#প্রেম_আমার♥
#পার্ট-৪০♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
.
🌺
.
—- এতোক্ষণ যা যা হলো তার সবটাই আপনার প্লানিং অনুযায়ী হয়েছে তাইনা?
.
নীবিড় ভাইয়া এবারেও কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে নিঃসংকোচে অস্বীকার করে গেলেন। ভাবখানা এই যে যখন এসব ঘটছিলো তখন উনি বোধহয় মঙ্গল গ্রহে অবস্থান করছিলেন।
আমি আবারও হতাশ হয়ে এবার ভ্রু কুঁচকে অগ্নি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। অগ্নি ভাইয়া সাথেসাথেই ঠোঁট উল্টে জানান দিলো এসবের সাথে বিন্দুমাত্রও যোগসূত্র নেই তার। আমি অগ্নি ভাইয়ার থেকে চোখ সরিয়ে রুশো ভাইয়ার দিকে তাকাতেই ভাইয়া মুখ বাকিয়ে “প্রশ্নই আসে না!” বলে চালিয়ে দিলো।
এবার বাকি থাকলো শুধু নিত্য আপু, কারণ রাত্রি তো সবে এলো। আমি নিত্য আপুকে কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই নিত্য আপু হাত উঠিয়ে বলে উঠলো,
.
—- হেই এটেনশন প্লিজ। এটা সম্পূর্ণ আমার প্লান। আচ্ছা তোমরাই বলো আমি কি করে ভাবি হয়ে নিজের ননদকে অন্য ঘরে পাঠানোর সুযোগ করে দেই?
.
নীবিড় ভাইয়া বাদে সবাই এক সুরে বলে উঠলো,
—- হুম, ঠিক।
.
নিত্য আপু আবারও বলতে শুরু করলো,
—- এক্সাক্টলি! তাই তো সুযোগ বুঝে একটা জুসের গ্লাসে ইচ্ছেমতো সোডা মিশিয়ে দিয়েছি। আর সেটাই গিয়ে ওই ভোলাভালা চাশমিশ টাকে খাইয়ে দিয়েছি! বেশ হয়েছে! আমার একমাত্র ননদ প্লাস ভাবীকে বিয়ে করতে আসা তাইনা? ইচ্ছে তো করছিলো সামনে রাখা কাটা চামচ দিয়ে চোখ দুটো ফুটো করে দেই! হুহ!
.
নিত্য আপুর মুখের এমন ধরণের কথায় হকচকিয়ে উঠলাম আমি। আমার মতে নিত্য আপু খুবই শান্তশিষ্ট নম্র ভদ্র! আপুও যে এসব ভাবনা মনে মনে পুষে রেখে বাইরে স্বাভাবিকতা ফুটিয়ে রাখে তা দেখে একেবারেই বোঝা যায় না। এবার নিত্য আপুকে নীবিড় ভাইয়ার বোন বলে মনে হচ্ছে আমার। দুজনই বাইরে ফিটফাট কিন্তু ভেতরে জট পেচিয়ে কুঁপোকাত!
আশেপাশে একবার আড় চোখে দেখে নিতেই অগ্নি ভাইয়া, রুশো ভাইয়া আর রাত্রির মুখটা চোখে ভেসে উঠলো। আমার মতো তাদেরও ঠিক একই অবস্থা! এতোকিছুর মাঝে শুধু নীবিড় ভাইয়া স্বাভাবিক! অবশ্য স্বাভাবিক থাকাটাও বড্ড স্বাভাবিক। কারণ নিজের বোনকে উনার থেকে বেশি আর কেই বা চিনে!
.
নীরবতা ভেঙে রুশো ভাইয়া দুহাতে তালি বাজিয়ে বিস্ময়ে বলে উঠলো,
—- ওত্তেরি! ভাবি দেখি গভীর জলের মাছ! যাই বলো ভাবি, তুমি কিন্তু জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছো! একদম লিকুইড পটি করে ছাড়িয়েছো কান্টুসটাকে! ওয়াহ!
