মৃগতৃষ্ণা #পর্ব: ০৩

0
389

#মৃগতৃষ্ণা
#পর্ব: ০৩

রূপার ভয়ার্ত চেহারা দেখেই বরং জুলেখা বিস্মিত হলো।
রূপা সুলায়মানের পাঞ্জাবির নিচের অংশটুকুর কাপড়টা দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে জুলেখার কাছে যেতে চাইছে না।
কি অবাক করা কান্ড তাইনা যে মেয়ে কিনা জল্লাদকেও ভয় পায়নি সে এখন সুলায়মানের বেগমকে দেখে ভয় পাচ্ছে।
জুলেখা রূপাকে তার কাছে টেনে নিয়ে বললো কি হয়েছে রূপা? তুমি এমন ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি তো তোমার মায়ের মতোই।
রূপা চেয়ে আছে সুলায়মানের মুখপানে। সুলায়মান ও রূপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো রূপা আজকে থেকে ইনিই তোমার মা। তোমাকে যে কত্ত আদর করবে, তুমি খুব খুশি থাকবে আমাদের সাথে।
রূপা এবার কিছুটা শান্ত হয়ে বললো আমি কি ওনাকে মা বলে ডাকবো??
এবার জুলেখা রূপার গালে হাত বুলাতে বুলাতে বললো বলো তো দেখি – মা ডাক শোনার অনুভূতি কেমন হয় শুনি একবার।
রূপা ডাকলো -মা!
– আবার ডাক তো রূপা !!
– মা।
জুলেখা এবার রূপাকে জড়িয়ে ধরে বললো কি এক অপরূপ ডাক।
সুলায়মান জুলেখা কে বললো – বেগম আমি যেম তোমার মুখে এই হাসিটাই দেখতে চেয়েছিলাম।রূপাকে আমাদের রাজবাড়ীতে রাখা সম্ভব নয় কারন কেউ দেখে ফেললে আমরা বিপদে পড়তে পারি। তাই আমি চাইছি রূপা দিনের বেলায় পাতালঘরে থাকবে আর রাতে যখন সুযোগ পাবে আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে।

এখন তোমরা মা-মেয়ে মিলে গল্প করো কেমন, আমি বরং হাবু কে দিয়ে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি আমার ঘরে নতুন অতিথির আগমন যে হয়েছে। গ্রামের সবার আজ রাজবাড়ীতে নিমন্ত্রণ।

জুলেখা প্রশ্নাত্মক বাক্য নিয়ে বলল কিসের আয়োজন যদি জিজ্ঞেস করে তবে সবাইকে কি উত্তর দিবেন আপনি?
সুলায়মান হেসে উত্তর দিল “আজ সুলায়মান ও জুলেখার মহানন্দের দিন তাই নিমন্ত্রণ”।

সুলায়মান এবার বেড়িয়ে পড়ল। কক্ষে কেবল রূপা ও জুলেখা। রূপাকে কোলে তুলে নিয়ে জুলেখা রূপার বুকে হাত বুলিয়েই চলেছে। রূপার ছোট্ট হৃদয়খানা ভয়ে ধুকপুক করছে। একটা সময় জুলেখার হাত গিয়ে থামলো রূপার কলিজার স্থানে, মনে হলো যেন সে রূপার কলিজাখানা মেপে নিলো।

জুলেখার চোখের চাহনি আর হাত বুলানো রূপার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। তার উপর জুলেখার রহস্যময় হাসি তো আছেই।
____________

বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের দলগত এস্যাইনমেন্ট দেওয়া হলো। বিভিন্ন জেলার বিখ্যাত স্থানের অনুসন্ধান করা ও সেখানে গিয়ে সেই স্থানে সম্পর্কে ডায়েরিতে উল্লেখ করা যা পত্রিকায় লিপিবদ্ধ করা হবে বলে প্রফেসর জানান।

ইতিহাস বিভাগে মেয়েদের সংখ্যা খুবই নগন্য।এমনিতেও মেয়েরা বেশি লেখাপড়া করে না তখন, তবুও কিছু বংশীয় মেয়েরা আছে যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহন করছে। সবচেয়ে বেশি মেয়ে ও ছেলে ছিলো ইংরেজি বিভাগে কারন তখন ইংরেজদের শাসনামল ছিলো, তাদের দখলেই ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্হান সহ আরও ১০টি জেলা।
ইংরেজদেরই একটি মেয়ে সোফিয়ার ইতিহাসের প্রতি ছিলো ভিষণ রকমের ঝোক, ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী সে।
সিরাজ, রফিক, সোফিয়া, হেমন্তি ও দিগন্ত -এই পাঁচজন মিলে একটি গ্রুপ। ওরা অনেক অনুসন্ধান করে বের করে যে ভ্রমণের ও জ্ঞান অর্জনের জন্য ইসলামাবাদের * রাজবাড়ী * যাবে। সেখানে যেহেতু রাজা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যাবে তাই রাজবাড়ীই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো ওরা।

