#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_৪২
এই শীতের মধ্যে বৃষ্টির দেখা পাওয়া দূর্লভ বস্তুর মতো হলেও মাঝেমধ্যে শীতের কোনো এক প্রহরে বৃষ্টি নামে চারপাশকে আরেকটু শীতল করে তোলার উদ্দেশ্যে।
যেমন করে আজও শীতের রেশ বাড়াতে এই অবেলায় ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। আর সেই বৃষ্টিতে ভিজে চারজন ব্যাক্তি কাধে করে মিনহাজের লাশ নিয়ে যাচ্ছে কবর দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
চারজন ব্যাক্তি হলো নাহিদ চৌধুরী, নোমান আহমেদ, তন্ময় ও সমুদ্র। সাথে বেশ কিছু র্যাব রয়েছে এই চারজনকে ঘিরে। আর রয়েছে শতশত সাধারণ জনগণ।
তন্ময় সিস্টেমের বাহিরে গিয়ে নাহিদ চৌধুরীকে মুক্তি দিয়েছে সাময়িক সময়ের জন্য। মিনহাজের দেহ মাটিতে দাফন করার পরমূহুর্তেই গ্রেফতার করা হবে উনাকে। এর জন্য উপর মহলে কড়া জবাবদিহিতা করতে হবে তন্ময়কে। জেনেশুনেই এতো বড় রিস্ক নিয়ে সিস্টেমের বাহিরে গিয়ে এ কাজ করেছে তন্ময়। এমনও হতে পারে এই কাজের জন্য তন্ময়কে নিজের চাকরিটাই হারাতে হবে।
জানাজা হলো, মৃতদেহকে দাফন করা হলো। আস্তেধীরে ভির কমতে লাগলো কবরস্থান থেকে। নাহিদ চৌধুরী গ্রেফতার হলেন তন্ময়ের নির্দেশ মতে।
নাহিদ চৌধুরীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার সময় চারপাশ থেকে সাংবাদিকেরা ঘিরে ধরেছে র্যাবদের। একেক সাংবাদিক একেক রকমের প্রশ্ন করে যাচ্ছে নাহিদ চৌধুরীকে। কিন্তু নাহিদ চৌধুরীর মাঝে কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। সন্তান হারিয়ে পাথরের ন্যায় অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছেন উনি।
র্যাবের সদস্যরা ভির ঠেলে নাহিদ চৌধুরীকে সুরক্ষিত ভাবে গাড়িতে তুললো। অপরদিকে এ চিত্র সকল পত্রিকায় প্রথম পাতায় ছাপানো হলো। টিভিতে লাইভ দেখানো হলো। যার শিরোনামে ছিলো,”অসৎ কর্মকান্ডের জন্য আবারও গ্রেফতার হলেন হৃদয়পুরের সাবেক মেয়র নাহিদ চৌধুরী। জানা গেছে উনি এতোকাল পলাতক ছিলেন। গতবার জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন উনার ছেলের মাধ্যমে। আর আজ সেই ছেলেরই জানাজার পর র্যাব উনাকে আটক করেছে।”
একসময় সবাই প্রস্হান করলো কবরস্থান থেকে। কিন্তু সবাই চলে যাওয়ার পর একজন গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো সদ্য দেওয়া কবরটির সম্মুখে। সাদা রঙের একগুচ্ছ গোলাপ কবরের পাশে রেখে বিরবির করে বললো,”হয়তো আপনি আমায় ভালোবাসেন নি কিন্তু আমি ভেসেছিলাম, মনের গহিন থেকে। তাই না চাইতেও চলে এলাম। তবে এটাই প্রথম এবং এটাই শেষ। আর কখনো আসবো না আপনার নতুন এই আঙ্গিনায়।”
কথাটি বলে পিছু ঘুরতেই এক পুরুষালী দেহের সাথে ধাক্কা খেতে গিয়েও থেমে যায়। মাথা উচু করে লোকটির মুখের দিকে তাকালে দেখতে পায় সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে।
আরভী সমুদ্রকে দেখে সমুদ্রের থেকে চোখ নামিয়ে নেয়। যা দেখে সমুদ্র আরভীর চিবুকের নিচে এক আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে মুখমণ্ডল খানিকটা উপরের দিকে তুলে চোখের দিকে তাকায়। দেখতে পায় আরভী নিজের চোখ যুগল বন্ধ করে আছে। কিন্তু চোখের পাপড়ি ভিজে আছে পানিতে।
সমুদ্র বিষাদ হাসলো। আর বললো,”বাবার খুনীর জন্য কাঁদছেন?”
“বৃষ্টিতে ভিজেছে চোখ।”
“ঠোঁট কাপছে কেন?”