.
বলেই হাই ফাইভ করার জন্য রুশো ভাইয়া হাত উঠালো। নিত্য আপু হেসে দিয়ে রুশো ভাইয়ার সাথে হাই ফাইভ করে আরাম করে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়লো।
আমি অবাক চোখে আপুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
.
—- আপুউউ…! তুসসি গ্রেট হো! কতো সুন্দর করে টুপ করে বিয়েটা ভেঙে দিলে আমার! আম জাস্ট স্পিচলেস!
.
অগ্নি ভাইয়া ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,
—- নিত্য! তুমি আমায় বললে না কেনো বলোতো? আমি নাহয় আরো একটু হেল্প করতাম। আর সব তোমরা দুটোয় মিলে করলে কেনো আমাদের শুধু সান্ত্বনা দিয়ে রেখে?
.
নিত্য আপু অগ্নি ভাইয়ার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার বদলে কাশতে শুরু করে দিলো। রাত্রি বেড টেবিলে থাকা পানির গ্লাস নিয়ে আপুকে দিতেই ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করে ফেললো আপু।
গলা খাকারি দিয়ে আপু বললো,
.
—- আমি একাই সব করেছি অগ্নি। কারোর হেল্প লাগে নি আমার।
.
অগ্নি ভাইয়া জ্বিবে কামড় দিয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে উঠলো,
—- ও হ্যাঁ, তাইতো! একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
.
নিত্য আপু অগ্নি ভাইয়াকে ভেংচি কেটে দিলো।
আর আমি শুধু বোকার মতো চেয়ে চেয়ে দেখছি সবার কার্যকলাপ।
একটু পরই আম্মু হন্তদন্ত হয়ে দরজায় নক করতে লাগলো।
আমি সবাইকে থামতে বলে দরজা খুলে দিতেই আম্মু তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকে পড়লো। আম্মুকে এতো সিরিয়াস দেখে সবাই বসা থেকে উঠে পড়লো।
.
—- মনি, হোয়াট হ্যাপেন্ড?
.
—- কি হয়েছে আম্মু? তোমাকে এমন দেখ
আম্মু হাঁপাতে হাঁপাতে একটু শান্ত হয়ে বললো,
.
—- তোদের দিদুন ফোন করেছিলো রে। হবু নাত বউ কে দেখতে চায়। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই যেতে বলেছে। আর তোরা তো জানিস তোদের দিদুনের মুখের ওপর কারোও কিছু বলার সাহস নেই। তাই যেতে হবে সবাইকে। না জানি নিত্য কে কতোভাবে পরীক্ষা করে এই ভয়ে আমার টনক নড়ে উঠছে। উনি যে কঠিন মানুষ!
.
অগ্নি ভাইয়ার দিদুনের নাম শুনেই অলরেডি হাটু কাঁপা শুরু হয়ে গিয়েছে। আর এদিকে আমার গলা শুকিয়ে আসছে। দিদুন আমাদের ভীষণ ভালোবাসলেও চূড়ান্ত স্ট্রিক্ট স্বভাবের একজন মানুষ। একটু চুন থেকে পান খসলেই পুরো এলাহি কান্ড বাঁধিয়ে ফেলে।
.
—- হেই মনি, ইনি তো সেই যিনি আমায় না বলে আম পারার জন্য লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিলো তাইনা?
.
আম্মু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলতেই রুশো ভাইয়ার কাশি উঠে গেলো। কাশতে কাশতে জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো রুশো ভাইয়া।
.
—- ওহ নো মনি, শি ইজ ভেরী ডেঞ্জারাস! যাওয়াটা কি খুব জরুরী? আমি না গেলে হয় না?
.