রাজবাড়ী যাওয়ার কথা প্রথমেই বলে সিরাজ। ওদের গ্রামের বাড়ির পাশের জেলাতেই পড়েছে সেই ইসলামাবাদ। তবে কখনোই যাওয়া হয়ে ওঠেনি তার, এবার বন্ধুদের সাথে সেই রাজবাড়ী যাবে। সিরাজের রাজবাড়ী যাওয়ার থেকে রূপবতী সুনয়নাকে মানে জুলেখাকে দেখার ইচ্ছে বেশি বললেই চলে।

আজ ওরা রাজবাড়ী যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। প্রায় ১৫ দিনের সফর।
সিরাজের বন্ধুরা ২৪ বছরের যুবককে ৩২ বছরের মহিলাকে(জুলেখা) নিয়ে রসাত্মক ব্যঙ্গ করতে লাগলো।
“যদি সুলায়মানের মৃত্যু হতো তবে সিরাজের রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যেতো,” উক্তিটি করে বসলো হেমন্তি।

চমকে উঠলো সিরাজ,বললো কোথাও যাত্রা করার সময় এমন অলুুক্ষুনে কথা মুখে আনতে নেই। ধ্যাত।

হেমন্তি তার পড়নের কাপড়ের আচল দিয়ে মুখের হাসি চাপছে আর বলছে এগুলো মেয়েলি কুসংস্কার, আর তুই কিনা এসব বলছিস। কুসংস্কারই যদি মানবি তবে বিদ্যা অর্জন করার প্রয়োজন কি ছিলো বলতো??

রফিক এবার ওদের ধমক দিয়ে যুক্তিতর্ক থামালো।সোফিয়ার একটু অভিমান হলো কেননা ওরা এতদিন বিদেশি সোফিয়ার গুনগান গাইতো আর আজ তিনদিন যাবৎ কেবলই জুলেখার রূপের প্রশংসা করে চলেছে।

সোফিয়া এমনি তে বেশি কথা বলেনা, তবে যখন বলে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে কি সুন্দর করে সাধুভাষায় বাংলা বলে।
হঠ্যাৎ দিগন্ত সোফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো – কি মিস. সোফিয়া আজ যে একেবারেই চুপ করে আছেন।( দিগন্ত সোফিয়াকে আপনি বলে সম্বোধনে করে)
– আমার কিছুই বলিবার নাই মি.দিগন্ত। সেকারণেই মূলত আমি চুপ করিয়া বসিয়া আছি। তোমরা কথা বলিতে থাকো আমি বরং শুনিতে থাকি।

গরুর গাড়ি থেকে নেমে এবার পালা নৌকেতে উঠার। এরপরে যে আরও কতদিন লাগবে তা জানা নেই, কারন ইসলামাবাদে অনেকগুলো গ্রাম আছে। আগে সেগুলো অতিক্রম করে তারপর যেতে হবে রাজবাড়ী।
প্রায় ২ দিন পর ওরা এসে পৌছালো রাজবাড়ীর বিশাল গেটের সামনে। গ্রামের সব মানুষ রাজবাড়ীতে নিমন্ত্রণ খেতে এসেছে। এত এত মানুষের ভীড়ে সুলায়মানকে পাওয়া এখন অসম্ভব। দুইজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে বিশাল গেইটের দুই প্রান্তে। তাদেরকে দিয়ে সুলায়মানের থেকে অনুমতি নিয়ে তারা প্রবেশ করলো রাজবাড়ীর অন্দরমহলে।
সুলায়মানকে দেখে সবাই মুগ্ধ। কি সুদর্শন পুরুষ!! বয়সের ছাপ একদমই চেহারায় পড়েনি। ঠিক যেন রূপকথার রাজপুত্রের ন্যায় সুন্দর। পাঞ্জাবি – পাগড়ি, আর চোখে সুরমা দেওয়া পুরুষটাকে দেখে মনে হচ্ছ সে এই পৃথিবীর কেউ নয়। ভিনগ্রহের কোনো বাসিন্দা।