“বড্ড শীত করছে।”
“চোখ বন্ধ করে আছেন যে? লুকোচ্ছেন কিছু?”
সমুদ্রের এ প্রশ্নে আরভী চোখ মেলে তাকালো। নিজের ভেতরকার কথাগুলো আর চেপে রাখতে পারলো না। এতোকাল তো রেখেছিলো। কিন্তু এখন কেমন দম আটকে আসছে। নিজের অনুভূতিদের আর দমিয়ে রাখতে পারছে না। তাই তো সমুদ্রের চোখে চোখ রেখে বললো,”আমি জানি না সমুদ্র। আমি সত্যি জানি না আমি কেন কাঁদছি। আমি সত্যি জানি না আমার কেন এতো কষ্ট হচ্ছে। এ যে অনুচিত সমুদ্র। শত্রুদের জন্য কাঁদতে নেই, তবুও কেন কাঁদছি আমি?”
আরভীর চোখ পানিতে টইটম্বুর হয়ে আছে। যে কোনো সময় গড়িয়ে পড়বে।
“কান্না আটকে রেখে গুমড়ে মরবেন না দয়া করে। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিন। আমি আর আপনি ছাড়া কেউ নেই এখানে। তাই লোকে জেনে যাওয়ার কোনো ভয়ও নেই। অশ্রুদের ঝড়তে দিয়ে মনকে হালকা করে নিন।”
আরভী আর নিজের অশ্রুদের বাঁধা দিলো না। ঝড়তে দিলো। প্রকৃতির মাঝে কিছু সময়ের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিলো। যার মাধ্যমে কিছু সময়ের জন্য খুঁজে পেলো পুরোনো সেই আরভী সত্ত্বাকে।
রাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আজ সকালের কথা ভেবে চলেছে আরভী। আজ সকালে নাহিদ চৌধুরী আরভীকে কল করেছিলেন। নাহিদ চৌধুরীর কল পেয়ে আরভী ভেবেছিলো হয়তো হুমকি দিবে বা কিছু খারাপ কথা বলবে আরভীকে। কিন্তু এমন কিছুই হয় নি। উনার গলার স্বর ছিলো ভাঙ্গা। উনি কোনো রকমে থেমে থেমে কেবল কিছু বাক্যই বলেছিলেন। উনি বলেছিলেন,”সমুদ্র তোমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার ভুলের মাশুল তুমি সমুদ্রকে দিয়ো না মা। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি আইনের হাতে নিজেকে সঁপে দিবো কথা দিচ্ছি। কিন্তু তুমি আমার পাপের শাস্তি আমার ভাগ্নেকে দিয়ো না।”
এরপর আরভীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দেন। আরভী ভেবেছিলো হয়তো নতুন কোনো ফাঁদ পেতেছেন নাহিদ চৌধুরী। কেননা উনি এরকম একজন মানুষ যার থেকে এই কথাগুলো কোনো কালেই আশা করা যায় না।
কিন্তু যখন দুপুরে নিউজ দেখলো তখন আসল ঘটনা বুঝতে পারলো। ছেলেকে হারিয়ে পরিবর্তন এসেছে তবে!
চারপাশে বেশ কুয়াশা পড়েছে। কোনো কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। শীতে আরভীর শরীর ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। তাই আর বেশিক্ষণ দাড়ালো না বাহিরে। ঘরে চলে এলো। বিছানায় শুয়ে বিরবির করে বললো,”সবার শাস্তি সবাই পেয়েছে। এবার আপনার পালা সমুদ্র। প্রস্তুত হোন নিজের শাস্তির জন্য।”
কেটে গেলো দুদিন। আরভী নিজের কাজ নিয়ে অনেকটাই ব্যাস্ত ছিলো এই দু’দিনে। এছাড়া সামনে আরভীর বিয়ে। ব্যাস্ত তো থাকবেই। এইতো কাল রাতে বিয়ের কার্ড ছাপিয়ে এনেছে। এখন সবার কাছে পৌছে দেওয়ার পালা। তবে সবার আগে পৌছাতে হবে সমুদ্রের কাছে। আরভী চায় আরভীর বিয়ের প্রথম কার্ড যেনো সমুদ্র পায়। তাই সকাল সকাল একটা কার্ড হাতে নিয়ে পৌছে গেলো সমুদ্রদের বাড়িতে। সাথে ফায়াজকেও নিয়ে নিলো।
আরভীকে হঠাৎ বাড়িতে দেখে নোমান আহমেদ ও ইয়াসমিন অবাক হলেন। তারপর আবার নিজেদের সামলে নোমান আহমেদ হাসিমুখে বললেন,”আরে মা এসো এসো। আজ হঠাৎ আমাদের বাড়িতে এলে যে? সমুদ্র কিছু করেছে?”