ওমনি অগ্নি ভাইয়া রুশো ভাইয়ার মাথায় চাটি মেরে ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে উঠলো,
—- ফাজিল, আমাদের একা বিপদে ফেলে তুই কোথায় পালাচ্ছিস! তুই ও যাচ্ছিস এটা ফাইনাল। আন্টি আংকেল কে আমি ম্যানেজ করে নেবো।
.
এবার নীবিড় ভাইয়া নড়েচড়ে বসে শান্ত গলায় বলে উঠলেন,
—- মামনি এতো চিন্তার কি আছে? দিদুন যখন যেতে বলেছে হবু নাত বউ কে দেখবেই তখন যাবো আমরা। আর নিত্য তুই একটু সাবধানে থাকবি। কোনো ভুল ত্রুটি যেনো না হয় তাহলেই হয়ে গেলো।
.
নিত্য আপুও নীবিড় ভাইয়ার কথায় শায় দিয়ে মাথা নাড়ালো। আর আমি ভাবছি রাত্রিকেও বেঁধে নিয়ে যাবো। ওখানে গেলে নিম্নে সপ্তাহখানেক এর আগে নিশ্চয় আসতে দেবে না দিদুন। আর এতোগুলো দিন রাত্রিকে ছাড়া থাকা জাস্ট ইম্পসিবল। তাই আমি রাত্রি কাছে গিয়ে ওর হাত টেনে ধরে বলে উঠলাম,
.
—- তুইও আমাদের সাথে যাবি কিন্তু। কোনো না শুনবো না আমি। তোর বাসায় আমার কথা একবার বললেই তোকে যেতে দেবে আন্টি। সেখানে তো আমাদের পুরো পরিবার যাচ্ছে। না করার কোনো প্রশ্নই আসে না।
আম্মুউউ আমরা রাত্রিকেও নিয়ে যাই প্লিজ!
.
আম্মু নিশ্চিত হয়ে বলে উঠলো,
—- এতে আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে? রাত্রিও যাক। বগুড়ার পরিবেশ দেখুক ভালো লাগবে ওর।
.
রাত্রি আবারও না করবে তার আগেই আমি ওর পেটে চিমটি কেটে দিলাম। বেচারি শেষমেশ চিপায় পরে রাজি হয়ে গেলো।
.
🍂
.
আজ বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি আমরা সবাই৷ তবে আজ নিজস্ব কারে যাচ্ছিনা আমরা, ইভেন রাজশাহী থেকে বাসে যাওয়া গেলেও বাস নামক উল্টির উৎস কে আমি বা ভাইয়া কেউই চুজ করি নি। এক কথায় জার্নি নামক ভয়ংকর জিনিসটা আমরা দুই ভাই বোনের কেউই ঠিক নিতে পারিনা। সামান্য কারে বসে ২ ঘন্টার জার্নিতেই উল্টি প্রসেস অন হয়ে যায় আমার। অগ্নি ভাইয়াও বেশিক্ষণ বাস বা কারে জার্নি করতে পারে না। তাই মোস্ট অফ দ্য টাইম বাসায় প্রাইভেট কার থাকা সত্ত্বেও বাইক নিয়ে ঘুরে বেরায়! রুশো ভাইয়ারও আগে আমাদের মতোই উল্টা উল্টি হতো তবে ইউএস যাওয়ার পর থেকে এখানে সেখানে ফ্লাইটে, কারে করে যেতে যেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আর রইলো নিত্য আপু আর নীবিড় ভাইয়া, তারা তো আগে থেকেই স্ট্রং। যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে পারে খুব সহজেই তাই তাদের কোনো প্রবলেমই নেই। আবার রাত্রিও আমার থেকে এসব ব্যাপারে কয়েক ধাপ এগিয়ে। মাঝখান থেকে বিপত্তি ঘটলো শুধু আমায় আর অগ্নি ভাইয়াকে নিয়ে।
৪ ঘন্টার জার্নিতে কোনো ভাবেই আমরা কারে বা বাসে যেতে ইচ্ছুক নই। গেলে বোধহয় শহিদ হয়ে ফিরতে হবে আমাদের।
.
