নিবো কি করে? এই ভার যে আমি বহন করতে পারবো না।”
“আজ বুঝলে তো মামা? কারো কাছের মানুষ মারা গেলে কেমন লাগে!” কথাটি বলে সমুদ্র সাদা কাপড়ে আবৃত মৃতদেহের সামনে বসে পড়ে। মুখের উপর থেকে সামান্য একটু কাপড় সরিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠে,”ওপারে ভালো থাকিস আমার ভাই।”
চলবে….