“এসব কথা পরে জিজ্ঞেস করলেও তো হয়। আগে মেয়েটাকে একটু বসতে দাও।” ইয়াসমিন বললেন।
“ওহ হ্যাঁ, তাই তো। কিছু মনে করো না মা। আসলে তোমাকে হঠাৎ এ বাড়িতে দেখে খানিকটা চমকে উঠেছি।”
“সমস্যা নেই, আপনারা প্লিজ ব্যাস্ত হবেন না আমাকে নিয়ে।” আরভী প্রতিত্তোরে বললো।
“তা কি করে হয়? তুমি প্রথমবার এসেছো আমাদের বাড়িতে। তুমি বসো আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে আনছি।” ইয়াসমিন কথাটি বলেন। কিন্তু আরভী উনাকে বাঁধা দিয়ে বলে উঠে,”না না আন্টি। অযথা কষ্ট করবেন না। আমার কাছে সময় নেই তেমন একটা। এখান থেকে বেড়িয়েই সমাবেশে যেতে হবে। আমি একটু প্রয়োজনে এসেছি এখানে।”
আরভীর মুখে প্রয়োজনের কথা শুনে সামান্য ভয় পেলেন নোমান আহমেদ ও ইয়াসমিন। তবে কি নোমান আহমেদের ধারণাই ঠিক? সমুদ্র কিছু করেছে?
নোমান আহমেদ ও ইয়াসমিনকে এভাবে চিন্তিত হতে দেখে আরভী মিষ্টি হাসি উপহার দিলো উমাদের উদ্দেশ্যে। তারপর সোফায় বসে বললো,”এই নিন বসেছি। এবার আপনারাও একটু নিশ্চিন্তে বসুন তো।”
আরভীর কথায় নোমান আহমেদ ও ইয়াসমিন ভয়ে ভয়ে বসলেন। দুজনের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। হয়তো সমুদ্রকে নিয়ে চিন্তা করছেন। হয়তো ভাবছেন সমুদ্র কোনো গন্ডগোল বাঁধিয়েছে দেখেই আরভী এখানে এসেছে। নয়লে তো এ বাড়িতে আরভীর পা ফেলার কথা না।
আরভী ফায়াজের দিকে তাকিয়ে দেখলো ফায়াজ দাঁড়িয়ে। তা দেখে বললো,”আরে ফায়াজ তুমি দাঁড়িয়ে কেন আবার?”
আরভীর কথায় ফায়াজ পাশের সোফায় বসলো। তারপর আরভী নোমান আহমেদ ও ইয়াসমিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,”ভয় পাবেন না। সমুদ্র কিছু করে নি। তবে করতে পারে। তারজন্যই আপনাদের কাছে আসা। বলতে পারেন আপনাদের সাহায্যের জন্যই এসেছি। আসলে আমি আপাতত কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছি না। তাই নিজেদের মাঝেই সবকিছু মিটমাট করে নিতে চাইছি।”
নোমান আহমেদ ও ইয়াসমিন একে অপরের দিকে তাকালেন। উনারা কিভাবে আরভীকে সাহায্য করতে পারেন তাই বুঝতে পারছেন না। এছাড়া সমুদ্র কি ঝামেলা’ই-বা করতে পারে? যার জন্য হৃদয়পুরের মেয়র আরভী রায়হান নিজে এসেছেন উনাদের সাহায্য যাইতে।
“জ্বি মা, আমরা তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? আর সমুদ্র’ই বা কি ঝামেলা বাধাতে পারে?” নোমান আহমেদ চিন্তিত স্বরে শুধালেন।
আরভী নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে নোমান আহমেদ ও ইয়াসমিনের সামনে ধরে বললো,”এটা আমার বিয়ের কার্ড। আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ রইলো।”
নোমান আহমেদ কার্ডটি হাতে নিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। ছেলেটা তার ভালোবাসার মানুষটাকে হারালো। অথচ উনারা কিছুই করতে পারলেন না।
“আমরা অবশ্যই যাবো মা। কিন্তু তুমি যে বললে!”
“বলছি সব। আশা করছি আপনারা আমাকে সাহায্য করবেন। আসলে সমুদ্র এতো সহজে আমার বিয়েটা হতে দিবে না এটা আমার বিশ্বাস। অলরেডি আমার হবু বরের গায়ে হাত তুলেছে সমুদ্র। আমি চাইছি না পরবর্তীতে এমন কিছু হোক। যদি আবারো সমুদ্র এমন কিছু করে তবে আমি বাধ্য হবো আইনিপদক্ষেপ নিতে। এছাড়া আমি চাই না আমার বিয়েতে কোনো প্রকার বাঁধা আসুক। তাই আপনাদের সাহায্য কামনা করছি আমি।”
চলবে…