বগুড়ায় এয়ারপোর্ট না থাকায় ফ্লাইটে যাওয়ার প্লান ও মাঠে মারা গেলো সবার। এখন বাকি থাকলো শুধু ট্রেন নামক ফুরফুরে ভেহিকল। এক কথায় ট্রেন জার্নি কথাটা শুনা মাত্রই মনটা ময়ূরের ন্যায় নেচে ওঠে আমার। ট্রেনে আমাকে আর ভাইয়াকে ১০ ঘন্টা এক নাগারে জার্নি করালেও আমাদের কিচ্ছু হবে না। তাই অগত্যাই সবাইকে আমাদের দুই ভাই বোনের জন্য সব প্লান ক্যান্সেল করে শেষমেশ ট্রেন ধরেই যেতে হবে। রাজশাহী থেকে সোজা বগুড়া যাওয়া যাবে না তাই একেবারে সান্তাহার নেমে সেখান থেকে সিএনজি রিজাভ করে বগুড়া যেতে হবে এমনটাই কথা আছে।
.
🌸
.
আমাদের রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে টোটাল ৫ টা প্লাটফর্ম। তার মধ্যে বর্তমানে ৩ টে প্লাটফর্মে ৩ টে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।
যেহেতু এটাই শেষ সীমানা, আব্দুলপুরের পরেই আমাদের রাজশাহী তবে তা বাঁকা পথে। আব্দুলপুর পার করে সোজা রেললাইন ধরে গেলে ভেরামারা। তাই এরপরে উত্তরবঙ্গের কোনো ট্রেন রাজশাহী পার করে যেতে পারে না। এখানেই শেষ হয়েছে রেলপথ তাই ট্রেন আসার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বরং ট্রেনই যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। তবে সব জায়গার ট্রেনের মতো এখানে কোনোভাবেই সময়ের গরমিল হয় না। যদি ট্রেন ৩ টেয় ছাড়ার কথা থাকে তবে ঠিক ৩ টেতেই ছেড়ে দেবে। তাই সময় মেইনটেইন করেই বেরোতে হয় ২-৩ মিনিট এদিক ওদিক হওয়া মানেই ট্রেন হাওয়া। সেই হিসেবে আমরাও হাতে ১৫ মিনিট বেশি রেখে বেরিয়েছি!
.
আম্মু আব্বু আমাদের সুবিধায় ২ টো কেবিনের টিকিট বুক করেছে।
তবে সিটগুলো এমন ভাবে পড়েছে যে আম্মু আব্বু আমাদের বাচ্চাপার্টির ঠিক উল্টো দিকের কেবিনে বসেছে। আর আমরা এদিকে সামনে-পেছনে মিলে পুরো কেবিনজুড়ে বসেছি। এদিকে ৩ টে সিট আবার সামনের ৩ টে সিট মিলে আরামে আমরা ৬ জন বসতে পারবো।
ভবনা ছিলো আমরা মেয়েরা এপাশে আর ছেলেরা ওপাশে বসবে কিন্তু আমাদের সকলের ভাবনায় এক ট্যাংকি জল ঢেলে দিয়ে অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপু পাশাপাশি বসার বায়না ধরেছে। তবে আমার একটাই কথা, যে যেখানেই বসুক না কেনো আমি জানালার পাশের সিট ছাড়ছি না কোনোমতেই। এটা আমার ছোট্টবেলার অভ্যেস। জানালার পাশে না সিট পরলেও ছলে বলে কৌশলে যাত্রীদের উঠিয়ে তবে আমি ক্ষ্যান্ত হই। মাঝেমাঝে উল্টি করে দেবার ভয়ও দেখাই। নিজেদের গা বাঁচাতে প্রতিবারই সিট বদলে ফেলে প্যাসেঞ্জারেরা।
.