সুলায়মানকে তারা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বললে সুলায়মান রাজি হয় তাদের থাকতে দিতে। কিন্তু সে মনে মনে ভয় পাচ্ছিলো এতগুলো ছেলেমেয়েদের নিয়ে।ওরা যদি কোনোভাবে জুলেখার বাচ্চাদের ক*লিজা খা*ওয়ার কথা জেনে যায় বা সন্দেহ করে তবে তো সব শেষ।
তবুও থাকতে দিতে হবে ওদের কারন সুলায়মানদের বাড়িতে প্রথা প্রচলিত আছে যে কোনো মেহমানকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না বরং মেহমানদের আপ্যায়ণ করতে হবে দেহের শেষ রক্তবিন্দু অবদি।
সুলায়মান ওদেরকে রাজবাড়ীর মেহমানশালায় থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন আর বললেন এ বাড়িতে অনেকে দাস- দাসী রয়েছে, কোনো প্রয়োজন হলে অবশ্যই তাদের জানাতে।
সুলায়মান যতক্ষণ সামনে ছিল হেমন্তি তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। এত ছটফটে মেয়ে মুখ দিয়ে একটা রা ও কাটেনি । এমন সুদর্শন পুরুষ মানুষ সে তার এই জীবনে দেখেনি।

সোফিয়াও তার দিকে তাকিয়ে ছিলো বিস্ময়কর ভাবে। তার জানামতে ইংরেজদের চেয়ে সুন্দর আর কোনো পুরুষ বা রমনী নেই। সুলায়মানকে দেখে তার একটি ভুল ভাঙলো, তবে তার চেয়ে সুন্দর রমণী এ বাংলার বুকে আছে সেটা সে নিজের চোখে না দেখে বিশ্বাস করতে পারছেনা।

ওরা এখন বিশ্রাম নিচ্ছিল। সিরাজ, রফিক ও দিগন্ত একটি কক্ষে আর সোফিয়া যেহেতু কারো সাথে কক্ষে অবস্থান করতে পারে না তাই হেমন্তি ও সোফিয়া আলাদা দুইটি কক্ষে।
ওরা সিদ্ধান্ত নিল যে কাল সুলায়মানের অনুমতি নিয়ে পুরো রাজবাড়ী ঘুরে দেখবে। এখন সবাই রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমাতে গেলো।

দিনের আলোতে রাজবাড়ী যতটা উজ্জ্বল ও সুন্দর, রাতের রাজবাড়ী ততটাই ভয়ংকর সুন্দর।
মেহমানশালার তিনটে কক্ষে আজ অবস্হান করছে পাচজন যুবক-যুবতী। মধ্যরাতে হঠাৎ হেমন্তির ঘুম ভেঙে যায় কেমন যেন নিস্তব্ধ নগরীর মতো মনে হচ্ছে চারদিক। হেমন্তি বাথরুমে গিয়ে কক্ষে এসে বিছানায় আবার হেলান দিতে না দিতেই কোনো এক বাচ্চার চিৎকারের শব্দ পায় তবে সেই আওয়াজ খুব বেশি জোরে নয় বরং খুবই নগন্য আওয়াজ।
তবুও হেমন্তির বুকটা ধরফর করে উঠে এত রাতে বাচ্চার চিৎকার কোথা থেকে এলো, রাজবাড়ীতে তো কোনো বাচ্চাকে দেখতে পায়নি তারা তবে কোথা থেকে এলো এই চিৎকারের আওয়াজ। এক অজানা ভয় ও কৌতুহল মনে নাড়া দিয়ে উঠলো, হেমন্তি কক্ষ থেকে বেড়িয়ে পড়লো সেই আওয়াজের খোঁজে।কোনদিক থেকে আওয়াজ এলো তা সে অনুসরণ করতে লাগলো কিন্তু কোনো বাচ্চাকেই ও দেখতে পাচ্ছে না। পুরো রাজবাড়ীটা মোম ও মশালের আলোতে সুন্দর দেখালেও হেমন্তির কেনো যেন মনের মধ্যে ভয় লাগা শুরু করলো। হেমন্তি হাটছে এত বড়ো বাড়ির মধ্যে কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুজে বের করা কষ্টসাধ্য। আস্তে আস্তে পা ফেলে হেমন্তি এগিয়ে চলছে হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে হেমন্তির কাধে হাত রাখলো…
হেমন্তির বুকের ভেতর ধুপধুপ আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, হেমন্তি খিচ মেরে নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।এরপর………

চলবে,,,,
#লেখা: মুন্নি ইসলাম
[ নেক্সট লেখার পাশাপাশি গল্প সম্পর্কে মন্তব্য করলে আরও বেশি খুশি হবো। গল্পটি ভালো লাগলে শেয়ার করে পাশে থাকবেন। ধন্যবাদ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here