সিট নিয়ে যখন তুমুল গন্ডগোল তখন নীবিড় ভাইয়া সবাইকে এক ধমক মেরে চুপ করিয়ে দিলো। আমাদের সামনের সিটে অগ্নি ভাইয়া আর নিত্য আপুকে বসিয়ে নীবিড় ভাইয়া আমার পাশে এসে বসে গেলেন। উনার ঠিক অপর পাশেই বসা রাত্রি। বর্তমানে রাত্রি আর রুশো ভাইয়া পরগাছার মতো মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। তাদের মতে কাপলদের ভীরে তারা নিতান্তই কাবাবের মাঝে হাড্ডির স্বরুপ। এদিকে রুশো ভাইয়া চাচ্ছে রাত্রির পাশে বসতে কিন্তু মুখ ফুটে আর বলে হয়ে উঠছে না ভাইয়ার।
নীবিড় ভাইয়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমায় দাঁড়িয়ে যেতে বললেন।
হঠাৎ আমায় দাঁড়াতে বলার কোনো কারণ বুঝে উঠতে না পারায় আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
.
—- দাঁড়াবো কেনো?
.
কথা না মানায় উনি আবারও ধমক দিয়ে উঠায় চটজলদি উঠে দাঁড়ালাম আমি।
উনি রুশো ভাইয়াকে নিজের জায়গায় এসে বসতে বলে আমার বসা জায়গায় ফুসসস করে সরে এসে বসে পড়লেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে হকচকিয়ে বলে উঠলাম,
.
—- আরে আরে একি করছেন? আমার উইন্ডো সিটে আপনি বসলেন কেনো?
.
উনি আমার কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হেঁচকা টান মেরে নিজের কোলে বসিয়ে দিলেন। যা দেখে সবার মুখ অটোমেটিকালি হা হয়ে গেলো। রুশো ভাইয়ার চোখ তো মনে খুলে বেরিয়ে আসবে। অগ্নি ভাইয়া নীবিড় ভাইয়ার এমন কান্ডে মুখ ঘুরিয়ে কাশতে শুরু করে দিলো। এদিক রাত্রি অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে সাথে নিত্য আপু ঠোঁট চেপে হেসে চলেছে। রুশো ভাইয়া রাত্রির পাশে জায়গা ফাঁকা পেয়ে ততক্ষণাৎ এক লাফ মেরে এসে বসে পরলো।
.
—- আপনি আমায় কোলে নিলেন কেনো? ছাড়ুন বলছি। যান ভাইয়ার পাশে গিয়ে বসুন।
.
—- শাট আপ অনন্যা! ওদের মাঝে আমি গিয়ে বেকার কাবাব মে হাড্ডি হতে পারবোনা। চুপচাপ বসে থাকো। তোমার উইন্ড সিট চাইতো তাইনা? তাহলে ভদ্রভাবে বসে থাকো। একদম নড়াচড়া করবা না। নাহলে নিচে বসিয়ে রেখে দেবো।
.
নীবিড় ভাইয়ার কথার রেশ ধরে রুশো ভাইয়াও দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
—- ফ্রি ফ্রি এতো আরামদায়ক সিট পেয়েছিস ছুটকি! বাহ বাহ তোর কি লাক!
.
—- ভাইয়ায়ায়ায়া…….!😤
.
ওমনি রুশো ভাইয়া চুপ করে গেলো। আমাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাত্রির মুখপানে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে ভাইয়া বললো,
—- হ্যালো এটম বোম্ব!
.
রাত্রি রেগেমেগে হাত উঠাতে নিলেই রুশো ভাইয়া ততক্ষণাত নিজের নাক চেপে ধরে বলে উঠল,
—- ট্রাস্ট মি! আর একবার মারলে আমার নাকটা মারা যাবে!
.
রুশো ভাইয়ার কথায় না চাইতেও ফিক করে হেসে উঠলাম আমি। অগ্নি ভাইয়া হাসতে হাসতে বলে উঠলো,
—- আরে নাক আবার কিভাবে মরে রে ভাই?
.
রুশো ভাইয়া মাথা চুলকে বললো,
—- আই ডোন্ট নো বাট নাক ফাটানোর ভয়ে এবার নাক কেটেই ফেলবো আমি। যদি ওগি এন্ড দ্য ককরোচের ওগির মতো নাক খুলে রাখার সিস্টেম থাকতো দেন আমি নাক খুলে রেখে দুষ্টুমি করা হয়ে গেলে আমার টুপ করে লাগিয়ে নিতাম।
.
রুশো ভাইয়ার এমন বোকার মতো কথায় পুরো কেবিন জুড়ে হাসির রেশ উঠে গেলো। আমি নীবিড় ভাইয়ার কোলের মধ্যে বসে থেকে হু হা করে হাসতে লাগলাম। তবে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে আমার। এভাবে কারো কোলে বসে যাওয়া যায় নাকি? আমি একটু নড়েচড়ে উঠতে নিলেই দুহাতে আমার কোমড় চেপে ধরে ঝাঁঝালো কন্ঠে উনি বলে উঠলেন,
.
—- সমস্যা কি? চুপচাপ থাকা যায় না? দেখো আমার রাতে ঘুম হয়নি। আর সকাল বেলা তো গোছগাছ আর দৌড়াদৌড়ির ওপরই কেটে গেছে। একটু শান্তি মতো বসে রেস্ট নিতে দাও। আম রিয়েলি ভেরী টায়ার্ড!
.
উনার কথায় আর কিছু বললাম না। কারণ আমার নিজেরও একই অবস্থা! সারারাত উত্তেজনায় ঘুম হয়নি আমার। উনার কোলে বসে অস্বস্তি লাগলেও এক অদ্ভুত রকমের উষ্ণতা অনুভব করছি আমি। তার সাথে চলতি ট্রেনের জানালা দিয়ে আসা গা হিম করা হিমেল হাওয়া! যা মনটাকে ছুয়ে যাচ্ছে গভীর ভাবে।
সবাই যখন আড্ডায় মত্ত তখন আমার চোখে নেমে আসতে লাগলো রাজ্যের ঘুম। অনেক চেষ্টা করেও চোখজোড়া খুলে রাখতে পারলাম না আমি। শেষমেশ ঘুমের সাথে কঠিন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে গেলাম অামি নীবিড় ভাইয়ার উষ্ণ বুকে মাথা রেখেই।
আমায় নিজের বুকে গা এলিয়ে দিতে দেখে নীবিড় ভাইয়া মুচকি হেসে আমার ললাটে নিজের ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা গভীর চুম্বন এঁকে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
ঘুমের ঘোরে উনার স্পর্শ অনুভব করলেও চোখ খুললাম না। এতো শান্তির ঘুম সহজে পাওয়া যায়না। তাই শুধু শুধু ঘুমটা বরবাদ করে পরে আফসোস করতে চাইনা আমি।
.
—- হেই ব্রো ছুটকি তো ঘুমিয়ে পড়লো!
.
—- হুশশশশ! ঘুমোক! শরীর ক্লান্ত অনেক। ওকে জাগিয়ো না।
.
🍁
.
পিটপিট করে চোখ খুলতেই অনুভব করলাম আমি হাওয়ায় ভাসছি। আচমকা এমন অনুভব হওয়ায় হকচকিয়ে উঠলাম আমি। চোখ মেলে তাকাতেই প্রথমে চোখে পড়লো নীবিড় ভাইয়ার ক্লান্তিমাখা মুখখানা। উনি আমায় কোলে নিয়ে হাটছেন। মাথা উঁচু করে আশেপাশে চোখ বোলাতেই বুঝলাম আমরা এখন শহর থেকে ভেতরে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় অবস্থান করছি। আমাদের সামনে অগ্নি ভাইয়া, নিত্য আপু, আম্মু-আব্বু আর পাশে রুশো ভাইয়া আর রাত্রি। রাত্রি মুখ ফুলিয়ে গটগট করে হেটে যাচ্ছে আর রুশো ভাইয়া মুখ কাচুমাচু করে লাগেজ টানতে টানতে এগোচ্ছে।
গ্রামে পৌঁছে গিয়েছি আমরা। তার মানে গত ৪ ঘন্টা যাবৎ মরার মতো ঘুমিয়েছি আমি? এটাও সম্ভব!
.
—- ভাইয়া আমাকে নামিয়ে দিন আমি যেতে পারবো।
.
আমার কথায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেন উনি। সামনে তাকিয়ে হাটতে হাটতেই বলে উঠলেন,
—- এতোক্ষণ যখন পারো নি আর এইটুকু রাস্তা পারতে হবে না। এইতো চলেই এসেছি।
.
বলেই আর ৩-৪ ধাপ এগিয়ে আমায় কোল থেকে নামিয়ে দিলেন উনি। আমি আশেপাশের পরিবেশ দেখে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম এখন ঠিক কটা বাজে! আকাশে সূর্যের অবস্থান দেখে অনুমান করলাম এখন বিকেল ৪ টে বেজে এসেছে প্রায়। নীবিড় ভাইয়া বেশ ভালোই ঘেমে গিয়েছেন। গায়ে থাকা শার্ট লেগে গিয়েছে উনার শরীরের সাথে। উনার এই ক্লান্তিমাখা মুখটাও যেনো কতো স্নিগ্ধতায় ঘেরা।
উনি আমায় নামিয়ে দিয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম গুলো মুছে নিয়ে বলে উঠলেন,
.
—- আমায় না দেখে সামনের দিকে তাকাও!
.
উনার কথায় লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম আমি। রুশো ভাইয়া লাগেজ টানতে টানতে পেছনে এসে বলে উঠলো,
—- ম্যায় তো মার গেয়া রে ছুটকি! তুই তো কত্তো আরাম করে এলি! কি লাক রে ভাই তোদের! শালার আমার কপালই ফুট্টা! 😩
.
আমি রুশো ভাইয়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে কিছু বলবো তার আগেই সদর দরজা খুলে গেলো। আম্মু ততক্ষণাত আমাদের ইশারা করলো মাথায় কাপড় দিতে! আমি, নিত্য আপু আর রাত্রি চটজলদি মাথায় ওড়না টেনে দিলাম।
ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক হাস্যজ্বল প্রতিমা! ইনি হলেন আমার চাচিমনি! আমার আব্বুরা তিন ভাই তার মধ্যে ইনি ছোট চাচ্চুর ওয়াইফ! দরজা খুলে আমাদের সকলকে দেখেই খুশিতে চোখ চিকচিক করে উঠলো চাচিমনির। আমাদের সবাইকে ভেতরে প্রবেশ করতে বলে বাড়ির সবাইকে ডাকতে লাগলেন উনি।
.
আমরা সবাই ধীর পায়ে বাড়িতে প্রবেশ করলাম। দুতলা পাকা বাড়ি। নিচে বিশাল এক উঠান। বাড়িটা আকারে আসলেই অনেক বড়। যৌথ পরিবার থাকার জন্য পারফেক্ট। শোনা যায় এক সময় দাদুভাই গ্রামের মোড়ল ছিলেন সাথে ছিলেন বেশ সম্পদশালীও। দাদুবাড়ি আসিনি ২ বছর হবে। এউ দুবছরে তেমন কোনো পরিবর্তন না হলেও বাড়ির উঠানটা খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। উঠানটা আগে কাঁচা ছিলো এখন পাকা করা হয়েছে।
.
ক্ষণিকের মধ্যেই ধীর পায়ে উঠানে এসে উপস্থিত হলেন দিদুন। দিদুনের বয়স এক্সাক্টলি কতো তা জানা নেই আমার তবে এখনো নিরদ্বিধায় হাটা চলা করতে পারে দিদুন। মাথার চুলগুলো সব লালচে, যেমনটা পাকা চুলে মেহেদী লাগালে হয় ঠিক তেমন। চেহারায় বয়সের ছাপের সাথে কুঁচকে যাওয়া চামড়াও দিদুনের সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র কমাতে পারে নি বলে আমার ধারণা। বরং আরোও অদ্ভুত রকমের সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে দিদুনের চেহারায়। তবে দিদুন আর আগের মতো হাসি-খুশি মাখা মুখে থাকে না। ১০ বছর আগে দাদুভাই গত হওয়ার পর থেকেই এমন গম্ভীরতা ছেয়ে গেছে দিদুনের রন্দ্রে রন্দ্রে।
.
দিদুনকে আসতে দেখেই রুশো ভাইয়া একটা ঢোক গিলে দু ধাপ পিছিয়ে গেলো।
পরমুহূর্তে দিদুনের হাতে লাঠি না থাকায় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রুশো ভাইয়া।
.
দিদুনকে দেখেই আম্মু আব্বু গিয়ে সালাম করলো। আমরাও একে একে এগিয়ে গিয়ে দিদুনকে সালাম করলাম। দিদুন সবাইকেই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
.
—- হবু নাত বউ কোনটা?
.
আম্মু নিত্য আপুকে দেখিয়ে দিয়ে বললো,
—- এই যে মা, ওর নাম….
.
আর কিছু বলার আগেই দিদুন হাত মেলে আম্মুকে থামিয়ে দিয়ে নিত্য আপুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
—- নাম কি?
.
নিত্য আপু কিছুটা ভরকে গিয়ে তাও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলো,
—- নিত্য!
.
দিদুন কপাল কুচিকে আরোও গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
—- নাম জিজ্ঞেস করলে পুরো নামটা বলতে হয় জানো না?
.
নিত্য আপু আগের থেকেও নারভাস ফিল করে বলে উঠলো,
—- দুঃখিত! আমার নাম সানজানা সাবরিন নিত্য!
.
দিদুন এবার কিছুটা আস্বস্ত হয়ে বলে উঠলেন,
—- তোমরা সবাই গিয়ে গোসল করে পরিষ্কার হয়ে এসো আগে। তারপর কথা বলছি।
সালমা…! ওদের নিয়ে যাও তার মামুনকে বলো ছেলেদের পুকুরে নিয়ে যেতে।
.
পুকুরের নাম শুনতেই রুশো ভাইয়া একপ্রকার চেঁচিয়েই “হোয়াট!” বলে উঠলো। সাথেসাথেই অগ্নি ভাইয়া আর নীবিড় ভাইয়া রুশো ভাইয়ার ঠোঁট চেপে ধরে জোড়পূর্বক হেসে দিয়ে বলে উঠলো,
.
—- ও কিছু না দিদুন৷ ওকে পিঁপড়ে কামড়েছে মাত্র!
.
দিদুন চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ করে রুশো ভাইয়াকে নিচ থেকে উপরে একবার দেখে নিয়ে বলে উঠলো,
—- এটা ওই আমচোর টা না?
.
দিদুনের ৫ বছর আগের কথাও মনে আছে দেখে আমার আর ভাইয়ার কাশি উঠে গেলো। আর রুশো ভাইয়া তো পারছে না মাটি দু ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে যেতে। রুশো ভাইয়ার চেহারা বর্তমানে একদম দেখার মতো হয়েছে।
মাঝখান থেকে রাত্রি রুশো ভাইয়াকে এমন অসহায় পরিস্থিতিতে দেখে সবার আড়ালে মিটিমিটি হেসে চলেছে।
.
.
.
চলবে………………💕